বহে কাল নিরবধি-'এখনই অন্ধ বন্ধ করো না পাখা' by এম আবদুল হাফিজ
আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের ২০০১-০৬ সাল পর্যন্ত মেয়াদে আওয়ামী লীগের প্রচণ্ড দুর্দিন ছিল। মনে পড়ে, সে সময় দলটির ওপর নির্যাতনের যে খৰ নেমে এসেছিল, তাতে আওয়ামীদের মতো লড়াকু দলও ভড়কে গিয়েছিল। নির্যাতনের জন্য সহানুভূতির উদ্রেক মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি।
সেই প্রবৃত্তি থেকে আমার মনও বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিল। মনে আছে, হুমায়ুন আজাদকে মারাত্মক অবস্থায় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে আনা হলে বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে তাঁকে (হুমায়ুন আজাদকে) সেখানে দেখতে যেতে দেওয়া হয়নি। অতঃপর একুশে আগস্ট ঘটেছিল। যদিও আওয়ামী লীগ তাদেরই সূচিত সন্ত্রাস ও নির্যাতনের প্রতিবাদে জোটের বিরুদ্ধে মেয়াদের শুরু থেকেই তাদের বৈশিষ্ট্যগত আন্দোলনের সূত্রপাত করেছিল, তা খুব একটা সাফল্যের মুখ দেখছিল না। দেখা হলেই জনৈক আওয়ামী লীগার (এখন একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী) বলতেন, 'পুলিশের পেটাই আর সহ্য করতে পারছি না।'
কোনো আওয়ামী লীগ নেতা যখন এমন স্বীকারোক্তি করেন, তাহলে বুঝতে হবে যে নির্যাতনের মাত্রা কী পরিমাণ ছিল। পুলিশকে তখন এ কাজের জন্য আধুনিকতম গ্যাজেট (Gadget) ও জনবল দেওয়া হয়েছে। র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন তৈরির পথে খোদ বিলেত থেকে এসেছে ডগ স্কোয়াড- যাদের গোয়েন্দা ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে। অথচ দেশে তখন আর্থসামাজিক সংকট তুঙ্গে। বিদ্যুৎ নেই, পানি নেই, শুধু প্রধানমন্ত্রীর মুখে আছে 'উন্নয়নে'র ধারা। আর আইনশৃঙ্খলা? দেশময় পাশবিক অপরাধের মচ্ছব।
আমি কোনো রাজনীতিক নই। সামান্যতম রাজনৈতিক অভিলাষও কখনো মনে উদয় হয়নি। কিন্তু খুব বিবেকের দংশন অনুভব করতাম এই ভেবে যে এসব অন্যায়-অবিচারে আমার কি কিছুই করার নেই? বঙ্গবন্ধুর দল, যা নাকি স্বাধীনতার অগ্রদূত ছিল, তারা কি নিশ্চিহ্নই হয়ে যাবে? সম্ভবত এমনই কোনো সংকটকালে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলে The Daily Star-এ লিখলাম : Sheikh Mujibur Rahman : Dealing with the Phenomenon। তখনো কিন্তু বঙ্গবন্ধুর কোনো উল্লেখ রীতিমতো ট্যাবু (Taboo)। তবু লিখলাম। অনেকে আমার দিকে আড় চোখে দেখল। অনেকে টিপ্পনী কাটল। অতঃপর আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষাবলম্বন করে অনেক লিখেছি। আরো কেউ কেউ লিখতে শুরু করলেন। সাবেক কূটনীতিক মহিউদ্দীনের স্টাইল ছিল পাঠককে তাঁর লেখা শেষ পর্যন্ত পড়তে বাধ্য করা। আরো লিখতে শুরু করলেন এ জেড এম আবদুল আলী। তিনি নির্ভুল তথ্য পরিবেশনে সিদ্ধহস্ত। লিখলেন ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন। জানি না, আমাদের এসব লেখালেখির কোনো প্রভাব কোথাও পড়েছিল কি না।
তবে এরই মধ্যে বঙ্গবন্ধু জাদুঘরে! কে যেন আমাকে '৭ই মার্চের ভাষণ' নিয়ে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের এক আলোচনা সভায় একজন আলোচক হিসেবে উপস্থিত থাকার আমন্ত্রণ জানিয়ে একটি পত্র প্রেরণ ছাড়াও টেলিফোনেও আমন্ত্রণ জানালেন। মাত্র কয়েক বছর আগে মিলিটারি থেকে অবসর নিয়েছি। এখনো গায়ে উর্দির গন্ধ। তাই আমন্ত্রণটি পাওয়ার পর কিছুটা থতমত খেলাম। যাব কি যাব না- এ নিয়ে দ্বিধায় থাকলাম কয়েক দিন।
আমার অত্যন্ত প্রিয় সাবেক সেনাপ্রধান (এখন প্রয়াত জেনারেল) মুস্তাফিজের কথা মনে হলো। তিনি নিজে বৈবাহিক সূত্রে দেশের ফার্স্ট ফ্যামিলির সঙ্গে যুক্ত। ভাবলাম, একই সভায় তিনিও আমন্ত্রিত হয়ে থাকবেন এবং তিনিও সম্ভবত ওই অনুষ্ঠানে যাবেন। তা ছাড়া আমার ভাঙাচুড়া গাড়িটিও তখন গ্যারেজে। হয়তো আমাকে জেনারেল মুস্তাফিজের সঙ্গেই যেতে হবে। যা হোক, শলাপরামর্শের জন্য মুস্তাফিজের সঙ্গে দেখা করলাম। জানলাম, তিনি নাকি সেখানে আমন্ত্রিত নন এবং একাধিক কারণে তিনি সেখানে যেতেও পারবেন না। হতাশ হলাম।
কিন্তু তিনি আমাকে তাঁর গাড়িটি অফার করলেন। অনুষ্ঠানে পেঁৗছার পর দেখলাম, ইনস্টিটিউশনের ভেতর-বাহির কানায় কানায় পূর্ণ। ভেতরে প্রবেশ করে দেখলাম, অন্য আমন্ত্রিত অতিথিরা ইতিমধ্যেই মঞ্চে উপবিষ্ট। শুধু সভানেত্রী শেখ হাসিনার আসনটিই শূন্য। কারো ইশারায় আমি আমার জন্য বরাদ্দ আসনটি গ্রহণ করলাম। ততক্ষণে জাতীয় সংগীত পরিবেশন শুরু হয়ে গেছে। আমার সোনার বাংলা আমি... সংগীতটি গাইছিলেন দলের মহিলা কর্মীরা। বহুবার শোনার পরও আমার মনে হয়েছিল, এ সংগীত এত দরদ দিয়ে গীত হতে কখনো শুনিনি। অনুষ্ঠানে আমার বক্তব্য দেওয়ার খুব একটা প্রস্তুতি ছিল না। কিন্তু দেখলাম, অন্য দুইজন আলোচক এ জেড এম আবদুল আলী ও অধ্যাপিকা ড. সাদেকা হালিম শুধু প্রস্তুতই নন, এমন অনুষ্ঠানে বক্তব্য প্রদানে আমার চেয়ে অনেক যোগ্য।
একসময় আলোচনা সভাটি যথারীতি শেষ হলো। অতঃপর মঞ্চেরই এক কোণে চা পর্ব। সেখানেও আবার অনুষ্ঠানের ভিআইপি শেখ হাসিনা এবং তাঁর পরিবারের কয়েকজন ঘনিষ্ঠের কাছ থেকে কিছুটা দূরত্ব রেখে আমি এবং আলী সাহেব বসলাম। সেই প্রথম ও শেষ দেশের ফার্স্ট ফ্যামিলির এত নিকটবর্তী হয়েছিলাম। শেখ হাসিনা তাঁর মা-বাবার স্মৃতিচারণায় লিপ্ত ছিলেন। আলোচ্য আলোচনা সভায় আমার অংশগ্রহণ অসংখ্য রাজনৈতিক ঘটনার সমুদ্রে সামান্য একটি বুদবুদের মতো। হয়তো আওয়ামী লীগের জন্য বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষায় আমার অসংখ্য দরদ দিয়ে লেখা নিবন্ধের জন্যই আমাকে দেওয়া হয়েছিল ওই বিরল সম্মান।
আজ বারবার মনে হয়, কোথায় উবে গেল আমাদের সেই ত্রয়ীর সাধনা। শুনেছি, মহিউদ্দীন নাকি গুরুতর অসুস্থ। এ জেড এম আবদুল আলীর কোনো লেখা আমি দীর্ঘদিন পড়িনি। জীবিকা নির্বাহের তাগিদে আমিই শুধু কলম পিষে চলেছি। আমরা কি তাহলে শুধুই অতিথি পাখি ছিলাম?
বৈরী পরিবেশ, আচরণ ও আবহে আমরা আর এখানে স্বাচ্ছন্দ্যে নেই। শুরু হবে আরেক গন্তব্যে আমাদের বিরতিহীন যাত্রা। তবু অপর দুইজন সহযাত্রীকে আমার মিনতি, 'হে বন্ধু : এখনই অন্ধ বন্ধ করো না পাখা।'
লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, বিআইআইএসএস, নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও কলামিস্ট
কোনো আওয়ামী লীগ নেতা যখন এমন স্বীকারোক্তি করেন, তাহলে বুঝতে হবে যে নির্যাতনের মাত্রা কী পরিমাণ ছিল। পুলিশকে তখন এ কাজের জন্য আধুনিকতম গ্যাজেট (Gadget) ও জনবল দেওয়া হয়েছে। র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন তৈরির পথে খোদ বিলেত থেকে এসেছে ডগ স্কোয়াড- যাদের গোয়েন্দা ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে। অথচ দেশে তখন আর্থসামাজিক সংকট তুঙ্গে। বিদ্যুৎ নেই, পানি নেই, শুধু প্রধানমন্ত্রীর মুখে আছে 'উন্নয়নে'র ধারা। আর আইনশৃঙ্খলা? দেশময় পাশবিক অপরাধের মচ্ছব।
আমি কোনো রাজনীতিক নই। সামান্যতম রাজনৈতিক অভিলাষও কখনো মনে উদয় হয়নি। কিন্তু খুব বিবেকের দংশন অনুভব করতাম এই ভেবে যে এসব অন্যায়-অবিচারে আমার কি কিছুই করার নেই? বঙ্গবন্ধুর দল, যা নাকি স্বাধীনতার অগ্রদূত ছিল, তারা কি নিশ্চিহ্নই হয়ে যাবে? সম্ভবত এমনই কোনো সংকটকালে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলে The Daily Star-এ লিখলাম : Sheikh Mujibur Rahman : Dealing with the Phenomenon। তখনো কিন্তু বঙ্গবন্ধুর কোনো উল্লেখ রীতিমতো ট্যাবু (Taboo)। তবু লিখলাম। অনেকে আমার দিকে আড় চোখে দেখল। অনেকে টিপ্পনী কাটল। অতঃপর আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষাবলম্বন করে অনেক লিখেছি। আরো কেউ কেউ লিখতে শুরু করলেন। সাবেক কূটনীতিক মহিউদ্দীনের স্টাইল ছিল পাঠককে তাঁর লেখা শেষ পর্যন্ত পড়তে বাধ্য করা। আরো লিখতে শুরু করলেন এ জেড এম আবদুল আলী। তিনি নির্ভুল তথ্য পরিবেশনে সিদ্ধহস্ত। লিখলেন ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন। জানি না, আমাদের এসব লেখালেখির কোনো প্রভাব কোথাও পড়েছিল কি না।
তবে এরই মধ্যে বঙ্গবন্ধু জাদুঘরে! কে যেন আমাকে '৭ই মার্চের ভাষণ' নিয়ে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের এক আলোচনা সভায় একজন আলোচক হিসেবে উপস্থিত থাকার আমন্ত্রণ জানিয়ে একটি পত্র প্রেরণ ছাড়াও টেলিফোনেও আমন্ত্রণ জানালেন। মাত্র কয়েক বছর আগে মিলিটারি থেকে অবসর নিয়েছি। এখনো গায়ে উর্দির গন্ধ। তাই আমন্ত্রণটি পাওয়ার পর কিছুটা থতমত খেলাম। যাব কি যাব না- এ নিয়ে দ্বিধায় থাকলাম কয়েক দিন।
আমার অত্যন্ত প্রিয় সাবেক সেনাপ্রধান (এখন প্রয়াত জেনারেল) মুস্তাফিজের কথা মনে হলো। তিনি নিজে বৈবাহিক সূত্রে দেশের ফার্স্ট ফ্যামিলির সঙ্গে যুক্ত। ভাবলাম, একই সভায় তিনিও আমন্ত্রিত হয়ে থাকবেন এবং তিনিও সম্ভবত ওই অনুষ্ঠানে যাবেন। তা ছাড়া আমার ভাঙাচুড়া গাড়িটিও তখন গ্যারেজে। হয়তো আমাকে জেনারেল মুস্তাফিজের সঙ্গেই যেতে হবে। যা হোক, শলাপরামর্শের জন্য মুস্তাফিজের সঙ্গে দেখা করলাম। জানলাম, তিনি নাকি সেখানে আমন্ত্রিত নন এবং একাধিক কারণে তিনি সেখানে যেতেও পারবেন না। হতাশ হলাম।
কিন্তু তিনি আমাকে তাঁর গাড়িটি অফার করলেন। অনুষ্ঠানে পেঁৗছার পর দেখলাম, ইনস্টিটিউশনের ভেতর-বাহির কানায় কানায় পূর্ণ। ভেতরে প্রবেশ করে দেখলাম, অন্য আমন্ত্রিত অতিথিরা ইতিমধ্যেই মঞ্চে উপবিষ্ট। শুধু সভানেত্রী শেখ হাসিনার আসনটিই শূন্য। কারো ইশারায় আমি আমার জন্য বরাদ্দ আসনটি গ্রহণ করলাম। ততক্ষণে জাতীয় সংগীত পরিবেশন শুরু হয়ে গেছে। আমার সোনার বাংলা আমি... সংগীতটি গাইছিলেন দলের মহিলা কর্মীরা। বহুবার শোনার পরও আমার মনে হয়েছিল, এ সংগীত এত দরদ দিয়ে গীত হতে কখনো শুনিনি। অনুষ্ঠানে আমার বক্তব্য দেওয়ার খুব একটা প্রস্তুতি ছিল না। কিন্তু দেখলাম, অন্য দুইজন আলোচক এ জেড এম আবদুল আলী ও অধ্যাপিকা ড. সাদেকা হালিম শুধু প্রস্তুতই নন, এমন অনুষ্ঠানে বক্তব্য প্রদানে আমার চেয়ে অনেক যোগ্য।
একসময় আলোচনা সভাটি যথারীতি শেষ হলো। অতঃপর মঞ্চেরই এক কোণে চা পর্ব। সেখানেও আবার অনুষ্ঠানের ভিআইপি শেখ হাসিনা এবং তাঁর পরিবারের কয়েকজন ঘনিষ্ঠের কাছ থেকে কিছুটা দূরত্ব রেখে আমি এবং আলী সাহেব বসলাম। সেই প্রথম ও শেষ দেশের ফার্স্ট ফ্যামিলির এত নিকটবর্তী হয়েছিলাম। শেখ হাসিনা তাঁর মা-বাবার স্মৃতিচারণায় লিপ্ত ছিলেন। আলোচ্য আলোচনা সভায় আমার অংশগ্রহণ অসংখ্য রাজনৈতিক ঘটনার সমুদ্রে সামান্য একটি বুদবুদের মতো। হয়তো আওয়ামী লীগের জন্য বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষায় আমার অসংখ্য দরদ দিয়ে লেখা নিবন্ধের জন্যই আমাকে দেওয়া হয়েছিল ওই বিরল সম্মান।
আজ বারবার মনে হয়, কোথায় উবে গেল আমাদের সেই ত্রয়ীর সাধনা। শুনেছি, মহিউদ্দীন নাকি গুরুতর অসুস্থ। এ জেড এম আবদুল আলীর কোনো লেখা আমি দীর্ঘদিন পড়িনি। জীবিকা নির্বাহের তাগিদে আমিই শুধু কলম পিষে চলেছি। আমরা কি তাহলে শুধুই অতিথি পাখি ছিলাম?
বৈরী পরিবেশ, আচরণ ও আবহে আমরা আর এখানে স্বাচ্ছন্দ্যে নেই। শুরু হবে আরেক গন্তব্যে আমাদের বিরতিহীন যাত্রা। তবু অপর দুইজন সহযাত্রীকে আমার মিনতি, 'হে বন্ধু : এখনই অন্ধ বন্ধ করো না পাখা।'
লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, বিআইআইএসএস, নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও কলামিস্ট
No comments