বৃত্তের ভেতর বৃত্ত-স্থানীয় সরকারব্যবস্থা : শুধু উচ্চারণেই গুরুত্ব! by দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু

এই লেখাটি যখন প্রকাশিত হবে, তখন দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের ৭২টি উপজেলার প্রায় ৫৬৮ ইউনিয়নের নির্বাচনোত্তর চিত্র আমাদের সামনে থাকবে। ২৯ মার্চ থেকে শুরু হওয়া দেশের স্থানীয় সরকারের তৃণমূল পর্যায়ের এই নির্বাচন চলবে মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত। তবে ভোটার তালিকায় ত্রুটি,


আইনি জটিলতা কিংবা সীমানা নির্ধারণ-সংক্রান্ত সমস্যার কারণে নির্বাচন হচ্ছে না এমন ইউনিয়নের সংখ্যা ২৩০-এর ওপরে। এর পরও আশার কথা, দীর্ঘদিন পর স্থানীয় সরকারের প্রাথমিক স্তরে নির্বাচন হচ্ছে এবং বিক্ষিপ্ত কিছু সংঘাত-সংঘর্ষ বাদে এ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের চিত্র মোটামুটি সুখপ্রদ। নির্বাচন কমিশনকে এ জন্য সাধুবাদ। সাধুবাদ সরকারকেও।
আমাদের স্মরণে আছে, ২০০৩ সালে সর্বশেষ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন হয়। দীর্ঘদিন স্থানীয় সরকারের এই গুরুত্বপূর্ণ স্তরে নির্বাচন না হওয়ায় শুধু যে এক ধরনের স্থবিরতাই দেখা দিয়েছিল তা নয়, স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার অঙ্গীকারও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। স্বাধীনতা-উত্তর প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক, অরাজনৈতিক সরকারই স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করার অঙ্গীকার করে আসছে। তারা এই সরকারব্যবস্থার গুরুত্ব বারবার উপস্থাপন করছে বটে, কিন্তু বাস্তবে এর প্রমাণ কতটা কী মিলছে এর নজির তো আমাদের সামনেই আছে। স্থানীয় সরকারব্যবস্থার ব্যাপারে তাদের এই গুরুত্ব উচ্চারণেই সীমাবদ্ধ থাকছে। উচ্চারণসর্বস্ব অঙ্গীকারের মধ্যেই যদি বাস্তবায়নের পুষ্ট চিত্রের খোয়াব দায়িত্বশীলরা দেখে চলেন, তাহলে এর ফল কী_এ বিষয়ে নতুন করে আলোচনা করা নিষ্প্রয়োজন। তবে শুধু এটুকুই বলা যায়, আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা তিক্ত।
এবারই প্রথম বিধিমালার অধীনে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের জন্য এর আগে পৃথক আইন থাকলেও কোনো বিধিমালা ছিল না। সন্দেহ নেই, নতুন বিধিমালার অধীনে নির্বাচন হওয়ায় তা নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় নতুন এবং ইতিবাচক মাত্রা যোগ করেছে। নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ করার যে অঙ্গীকার, সেসব ক্ষেত্রে এ বিধিমালা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তাতেও কোনো সন্দেহ নেই। বর্তমান মহাজোট সরকারের কতকগুলো নতুন অঙ্গীকার রয়েছে, যা জাতীয় নির্বাচনের আগে ভোটারদের মনে বেশ সাড়া জাগিয়েছিল এবং বিশ্লেষকদের অভিমত, নির্বাচনী ফলাফলে এরই প্রতিফলন ঘটেছে। এ সরকার উপজেলা পরিষদ চালু এবং নির্বাচনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। বলতে দ্বিধা নেই, এটুকু পর্যন্ত তারা এ ক্ষেত্রে সফল হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এ ক্ষেত্রে যেসব জটিলতা এখনো বিদ্যমান, সেসব অপসারণে সরকার সফল হচ্ছে না কেন? বহুবিধ জটিলতা ক্রমেই পুষ্ট থেকে পুষ্টতর হচ্ছে। ফলে সরকারের সদিচ্ছা নতুন করে আবার প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। ইউনিয়ন পরিষদ যেমন, তেমনি উপজেলা পরিষদও একেবারেই জনসাধারণের হাতের নাগালের সরকারব্যবস্থা। স্থানীয় পর্যায়ে উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু যেমন ইউনিয়ন পরিষদ, তেমনি উপজেলা পরিষদও। তবে স্থানীয় সরকারের একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ের ইউনিয়ন পরিষদ স্তরটি নানা কারণেই অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
আমরা জানি, স্থানীয় সরকারের এ স্তরের নির্বাচন রাজনৈতিক দলের মোড়কে হয় না। তবুও রাজনীতির ছোঁয়া তো আছেই। স্থানীয় অনেক সংসদ সদস্যসহ নেতা-কর্মীর নির্দলীয়ভাবে অংশগ্রহণ দৃশ্যত দলীয় মোড়কমুক্ত হলেও প্রকৃতপক্ষে রাজনীতির প্রভাবমুক্ত নয়। কেন নয়, তা-ও সচেতন মানুষমাত্রই জানেন এবং এ ব্যাপারে এখানে আলোচনা করা নিষ্প্রয়োজন। তৃণমূল পর্যায়ের এ নির্বাচন অন্যদিকে অনেকটাই গোষ্ঠীভিত্তিক নির্বাচন হিসেবে পরিচিত। এ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যাও বেশি। উপজেলা পরিষদকে এখনো জনপ্রত্যাশা মোতাবেক কাঙ্ক্ষিত রূপ দিতে না পারার ব্যর্থতার প্রেক্ষাপটের কারণও রাজনৈতিক। ইউনিয়ন পরিষদের বেলায় এমনটির অবকাশ বেশ কিছুটা কম হলেও, এর পরও যেটুকু বিদ্যমান, সেটুকু যদি অপসারণ করা না যায় তাহলে স্থানীয় সরকারের এই স্তরটিরও কাঙ্ক্ষিত রূপ লাভ সম্ভব নয়। আর কাঙ্ক্ষিত রূপ লাভ না করলে স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা-দায়বদ্ধতার মতো জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো যেমন প্রতিষ্ঠিত হবে না, তেমনি উন্নয়নও গতিশীল মাত্রা পাবে না। ইউনিয়ন পরিষদ কাঠামোতে নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়টি যত ক্ষুদ্র কিংবা সীমাবদ্ধ পরিসরেই হোক, এর একটি ইতিবাচক প্রভাব ইতিমধ্যে সমাজে লক্ষণীয়। এখানেও নানা রকম দ্বন্দ্ব এবং জটিলতা বিদ্যমান। এসব দ্বন্দ্ব-জটিলতা জিইয়ে রেখে ইউনিয়ন পরিষদকে অধিকতর গতিশীল ও সত্যিকার অর্থে নারীর ক্ষমতায়নের কিংবা কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় নিয়ে যাওয়ার যেসব কথাবার্তা হচ্ছে তা একেবারেই অসার। এর পরও সচেতন মানুষ প্রত্যাশা করেন, সরকার তাদের নির্বাচনী অঙ্গীকারের বিষয়গুলো মাথায় রেখে এগিয়ে যাবে। 'হবে', 'হচ্ছে', 'করব', 'করছি' ইত্যাদি শব্দ আমাদের সব কিছুতে সব সময়ই এক অদ্ভুত জটাজাল তৈরি করে রাখে। মানুষ আশা করে, এ সরকার এসবের অবসান ঘটাবে তাদের নির্বাচনী অঙ্গীকার রক্ষার তাগিদে।
পুনর্বার বলতে হয়, ইউনিয়ন পরিষদকে শক্তিশালী হিসেবে গড়ে তুলতে না পারলে স্থানীয় সরকারব্যবস্থার আঁতুড়ঘরেই মৃত্যু হবে। স্থানীয় সরকারকে স্বাধীন ও স্বয়ংসম্পূর্ণ করা তাই সর্বাগ্রে জরুরি এবং তা করতে হলে কী কী করতে হবে তা-ও সরকারের নীতি-নির্ধারকদের জানা আছে। ইউনিয়ন পরিষদ স্থানীয় সরকারের একটি শক্তিশালী ভিত হিসেবে গড়ে উঠুক_এ প্রত্যাশা এবং দাবি নতুন নয়। স্থানীয় প্রশাসন কিংবা স্থানীয় শক্তিশালী ব্যবস্থা ভিন্ন জনগণের জন্য গৃহীত সরকারের ভালো বা উত্তম পরিকল্পনার সুফল জনগণের দোরগোড়ায় পেঁৗছে দেওয়া সম্ভব নয়। তা ছাড়া স্থানীয় প্রতিনিধি ও জনগণের মধ্যে সম্পর্কটা খুব কাছের বিধায় জনগণের চাহিদা, সমস্যা, সংকট ইত্যাদি সব বিষয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা এবং সমাধান সূত্র বের করে জনকল্যাণ নিশ্চিত করার সবচেয়ে উপযুক্ত মাধ্যম হলো এই সরকারব্যবস্থা। এমনটি মনে করার কোনোই কারণ নেই কিংবা সান্ত্বনা পাওয়া অযৌক্তিক, শুধু ভোটবাঙ্ েভোট ফেলতে ভোটারদের সন্তোষজনক উপস্থিতি ও শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন সম্পন্ন করার মধ্যেই স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করার কিংবা গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার বিদ্যমান সব বাধা অতিক্রম করা গেল। এ ব্যাপারে করণীয় রয়ে গেছে অনেক এবং এসব করণীয় সরকারের সামনে বিভিন্ন পর্যায় থেকে এ যাবৎ বহুবার উপস্থাপন করা হয়েছে এবং এখনো তা অব্যাহত।
আবারও বলতে হয়, বিলম্বে হলেও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন নাগরিক সমাজকে আশাবাদী করে তুলেছে। স্থানীয় জনগণ তাদের পছন্দের প্রতিনিধি নির্বাচন করার বিলম্বিত অবকাশ পেয়েছে। তবে একটি উদ্বেগের বিষয় নতুনভাবে সামনে এসেছে। অভিযোগ আছে, এবার অনেক বেশি মন্দপ্রার্থী অর্থাৎ যারা নানাভাবে সমাজের বিষফোঁড়া কিন্তু একটা মুখোশ পরে সমাজে জায়গা করে আছে, নির্বাচনে তারা অংশগ্রহণ করছে।
এখানে নির্বাচন কমিশন কিংবা সরকারের চেয়েও অনেক অনেক বেশি করণীয় রয়েছে জনগণের, ভোটারদের। তারাই পারে তাদের প্রত্যাখ্যান করে যোগ্যদের নির্বাচনের পথটা কুসুমাস্তীর্ণ করতে। আশার কথা, সমাজের নানা স্তরে বসবাসকারী মানুষ এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন। গণমানুষের এই সচেতনতা একটি সমাজ ও রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান শক্তি। এই শক্তিকে সরকার এবং প্রশাসনেরও অবজ্ঞা করার ক্ষমতা নেই। কাজেই এ প্রত্যাশাও সংগত কারণেই এখন অনেক বেশি পুষ্ট, স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করার সরকারের অঙ্গীকার উচ্চারণসর্বস্ব রাখার অবকাশ ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে আসছে। তবে আমরা সে পর্যন্ত অপেক্ষা করব কেন? সরকার উচ্চারণসর্বস্ব প্রতিশ্রুতি বর্জন করে জনগুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়ে নিজ তাগিদেই যথাযথ কাজ করবে_এ প্রত্যাশা খুবই সংগত।

লেখক : সাংবাদিক
deba_bishnu@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.