সম্পাদকের কলাম-দুই নেত্রী by ইমদাদুল হক মিলন

দুই নেত্রী পাশাপাশি বসে আছেন। বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। দুজনের হাতে চায়ের কাপ। তাঁরা চা খেতে খেতে হাসিমুখে কথা বলছেন আর এশিয়া কাপ ক্রিকেট দেখছেন। বাংলাদেশ ক্রিকেট টিমের টাইগাররা নাস্তানাবুদ করে দিচ্ছে পাকিস্তান টিমকে।


এর আগে বিশ্বকাপজয়ী ভারত ও শ্রীলঙ্কাকে হারিয়েছে। স্টেডিয়াম-ভর্তি দর্শক। কারো হাতে বাংলাদেশের পতাকা, কারো হাতে তুলোর তৈরি রয়েল বেঙ্গল টাইগার। শিশু-কিশোর ও সুন্দরী মেয়েরা তাদের গালে বাংলাদেশের মানচিত্র এঁকে তুমুল উত্তেজনা নিয়ে খেলা দেখছে।
আমাদের প্রিয় দুই নেত্রী খেলা দেখছেন মুগ্ধ হয়ে। আকাশ থেকে তাঁদের মুখে এসে পড়েছে বিকেলবেলার প্রসন্ন আলো। সেই আলোয় তাঁদের আলোকিত মুখ আরো আলোকিত হয়েছে। খেলা দেখার ফাঁকে ফাঁকে তাঁরা দেশের বড় সমস্যাগুলো নিয়ে কথা বলছেন। ঢাকার দুঃসহ যানজট কিভাবে নিরসন করা যায়, কী করলে দূর হবে যানজট, মানুষ সময়মতো পৌঁছুতে পারবে কর্মস্থলে। যানজটের কারণে অ্যাম্বুলেন্সেই মারা পড়বে না রোগী।
সময় বাঁচবে, অকারণে পুড়ে যাওয়া তেল-গ্যাসের বিশাল সাশ্রয় হবে। মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে। কী করলে মিটবে বিদ্যুতের সমস্যা, ধানচাষিরা মনের আনন্দে সেচ দিতে পারবেন ধানক্ষেতে, মিল-কারখানা চলবে ২৪ ঘণ্টা, খাদ্যের ঘাটতি পড়বে না। আগামী মৌসুমে বরং উদ্বৃত্ত হবে। মিল-কারখানার উৎপাদন বেড়ে যাবে বহুগুণ। বিদ্যুতের অভাবে গরমে কষ্ট পাবে না দেশের মানুষ। ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটবে না। পানির জন্য হাহাকার লেগে গেছে ঢাকায়। ওয়াসাকে আরো কার্যকর করতে হবে। ভারতের সঙ্গে পানিচুক্তি করতে হবে এমনভাবে, যেন বেঁচে ওঠে দেশের মরে যাওয়া নদীগুলো, আগের চেহারা ফিরে পায় প্রতিটি নদী। পানির দেশে কেন থাকবে পানির অভাব? গ্যাসের অভাবও মেটাতে হবে। কী পরিমাণ গ্যাস মজুদ আছে, নতুন গ্যাসফিল্ড আবিষ্কার করে কিভাবে স্বাভাবিক করা যায় এ ক্ষেত্র, সে ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। দুর্নীতি উপড়াতে হবে শিকড় থেকে। দেশের কোনো স্তরের কোনো মানুষ কোনোভাবেই পারবে না কোনো দুর্নীতি করতে। এ ক্ষেত্রে আইনের কঠোর প্রয়োগ করা হবে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে আরো কার্যকর ভূমিকায় অবতীর্ণ করা হবে। এ মুহূর্তে দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা এগুলো। এসব সমস্যা মেটাতে পারলে দেশের মানুষ হাঁফ ছেড়ে বাঁচবে। আমাদের শ্রদ্ধেয় দুই নেত্রী এসব নিয়ে গভীরভাবে ভাবছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলছেন, 'দেশ পরিচালনায় বিরোধী দলেরও থাকে বিশাল ভূমিকা, বিশাল দায়িত্ব। আসুন, আমরা বিভেদ ভুলে একত্রে কাজ করি। যে-যার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করি। দেশের মানুষকে সুখী ও আনন্দিত করি।' বিরোধীদলীয় নেত্রী হাসিমুখে বলছেন, 'নিশ্চয়, আমাদের তা-ই করা উচিত। দেশের ১৫ কোটি মানুষ আমাদের দুজনকে শ্রদ্ধা করে, ভালোবাসে। তাদের শ্রদ্ধা-ভালোবাসার মূল্য অবশ্যই আমরা দেব। চলুন, একত্রে কাজ করে আমরা দেশের মানুষকে স্বস্তি ও শান্তির জীবন দিই। মানুষের মুখে হাসি ফোটাই। আমরা আমাদের প্রত্যেক মানুষকে কাজে লাগাই। আমরা প্রমাণ করি, আমরা পারি। আমাদের ক্রিকেট টিম যেমন করে পারছে, আমরাও তেমন করে পারতে চাই। ইচ্ছা ও চেষ্টা থাকলে কেন পারব না! অবশ্যই পারব।'
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বললেন, 'আপনার ওই কথাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, দেশের মানুষকে কাজে লাগানো। জনসমস্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তরিত করা। আমাদের শ্রমবাজার আরো বিস্তৃত করতে হবে। পৃথিবীর বহু দেশে একটু চেষ্টা করলেই আমরা তৈরি করতে পারব শ্রমবাজার। দক্ষ ও প্রশিক্ষিত শ্রমিকের চাহিদা বহু দেশে। আমরা দক্ষ ও প্রশিক্ষিত শ্রমিক তৈরি করব। আমাদের দেশের শ্রমজীবী মানুষ বিদেশে অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে কাজ করছে। অন্যান্য দেশের শ্রমিকদের তুলনায় বাংলাদেশের শ্রমিকদের বেশি পছন্দ করছে ধনী দেশগুলো।'
এ সময় বাংলাদেশ টিম আফ্রিদির উইকেটটি নিল। গভীর আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠলেন দুই নেত্রী। স্টেডিয়াম-ভর্তি দর্শক তখন আনন্দে লাফাচ্ছে। দেশের ১৫ কোটি মানুষই আজ ফাইনাল খেলা দেখছে। আজ কোথাও বিদ্যুতের লোডশেডিং নেই। প্রতিটি বাড়ির টেলিভিশনের সামনে বাড়ির প্রত্যেক লোক। গ্রামগঞ্জের বাজারে, চায়ের দোকানে একটা টেলিভিশন ঘিরে শত শত দর্শক। বাংলাদেশ টিমে শুধু ১১ জন খেলোয়াড়ই খেলছেন না, তাঁদের সঙ্গে খেলছে দেশের ১৫ কোটি মানুষ। এমনিতে কারো প্রিয় দল ভারত, কারো শ্রীলঙ্কা, কারো বা পাকিস্তান। কিন্তু যেদিন বাংলাদেশ দলের খেলা সেদিন ১৫ কোটি মানুষের একটাই দল, সেই দলের নাম বাংলাদেশ। প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশ দুটো দলে ভাগ হয়ে আছে বহুদিন ধরে- আওয়ামী লীগ আর বিএনপি। খেলার দিন এই ভাগ লুপ্ত হয়ে যায়। সেদিন কোনো আওয়ামী লীগ-বিএনপি নেই, সেদিন শুধু বাংলাদেশ, সবাই একদল। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও বিএনপি সভানেত্রী পাশাপাশি বসে খেলা দেখছেন, আমাদের ক্রিকেটারদের গৌরবে আনন্দে উজ্জ্বল হচ্ছেন। গভীর আবেগে নিজেদের অজান্তেই একজন আঁকড়ে ধরছেন আরেকজনের হাত।
প্রিয় পাঠক, এই দৃশ্য এবং দুই নেত্রীর কথোপকথন সম্পূর্ণ কাল্পনিক। বাংলাদেশ-পাকিস্তান ফাইনাল খেলা দেখার দিন আমার ভাবতে ভালো লেগেছিল যদি ভিভিআইপি গ্যালারিতে এ রকম একটা দৃশ্য সত্যি সত্যি আমরা দেখতে পেতাম, এর চেয়ে বড় আনন্দের ঘটনা আর কিছু হতো না। আমরা দুই রানে হেরে গেছি, সেই দুঃখও দেশের মানুষ মনে রাখত না।
দেশ এখন নানা সমস্যায় জর্জরিত। যানজট, বিদ্যুৎ-পানি-গ্যাস সংকট আর দুর্নীতি তো আছেই। বাজারে আগুন, দ্রব্যমূল্য লাগামছাড়া। মধ্যবিত্ত ও গরিব মানুষের নাভিশ্বাস উঠে গেছে। বহু পরিবারে দুবেলা রান্না হয় না। মাদকাসক্তদের লালসার বলি শিশু জান্নাতুল ফেরদৌস। পাশবিক নির্যাতনের পর হত্যা করে, হাত-পা ভেঙে তার লাশ প্যাকেট করে তুলে দেওয়া হয় ট্রেনে। ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পাওয়া নাঈমুল ইসলাম নাঈমকে কোচিং পরীক্ষার প্রশ্নপত্র দেওয়ার কথা বলে অপহরণ করা হয়। তারপর তাকে হত্যা করে লাশ ইটখোলার আগুনে পুড়িয়ে দেয়। কী নৃশংস ঘটনা! কিছুদিন আগে খবরের কাগজে পড়লাম, দুই পড়শির ঝগড়া লেগেছে বাড়ির সীমানা নিয়ে। এক পড়শির তিন বছরের শিশুটি কিছু না বুঝে পা দিয়েছে অন্য পড়শির সীমানায়, পড়শি দায়ের কোপে হত্যা করেছে সেই অবোধ শিশুকে। এ রকম কত ঘটনা ঘটছে। মানুষ যেন হঠাৎ করেই নৃশংস হয়ে উঠেছে। এসব ঘটনার নিশ্চয় মনস্তাত্তি্বক ব্যাখ্যা আছে। কেন মানুষ এত ভয়ংকর হয়ে উঠছে? কোন মানসিক অস্থিরতা তাড়া করছে তাদের?
এ রকম পরিস্থিতিতে মানুষকে খুশি করার, দেশের মানুষের মুখে হাসি ফোটাবার, এত দুঃখ-বেদনা-অস্থিরতার অবসান ঘটানো যেতে পারে একটি মাত্র কাজ করলে, দুই নেত্রী পরস্পরের হাত ধরে দাঁড়ালে। দেশের মানুষকে বললে, আমরা দুজন আছি, আমরাই ঠিক করব দেশ। আমি নিশ্চিত, মুহূর্তে বদলে যাবে বাংলাদেশ। মুহূর্তে মানুষ ভুলে যাবে তাদের দুঃখ-বেদনা, অভাব-অভিযোগের কথা। হাসিমুখে শত্রু জড়িয়ে ধরবে শত্রুর গলা, শত্রু হয়ে যাবে প্রিয় বন্ধু। যেমন করে একাত্তরে একত্র হয়েছিল বাংলার মানুষ, তেমনি একত্র হয়ে রাতারাতি বদলে ফেলবে বাংলাদেশ। আমাদের মানুষগুলো অতি সরল, আর হৃদয়ভরা ভালোবাসা তাদের। আবেগ আমাদের বড় সম্পদ। দেশের গৌরবে যেমন মুহূর্তে দলাদলি ভুলে এক হয়ে যায় সবাই, দুই নেত্রী হাতে হাত ধরে দাঁড়িয়েছেন- এ দৃশ্য দেখার সঙ্গে সঙ্গে ১৫ কোটি মানুষ এক হয়ে যাবে। গভীর আনন্দে ঘর থেকে বেরিয়ে আসবে সব মানুষ। যে যেখানে আছে সেখানে দাঁড়িয়েই মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলবে আকাশের দিকে। চিৎকার করে বলবে, এই তো আমার বাংলাদেশ!
এ রকম দৃশ্য কি আমরা কখনো দেখতে পাব?
কাল পহেলা বৈশাখ। বাংলা নববর্ষ। আহা, এই দিনে আমরা যদি সত্যি সত্যি ও-রকম একটা দৃশ্য দেখতে পেতাম! দুই নেত্রী যদি দেশের মানুষকে নববর্ষের উপহার হিসেবে দিতেন তাঁদের সৌহার্দ্য!
পরম করুণাময়, আমাদের প্রিয় দুই নেত্রীর মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করে দাও। দেশে স্বস্তি ও শান্তি দাও।

No comments

Powered by Blogger.