আন্তর্জাতিক নারী দিবস-শতবর্ষে ৮ মার্চের ডাক by মালেকা বেগম

শ্রমজীবী নারীদের রক্তস্নাত আন্দোলনকে (ন্যায্য শ্রমমজুরি, শোষণ বন্ধ, আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে ১৮৫৭ সালের ৮ মার্চ আমেরিকার নিউইয়র্কের বস্ত্রশিল্পের শ্রমিক নারীদের রাজপথে আন্দোলন) সারা পৃথিবীর শোষিত-বঞ্চিত-নিপীড়িত নারী জাগরণের ইতিহাসে বিশ্বজনীন করে রাখার লক্ষ্যে ১৯১১ সালে ৮ মার্চকে ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিলেন জার্মান সমাজতন্ত্রী বিপ্লবী রাজনীতিবিদ ক্লারা জেৎকিন।


এ বছর পৃথিবীজুড়ে পালিত হচ্ছে ৮ মার্চের শতবর্ষ, যার প্রতিপাদ্য বিষয় হলো: শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তিতে সমসুযোগ: নারীর মর্যাদাপূর্ণ কাজের পথ। ১৯১১ সালে পৃথিবীজুড়ে চলেছিল সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন-শোষণের বিরুদ্ধে শোষিত-নিপীড়িত মানুষের যুদ্ধ, সংগ্রাম ও বিপ্লব। সেই সংগ্রামে নারীসমাজের অবদান, আত্মত্যাগ ইতিহাসে লিপিবদ্ধ করার সংগ্রামও নারীকেই করতে হয়েছে ১০০ বছর ধরে। ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালনের কর্মসূচি ক্রমান্বয়ে পৃথিবীর দেশে দেশে জাতীয় নারী দিবসের মর্যাদায় উন্নীত ও বিস্তৃত হয়েছে। উন্নত ও অনুন্নত—সব দেশেই ৮ মার্চ একুশ শতকেও নারী প্রগতির আন্দোলন হিসেবেই গুরুত্ব পাচ্ছে।

বাংলাদেশে ৮ মার্চ পালনের ইতিহাস
১৯১১ সালে বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া মহীয়সী সুফিয়া কামাল এবং আন্তর্জাতিক নারী দিবস শত বছরের বন্ধনে আবদ্ধ। তিনি ১৯৬৭ সালে তৎকালীন সোভিয়েত সরকারের আমন্ত্রণে মস্কোয় ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন। এ দেশে তখন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক-সামরিক শাসকগোষ্ঠী চালাচ্ছিল দমননীতি। দেশের জনগণ রাজনৈতিক সংগ্রামে যুক্ত ছিলেন। নারীসমাজও সেই সংগ্রামে নারী আন্দোলনের বিভিন্ন দাবিতে সম্পৃক্ত হয়েছিল। সুফিয়া কামাল সেই সময় সামাজিক-সাংস্কৃতিক তথা স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলন-সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। তিনিই প্রথম বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের) প্রতিনিধি হিসেবে ৮ মার্চের আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনে ভাষণদানকারী এবং প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারীর মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়েছিলেন (সূত্র: সোভিয়েটের দিনগুলি, সুফিয়া কামাল রচনা সংগ্রহ,)। সেই সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন: ‘ভাষার জন্য, স্বাধীনতার জন্য, মারী-মড়কে, দুর্ভিক্ষে, সংগ্রামে আমার দেশের ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে এগিয়ে এসেছে। বাইরে আমাদের দেশের পরিচয় অনুন্নত দরিদ্র দেশ বলে। হয়তো কিছুটা আমরা তাই, কিন্তু চিত্তের ঐশ্বর্য আমাদের প্রচুর।’
তাঁর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত তৎকালীন ‘পূর্ব পাকিস্তান মহিলা পরিষদ’ ১৯৭০ সালে এ দেশে প্রথম ৮ মার্চ পালন করেছিল নারীর সম-অধিকারের দাবি উত্থাপন করে। সংগঠনটির সে সময়ের সাধারণ সম্পাদিকা হিসেবে আমার মনে পড়ছে সেই ৮ মার্চ পালনের স্মৃতি। সুফিয়া কামালের অভিজ্ঞতাসঞ্জাত ৮ মার্চের ইতিহাস ধারণ করে সেই উত্তাল সংগ্রামমুখর দিনে এ দেশের নারীসমাজ অধিকার আদায়ের পথ খুঁজে পেয়েছে। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সাল থেকে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ ৮ মার্চ পালনে নিবিষ্ট আছে। এ দেশের নারী আন্দোলনকে আন্তর্জাতিক নারী আন্দোলনের ইতিহাসে যুক্ত করার নেতৃত্ব দিয়েছেন সুফিয়া কামাল।
পরবর্তীকালে জাতিসংঘ ১৯৮৪ সালে সব সদস্য রাষ্ট্রকে ৮ মার্চ পালনের আহ্বান জানালে বাংলাদেশ সরকারও সেই আহ্বানে সাড়া দেয়। সেই সময় থেকে জাতিসংঘের আহ্বানে শ্রমজীবী ও স্বেচ্ছাসেবীসহ সব নারী সংগঠন, বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনও দিবসটি পালন করছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ’ বিভাগ প্রতিবছর নানামুখী কর্মসূচিতে ৮ মার্চ পালনের মাধ্যমে নারীবাদের আদর্শকে জাতীয় পর্যায়ে প্রসারিত করছে।
বাংলাদেশের নারী আন্দোলন অব্যাহতভাবে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সোচ্চার ও কার্যকর ভূমিকা রাখায় সরকার নারী নির্যাতনবিরোধী বিভিন্ন আইন প্রণয়নে বাধ্য হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রভাব সুদূরপ্রসারী।

বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে ৮ মার্চ
আমরা যখন আন্তর্জাতিক নারী দিবসের শতবর্ষ পূর্তি পালন করছি, তখন বাংলাদেশের নারীরা নানা ধরনের সামাজিক, পারিবারিক সহিংসতা; সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক বৈষম্যে, অসাম্যে, নির্যাতনে; ফতোয়া-দোররার পীড়নে, মানবাধিকার হরণের অঘটনের শিকার। ফতোয়া দোররার আঘাতে নারীরা জর্জরিত। পথেঘাটে, কর্মক্ষেত্রে তারা যৌন হয়রানি ও নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। এমনকি ধর্ষণ, যৌন হয়রানির শিকার হয়ে আত্মহননে বাধ্য হচ্ছে।
তবে স্বীকার করতে হবে, নারীর এ অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটানোর প্রয়াসও রয়েছে। ব্যক্তি, সামাজিক-সাংগঠনিক এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সরকারি কিছু কিছু ঘোষণায় ও সিদ্ধান্তে, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের পদক্ষেপে, মহামান্য উচ্চ আদালতের কিছু কিছু যুগান্তকারী রায়ে নারীসমাজ কিছুটা হলেও আশার আলো দেখছে। কিন্তু সরকারের নীতি ও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতা, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ঔদাসীন্যের কারণে নারীর সার্বিক অগ্রগতি আশাব্যঞ্জক নয়। এ ছাড়া নারীর প্রতি সামাজিক-সাংস্কৃতিক অপদৃষ্টিভঙ্গি, আচার-আচরণে নৃশংসতার কারণে তাকে ঠেলে দিয়েছে চরম নিরাপত্তাহীন পরিবেশে। বেঁচে থাকার নিয়ত সংগ্রামে রত দরিদ্র, হতদরিদ্র শতকরা ৮০ ভাগ জনগোষ্ঠীর নারীরা দরিদ্র পুরুষের তুলনায় বেশি শোষিত ও অত্যাচারিত। এ পীড়ন অর্থনৈতিক, সামাজিক, পারিবারিক ও সাংস্কৃতিক। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণ বাড়লেও নেই মজুরির নিশ্চয়তা, জীবনের নিরাপত্তা। নেই শিক্ষার সুযোগ, পারিবারিক ও সামাজিক সুস্থ পরিবেশ। এই শোষণ ও বঞ্চনার প্রেক্ষাপটে আমাদের নারীসমাজ এ বছর শতবর্ষী আন্তর্জাতিক নারী দিবসে নানা দাবিতে সোচ্চার হচ্ছে।

প্রধান দাবি: মানবাধিকার নিশ্চিত করতে হবে
দেশের নারীসমাজ মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত। অনেকেই যৌন নির্যাতন ও হয়রানির শিকার এবং ফতোয়াবাজদের দোররায় ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে। মহামান্য উচ্চতর আদালতে ফতোয়া নিষিদ্ধ আইন ঘোষিত ও বিধিবদ্ধ হওয়ার পরও দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে, শহরে-বন্দরে, এমনকি রাজধানীতেও নারীদের স্বাধীন জীবনযাপন, চলাচল বিঘ্নিত হচ্ছে। পারিবারিক জীবন ও বিয়ে, ব্যক্তি-সম্পর্ক, চাকরি—সব ক্ষেত্রেই তারা বৈষম্যের শিকার। ফতোয়ার নামে বেআইনি বিচার সালিস বসিয়ে নারীর ওপর দোররার পীড়ন চালিয়ে হত্যা করার ঘটনাও ঘটছে। সাম্প্রতিককালে শরীয়তপুরে হেনার মৃত্যুর ঘটনাটি তার প্রমাণ।
বর্তমানে উচ্চতর আদালতে ফতোয়ার আইনের বিরুদ্ধে একটি মামলা চলছে। এই মামলার শুনানিতে ‘আইন ও সালিশ কেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠানের আইনজীবী ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন দৃঢ়ভাবে বলেছেন, ‘ফতোয়া দিয়ে হত্যাকাণ্ড বিধিবদ্ধ করার কোনো আইনি পথ নেই।’ সম্প্রতি ‘হেনা’কে ফতোয়া ও দোররা মেরে হত্যা করার ঘটনায় আদালত স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কতিপয় নির্দেশনা দিয়েছেন, যা নারীর নিরাপত্তা ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখবে। অন্যদিকে ফতোয়ার সমর্থনে মুষ্টিমেয় ধর্মের অপব্যবহারকারীরা ফতোয়াবাজদের পক্ষে অরাজকতা সৃষ্টির চেষ্টা চালাচ্ছে। আশার কথা, দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী তাদের সমর্থন করছে না। প্রতিটি সচেতন ও প্রগতিবাদী মানুষ ফতোয়াবাজদের অপচেষ্টা রুখে দিতে প্রস্তুত।
গত ৪০ বছরে অনেক ক্ষেত্রেই নারীর ক্ষমতায়ন ঘটেছে। মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাস পেয়েছে, নারী শিক্ষার হার বেড়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানে নারীর মুক্তি ও সম-অধিকারের ব্যাপক স্বীকৃতি ও অনুমোদন আছে। দেশের বিবিধ আইনেও নারীর প্রতি অন্যায় অপরাধের বিরুদ্ধে দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়ার কথা রয়েছে। রয়েছে শ্রম আইনে নারীশ্রমিকের নিরাপত্তা বিধান, পারিবারিক সহিংসতা বন্ধে আইন, এসিড নিক্ষেপ নিষিদ্ধ আইন, ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনবিরোধী আইন, যৌতুকবিরোধী আইন। ফতোয়া নিষিদ্ধ করে উচ্চ আদালত অনেক আগেই রায় দিয়েছেন।
জাতিসংঘের সিডও সনদের প্রতি (সংরক্ষিত) স্বীকৃতি, বেইজিং কর্মপরিকল্পনার সমর্থনে দেশের নারী উন্নয়ন কর্মপরিকল্পনা, জাতীয় নারীনীতি, জাতীয় নারী উন্নয়ন পরিষদ এবং মানবাধিকার কমিশন বাংলাদেশে নারীর সার্বিক মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সফল ও দৃঢ় ভূমিকা রাখতে পারত নিঃসন্দেহে। কিন্তু এসব আইন ও সনদ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বহুবিধ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দুর্বলতা, অনীহা, ধর্মান্ধ অপরাজনীতি, নারীর প্রতি হীন দৃষ্টিভঙ্গি অগ্রযাত্রার অন্তরায় হয়ে আছে।
আন্তর্জাতিক নারী দিবসের শতবর্ষে আজ দেশের নারীসমাজের সোচ্চার হওয়ার সময় এসেছে সব প্রকার বৈষম্য ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়ার। সব ক্ষেত্রে নারীর সম-অধিকার নিশ্চিত করেই আমরা রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন-সুফিয়া কামালের স্বপ্ন সফল করব! এই হোক এবারের আন্তর্জাতিক নারী দিবসের অঙ্গীকার।
মালেকা বেগম: নারীনেত্রী। শিক্ষক, উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.