বাঙালি ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি by ড. নিয়াজ আহম্মেদ
বাঙালির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির এক বড় অংশ জুড়ে রয়েছে পহেলা বৈশাখ। শুধু ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অংশই নয়, আমাদের জাতীয় উৎসবগুলোর অন্যতমও এটি। আর এক দিন পরই বাংলা নববর্ষ। বিভিন্ন ধর্ম, বর্ণ ও গোত্রের মানুষকে এক জায়গায় শামিল করার অনেক আয়োজনের মধ্যে পহেলা বৈশাখকে অনন্য বিবেচনা করা সমীচীন।
আবহমান বাংলার চিরাচরিত নিয়মের মধ্যে বৈশাখ মাসের প্রথম দিন হালখাতা দিয়ে যে যাত্রা শুরু হয়, সে যাত্রা নতুন বছরকে বরণের পাশাপাশি একটি সুন্দর প্রত্যয়ে আমাদের উদ্বেলিত করে। পুরনো সব কিছু ভুলে নতুনভাবে জীবনকে সাজানোর মনোভাব নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করে। পহেলা বৈশাখ আমাদের নতুন করে ভাবতে শেখায়। ছোট ছেলেমেয়েদের মহা-আনন্দের পাশাপাশি বড়দেরও নতুন বছরের শুরু নিজস্ব পরিকল্পনা গ্রহণের খোরাক জোগায়। বাঙালির এ উৎসব যত উৎসাহ ও উদ্দীপনার সঙ্গে চলতে থাকবে, তত বেশি আমাদের মধ্যে সমন্বয়তা ও অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনার পরিস্ফুটন ঘটানো সম্ভব হবে।
পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন স্বাভাবিকভাবেই আমাদের বাঙালি জাতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। কতগুলো কারণের জন্য এ দিনটির তাৎপর্য অপরিসীম। এর মধ্যে একটি হলো বাঙালির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে ধারণ, লালন ও এর মাধ্যমে নতুন প্রজন্মকে এর আঙ্গিকে গড়ে তোলা। আমাদের ছেলেমেয়েদের বৈশাখের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাদের ভেতর বাঙালি সংস্কৃতির বীজ বপন করানো প্রয়োজন। আধুনিক যুগের প্রচারমাধ্যমের অবাধ বিচরণের মাধ্যমে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাবে ছেলেমেয়েদের মধ্যে নিজস্ব সংস্কৃতি ভুলে যাওয়া অবান্তর নয় এবং অনেক ক্ষেত্রে তা-ই ঘটছে। এই ভুলে যাওয়াটা এখন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে বিশেষ দিনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য জানাটাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অসাম্প্রদায়িক সমাজ নির্মাণের একটি হাতিয়ার হিসেবে পহেলা বৈশাখের উৎসবকে বিবেচনা করা যেতে পারে। পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে গ্রামগঞ্জে গান, নৃত্য ও মেলার আয়োজন করা হয়। বিভিন্ন ধর্ম, মত ও পথের মানুষদের একটি মহাসম্মেলন ঘটে। সঙ্গে চলে আলোচনা সভা। বাঙালির উৎসবগুলো আয়োজনের ইতিহাস থেকে শুরু করে এর তাৎপর্য তুলে ধরা হয় এসব আলোচনা সভায়। তুলে ধরা হয় বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব ও সংস্কৃতির নানা দিক। ছেলেমেয়ে থেকে শুরু করে বয়স্করা পর্যন্ত এখানে অংশগ্রহণ করেন। এর মাধ্যমে সবার মধ্যে একটি অসাম্প্রাদায়িক চেতনার জন্ম হয়। এক ধর্মের প্রতি অন্য ধর্মের শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত হয়। আমরা জানতে পারি, বিভিন্ন ধর্মীয় সংস্কৃতির নানাবিধ দিক। বাঙালি সমাজের উৎসবগুলোর আয়োজন যত বেশি করে আমরা করতে পারব, তত বেশি মাত্রায় একের প্রতি অন্যের দূরত্ব কমে আসবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এখন আমরা এসব উৎসব উদ্যাপনে অনেক দূরে চলে যাচ্ছি। একদিকে যেমন দূরে চলে যাচ্ছি, অন্যদিকে এসব উৎসবের মধ্যে আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। করপোরেট সেক্টর এর ভেতর প্রবেশ করেছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে উৎসবের মূলমন্ত্র থেকে দূরে সরে আনুষ্ঠানিকতার প্রতি আমরা বেশি মাত্রায় ঝুঁকে পড়েছি। এ থেকে বেরিয়ে আসা আমাদের একান্ত প্রয়োজন।
ভৌগোলিক বিচারে আমি বাংলাদেশি, কিন্তু সংস্কৃতির বিচারে আমি বাঙালি। বাঙালি হিসেবে আমার রয়েছে নিজস্ব সংস্কৃতি। বিশ্বের যেখানেই বাঙালি রয়েছে, সেখানেই বাঙালি ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারক ও বাহক রয়েছে। বাংলাদেশে আমরা যখন পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন করি, ঠিক তখন কলকাতাসহ অন্যান্য বাংলা ভাষাভাষী মানুষও পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন করে। এ উৎসবের মাধ্যমে বাংলাভাষী মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান_সব একত্র হয়। এর মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষতার বীজও রোপিত হয়।
আমার প্রথম পরিচয় আমি বাঙালি। বাংলা আমার ভাষা, বাঙালি আমার সংস্কৃতি। বাঙালি উৎসব আমার দেহে, পোশাকে, চেতনায়, মনে, মননে ও মানসিকতায়। বিশ্বের যে প্রান্তেই আমি থাকি না কেন, আমার বাঙালিমনস্কতাকে কেউ উৎপাটন করতে পারবে না। বাঙালিমনস্কতাকে ধারণ, লালন ও পরিপূর্ণ বিকশিতকরণের জন্য আমাদের প্রয়োজন আবহমানকালের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির লালন ও এর বিকাশ সাধন। শুধু সংস্কৃতিকে লালনের মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখলেও চলবে না, বরং এর বাস্তব অনুশীলন করতে হবে। পহেলা বৈশাখ আমাদের সেই প্রেরণাই দেয়।
লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
neazahmed_2002@yahoo.com
পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন স্বাভাবিকভাবেই আমাদের বাঙালি জাতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। কতগুলো কারণের জন্য এ দিনটির তাৎপর্য অপরিসীম। এর মধ্যে একটি হলো বাঙালির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে ধারণ, লালন ও এর মাধ্যমে নতুন প্রজন্মকে এর আঙ্গিকে গড়ে তোলা। আমাদের ছেলেমেয়েদের বৈশাখের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাদের ভেতর বাঙালি সংস্কৃতির বীজ বপন করানো প্রয়োজন। আধুনিক যুগের প্রচারমাধ্যমের অবাধ বিচরণের মাধ্যমে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাবে ছেলেমেয়েদের মধ্যে নিজস্ব সংস্কৃতি ভুলে যাওয়া অবান্তর নয় এবং অনেক ক্ষেত্রে তা-ই ঘটছে। এই ভুলে যাওয়াটা এখন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে বিশেষ দিনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য জানাটাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অসাম্প্রদায়িক সমাজ নির্মাণের একটি হাতিয়ার হিসেবে পহেলা বৈশাখের উৎসবকে বিবেচনা করা যেতে পারে। পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে গ্রামগঞ্জে গান, নৃত্য ও মেলার আয়োজন করা হয়। বিভিন্ন ধর্ম, মত ও পথের মানুষদের একটি মহাসম্মেলন ঘটে। সঙ্গে চলে আলোচনা সভা। বাঙালির উৎসবগুলো আয়োজনের ইতিহাস থেকে শুরু করে এর তাৎপর্য তুলে ধরা হয় এসব আলোচনা সভায়। তুলে ধরা হয় বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব ও সংস্কৃতির নানা দিক। ছেলেমেয়ে থেকে শুরু করে বয়স্করা পর্যন্ত এখানে অংশগ্রহণ করেন। এর মাধ্যমে সবার মধ্যে একটি অসাম্প্রাদায়িক চেতনার জন্ম হয়। এক ধর্মের প্রতি অন্য ধর্মের শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত হয়। আমরা জানতে পারি, বিভিন্ন ধর্মীয় সংস্কৃতির নানাবিধ দিক। বাঙালি সমাজের উৎসবগুলোর আয়োজন যত বেশি করে আমরা করতে পারব, তত বেশি মাত্রায় একের প্রতি অন্যের দূরত্ব কমে আসবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এখন আমরা এসব উৎসব উদ্যাপনে অনেক দূরে চলে যাচ্ছি। একদিকে যেমন দূরে চলে যাচ্ছি, অন্যদিকে এসব উৎসবের মধ্যে আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। করপোরেট সেক্টর এর ভেতর প্রবেশ করেছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে উৎসবের মূলমন্ত্র থেকে দূরে সরে আনুষ্ঠানিকতার প্রতি আমরা বেশি মাত্রায় ঝুঁকে পড়েছি। এ থেকে বেরিয়ে আসা আমাদের একান্ত প্রয়োজন।
ভৌগোলিক বিচারে আমি বাংলাদেশি, কিন্তু সংস্কৃতির বিচারে আমি বাঙালি। বাঙালি হিসেবে আমার রয়েছে নিজস্ব সংস্কৃতি। বিশ্বের যেখানেই বাঙালি রয়েছে, সেখানেই বাঙালি ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারক ও বাহক রয়েছে। বাংলাদেশে আমরা যখন পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন করি, ঠিক তখন কলকাতাসহ অন্যান্য বাংলা ভাষাভাষী মানুষও পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন করে। এ উৎসবের মাধ্যমে বাংলাভাষী মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান_সব একত্র হয়। এর মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষতার বীজও রোপিত হয়।
আমার প্রথম পরিচয় আমি বাঙালি। বাংলা আমার ভাষা, বাঙালি আমার সংস্কৃতি। বাঙালি উৎসব আমার দেহে, পোশাকে, চেতনায়, মনে, মননে ও মানসিকতায়। বিশ্বের যে প্রান্তেই আমি থাকি না কেন, আমার বাঙালিমনস্কতাকে কেউ উৎপাটন করতে পারবে না। বাঙালিমনস্কতাকে ধারণ, লালন ও পরিপূর্ণ বিকশিতকরণের জন্য আমাদের প্রয়োজন আবহমানকালের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির লালন ও এর বিকাশ সাধন। শুধু সংস্কৃতিকে লালনের মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখলেও চলবে না, বরং এর বাস্তব অনুশীলন করতে হবে। পহেলা বৈশাখ আমাদের সেই প্রেরণাই দেয়।
লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
neazahmed_2002@yahoo.com
No comments