বৈদেশিক সাহায্য ব্যবহারে শ্লথগতি by এ এম এম শওকত আলী

সম্প্রতি বৈদেশিক সাহায্য ব্যবহারের শ্লথগতির বিষয়টি একাধিক সংবাদপত্রে প্রকাশ করা হয়েছে। বৈদেশিক সাহায্য তিন ধরনের। এক. প্রকল্প সাহায্য। দুই. পুনর্ভরণযোগ্য প্রকল্প সাহায্য। তিন. কারিগরি সহায়তা। প্রকল্প সাহায্য ঋণচুক্তির পর সরাসরি পাওয়া যায়।


কিছু শর্ত সাপেক্ষে পুনর্ভরণযোগ্য প্রকল্প সাহায্যের জন্য প্রথমে সরকারি অর্থ ব্যয় করে পরবর্তী পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট দাতা সংস্থার কাছে হিসাব দিয়ে ব্যয়কৃত অর্থ চাইতে হয়। এ ক্ষেত্রে দাখিলকৃত কাগজপত্রের পরীক্ষার পরই অর্থ পাওয়া যায়। সাধারণত প্রক্রিয়াটি সময়সাপেক্ষ। কারিগরি সহায়তার বরাদ্দ দাতা সংস্থাই প্রকল্প দলিল অনুযায়ী ব্যয় করে থাকে। এর সিংহভাগই খরচ হয় পরামর্শকের বেতন ভাতা খাতে। বিভিন্ন কারণে পরামর্শক নিয়োগে বিলম্ব হলে বরাদ্দকৃত অর্থ যথাসময়ে ব্যয় করা সম্ভব হয় না। আমাদের অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, উপযুক্ত বিদেশি পরামর্শক নিয়োগে বেশি সময়ের প্রয়োজন হয়।
কারিগরি সহায়তা প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের মূল উদ্দেশ্য বিভিন্ন ধরনের। এক. প্রস্তাবিত প্রকল্পের প্রকৃতি ও ধরন নির্ধারণ করা। দুই. কোনো সরকারি সংস্থার দক্ষতা বৃদ্ধি করা। এ ধরনের প্রকল্প গ্রহণের প্রধান যুক্তি হলো দেশি বিশেষজ্ঞদের অভাব। এর জন্য বিদেশি দাতাদের পক্ষ থেকে যুক্তি দেওয়া হয় যে এ ধরনের প্রকল্পের মাধ্যমে কারিগরিবিষয়ক দক্ষতা বাংলাদেশ অর্জন করতে সক্ষম হবে। যে প্রশ্নটি গবেষকরা বলে থাকেন তা হলো, প্রায় ৪০ বছর ধরে এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়িত হওয়ার পরও কি দক্ষতা অর্জন সম্ভব হয়নি। এটা কি হবে একটি অন্তহীন প্রক্রিয়া? নিন্দুকেরা বলে থাকেন যে বেকার বিদেশিদের জন্য কর্মসংস্থান নিশ্চিত করাই এ ধরনের প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য। এ বিষয়টি অনুসন্ধানযোগ্য।
সরকারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (অসবি) সম্প্রতি বিদেশি সাহায্যপুষ্ট ৩৭টি প্রকল্পের মূল্যায়ন করেছে। যাতে দেখা যায় যে প্রকল্প সাহায্য ব্যবহারের মাত্রা অত্যন্ত কম। এ বিষয়ে যেসব মন্ত্রণালয় সবচেয়ে পিছিয়ে আছে তা হলো শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ, সড়ক ও সেতু এবং স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। মূল্যায়নে বলা হয়েছে, এ ক্ষেত্রে সরকারি অর্থের ব্যবহার অধিকতর। প্রকল্প সাহায্য ব্যবহারের ব্যর্থতার দরুন এডিপির বাস্তবায়ন আশানুরূপ হয়নি। অসবির মতে, এডিপি প্রণয়নকালে বৈদেশিক সাহায্যের চাহিদা বিবেচনায় না নিয়ে অনুমাননির্ভর প্রকল্প প্রণীত হয়েছে। বিষয়টি স্পষ্টীকরণের প্রয়োজন।
কারণ, যেকোনো বিদেশি সাহায্যপুষ্ট প্রকল্পে অর্থায়নের আগে দাতা সংস্থাগুলোই প্রকল্পের যথার্থতা বা যৌক্তিকতা সম্পর্কে নিশ্চিত করে। এ জন্য প্রাক-প্রকল্প সমীক্ষাও প্রণয়ন করে তা পরীক্ষা-নীরিক্ষা করা হয়। সাধারণত বড় বড় প্রকল্পে অভিজ্ঞ ও দক্ষ দেশিসহ বিদেশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এ কাজটি করে থাকে। এর পরও কেন অনুমাননির্ভর প্রকল্প বিদেশি সাহায্যপুষ্ট তালিকায় স্থান লাভ করে তা বোধগম্য নয়।
অসবির মূল্যায়নে প্রকল্প সাহায্য ব্যবহারের মাত্রা কমে যাওয়ার বিষয়ে কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। এক. ঋণদাতাদের সম্মতি পাওয়ার বিষয়ে দীর্ঘসূত্রতা। দুই. নকশা প্রণয়নে ত্রুটি। তিন. বিভিন্ন ধরনের প্রকল্প দলিল সংশোধনে বিলম্ব। চার. পরামর্শকদের কার্যপরিধি সঠিকভাবে চিহ্নিত করার ব্যর্থতা। পাঁচ. উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার মালামাল ক্রয়ের বিধি-বিধান সম্পর্কে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কর্মকর্তাদের অজ্ঞতা।
যেসব কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে তা দাতাগোষ্ঠী ও সরকারের অজানা নয়। যেন দাতা পর্যায়ে সম্মতি লাভের বিষয়ে যে বিলম্বের কথা বলা হয়েছে, এর জন্য সংশ্লিষ্ট সংস্থার নিয়মকানুনের জটিলতা বা দীর্ঘ প্রক্রিয়াই মূল কারণ। এ ক্ষেত্রে সরকারি নিয়মকানুন সম্পন্ন করতেও বিলম্ব হতে পারে। সাধারণত ঋণচুক্তি দুই পক্ষের স্বাক্ষরিত হওয়ার পরই প্রকল্প দলিল প্রণীত হয়। স্বাক্ষরিত দলিল সম্পন্ন হওয়ার পরই যে প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু করা যাবে এমন কোনো কথা নয়। সংশ্লিষ্ট বিদেশি সাহায্য সংস্থার আনুষ্ঠানিক সম্মতি_যাকে বোর্ডের সম্মতি বলা হয়, তার পরও কয়েকটি পদক্ষেপ চুক্তির শর্ত অনুযায়ী পূরণ করতে হয়। শর্তের মধ্যে সংস্কারমূলক শর্তও সনি্নবেশিত করা হয়। এ ধরনের শর্ত অনেক সময় সরকার যথাসময়ে বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয়। ফলে অর্থ ছাড় করা থেকে বিদেশি সংস্থা বিরত থাকে।
নকশার ত্রুটির বিষয়ও কেন উত্থাপিত হবে তা স্পষ্টীকরণের প্রয়োজন রয়েছে। ক্ষমতাসীন সরকার অনেক সময় দাতা সংস্থার সম্মতির পর কিছু রদবদলের চেষ্টা করে। এ ক্ষেত্রেও উভয় পক্ষের জন্য যথাসময়ে একমত হওয়ার বিষয়ে জটিলতার সৃষ্টি হয়। প্রকল্প দলিল সংশোধনের একমাত্র কারণ ত্রুটিপূর্ণ নকলা না-ও হতে পারে। যেকোনো সংশোধন প্রক্রিয়ায় সরকারি পর্যায়ে নথির ওঠানামার বিষয়টিও এ ক্ষেত্রে বিবেচ্য। এ প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় প্রথমে একটি আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠক করে। এতে পরিকল্পনা কমিশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগের প্রতিনিধিও উপস্থিত থাকেন। এরপর সংশোধিত প্রকল্প দলিলের অনুমোদনে উদ্যোগী মন্ত্রণালয়েও দেরি হতে পারে। কারণ সংশ্লিষ্ট শাখা থেকে নথি বিভিন্ন স্তর অতিক্রম হওয়ার বিষয়ে বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এরপর সংশোধিত প্রকল্প দলিল পরিকল্পনা কমিশনে প্রেরণ করা হয়। এ ক্ষেত্রে যে প্রশ্নটি বিবেচ্য তা হলো আন্তমন্ত্রণালয় সভায় একই কমিশনের প্রতিনিধি উপস্থিত হওয়ার পরও কেন পুনরায় ওই কমিশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগ বিষয়টি পরীক্ষা-নীরিক্ষা করবে।
একমাত্র কারণ হতে পারে যে সভার মন্তব্য বক্তব্য অনুযায়ী সংশোধনী করা বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া। এ পর্যায়েও কমিশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগের একাধিক স্তরে বিষয়টি পরীক্ষা করে প্রয়োজনবোধে পুনরায় কমিশন একটি আন্তমন্ত্রণালয় সভায় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এ ক্ষেত্রে কত দিন সময়ের প্রয়োজন হয় সে বিষয়টিও চিহ্নিত করা প্রয়োজন। সার্বিকভাবে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতার কারণ চিহ্নিত করে। প্রতিবছর এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদে আলোচিত হয়।
অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, আলোচনা হয় নিতান্তই আনুষ্ঠানিক। আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হয়, বিলম্বের যেসব কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। এ কথা অবশ্যই বলা যায়, এত উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে প্রতিটি প্রকল্পের বিষয় চুলচেরা আলোচনা করা সম্ভব নয়। তবে যে বিষয়টি উল্লেখ করা সমীচীন তা হলো, প্রতি মাসেই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর নেতৃত্বে মন্ত্রণালয় পর্যায়ে এডিপি বাস্তবায়নের অগ্রগতি পর্যালোচনা করা হয়। এসব সভায়ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় যে সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থা বাস্তবায়ন তরান্বিত করবে। এর পরও প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি রোধ করা সম্ভব হয়নি।
উপরোক্ত প্রসঙ্গে অন্য একটি বিষয়ও উল্লেখ করা যায়। বিষয়টি হলো, প্রকল্প বাস্তবায়ন পর্যায়ে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার পর্যালোচনা দল সময় সময় সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের অগ্রগতির বিষয়টি পরিবীক্ষণ করে। এই দল পর্যালোচনার ফলাফল ও ভবিষ্যতে করণীয় কী সে বিষয়ে মন্ত্রণালয়ে বৈঠক করে একটি প্রতিবেদনও দাখিল করে।
কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায়, প্রতিবেদনটি একতরফাই হয়। এ জন্য প্রতিবেদনের ওপর সংশ্লিষ্ট সংস্থাসহ মন্ত্রণালয় সুচিন্তিত মতামত প্রদান করলে প্রকল্প বাস্তবায়নের ধীরগতি এড়ানো সম্ভব। এ ক্ষেত্রে যে বিষয়টি সরকারি পর্যায়ে নিশ্চিত করা প্রয়োজন তা হলো_এক. প্রতিবেদনে উলি্লখিত করণীয় বিষয় সম্পর্কে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ এবং দুই. দাতা সংস্থার পক্ষে যেসব করণীয় বিষয় সেগুলো যাতে ওই সংস্থা সময়মতো বাস্তবায়ন করে, সে বিষয়ে সচেতন হওয়া।
অতীতে প্রকল্পের ধীরগতি সম্পর্কে দাতাগোষ্ঠী একতরফাভাবে সরকারি প্রশাসনের অদক্ষতার বিষয়ে সোচ্চার ছিল। তারা মন্ত্রণালয় পর্যায়ে আলোচনার সময় দক্ষতা বৃদ্ধির ওপর গুরুত্বারোপ করত। তাদের নিজস্ব সংস্থায়ও যে লাল ফিতার দৌরাত্ম্য রয়েছে সে বিষয়টি সহজে বা প্রকাশ্যে স্বীকার করত না। এখনো যে করে তা নয়। তবে অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় মাঝেমধ্যে এ কথা তারা স্বীকার করে।
অসবির মূল্যায়ন প্রতিবেদনের মন্তব্য ও বক্তব্যের সঙ্গে পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন, মূল্যায়ন ও পরিবীক্ষণ বিভাগের একই বিষয়ে সাম্প্রতিক প্রতিবেদনও বিবেচ্য। এ প্রতিবেদনের মূল কথা হলো, অতীতে গুটিকয়েক বছর ব্যতীত অন্য কোনো সময়ে প্রকল্প সাহায্যের মাত্রা সরকারি বরাদ্দের অধিক হয়নি। অর্থাৎ প্রকল্প সাহায্য ব্যবহারের ধীরগতি অল্প কয়েক বছর ছাড়া সব সময়ই কম ছিল। এর মানে এই নয় যে এ অবস্থার কোনো উন্নতি করা যাবে না। উন্নতি করার জন্য দাতাগোষ্ঠীসহ সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে। প্রয়োজন হলো লাল ফিতার দৌরাত্ম্য যথাসম্ভব হ্রাস করা। সরকারের জন্য এ ক্ষেত্রে আমলাসহ ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতাদের দক্ষতার প্রশ্নটিও বিবেচনার দাবি রাখে। এ বিষয়টির ওপর প্রধানমন্ত্রী ইতিমধ্যে একাধিকবার গুরুত্বারোপ করেছেন।

লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা

No comments

Powered by Blogger.