আলোকের এই ঝরনাধারায় (পর্ব-৭১)-কলকাতা শহরে by আলী যাকের
একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছিলাম আমি। ২৬শে মার্চ রাত দেড়টায়। জেগে জেগে স্বপ্ন দেখা। তখন পাকিস্তানি আর্মি পূর্ণোদ্যমে আক্রমণ করে চলেছে ঢাকা শহরের ওপর। আমি দেখেছিলাম, দিব্যদৃষ্টিতে কারা যেন দাউদাউ আগুনের গহ্বরে ছুড়ে ফেলছে লাখ লাখ বাংলাদেশের প্রথম পতাকা।
আমার প্রিয় বাংলা নামধারী দোকানগুলোর নাম বদলে যাচ্ছে উর্দু নামে। রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ দাশ, নজরুল, সুধীন দত্তের কবর খোঁড়া হচ্ছে রমনার রেসকোর্স ময়দানে। ক্রুশবিদ্ধ শেখ মুজিবের মরদেহ এক মাইল উঁচু থেকে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে জিন্নাহ অ্যাভিনিউতে। এই একেকটি দুঃস্বপ্ন আমার শরীরে বসিয়ে দিচ্ছিল যেন কালসাপের একেকটি ছোবল। ২৮ মার্চ কারফিউ শিথিল করা হলে দুঃস্বপ্ন থেকে সদ্য জেগে ওঠা আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, পাকিস্তানে আর নয়। কলকাতায় শেষ অবধি কী হবে? এই প্রশ্নও যে আমার মনে জাগেনি, তা নয়। এখানে যদি থেকে যেতেই হয় বাকি জীবনটা? বাংলাদেশকে স্বাধীন করা যদি সম্ভব না হয়? তাহলে? এর পরে আর এই ভাবনাকে প্রশ্রয় দিইনি। জীবনে সব কিছু চিন্তাভাবনা করে হয় না। যা হওয়ার তা হবে।
আরো একটা বিষয় আমাকে উদ্যোগী করেছিল এমন বেপরোয়া একটা সিদ্ধান্ত গ্রহণে। ঢাকা ছেড়ে আসার পর বর্ডার পেরিয়ে ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করার আগে নৌকায়, হেঁটে বিস্তর পথ পেরিয়ে আমি ও আমার সঙ্গীরা নবীনগরের এক অজপাড়াগাঁয়ে আমার পৈতৃক গ্রামে এসে উঠেছিলাম। ঢাকা থেকে গ্রাম অবধি এই পথপরিক্রমার সময় সর্বত্র মুক্তি-উন্মুখ বাঙালির স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন লক্ষ করেছি। প্রতিনিয়তই তারা বলেছে, 'আপনারা যান, যুদ্ধ করুন, বাংলা মায়ের হৃতগৌরব ফিরিয়ে আনুন। আমরা আপনাদের হাতে হাত রেখে লড়াই করব।'
হঠাৎ কেউ একজন আমার নাম ধরে পেছন থেকে ডেকে উঠল। প্রায় চমকে উঠি দিবাস্বপ্ন দেখা থেকে। অজয়! আমার ছোটবেলার বন্ধু। যত দূর খবর পেঁৗছেছিল আমার কাছে, অজয় এখন প্রায় ছন্নছাড়া একটি জীবন যাপন করছে কলকাতায়। বাবার পয়সা আছে। কিছু করতে হয় না জীবনধারণের জন্য। অজয়, যার কাছে রাজনীতি আর রসায়নশাস্ত্র সমান অপরিচিত, আবেগে শক্ত করে ধরে আমার হাত। বলতে থাকে, 'কী করলি তোরা বল তো? একেবারে দুনিয়াটাকে কাঁপিয়ে দিলি? চল, বাড়ি চল। বাবা দেখলে খুশি হবে।' অজয়ের পেছনে পেছনে চললাম আমি।
অজয়ের বাড়ি একসময় ঢাকায় ছিল। ঊনপঞ্চাশে ওদের গোটা পরিবার কলকাতায় চলে যায়। ঢাকার দয়াগঞ্জ পাড়ায় থাকত ওরা। অজয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় অবশ্য এই কলকাতায়ই। সেই বাল্যকালে। মায়ের সঙ্গে যখন নানা বাড়িতে বেড়াতে আসতাম, তখন। একবার অজয়ের বাবা আমাকে ওদের দয়াগঞ্জের ঠিকানা দিয়েছিলেন বাড়িটা কেমন আছে গিয়ে দেখার জন্য। আমি গিয়েওছিলাম। বেশ বড় দালান। দীর্ঘদিন কোনো সংস্কার হয়নি। এখন একটু জীর্ণ হয়ে পড়েছে। বিহার থেকে আগত এক ভদ্রলোক অজয়ের বাবার কাছ থেকে কিনে নিয়েছিলেন বাড়িটা। বর্তমান অধিবাসীদের অনুমতি নিয়ে আমি বাড়ির ভেতরের উঠানে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। দেখতে পাচ্ছিলাম স্পষ্টই যেন অজয়ের মা নানা কাজে ব্যস্ত এ-ঘরে, সে-ঘরে। অজয়ের বড় বোনেরা কড়ি খেলছে বারান্দায় বসে। অজয় হামাগুড়ি দিচ্ছে উঠানে।
'ইস! একবারে দড়ির মতো চেহারা হইয়া গেছে তর', বলে ওঠেন অজয়ের মা। প্রায় পর্বতপ্রমাণ খাবার আমার সামনে পরিবেশন করা হয়। এর অনেকটাই উদরস্থ করে বের হতে পেরেছিলাম ওই বাড়ি থেকে সেই দিন। টেবিলের চারপাশে বসে আমার এই খাওয়ার তদারক করছিলেন অজয়ের মা-বাবা, তিন বোন, অজয়ের তিন ভাগ্নে-ভাগি্ন এবং অজয় স্বয়ং। আমার মনে হয়েছিল, ঘরছাড়া হয়ে যেন ঘরে ফিরে এলাম আমি। চোখ ভিজে আসে আমার এই আপনজনের সানি্নধ্যে।
পার্ক সার্কাস ট্রাম ডিপো থেকে ট্রামগুলো বেরিয়ে যে রাস্তাটি পড়ে, তার নাম কংগ্রেস এক্সিবিউশন রোড। ট্রাম ডিপোর ঠিক বাইরেই কালীদার মনোহারি দোকান। এই দোকানেই সেই ছোটবেলায় কোকা-কোলা কম্পানির অরেঞ্জ খেতাম। অজয়দের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে কালীদার দোকানের সামনে দাঁড়ালাম আমি। কালীদার বয়স কিছুটা বেড়েছে। জুলফির কাছে চুল কিছুটা পাক ধরেছে। গায়ের রং মিশমিশে কালো। তাঁর সঙ্গে ছেষট্টির পরে আর দেখা হয়নি আমার। পাঁচ বছর পর কলকাতায় এলাম। কালীদা একটা পানের খিলি বানাচ্ছিলেন। আমি কোনো কথা বলি না। সামনে এসে দাঁড়াই। চোখ তুলে তাকান তিনি। এক সেকেন্ডের দ্বিধা। তারপর লাফিয়ে দোকান থেকে নামেন। আমাকে জড়িয়ে ধরেন বুকে। বলেন, 'তুই বাঁইচ্যা আছোস? ঢাকার শহর বলে জ্বালাইয়া-পোড়াইয়া শ্যাষ কইরা দিছে? বিক্রমপুরের বজ্রযোগিনীর কোনো খবর জানোস?' এক নিঃশ্বাসে এত কথা বলে হাঁপাতে থাকেন কালীদা। আমাকে নিয়ে কী যে করবেন, ভেবে উঠতে পারেন না। তিন-চার প্যাকেট বিস্কুট তুলে দেন আমার হাতে। দিয়েই লজ্জিত হয়ে পড়েন। নিশ্চয়ই তাঁর মনে পড়ে যে আমি তো এখন আর স্কুলের বাচ্চা ছেলে নই?
প্রথম তিন-চার দিন একেবারে ঘোরের মধ্যে কেটে যায় আমার। এই তিন-চার দিনে আমি রীতিমতো চষে ফেলি আমার পরিচিত কলকাতা শহর। হাওড়া ব্রিজের ওপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে এপার থেকে ওপার যাই। বারকয়েক কলেজ স্ট্রিটের বইয়ের দোকানের সামনে দিয়ে হেঁটে যাই। কলেজ স্ট্রিটের বিখ্যাত কফি হাউসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকি চুপচাপ। ভাবি, এই কফি হাউসের ভেতরে নিশ্চয়ই সত্যজিৎ রায়, বিষ্ণু দে, সুভাষ মুখোপাধ্যায়রা চুটিয়ে আড্ডা দিচ্ছেন। অন্য কোনো টেবিল হয়তো তরুণ কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কলরবে মুখর। আচ্ছা, ওঁরা কি বাংলাদেশ সম্বন্ধে ভাবছেন? আমাকে খুব বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয়নি এই প্রশ্নের জবাবের জন্য। সেই গল্প এখন নয়।
(চলবে...)
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
আরো একটা বিষয় আমাকে উদ্যোগী করেছিল এমন বেপরোয়া একটা সিদ্ধান্ত গ্রহণে। ঢাকা ছেড়ে আসার পর বর্ডার পেরিয়ে ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করার আগে নৌকায়, হেঁটে বিস্তর পথ পেরিয়ে আমি ও আমার সঙ্গীরা নবীনগরের এক অজপাড়াগাঁয়ে আমার পৈতৃক গ্রামে এসে উঠেছিলাম। ঢাকা থেকে গ্রাম অবধি এই পথপরিক্রমার সময় সর্বত্র মুক্তি-উন্মুখ বাঙালির স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন লক্ষ করেছি। প্রতিনিয়তই তারা বলেছে, 'আপনারা যান, যুদ্ধ করুন, বাংলা মায়ের হৃতগৌরব ফিরিয়ে আনুন। আমরা আপনাদের হাতে হাত রেখে লড়াই করব।'
হঠাৎ কেউ একজন আমার নাম ধরে পেছন থেকে ডেকে উঠল। প্রায় চমকে উঠি দিবাস্বপ্ন দেখা থেকে। অজয়! আমার ছোটবেলার বন্ধু। যত দূর খবর পেঁৗছেছিল আমার কাছে, অজয় এখন প্রায় ছন্নছাড়া একটি জীবন যাপন করছে কলকাতায়। বাবার পয়সা আছে। কিছু করতে হয় না জীবনধারণের জন্য। অজয়, যার কাছে রাজনীতি আর রসায়নশাস্ত্র সমান অপরিচিত, আবেগে শক্ত করে ধরে আমার হাত। বলতে থাকে, 'কী করলি তোরা বল তো? একেবারে দুনিয়াটাকে কাঁপিয়ে দিলি? চল, বাড়ি চল। বাবা দেখলে খুশি হবে।' অজয়ের পেছনে পেছনে চললাম আমি।
অজয়ের বাড়ি একসময় ঢাকায় ছিল। ঊনপঞ্চাশে ওদের গোটা পরিবার কলকাতায় চলে যায়। ঢাকার দয়াগঞ্জ পাড়ায় থাকত ওরা। অজয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় অবশ্য এই কলকাতায়ই। সেই বাল্যকালে। মায়ের সঙ্গে যখন নানা বাড়িতে বেড়াতে আসতাম, তখন। একবার অজয়ের বাবা আমাকে ওদের দয়াগঞ্জের ঠিকানা দিয়েছিলেন বাড়িটা কেমন আছে গিয়ে দেখার জন্য। আমি গিয়েওছিলাম। বেশ বড় দালান। দীর্ঘদিন কোনো সংস্কার হয়নি। এখন একটু জীর্ণ হয়ে পড়েছে। বিহার থেকে আগত এক ভদ্রলোক অজয়ের বাবার কাছ থেকে কিনে নিয়েছিলেন বাড়িটা। বর্তমান অধিবাসীদের অনুমতি নিয়ে আমি বাড়ির ভেতরের উঠানে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। দেখতে পাচ্ছিলাম স্পষ্টই যেন অজয়ের মা নানা কাজে ব্যস্ত এ-ঘরে, সে-ঘরে। অজয়ের বড় বোনেরা কড়ি খেলছে বারান্দায় বসে। অজয় হামাগুড়ি দিচ্ছে উঠানে।
'ইস! একবারে দড়ির মতো চেহারা হইয়া গেছে তর', বলে ওঠেন অজয়ের মা। প্রায় পর্বতপ্রমাণ খাবার আমার সামনে পরিবেশন করা হয়। এর অনেকটাই উদরস্থ করে বের হতে পেরেছিলাম ওই বাড়ি থেকে সেই দিন। টেবিলের চারপাশে বসে আমার এই খাওয়ার তদারক করছিলেন অজয়ের মা-বাবা, তিন বোন, অজয়ের তিন ভাগ্নে-ভাগি্ন এবং অজয় স্বয়ং। আমার মনে হয়েছিল, ঘরছাড়া হয়ে যেন ঘরে ফিরে এলাম আমি। চোখ ভিজে আসে আমার এই আপনজনের সানি্নধ্যে।
পার্ক সার্কাস ট্রাম ডিপো থেকে ট্রামগুলো বেরিয়ে যে রাস্তাটি পড়ে, তার নাম কংগ্রেস এক্সিবিউশন রোড। ট্রাম ডিপোর ঠিক বাইরেই কালীদার মনোহারি দোকান। এই দোকানেই সেই ছোটবেলায় কোকা-কোলা কম্পানির অরেঞ্জ খেতাম। অজয়দের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে কালীদার দোকানের সামনে দাঁড়ালাম আমি। কালীদার বয়স কিছুটা বেড়েছে। জুলফির কাছে চুল কিছুটা পাক ধরেছে। গায়ের রং মিশমিশে কালো। তাঁর সঙ্গে ছেষট্টির পরে আর দেখা হয়নি আমার। পাঁচ বছর পর কলকাতায় এলাম। কালীদা একটা পানের খিলি বানাচ্ছিলেন। আমি কোনো কথা বলি না। সামনে এসে দাঁড়াই। চোখ তুলে তাকান তিনি। এক সেকেন্ডের দ্বিধা। তারপর লাফিয়ে দোকান থেকে নামেন। আমাকে জড়িয়ে ধরেন বুকে। বলেন, 'তুই বাঁইচ্যা আছোস? ঢাকার শহর বলে জ্বালাইয়া-পোড়াইয়া শ্যাষ কইরা দিছে? বিক্রমপুরের বজ্রযোগিনীর কোনো খবর জানোস?' এক নিঃশ্বাসে এত কথা বলে হাঁপাতে থাকেন কালীদা। আমাকে নিয়ে কী যে করবেন, ভেবে উঠতে পারেন না। তিন-চার প্যাকেট বিস্কুট তুলে দেন আমার হাতে। দিয়েই লজ্জিত হয়ে পড়েন। নিশ্চয়ই তাঁর মনে পড়ে যে আমি তো এখন আর স্কুলের বাচ্চা ছেলে নই?
প্রথম তিন-চার দিন একেবারে ঘোরের মধ্যে কেটে যায় আমার। এই তিন-চার দিনে আমি রীতিমতো চষে ফেলি আমার পরিচিত কলকাতা শহর। হাওড়া ব্রিজের ওপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে এপার থেকে ওপার যাই। বারকয়েক কলেজ স্ট্রিটের বইয়ের দোকানের সামনে দিয়ে হেঁটে যাই। কলেজ স্ট্রিটের বিখ্যাত কফি হাউসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকি চুপচাপ। ভাবি, এই কফি হাউসের ভেতরে নিশ্চয়ই সত্যজিৎ রায়, বিষ্ণু দে, সুভাষ মুখোপাধ্যায়রা চুটিয়ে আড্ডা দিচ্ছেন। অন্য কোনো টেবিল হয়তো তরুণ কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কলরবে মুখর। আচ্ছা, ওঁরা কি বাংলাদেশ সম্বন্ধে ভাবছেন? আমাকে খুব বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয়নি এই প্রশ্নের জবাবের জন্য। সেই গল্প এখন নয়।
(চলবে...)
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments