শেকড়ের ডাক-২০২০ সালের ঢাকা ও নানা আশঙ্কার কথা by ফরহাদ মাহমুদ

উন্নয়ন নিয়ে ঢাকঢোল বাজানোর অন্ত নেই। কার আমলে কতটা উন্নতি হয়েছে, তার অনেক লম্বা ফিরিস্তি আমরা পাই। কিন্তু বাস্তবতা কী বলে? সেই উন্নয়ন কাঙ্ক্ষিত মাত্রার ধারেকাছে পৌঁছেছে কি? ২০১১ সালে বসবাসযোগ্যতার দিক থেকে বিশ্বের ১৪০টি বড় শহরের মধ্যে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার অবস্থান ছিল ১৩৯তম।


কথাটা ঘুরিয়েও বলা যায়, বসবাস অনুপযোগী বা নিকৃষ্ট শহরের তালিকায় ঢাকা মহানগরীর অবস্থান দ্বিতীয়। এক নম্বরে আছে জিম্বাবুয়ের রাজধানী হারারে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) জরিপে এই তথ্য বেরিয়ে এসেছে। অন্য শহরগুলোর অবস্থাও তথৈবচ।
অনেক বিশেষজ্ঞই ইতিমধ্যে দাবি করছেন, বাংলাদেশে বছরে ১৫ থেকে ২০ হাজার মানুষ মারা যায় পরিবেশদূষণের কারণে, যার সিংহভাগই মারা যায় ঢাকা মহানগরীতে। তার চেয়েও অনেক বেশি মানুষ অসুস্থ হয়ে কর্মক্ষমতা হারায়। এখানে ওয়াসার সরবরাহ করা পানীয়জল পানের অযোগ্য। অনেক জায়গায়ই ওয়াসার পুরনো পানির লাইন ফুটো হয়ে স্যুয়ারেজ লাইনের সঙ্গে একাকার হয়ে গেছে। পানিতে কলিফর্ম জীবাণুর পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় পাঁচ শ গুণ পর্যন্ত বেশি পাওয়া যায়। তার পরও শুষ্ক মৌসুমে পানির জন্য হাহাকার চলে। গ্যাস-বিদ্যুতের অবস্থাও শোচনীয়। এমন অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে এই নগরী যে অনেক গলিপথে ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি, এমনকি অ্যাম্বুলেন্স ঢুকতে পারে না। তার পরও নগরীর অপরিকল্পিত বৃদ্ধি থেমে নেই। রাজপথে হাঁটু বা কোমর সমান পানি জমার জন্য এখন আর খুব একটা ভারী বৃষ্টির প্রয়োজন হয় না। মানুষের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার অবস্থা খুবই নাজুক। জনসাধারণের স্বাস্থ্যসেবার মানও অত্যন্ত নিম্নপর্যায়ের। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বা বিনোদনের সুযোগ দিন দিনই হারিয়ে যাচ্ছে। গাছপালা উধাও হয়ে শহর কেবল ইট-পাথরের এক ভাগাড়ে পরিণত হচ্ছে। ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। যানজটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকতে হয়। ইআইইউর জরিপে এ বিষয়গুলোই মূল্যায়ন করা হয়েছে। এ অবস্থায় ২০২০ সালে ঢাকার অবস্থা কেমন হবে? এখানে মানুষ বসবাস করতে পারবে কি? চলুন না, সাধারণ পাটি গণিতের জ্ঞান নিয়ে হিসাবটা একটু মেলানোর চেষ্টা করি।
ঢাকা মহানগরীর জনসংখ্যা এখন দেড় কোটির মতো। নানাবিধ কারণে ঢাকার ওপর ক্রমাগতভাবেই জনসংখ্যার চাপ বেড়ে চলেছে। সেদিক থেকে অনুমান করা যায়, ২০২০ সাল নাগাদ ঢাকার জনসংখ্যা দুই কোটি ছাড়িয়ে যাবে। বর্তমানে ঢাকায় পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশনের যে অবকাঠামোগত সুবিধা রয়েছে, তা ৫০ লাখ মানুষের জন্যও যথেষ্ট নয়। এর যে নাটকীয় কোনো উন্নতি হবে, তেমনটা আশা করা যায় না। ফলে স্যুয়ারেজ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে। আর তখন জলাবদ্ধতার যে রূপ দেখা যাবে, তা হবে অত্যন্ত ভয়াবহ। যানজট পরিস্থিতিরও দিন দিন অবনতি ঘটবে। কারণ, রাস্তাগুলোতে চাপ ক্রমেই বাড়বে, কিন্তু রাস্তার প্রস্থ বাড়ানো যাবে না। উপকূলীয় এলাকায় জীবন ধারণ ক্রমেই কষ্টকর হয়ে পড়ছে। ফলে জলবায়ু উদ্বাস্তুর সংখ্যাও দিন দিন বাড়বে এবং তাদেরও একটি বড় অংশ বেঁচে থাকার প্রয়োজনে ঢাকামুখী হবে।
বর্তমানে ঢাকা মহানগরীতে প্রতিদিন পানির চাহিদা গড়ে সোয়া দুই কোটি লিটার বলা হলেও বাস্তবে তা আরো বেশি। এর মধ্যে ওয়াসা প্রতিদিন ১৮০ থেকে ১৮৫ লাখ লিটার পানি সরবরাহ করতে পারে। আর এই পানির ৮৭ শতাংশই আসে ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে, অর্থাৎ গভীর নলকূপের মাধ্যমে উত্তোলন করা হয়। বাকি ১৩ শতাংশ আসে নদীর পানি শোধনের মাধ্যমে। কিন্তু এই প্রধান দুটি উৎসই ভয়াবহভাবে বিপর্যস্ত। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর প্রতিবছরই তিন থেকে পাঁচ মিটার করে নিচে নামছে। শুষ্ক মৌসুমে এখনই অনেক নলকূপে পানি ওঠে না। সেগুলো তুলে আবার আরো গভীরে স্থাপন করতে হচ্ছে। ২০২০ সাল নাগাদ এই স্তর ২৫ থেকে ৪০ মিটারেরও বেশি নিচে নেমে যেতে পারে। তখন কী হবে? তদুপরি বিজ্ঞানীরা বলছেন, ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন দ্রুত কমিয়ে আনা না গেলে ছোটখাটো ভূমিকম্পেও বড় ধরনের বিপর্যয় দেখা দিতে পারে।
ভূপৃষ্ঠস্থ উৎসের মধ্যে নদীগুলোই প্রধান। বর্তমানে শীতলক্ষ্যা নদীর পানি এবং সামান্য পরিমাণে বুড়িগঙ্গার পানি শোধন করে সরবরাহ করা হচ্ছে। কিন্তু অতিরিক্ত দূষণের কারণে শুষ্ক মৌসুমে এখনই এসব নদীর পানি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। অতিরিক্ত পরিমাণে শোধনকারী রাসায়নিক বস্তু ব্যবহার করতে হয়, যা নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশি জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। তদুপরি ট্যানারি, ডায়িং ও অন্যান্য কারখানা থেকে এমন সব বিষাক্ত রাসায়নিক বস্তু নদীর পানিতে মিশে যাচ্ছে, যেগুলো শোধনাগারে শোধন হয় না। সেগুলো নিশ্চিতভাবে মানুষের শরীরে বিষক্রিয়া ঘটাবে। আবার এসব দূষণকারী পদার্থের অনেকই ক্যান্সার সৃষ্টিকারী। চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা ইতিমধ্যেই এ ব্যাপারে তাঁদের আশঙ্কার কথা ব্যক্ত করেছেন। দূষণ বন্ধ করা না গেলে অদূর ভবিষ্যতে এসব নদীর পানিও সম্পূর্ণভাবে শোধনের অনুপযোগী হয়ে পড়বে। কিন্তু দূষণ বন্ধ করার কিংবা নদীগুলোকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার কার্যকর কোনো উদ্যোগই আমরা দেখতে পাচ্ছি না। বরং আমরা দেখছি দূষণের মাত্রা প্রতিনিয়তই বাড়ছে।
আমরা এক দশকেরও বেশি সময় ধরে শুনে আসছি, হাজারীবাগ থেকে ট্যানারিশিল্প সরিয়ে সাভারে নেওয়া হবে। কিন্তু এসব কারখানা এখনো অব্যাহতভাবে বুড়িগঙ্গার পানি দূষিত করে চলেছে। নিকট অতীতে ঢাকার চারপাশ দিয়ে বৃত্তাকার জলপথ সৃষ্টির অনেক গল্প আমরা শুনেছি। নদী খননের নামে পত্রিকায় কেবল কোটি কোটি টাকা ব্যয়ের খবর দেখেছি। কিন্তু নদীগুলোর অবস্থার কোনো উন্নতি দেখছি না, ক্ষেত্রবিশেষে আরো অবনতিই চোখে পড়ছে।
রাজধানীর বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ, যানবাহন। একে তো সেকেলে-পুরনো গাড়ির সংখ্যা বেশি। তদুপরি প্রতিদিন চলাচলকারী যানবাহনে স্বাভাবিকভাবে যতটুকু জ্বালানি পোড়ানোর কথা ছিল, যানজটের কারণে জ্বালানি পোড়ায় তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। কয়েক দিন আগে প্রকাশিত এক খবরে জানা যায়, সরকারি হিসাবেই ঢাকায় ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলছে ৮৫ হাজারের মতো। আর বেসরকারি হিসাবে অর্থাৎ ঘুষ দিয়ে ফিটনেস আদায় করা গাড়ির সংখ্যা কত, তার হিসাব কে রাখে? এ ধরনের গাড়ির বায়ুদূষণের মাত্রা অনেক বেশি। ২০২০ সাল নাগাদ এই সমস্যা অনেক বেশি হবে।
রাজধানীতে 'হাইরাইজ' ভবন তৈরির রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলছে। এই প্রতিযোগিতায় ইমারত নির্মাণ বিধিমালার কোনো তোয়াক্কাই করা হয় না। নির্দিষ্ট পরিমাণ জায়গা তো ছাড়াই হয় না, উপরন্তু রাস্তার জন্য বরাদ্দকৃত জায়গায়ও ভবনকে বাড়িয়ে দেওয়া হয়। রাজউক এসব নিয়ন্ত্রণ করার কথা থাকলেও বাস্তবে করে উল্টোটা। অর্থাৎ রাজউকের একশ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারী অনৈতিক সুবিধা নিয়ে অপরিকল্পিত, এমনকি অবৈধ নির্মাণকে সহযোগিতা দিয়ে যায়। এমনও অভিযোগ রয়েছে, রাজউক থেকে ২০ বছর আগের তারিখে প্ল্যান পাস করানো যায়, যাতে ইমারত নির্মাণ বিধিমালার বাধ্যবাধকতা প্রযোজ্য হয় না। এসব ভবনে না থাকে যথাযথ ভিত্তি, না ব্যবহার করা হয় মানসম্মত নির্মাণসামগ্রী। ফলে ভূমিকম্পের প্রয়োজন হয় না। এমনিতেই অনেক ভবন ধসে পড়ে। আবার বর্ধিত জনসংখ্যার প্রয়োজনে প্রতিনিয়তই ভবন তৈরি হচ্ছে এবং তৈরি হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু রাজউকের কোনো পরিকল্পনা না থাকায় নতুন করে গড়ে ওঠা পাড়া-মহল্লাগুলোতে রাস্তা ক্রমেই দুষ্প্রাপ্য হয়ে যাচ্ছে। অনেক বাড়িঘর দেখা যায়, যেখানে রিকশাও প্রবেশ করে না। আগুন লাগলে দমকল বাহিনীর গাড়ি আসা কিংবা মুমূর্ষু রোগীর জন্য অ্যাম্বুলেন্স প্রবেশ করার তো প্রশ্নই ওঠে না। দি ইকোনমিস্টের প্রতিবেদন অনুযায়ী ভূমিকম্পের ঝুঁকির দিক থেকেও ঢাকার অবস্থান দ্বিতীয়। এখানে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা এত বেশি হবে, যা কল্পনাও করা যায় না। ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপের জরিপে আরো যেসব বিষয় বিবেচনায় আনা হয়, সেগুলোর অন্যতম একটি হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। ঢাকার আইনশৃঙ্খলা নিয়ে প্রতিনিয়ত অনেক লেখালেখি হচ্ছে। এখানে নতুন করে তার উল্লেখ নাই বা করলাম। বলা যায়, বসবাসযোগ্যতার কোনো দিক থেকেই ঢাকা সুবিধাজনক অবস্থানে নেই। তাহলে কি এই ঢাকা আসলেই একটি পরিত্যক্ত নগরীর পথে এগিয়ে চলেছে? এ থেকে রক্ষা পাওয়ার কি কোনো উপায় নেই?
লেখক : সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.