শিক্ষা-পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে 'উচ্চশিক্ষা' কেমন চলছে? by আনোয়ারুল্লাহ ভূঁইয়া
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আরেকটি সমস্যা হলো উপাচার্যপন্থি নয়, এমন শিক্ষকদের পেশাগত জীবনকে ক্ষতিগ্রস্ত করা। নিয়ম হলো আরোপিত শর্তাদি বিদ্যমান থাকলে কোনো শিক্ষকেরই প্রমোশন কিংবা অন্য শর্তাদি বিদ্যমান থাকলে তা বাধাগ্রস্ত করা যাবে না।
শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় সুবিধাদি পাওয়ার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকবে, যা গোষ্ঠী বা দলীয় বিবেচনার ঊধর্ে্ব উঠে প্রয়োগ করা বাঞ্ছনীয়। নূ্যনতম এসব দাবি যদি বাস্তবায়ন করা না হয়, তাহলে বঞ্চিত শিক্ষকদের মধ্যে যে হতাশার সৃষ্টি হয় তাও শিক্ষার অগ্রগতিতে প্রতিবন্ধকতা
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো কাঠামো বা আদর্শ এখনও আমরা ঠিক করতে পারিনি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট, ১৯৭৩ কিছুটা হলেও আমাদের পথ দেখাতে চেয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেহেতু নতুন নতুন জ্ঞান নির্মাণ-বিনির্মাণের সঙ্গে যুক্ত থাকবে, সেহেতু এর স্বাধীনতা কিংবা স্বায়ত্তশাসন খুবই জরুরি। এর সঙ্গে সঙ্গে চলে আসে বিশ্ববিদ্যালয়টি পরিচালনার জন্য গণতন্ত্রের চর্চা। গণতান্ত্রিক চর্চাটি অংশগ্রহণের মানসিকতা তৈরি করে। সকলের জন্য সমানভাবে বিবেচনা করা, কোনো ধরনের অবিচার নয়। এই যদি হয় গণতন্ত্রের প্রতিশ্রুতি, তাহলে শিক্ষকদের প্রমোশনের ক্ষেত্রে, অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন বণ্টনের ক্ষেত্রে নিয়মনীতির যথাযথ অনুশীলন হবে এটাই সত্য। কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গণতান্ত্রিক চেতনার নূ্যনতম কোনো বালাই নেই। যদি কোনো শিক্ষক উপাচার্যের কর্ম-কুকর্মকে নিঃশর্তভাবে সমর্থন না করেন, তাহলে প্রতিষ্ঠিত কোনো নিয়মই তাদের বা তার ওপর প্রযোজ্য হবে না। প্রমোশন আটকে দেওয়া থেকে শুরু করে প্রতিটি পেশাগত সুবিধাকে সংকুচিত করে দেওয়া হয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ইতিমধ্যে এসব দুর্নীতি ও অপশাসনের বিরুদ্ধে শিক্ষকরা প্রতিবাদ ও আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। হয়তো অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এ কাজে এগিয়ে আসবেন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মঙ্গলের জন্য।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকটি অলঙ্কার হলো এর 'গণতন্ত্র' তথা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের সমন্বয়ে গঠিত সিনেট কর্তৃক উপাচার্য নির্বাচন। কিছু কিছু চাটুকার অপেক্ষাকৃত দুর্বল যুক্তি উপস্থাপনায় বলতে চায়, 'পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নির্বাচন যত সমস্যার কারণ।' এ রকম যুক্তিহীন দাবিতে গণতন্ত্র সম্পর্কে তাদের বোধবুদ্ধির অভাবকে স্পষ্ট করে তোলে। আমাদের বোঝা উচিত, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ কারোর জন্য সমস্যা হলেও সামষ্টিক স্বার্থে তা খুব জরুরি। এ জরুরি উপলব্ধিটি সম্পর্কে আমরা স্পষ্ট হই অ্যাক্টের ১১নং ধারা থেকে পাই। এখানে বলা হয়েছে : '(১) ঞযব ঠরপব-পযধহপবষষড়ৎ ংযধষষ নব ধঢ়ঢ়ড়রহঃবফ নু ঃযব ঈযধহপবষষড়ৎ ভড়ৎ ঢ়বৎরড়ফ ড়ভ ভড়ঁৎ ুবধৎং ভৎড়স ঢ়ধহবষ ড়ভ ঃযৎবব ঢ়বৎংড়হং ঃড় নব হড়সরহধঃবফ নু ঃযব ঝবহধঃব ড়হ ংঁপয ঃবৎসং ধহফ পড়হফরঃরড়হং ধং সধু নব ফবঃবৎসরহবফ নু ঃযব ঈযধহপবষষড়ৎ ধহফ ংযধষষ নব বষরমরনষব ভড়ৎ ৎব-ধঢ়ঢ়ড়রহঃসবহঃ ভড়ৎ ধ ভঁৎঃযবৎ ঢ়বৎরড়ফ ড়ভ ভড়ঁৎ ুবধৎং' (ঔট অপঃ, ১৯৭৩ :৫). এর দ্বিতীয় শর্তে (২)-এ বলা হয়েছে : যদি উপাচার্য পদটি 'সাময়িকভাবে শূন্য' হয়, হতে পারে পদত্যাগের কারণে, অসুস্থতার কারণে অথবা অন্য কোনো কারণে। এসব ক্ষেত্রে মহামান্য চ্যান্সেলর কেবল ভাইস চ্যান্সেলর অফিসের কর্মকাণ্ডগুলো করার জন্য একজনকে (যদি তিনি উপযুক্ত হন) উপাচার্য পদে নিয়োগ দিতে পারেন। আমার প্রশ্ন হলো, পূর্ণ মেয়াদ চার বছরের মধ্যে কতদিনকে আমরা 'সাময়িকভাবে শূন্য' হিসেবে উলেল্গখ করব? সাময়িকভাবে শূন্য অবস্থা পূরণ করার জন্য যে উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হয় তিনি নিশ্চয়ই চার বছরের জন্য হবেন না? যদিও বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন বছরের অধিক সময়কাল ধরে অবৈধ উপাচার্যরা দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। জাতীয় সংসদ থেকে পাস হওয়া অ্যাক্টের প্রতি গণতান্ত্রিক সরকারের এই অনীহাই-বা কেন?
বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানের প্রধানকে তার কাঠামোর মধ্যে নির্বাচিত হওয়া উচিত অনেক কারণে। এর মধ্যে প্রথমই বলতে হয় উপাচার্য যেন প্রতিষ্ঠান চালাতে গিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতার অন্যান্য অংশ থেকে চাপের সম্মুখীন না হন। কিন্তু ক্ষমতা কাঠামোর ধারায় অনির্বাচিত উপাচার্যদের ওপর বাইরের শক্তির খবরাদি করার সুযোগ থাকে। তিনি যাদের তদবির করে উপাচার্য হয়ে আসেন তাদের চাওয়া-পাওয়ার কাছে তার স্বাধীনতা শৃঙ্খলিত হয়ে যায়। সেসব ব্যক্তির খায়েশ মেটাতে গিয়ে তার নিজেরও অনেক স্বাদ-আহ্লাদ সৃষ্টি হয়। ফলে তিনি ধীরে ধীরে বেমালম ভুলে যান প্রাইভেট প্রপার্টি এবং পাবলিক প্রপার্টিও মধ্যকার পার্থক্যকে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হলেন কর্তৃত্বকারী সংস্থা। ওই সংস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত সব ব্যক্তির ন্যায্য অধিকার সংরক্ষণ করাই তার কাজ। কিন্তু তিনি যদি ইচ্ছামতো এ সম্পদ বণ্টনে ভূমিকা রাখেন, তাহলে সেটি পাবলিক প্রপার্টি না হয়ে প্রাইভেট প্রপার্টি হিসেবে পরিগণিত হবে। আমি যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, সেখানে মালিকানা স্বত্বের দুটি দিকই খতিয়ে দেখার প্রয়োজন রয়েছে। এ প্রসঙ্গে এখানকার বিভিন্ন বণ্টনরীতির কথা বলা যেতে পারে। যেমন_ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠিত নিয়ম হলো কোনো আবাসিক হলের হাউস টিউটর কিংবা ওয়ার্ডেন হিসেবে দশ বছর পূর্ণ হলে তার মেয়াদ আর বর্ধিত করা হবে না। কিন্তু আমরা লক্ষ্য করছি, আমাদের উপাচার্য কাউকে চিঠি দিয়ে বলে দিচ্ছেন আপনার দশ বছর মেয়াদ পূর্ণ হয়েছে, সেহেতু হলের হাউস টিউটর/ওয়ার্ডেন হিসেবে আর মেয়াদ বাড়ানো গেল না। এটাও লক্ষ্য করা গেছে, ওই সময়ই দলীয় লোকদের ক্ষেত্রে কিংবা অন্য কোনো বিকল্পের হিসাব-নিকাশের কারণে দশ বছর বা ততোধিক পূর্ণ হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও তাদের মেয়াদ বর্ধিত করা হচ্ছে। পাবলিক প্রপার্টির এ রকম ব্যবহার স্পষ্টতই প্রাইভেট অর্থে ব্যবহার করার মতো। এ রকম অসংখ্য দৃষ্টান্ত রয়েছে, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এর সম্পদ ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনাকে প্রাইভেট প্রপার্টির জায়গা থেকে দেখছেন।
অনিয়ম, শৃঙ্খলাহীনতা তথা বৈষম্যের মধ্য দিয়ে বর্তমান অগণতান্ত্রিক উপাচার্যরা বিশ্ববিদ্যালয় নামে প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করার এজেন্সির ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও আদমজী হওয়ার অপেক্ষার প্রহর গুনছে। ১৯৯৫ সালের শুরুর দিকে বাংলাদেশ-বিশ্বব্যাংক সমঝোতার মধ্য দিয়ে আদমজী জুট মিলস বন্ধ করে দেওয়া হলো। কর্মহীন হলো ২৫ হাজার শ্রমিক। আদমজীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা শিল্পটিকে সেদিন বাঁচিয়ে রাখার জন্য সে সময়কার বিরোধী দলও কোনো প্রতিরোধ গড়ে তোলেনি। একই সময়ে বিপরীত একটি চিত্র লক্ষ্য করেছি বিশ্বব্যাংকের। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে ৫০০ কোটি টাকার ঋণ দেওয়া হয় তাদের পাটশিল্পকে আরও উন্নত করার জন্য। আর আদমজী জুট মিল বন্ধ করার জন্য বিশ্বব্যাংক দিয়েছিল সমপরিমাণ অর্থ। আমাদের গোটা রাজনৈতিক প্রক্রিয়াটি যেখানে অন্য কোনো শক্তির করতলে, সেখানে আমাদের বেঁচে থাকার লড়াইটি কি এক অসম্ভাবনার জাঁতাকলে প্রতিরুদ্ধ তাও বুঝি আমরা।
সরকার পরিচালিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভবিষ্যৎ ভাগ্যও আদমজী থেকে আলাদা কিছু নয়। এর শনাক্তকারী বৈশিষ্ট্যগুলো ইতিমধ্যে আমাদের নজরে আসতে শুরু করেছে। এ কারণেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ব্যর্থ দেখানো খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে কোনো কোনো গোষ্ঠীর জন্য। সেটির যাত্রা শুরু হয়েছে উচ্চশিক্ষা বিস্তারের নামে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের লাগামহীন প্রসারের মধ্য দিয়ে। এ বিরোধে স্টেকহোল্ডার অসংখ্য। এর মধ্যে একমাত্র প্রতিপক্ষ হলো জনগণ। স্টেকহোল্ডারের আসনে তারা কখনোই নেই, তা হওয়ার প্রচেষ্টাও তাদের মধ্যে লক্ষ্য করি না। অন্যদিকে অসংখ্য স্টেকহোল্ডার রয়েছেন যারা হলেন উঠতি ধনিকশ্রেণী। এ শ্রেণীটি আবার ক্ষমতার শীর্ষেও। নানাভাবে তারা এটি অর্জন করেছেন। এ অর্জনে আবার রাষ্ট্রশক্তিকে নিয়ামক হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এই সংকট থেকে উচ্চশিক্ষাকে বাঁচানোর উপায় কী? এ সংকট দূর করার জন্য রাষ্ট্রকে আরও আন্তরিকতার সঙ্গে এগিয়ে আসা প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে প্রথমেই প্রয়োজন নিয়োগকৃত শিক্ষকদের মেধা ও দক্ষতার বিচারে নির্বাচন করা। নিয়োগপ্রাপ্তির অব্যবহিত পরেই দরকার মানসম্মত প্রশিক্ষণ। এ প্রশিক্ষণে যেমন থাকা উচিত ক্লাস বক্তৃতাকে আকর্ষণীয় করে তোলার কৌশল শেখানো, তেমনি প্রয়োজন ভাষাজ্ঞান রপ্ত করার দক্ষতা। মাতৃভাষার পাশাপাশি দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ইংরেজির ওপর অবাধ দখলও জরুরি। কীভাবে গবেষণা প্রবন্ধ লিখতে হয়, বহির্বিশ্বের মানসম্মত শিক্ষা প্রদানের উপযোগী করে গড়ে তোলার প্রচেষ্টাও থাকবে তাতে। একজন শিক্ষকের যাত্রাই যদি শুরু হয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী শিক্ষকদের ঠেকানো, উপাচার্যের অন্যায়কর্মকে টিকিয়ে রাখার জন্য ভোটের পাল্লায় নিজেকে আত্মসমর্পণ করা, তাহলে সেসব ব্যক্তিকে দিয়ে গুণগত শিক্ষা এগোবে কীভাবে?
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আরেকটি সমস্যা হলো উপাচার্যপন্থি নয়, এমন শিক্ষকদের পেশাগত জীবনকে ক্ষতিগ্রস্ত করা। নিয়ম হলো আরোপিত শর্তাদি বিদ্যমান থাকলে কোনো শিক্ষকেরই প্রমোশন কিংবা অন্য শর্তাদি বিদ্যমান থাকলে তা বাধাগ্রস্ত করা যাবে না। শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় সুবিধাদি পাওয়ার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকবে, যা গোষ্ঠী বা দলীয় বিবেচনার ঊধর্ে্ব উঠে প্রয়োগ করা বাঞ্ছনীয়। নূ্যনতম এসব দাবি যদি বাস্তবায়ন করা না হয়, তাহলে বঞ্চিত শিক্ষকদের মধ্যে যে হতাশার সৃষ্টি হয় তাও শিক্ষার অগ্রগতিতে প্রতিবন্ধকতা। উপর্যুক্ত বিষয়াদি ছাড়াও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষমতা কাঠামোয় গণতান্ত্রিক রীতির চর্চা থাকতে হবে সবার ওপর। বিশ্ববিদ্যালয় সময়ের সব থেকে অগ্রসর চিন্তা উৎপাদন করে থাকে। জ্ঞানদান, জ্ঞান ব্যবস্থাপনা এবং জ্ঞান নির্মাণ এই তিন লক্ষ্য নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় এগিয়ে যাবে। এ তিনটি মৌল কাজ পরিচালনার জন্য প্রয়োজন সুস্থ ও সুষ্ঠু প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ব্যবস্থাপনা তথা প্রশাসনিক পরিপার্শ্বটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বহুল প্রচলিত ধারণার সঙ্গে তুলনা করা যায় না। যায় না বলেই এটি ব্যর্থ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পরিণতিতে যা একটি জাতির জন্য ভয়াবহ পরিণাম নিয়ে আসতে পারে। এর চরম পরিণতি থেকে রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের সকলের।
আনোয়ারুল্লাহ ভূঁইয়া :শিক্ষক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো কাঠামো বা আদর্শ এখনও আমরা ঠিক করতে পারিনি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট, ১৯৭৩ কিছুটা হলেও আমাদের পথ দেখাতে চেয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেহেতু নতুন নতুন জ্ঞান নির্মাণ-বিনির্মাণের সঙ্গে যুক্ত থাকবে, সেহেতু এর স্বাধীনতা কিংবা স্বায়ত্তশাসন খুবই জরুরি। এর সঙ্গে সঙ্গে চলে আসে বিশ্ববিদ্যালয়টি পরিচালনার জন্য গণতন্ত্রের চর্চা। গণতান্ত্রিক চর্চাটি অংশগ্রহণের মানসিকতা তৈরি করে। সকলের জন্য সমানভাবে বিবেচনা করা, কোনো ধরনের অবিচার নয়। এই যদি হয় গণতন্ত্রের প্রতিশ্রুতি, তাহলে শিক্ষকদের প্রমোশনের ক্ষেত্রে, অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন বণ্টনের ক্ষেত্রে নিয়মনীতির যথাযথ অনুশীলন হবে এটাই সত্য। কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গণতান্ত্রিক চেতনার নূ্যনতম কোনো বালাই নেই। যদি কোনো শিক্ষক উপাচার্যের কর্ম-কুকর্মকে নিঃশর্তভাবে সমর্থন না করেন, তাহলে প্রতিষ্ঠিত কোনো নিয়মই তাদের বা তার ওপর প্রযোজ্য হবে না। প্রমোশন আটকে দেওয়া থেকে শুরু করে প্রতিটি পেশাগত সুবিধাকে সংকুচিত করে দেওয়া হয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ইতিমধ্যে এসব দুর্নীতি ও অপশাসনের বিরুদ্ধে শিক্ষকরা প্রতিবাদ ও আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। হয়তো অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এ কাজে এগিয়ে আসবেন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মঙ্গলের জন্য।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকটি অলঙ্কার হলো এর 'গণতন্ত্র' তথা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের সমন্বয়ে গঠিত সিনেট কর্তৃক উপাচার্য নির্বাচন। কিছু কিছু চাটুকার অপেক্ষাকৃত দুর্বল যুক্তি উপস্থাপনায় বলতে চায়, 'পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নির্বাচন যত সমস্যার কারণ।' এ রকম যুক্তিহীন দাবিতে গণতন্ত্র সম্পর্কে তাদের বোধবুদ্ধির অভাবকে স্পষ্ট করে তোলে। আমাদের বোঝা উচিত, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ কারোর জন্য সমস্যা হলেও সামষ্টিক স্বার্থে তা খুব জরুরি। এ জরুরি উপলব্ধিটি সম্পর্কে আমরা স্পষ্ট হই অ্যাক্টের ১১নং ধারা থেকে পাই। এখানে বলা হয়েছে : '(১) ঞযব ঠরপব-পযধহপবষষড়ৎ ংযধষষ নব ধঢ়ঢ়ড়রহঃবফ নু ঃযব ঈযধহপবষষড়ৎ ভড়ৎ ঢ়বৎরড়ফ ড়ভ ভড়ঁৎ ুবধৎং ভৎড়স ঢ়ধহবষ ড়ভ ঃযৎবব ঢ়বৎংড়হং ঃড় নব হড়সরহধঃবফ নু ঃযব ঝবহধঃব ড়হ ংঁপয ঃবৎসং ধহফ পড়হফরঃরড়হং ধং সধু নব ফবঃবৎসরহবফ নু ঃযব ঈযধহপবষষড়ৎ ধহফ ংযধষষ নব বষরমরনষব ভড়ৎ ৎব-ধঢ়ঢ়ড়রহঃসবহঃ ভড়ৎ ধ ভঁৎঃযবৎ ঢ়বৎরড়ফ ড়ভ ভড়ঁৎ ুবধৎং' (ঔট অপঃ, ১৯৭৩ :৫). এর দ্বিতীয় শর্তে (২)-এ বলা হয়েছে : যদি উপাচার্য পদটি 'সাময়িকভাবে শূন্য' হয়, হতে পারে পদত্যাগের কারণে, অসুস্থতার কারণে অথবা অন্য কোনো কারণে। এসব ক্ষেত্রে মহামান্য চ্যান্সেলর কেবল ভাইস চ্যান্সেলর অফিসের কর্মকাণ্ডগুলো করার জন্য একজনকে (যদি তিনি উপযুক্ত হন) উপাচার্য পদে নিয়োগ দিতে পারেন। আমার প্রশ্ন হলো, পূর্ণ মেয়াদ চার বছরের মধ্যে কতদিনকে আমরা 'সাময়িকভাবে শূন্য' হিসেবে উলেল্গখ করব? সাময়িকভাবে শূন্য অবস্থা পূরণ করার জন্য যে উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হয় তিনি নিশ্চয়ই চার বছরের জন্য হবেন না? যদিও বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন বছরের অধিক সময়কাল ধরে অবৈধ উপাচার্যরা দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। জাতীয় সংসদ থেকে পাস হওয়া অ্যাক্টের প্রতি গণতান্ত্রিক সরকারের এই অনীহাই-বা কেন?
বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানের প্রধানকে তার কাঠামোর মধ্যে নির্বাচিত হওয়া উচিত অনেক কারণে। এর মধ্যে প্রথমই বলতে হয় উপাচার্য যেন প্রতিষ্ঠান চালাতে গিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতার অন্যান্য অংশ থেকে চাপের সম্মুখীন না হন। কিন্তু ক্ষমতা কাঠামোর ধারায় অনির্বাচিত উপাচার্যদের ওপর বাইরের শক্তির খবরাদি করার সুযোগ থাকে। তিনি যাদের তদবির করে উপাচার্য হয়ে আসেন তাদের চাওয়া-পাওয়ার কাছে তার স্বাধীনতা শৃঙ্খলিত হয়ে যায়। সেসব ব্যক্তির খায়েশ মেটাতে গিয়ে তার নিজেরও অনেক স্বাদ-আহ্লাদ সৃষ্টি হয়। ফলে তিনি ধীরে ধীরে বেমালম ভুলে যান প্রাইভেট প্রপার্টি এবং পাবলিক প্রপার্টিও মধ্যকার পার্থক্যকে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হলেন কর্তৃত্বকারী সংস্থা। ওই সংস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত সব ব্যক্তির ন্যায্য অধিকার সংরক্ষণ করাই তার কাজ। কিন্তু তিনি যদি ইচ্ছামতো এ সম্পদ বণ্টনে ভূমিকা রাখেন, তাহলে সেটি পাবলিক প্রপার্টি না হয়ে প্রাইভেট প্রপার্টি হিসেবে পরিগণিত হবে। আমি যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, সেখানে মালিকানা স্বত্বের দুটি দিকই খতিয়ে দেখার প্রয়োজন রয়েছে। এ প্রসঙ্গে এখানকার বিভিন্ন বণ্টনরীতির কথা বলা যেতে পারে। যেমন_ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠিত নিয়ম হলো কোনো আবাসিক হলের হাউস টিউটর কিংবা ওয়ার্ডেন হিসেবে দশ বছর পূর্ণ হলে তার মেয়াদ আর বর্ধিত করা হবে না। কিন্তু আমরা লক্ষ্য করছি, আমাদের উপাচার্য কাউকে চিঠি দিয়ে বলে দিচ্ছেন আপনার দশ বছর মেয়াদ পূর্ণ হয়েছে, সেহেতু হলের হাউস টিউটর/ওয়ার্ডেন হিসেবে আর মেয়াদ বাড়ানো গেল না। এটাও লক্ষ্য করা গেছে, ওই সময়ই দলীয় লোকদের ক্ষেত্রে কিংবা অন্য কোনো বিকল্পের হিসাব-নিকাশের কারণে দশ বছর বা ততোধিক পূর্ণ হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও তাদের মেয়াদ বর্ধিত করা হচ্ছে। পাবলিক প্রপার্টির এ রকম ব্যবহার স্পষ্টতই প্রাইভেট অর্থে ব্যবহার করার মতো। এ রকম অসংখ্য দৃষ্টান্ত রয়েছে, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এর সম্পদ ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনাকে প্রাইভেট প্রপার্টির জায়গা থেকে দেখছেন।
অনিয়ম, শৃঙ্খলাহীনতা তথা বৈষম্যের মধ্য দিয়ে বর্তমান অগণতান্ত্রিক উপাচার্যরা বিশ্ববিদ্যালয় নামে প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করার এজেন্সির ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও আদমজী হওয়ার অপেক্ষার প্রহর গুনছে। ১৯৯৫ সালের শুরুর দিকে বাংলাদেশ-বিশ্বব্যাংক সমঝোতার মধ্য দিয়ে আদমজী জুট মিলস বন্ধ করে দেওয়া হলো। কর্মহীন হলো ২৫ হাজার শ্রমিক। আদমজীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা শিল্পটিকে সেদিন বাঁচিয়ে রাখার জন্য সে সময়কার বিরোধী দলও কোনো প্রতিরোধ গড়ে তোলেনি। একই সময়ে বিপরীত একটি চিত্র লক্ষ্য করেছি বিশ্বব্যাংকের। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে ৫০০ কোটি টাকার ঋণ দেওয়া হয় তাদের পাটশিল্পকে আরও উন্নত করার জন্য। আর আদমজী জুট মিল বন্ধ করার জন্য বিশ্বব্যাংক দিয়েছিল সমপরিমাণ অর্থ। আমাদের গোটা রাজনৈতিক প্রক্রিয়াটি যেখানে অন্য কোনো শক্তির করতলে, সেখানে আমাদের বেঁচে থাকার লড়াইটি কি এক অসম্ভাবনার জাঁতাকলে প্রতিরুদ্ধ তাও বুঝি আমরা।
সরকার পরিচালিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভবিষ্যৎ ভাগ্যও আদমজী থেকে আলাদা কিছু নয়। এর শনাক্তকারী বৈশিষ্ট্যগুলো ইতিমধ্যে আমাদের নজরে আসতে শুরু করেছে। এ কারণেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ব্যর্থ দেখানো খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে কোনো কোনো গোষ্ঠীর জন্য। সেটির যাত্রা শুরু হয়েছে উচ্চশিক্ষা বিস্তারের নামে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের লাগামহীন প্রসারের মধ্য দিয়ে। এ বিরোধে স্টেকহোল্ডার অসংখ্য। এর মধ্যে একমাত্র প্রতিপক্ষ হলো জনগণ। স্টেকহোল্ডারের আসনে তারা কখনোই নেই, তা হওয়ার প্রচেষ্টাও তাদের মধ্যে লক্ষ্য করি না। অন্যদিকে অসংখ্য স্টেকহোল্ডার রয়েছেন যারা হলেন উঠতি ধনিকশ্রেণী। এ শ্রেণীটি আবার ক্ষমতার শীর্ষেও। নানাভাবে তারা এটি অর্জন করেছেন। এ অর্জনে আবার রাষ্ট্রশক্তিকে নিয়ামক হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এই সংকট থেকে উচ্চশিক্ষাকে বাঁচানোর উপায় কী? এ সংকট দূর করার জন্য রাষ্ট্রকে আরও আন্তরিকতার সঙ্গে এগিয়ে আসা প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে প্রথমেই প্রয়োজন নিয়োগকৃত শিক্ষকদের মেধা ও দক্ষতার বিচারে নির্বাচন করা। নিয়োগপ্রাপ্তির অব্যবহিত পরেই দরকার মানসম্মত প্রশিক্ষণ। এ প্রশিক্ষণে যেমন থাকা উচিত ক্লাস বক্তৃতাকে আকর্ষণীয় করে তোলার কৌশল শেখানো, তেমনি প্রয়োজন ভাষাজ্ঞান রপ্ত করার দক্ষতা। মাতৃভাষার পাশাপাশি দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ইংরেজির ওপর অবাধ দখলও জরুরি। কীভাবে গবেষণা প্রবন্ধ লিখতে হয়, বহির্বিশ্বের মানসম্মত শিক্ষা প্রদানের উপযোগী করে গড়ে তোলার প্রচেষ্টাও থাকবে তাতে। একজন শিক্ষকের যাত্রাই যদি শুরু হয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী শিক্ষকদের ঠেকানো, উপাচার্যের অন্যায়কর্মকে টিকিয়ে রাখার জন্য ভোটের পাল্লায় নিজেকে আত্মসমর্পণ করা, তাহলে সেসব ব্যক্তিকে দিয়ে গুণগত শিক্ষা এগোবে কীভাবে?
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আরেকটি সমস্যা হলো উপাচার্যপন্থি নয়, এমন শিক্ষকদের পেশাগত জীবনকে ক্ষতিগ্রস্ত করা। নিয়ম হলো আরোপিত শর্তাদি বিদ্যমান থাকলে কোনো শিক্ষকেরই প্রমোশন কিংবা অন্য শর্তাদি বিদ্যমান থাকলে তা বাধাগ্রস্ত করা যাবে না। শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় সুবিধাদি পাওয়ার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকবে, যা গোষ্ঠী বা দলীয় বিবেচনার ঊধর্ে্ব উঠে প্রয়োগ করা বাঞ্ছনীয়। নূ্যনতম এসব দাবি যদি বাস্তবায়ন করা না হয়, তাহলে বঞ্চিত শিক্ষকদের মধ্যে যে হতাশার সৃষ্টি হয় তাও শিক্ষার অগ্রগতিতে প্রতিবন্ধকতা। উপর্যুক্ত বিষয়াদি ছাড়াও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষমতা কাঠামোয় গণতান্ত্রিক রীতির চর্চা থাকতে হবে সবার ওপর। বিশ্ববিদ্যালয় সময়ের সব থেকে অগ্রসর চিন্তা উৎপাদন করে থাকে। জ্ঞানদান, জ্ঞান ব্যবস্থাপনা এবং জ্ঞান নির্মাণ এই তিন লক্ষ্য নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় এগিয়ে যাবে। এ তিনটি মৌল কাজ পরিচালনার জন্য প্রয়োজন সুস্থ ও সুষ্ঠু প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ব্যবস্থাপনা তথা প্রশাসনিক পরিপার্শ্বটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বহুল প্রচলিত ধারণার সঙ্গে তুলনা করা যায় না। যায় না বলেই এটি ব্যর্থ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পরিণতিতে যা একটি জাতির জন্য ভয়াবহ পরিণাম নিয়ে আসতে পারে। এর চরম পরিণতি থেকে রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের সকলের।
আনোয়ারুল্লাহ ভূঁইয়া :শিক্ষক, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
No comments