ধর নির্ভয় গান-স্বপ্নভঙ্গে যে বিষণ্নতা ... by আলী যাকের
যে স্বপ্ন বুকে ধরে '৭১-এ যুদ্ধে গিয়েছিলাম, জয়ী হয়ে ফিরেছিলাম নিজ বাসভূমে, সেই স্বপ্ন আজ এক দুষ্ট গ্রহ দ্বারা তাড়িত, এ কথা বলা যায় নিঃসন্দেহে। সাফল্য যদি আনতে হয়, সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন যদি ঘটাতে হয় তাহলে আবহমান বাংলার চিরায়ত মূল্যবোধকে ধারণ করে যারা,
তাদের এগিয়ে আসতে হবে দেশের সব মানুষকে সঙ্গে নিয়ে একটি সফল, সভ্য এবং আত্মবিশ্বাসী দেশ প্রতিষ্ঠাকল্পে
মাঝে মধ্যে বড্ড বিমর্ষ হয়ে যাই আজকাল। এক অজ্ঞাত বিষণ্নতা আমাকে পেয়ে বসে যেন। তখন কিছুই ভালো লাগে না আর। মনে হয় ছুটে পালাই কোথাও। আমাদের প্রজন্মের যারা বড় হয়েছেন পাকিস্তানি অনুশাসনের আমলে তাদের মধ্যে সাম্প্রতিককালের ঘটনাবলি দেখে হতাশ হওয়ার অনেক কারণ থাকতে পারে বলে আমার বিশ্বাস। বাল্যকালে স্কুলের শিক্ষকরা এবং আমাদের অভিভাবকরা পড়ানো ছাড়াও মোটামুটি জীবন দর্শন সম্বন্ধে কিছু আলোক দান করার প্রয়াস পেয়েছেন সবসময়ই। আমার মনে আছে, আমাদের এক প্রবীণ মাস্টার মশাই একবার আমাকে পাপ-পুণ্য সম্বন্ধে কিছু কথা বলেছিলেন। সেগুলো আজ এই মধ্য ষাটে এসেও আমার হৃদয়ে গেঁথে আছে। তিনি বলতেন যে, পাপ অথবা পুণ্য কোনো মোল্লা, পুরোহিত দ্বারা নির্ধারিত হয় না। কোনো ধর্মগুরুর কাছেও কোনটা পাপ আর কোনটা পুণ্য, কোনটা ভালো আর কোনটা মন্দ, সে সম্বন্ধে কোনো সঠিক জবাব নেই। যে কোনো ধর্মের জন্ম আজ থেকে নূ্যনপক্ষে দুই হাজার বছর, কি তারও আগে। এই দুই হাজার বছরে এই পৃথিবীতে পথচলা মানুষ, আমরা, ধর্মের নানারকম ব্যাখ্যা দিতে দিতে এর রূপ বদলে গেছে অনেকাংশে। আজ থেকে ৫০ বছর পরও আজকের এই রূপ আর তার থাকবে না। তাহলে সমাজ নিয়ন্ত্রিত হবে কিসের দ্বারা? আমার ওই অতি শ্রদ্ধার মানুষটি আমায় বলেছিলেন যে, তখন মানুষের বিবেকের অনুশাসন মানুষের ব্যবহারকে নিয়ন্ত্রণ করবে। কোনো নিয়ম নয় এবং এই বিবেকটি তৈরি হবে নানারকম বিষয়ের ওপরে মানুষের নিরবচ্ছিন্ন অধ্যয়নের দ্বারা। অতি সামান্য ব্যাপার, জীবনের ছোট প্রশ্নগুলো_ এসবেরই জবাব আমরা খুঁজব আমাদের বিবেকের কাছে।
পরে বড় হয়ে যখন লজিক কিংবা যুক্তিবিদ্যা পড়লাম তখন প্রথমেই যেটি পড়ানো হলো তা হলো, গধহ রং ধ ৎধঃরড়হধষ ধহরসধষ. অর্থ্যাৎ মানুষ যুক্তির দ্বারা অনুশাসিত পশু। অর্থাৎ আমরা পশু ঠিকই কিন্তু নানা বিষয়ে যুক্তি প্রয়োগ করে আমরা মনুষ্যত্বের প্রমাণ রাখার চেষ্টা করি। এই যে যুক্তি বিষয়টি, এটি বড় সহজে আয়ত্ত করা সম্ভব নয়। মানুষ তখনই কেবল যুক্তিবান হয়ে ওঠে, যখন সে তার মেধা ও বুদ্ধির প্রয়োগ করতে সক্ষম হয়। আমাদের মানুষিক এই বৃত্তিগুলোকে শানিত করার জন্য প্রথমত আমাদের একটু ভাবতে হবে, তারপর জ্ঞানার্জনের জন্য লেখাপড়া করতে হবে। এটি বোধহয় সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন যারা আমাদের নেতৃত্ব দেন, তাদের জন্য। একটি দেশের নেতৃত্ব যদি অশিক্ষিতের হাতে যায় তাহলে দেশটি অশিক্ষা-কুশিক্ষায় ভরে যায়। তখন কেবল যুক্তিহীনতাকে নয়, তারও চেয়ে অধম যে চুরি, ডাকাতি, হত্যা, রাহাজানি তা থেকেও সমাজ চোখ ফিরিয়ে রাখে। সমাজের চোখের চামড়া মোটা হয়ে যায়। সমাজ হিংস্র গণ্ডার বনে যায়। এক সময় আমাদের এই বাঙালিদের মধ্যে সামাজিক কিংবা রাজনৈতিক নেতারা হয় শিক্ষিত ছিলেন নয়তো শিক্ষার প্রতি তাদের ছিল অবিচল শ্রদ্ধা। ফলে সমাজটা অনেক বেশি নিরাপদ ও বাসযোগ্য ছিল। সকলেই যে কোনো অনিয়মতান্ত্রিক কাজ করার আগে একটু ভেবে দেখতেন। বুকটা একটু কেঁপে উঠত। আমরা যদি আজকে সেসব সমাজের দিকে তাকাই যেখানে সমাজের মাথারা নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য যথেচ্ছাচার করেছে, তাহলে দেখব সেই দেশগুলো খুব একটা সুখে নেই। পাকিস্তানের কথাই ধরা যাক? কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের স্বৈরতান্ত্রিক কিছু দেশের কথা?
আজকে আমার মন কেমন করার পেছনে প্রধান যে বিষয়টি কাজ করছে তা হলো, সম্প্রতি চালু হওয়া একটি টেলিভিশন চ্যানেলের সঙ্গে আমার কিছু কথোপকথন। সাধারণ কুশল বিনিময় এবং শুভেচ্ছা ইত্যাদি দেওয়ার পর আমাকে প্রশ্ন করা হলো যে, একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে '৭১-এ আমি যে স্বপ্নটি বুকে ধারণ করে যুদ্ধে গিয়েছিলাম, সেই স্বপ্ন আজ কতটা বাস্তবতা পেয়েছে বলে মনে হয়? লক্ষণীয়, যেই তরুণীটি আমায় এই অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ এবং কঠিন প্রশ্নটি করেছিল সে কিন্তু আমায় 'আমাদের' কথা বলতে বলেনি। বলেছে 'আমার' কথা বলতে। ফলে আমার বলাটা অনেক সহজ হয়ে গিয়েছে। আমি কী ভাবি বা ভাবতে পারি, কিংবা কী ভাবি না বা ভাবতে পারি না তা বলা যত সহজ, সেটিকে বহুবচনে রূপান্তরিত করা সমধিক কঠিন। অন্যের কথা আমি কীভাবে বলব? আমি মেয়েটিকে যে কথা বলেছিলাম, তা অনেকটা নিম্নরূপ :
আমি তাকে বলেছিলাম যে, যখন পাকিস্তানের জন্ম হয় তখন আমার বয়স তিন বছরও হয়নি। অতএব, তার আগের যে ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলন, সে সম্বন্ধে কোনো প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আমার নেই। যেটুকু জেনেছি, তা বইপত্রের মাধ্যমে। কিন্তু পাকিস্তানের ২৩ বছর সময়ের যে ইতিহাস আমাদের এই বাংলাদেশে, সে সম্বন্ধে আমার সম্যক ধারণা আছে। কেননা আমি বোধ-বুদ্ধির স্টম্ফুরণ থেকে ভরা যৌবনে পেঁৗছতে পেঁৗছতে ওই ইতিহাসের সঙ্গে লগ্ন হয়ে গেছি। সেই ১৯৪৮-এ কতিপয় বাঙালি যুবক যে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সদম্ভ উক্তি, 'উর্দু এবং একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা', তার সরব প্রতিবাদ করেছিল, সেটি আমার শোনা কথা। তবে তারই ফলশ্রুতিতে ১৯৫২ সালে ঢাকার রাজপথ যে রক্তে রঞ্জিত হয়, তা একই দিনে আমি জানতে পাই আমার বাবার কাছ থেকে। সেই একটা বয়স, যাকে ইংরেজিতে ঋড়ৎসধঃরাব ধমব বলা হয়, যখন মানুষের বোধ এবং উপলব্ধির নির্মাণের শুরু। সেই বয়সে একটি বালক যখন জানতে পারে যে, তার দেশ শাসন করছে এমন সব মানুষ, যারা তার মুখের ভাষা কেড়ে নিয়ে তাকে বোবা বানাতে চায়, তখন তার মধ্যে এক ধরনের রসায়নের সৃষ্টি হয়। এই রসায়নটি পরে তার আত্মোপলব্ধিতে পরিণত হয়। সে নিজের ভাষা এবং সংস্কৃতির জন্য রুখে দাঁড়াতেও পিছপা হয় না। সে বুঝতে পারে যে, এক ধরনের শ্বাসরোধকারী পরিস্থিতিতে তার বাস। তাকে সেখান থেকে মুক্তি পেতে হবে, উন্মুক্ত স্থানে গিয়ে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে হবে। এভাবেই আমার রাজনীতিতে দীক্ষা। সেই রাজনীতি কোনো দলীয় রাজনীতি ছিল না। ছিল আমার চেতনায় রাজনীতির উন্মেষ। সাধারণ মানুষের দুঃখকষ্টে আমি ব্যথিত হতাম। দেশ এবং সংস্কৃতির অপমানে আমার ক্রোধ হতো। আমি ক্রমে আমার চেতনার অজান্তে পাকিস্তানবিরোধী একটি শক্ত অবস্থানে দাঁড়িয়েছিলাম। বুঝতে পেরেছিলাম যে, স্বাধীনতা ছাড়া আমাদের কোনো গতি নেই। আবহমান বাঙালির একটি চিরায়ত সংস্কৃতি আছে। এই সংস্কৃতির অন্তর্গত যেমন তার ভাষা, তার খাদ্য, তার পরিচ্ছদ, তার সামাজিক আচার, তার আন্তঃপারিবারিক সম্পর্ক এবং ধর্মীয় আচরণ, ঠিক তেমনি তার অতি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক পারস্পরিক সহনশীলতায়, অসাম্প্রদায়িক ব্যবহারে এবং বিনম্র আচরণে।
ওপরে যে বিশেষণগুলো উল্লেখ করলাম, এসব বিশেষণই বর্তমানের বাংলাদেশে বসবাসরত সব নৃগোষ্ঠীভুক্ত মানুষের জন্য প্রযোজ্য বলে আমি বিশ্বাস করি। পাকিস্তানি অনুশাসন আমাদের এসব মূল্যবোধ এবং বিশ্বাসকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করে ক্রমেই আমাদের ঠেলে দিয়েছিল এমন এক জায়গায়, যেখান থেকে ফেরার আর কোনো পথ ছিল না। আমরা ২৩ বছর পাকিস্তানের অনুশাসনে থেকে একটি উপলব্ধিতে দল-মত নির্বিশেষে দৃঢ়ভাবে অবস্থান নিয়েছিলাম যে, বাঙালির সত্তা পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের অন্তর্গত থাকতে পারে না। অতএব, ঘুরে দাঁড়িয়েছিলাম, অস্ত্র হাতে নিয়েছিলাম এবং যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছিলাম। নয় মাসের ক্ষণস্থায়ী ওই মুক্তিযুদ্ধের সময় হাতেগোনা কয়েকজন মানুষ ছাড়া আপামর সব বাংলাদেশবাসী মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন বলে আমি বিশ্বাস করি। একটি ক্লান্ত, অবসন্ন মুক্তিযোদ্ধাকে যে বৃদ্ধ মা এক গ্গ্নাস পানি তুলে দিয়েছিলেন হাতে তিনি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার সময় যে তরুণকে মাথায় হাত রেখে এক বৃদ্ধ পিতা আশীর্বাদ করেছিলেন, তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। যে বালকটি একজন আহত মুক্তিযোদ্ধার কপালের রক্ত সযত্নে মুছিয়ে দিয়েছিল সে একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিল। আমার দেখা রুস্তম নামে যে কিশোর তাজা গ্রেনেড হাতে পাকিস্তানি সৈন্যদের বাঙ্কারে 'জয় বাংলা' বলে ঝাঁপিয়ে পড়ে সব শত্রুকে নিধন করেছিল, সে নিঃসন্দেহে একজন মুক্তিযোদ্ধাই ছিল। সেই যে চেতনা, সেই আদর্শ, সেই মূল্যবোধ আজ প্রশ্নের সম্মুখীন হয় কীভাবে? অথচ হয়েছে যে, এটা তো সত্য? যুদ্ধ শেষে দেশে ফেরার পর থেকেই আমার মনে সন্দেহ ছায়া ফেলেছে যে, সবকিছু বোধহয় ঠিক নেই। যে রক্তের নদী সাঁতরে এতদূর এসে পেঁৗছেছি আমরা, পেয়েছি নিজের জন্য একটি স্বাধীন দেশ, তার বিরুদ্ধে চক্রান্ত শুরু হয়ে গেছে। এই চক্রান্তকে সার্বিক সহায়তা দিচ্ছে তারা, যারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে প্রত্যক্ষভাবে কাজ করেছিল। এদের মধ্যে ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশ এবং অবশ্যই পাকিস্তান। দুঃখের বিষয়, এই যে আমাদের বাংলাদেশের কিছু কুসন্তান সেই ফাঁদে পা দিয়ে আমাদের জাতির পিতাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে '৭৫-এর ১৫ আগস্ট। তারপর মাঝে মধ্যে সামান্য সময়ের যতি; কিন্তু বেশিরভাগ সময়ে বাংলাদেশের চেতনা, আদর্শ ও মূল্যবোধবিরোধী যারা, তারাই শাসন করেছে এই দেশ। যার ফলে আমরা প্রায় ভুলতেই বসেছি কী আদর্শ এবং চেতনা নিয়ে আমরা যুদ্ধ করেছি। কী মূল্যবোধের প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলাদশের জন্ম হয়েছিল। অতএব, যে স্বপ্ন বুকে ধরে '৭১-এ যুদ্ধে গিয়েছিলাম, জয়ী হয়ে ফিরেছিলাম নিজ বাসভূমে, সেই স্বপ্ন আজ এক দুষ্ট গ্রহ দ্বারা তাড়িত, এ কথা বলা যায় নিঃসন্দেহে। সাফল্য যদি আনতে হয়, সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন যদি ঘটাতে হয় তাহলে আবহমান বাংলার চিরায়ত মূল্যবোধকে ধারণ করে যারা, তাদের এগিয়ে আসতে হবে দেশের সব মানুষকে সঙ্গে নিয়ে একটি সফল, সভ্য এবং আত্মবিশ্বাসী দেশ প্রতিষ্ঠাকল্পে।
আলী যাকের : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
মাঝে মধ্যে বড্ড বিমর্ষ হয়ে যাই আজকাল। এক অজ্ঞাত বিষণ্নতা আমাকে পেয়ে বসে যেন। তখন কিছুই ভালো লাগে না আর। মনে হয় ছুটে পালাই কোথাও। আমাদের প্রজন্মের যারা বড় হয়েছেন পাকিস্তানি অনুশাসনের আমলে তাদের মধ্যে সাম্প্রতিককালের ঘটনাবলি দেখে হতাশ হওয়ার অনেক কারণ থাকতে পারে বলে আমার বিশ্বাস। বাল্যকালে স্কুলের শিক্ষকরা এবং আমাদের অভিভাবকরা পড়ানো ছাড়াও মোটামুটি জীবন দর্শন সম্বন্ধে কিছু আলোক দান করার প্রয়াস পেয়েছেন সবসময়ই। আমার মনে আছে, আমাদের এক প্রবীণ মাস্টার মশাই একবার আমাকে পাপ-পুণ্য সম্বন্ধে কিছু কথা বলেছিলেন। সেগুলো আজ এই মধ্য ষাটে এসেও আমার হৃদয়ে গেঁথে আছে। তিনি বলতেন যে, পাপ অথবা পুণ্য কোনো মোল্লা, পুরোহিত দ্বারা নির্ধারিত হয় না। কোনো ধর্মগুরুর কাছেও কোনটা পাপ আর কোনটা পুণ্য, কোনটা ভালো আর কোনটা মন্দ, সে সম্বন্ধে কোনো সঠিক জবাব নেই। যে কোনো ধর্মের জন্ম আজ থেকে নূ্যনপক্ষে দুই হাজার বছর, কি তারও আগে। এই দুই হাজার বছরে এই পৃথিবীতে পথচলা মানুষ, আমরা, ধর্মের নানারকম ব্যাখ্যা দিতে দিতে এর রূপ বদলে গেছে অনেকাংশে। আজ থেকে ৫০ বছর পরও আজকের এই রূপ আর তার থাকবে না। তাহলে সমাজ নিয়ন্ত্রিত হবে কিসের দ্বারা? আমার ওই অতি শ্রদ্ধার মানুষটি আমায় বলেছিলেন যে, তখন মানুষের বিবেকের অনুশাসন মানুষের ব্যবহারকে নিয়ন্ত্রণ করবে। কোনো নিয়ম নয় এবং এই বিবেকটি তৈরি হবে নানারকম বিষয়ের ওপরে মানুষের নিরবচ্ছিন্ন অধ্যয়নের দ্বারা। অতি সামান্য ব্যাপার, জীবনের ছোট প্রশ্নগুলো_ এসবেরই জবাব আমরা খুঁজব আমাদের বিবেকের কাছে।
পরে বড় হয়ে যখন লজিক কিংবা যুক্তিবিদ্যা পড়লাম তখন প্রথমেই যেটি পড়ানো হলো তা হলো, গধহ রং ধ ৎধঃরড়হধষ ধহরসধষ. অর্থ্যাৎ মানুষ যুক্তির দ্বারা অনুশাসিত পশু। অর্থাৎ আমরা পশু ঠিকই কিন্তু নানা বিষয়ে যুক্তি প্রয়োগ করে আমরা মনুষ্যত্বের প্রমাণ রাখার চেষ্টা করি। এই যে যুক্তি বিষয়টি, এটি বড় সহজে আয়ত্ত করা সম্ভব নয়। মানুষ তখনই কেবল যুক্তিবান হয়ে ওঠে, যখন সে তার মেধা ও বুদ্ধির প্রয়োগ করতে সক্ষম হয়। আমাদের মানুষিক এই বৃত্তিগুলোকে শানিত করার জন্য প্রথমত আমাদের একটু ভাবতে হবে, তারপর জ্ঞানার্জনের জন্য লেখাপড়া করতে হবে। এটি বোধহয় সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন যারা আমাদের নেতৃত্ব দেন, তাদের জন্য। একটি দেশের নেতৃত্ব যদি অশিক্ষিতের হাতে যায় তাহলে দেশটি অশিক্ষা-কুশিক্ষায় ভরে যায়। তখন কেবল যুক্তিহীনতাকে নয়, তারও চেয়ে অধম যে চুরি, ডাকাতি, হত্যা, রাহাজানি তা থেকেও সমাজ চোখ ফিরিয়ে রাখে। সমাজের চোখের চামড়া মোটা হয়ে যায়। সমাজ হিংস্র গণ্ডার বনে যায়। এক সময় আমাদের এই বাঙালিদের মধ্যে সামাজিক কিংবা রাজনৈতিক নেতারা হয় শিক্ষিত ছিলেন নয়তো শিক্ষার প্রতি তাদের ছিল অবিচল শ্রদ্ধা। ফলে সমাজটা অনেক বেশি নিরাপদ ও বাসযোগ্য ছিল। সকলেই যে কোনো অনিয়মতান্ত্রিক কাজ করার আগে একটু ভেবে দেখতেন। বুকটা একটু কেঁপে উঠত। আমরা যদি আজকে সেসব সমাজের দিকে তাকাই যেখানে সমাজের মাথারা নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য যথেচ্ছাচার করেছে, তাহলে দেখব সেই দেশগুলো খুব একটা সুখে নেই। পাকিস্তানের কথাই ধরা যাক? কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের স্বৈরতান্ত্রিক কিছু দেশের কথা?
আজকে আমার মন কেমন করার পেছনে প্রধান যে বিষয়টি কাজ করছে তা হলো, সম্প্রতি চালু হওয়া একটি টেলিভিশন চ্যানেলের সঙ্গে আমার কিছু কথোপকথন। সাধারণ কুশল বিনিময় এবং শুভেচ্ছা ইত্যাদি দেওয়ার পর আমাকে প্রশ্ন করা হলো যে, একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে '৭১-এ আমি যে স্বপ্নটি বুকে ধারণ করে যুদ্ধে গিয়েছিলাম, সেই স্বপ্ন আজ কতটা বাস্তবতা পেয়েছে বলে মনে হয়? লক্ষণীয়, যেই তরুণীটি আমায় এই অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ এবং কঠিন প্রশ্নটি করেছিল সে কিন্তু আমায় 'আমাদের' কথা বলতে বলেনি। বলেছে 'আমার' কথা বলতে। ফলে আমার বলাটা অনেক সহজ হয়ে গিয়েছে। আমি কী ভাবি বা ভাবতে পারি, কিংবা কী ভাবি না বা ভাবতে পারি না তা বলা যত সহজ, সেটিকে বহুবচনে রূপান্তরিত করা সমধিক কঠিন। অন্যের কথা আমি কীভাবে বলব? আমি মেয়েটিকে যে কথা বলেছিলাম, তা অনেকটা নিম্নরূপ :
আমি তাকে বলেছিলাম যে, যখন পাকিস্তানের জন্ম হয় তখন আমার বয়স তিন বছরও হয়নি। অতএব, তার আগের যে ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলন, সে সম্বন্ধে কোনো প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আমার নেই। যেটুকু জেনেছি, তা বইপত্রের মাধ্যমে। কিন্তু পাকিস্তানের ২৩ বছর সময়ের যে ইতিহাস আমাদের এই বাংলাদেশে, সে সম্বন্ধে আমার সম্যক ধারণা আছে। কেননা আমি বোধ-বুদ্ধির স্টম্ফুরণ থেকে ভরা যৌবনে পেঁৗছতে পেঁৗছতে ওই ইতিহাসের সঙ্গে লগ্ন হয়ে গেছি। সেই ১৯৪৮-এ কতিপয় বাঙালি যুবক যে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সদম্ভ উক্তি, 'উর্দু এবং একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা', তার সরব প্রতিবাদ করেছিল, সেটি আমার শোনা কথা। তবে তারই ফলশ্রুতিতে ১৯৫২ সালে ঢাকার রাজপথ যে রক্তে রঞ্জিত হয়, তা একই দিনে আমি জানতে পাই আমার বাবার কাছ থেকে। সেই একটা বয়স, যাকে ইংরেজিতে ঋড়ৎসধঃরাব ধমব বলা হয়, যখন মানুষের বোধ এবং উপলব্ধির নির্মাণের শুরু। সেই বয়সে একটি বালক যখন জানতে পারে যে, তার দেশ শাসন করছে এমন সব মানুষ, যারা তার মুখের ভাষা কেড়ে নিয়ে তাকে বোবা বানাতে চায়, তখন তার মধ্যে এক ধরনের রসায়নের সৃষ্টি হয়। এই রসায়নটি পরে তার আত্মোপলব্ধিতে পরিণত হয়। সে নিজের ভাষা এবং সংস্কৃতির জন্য রুখে দাঁড়াতেও পিছপা হয় না। সে বুঝতে পারে যে, এক ধরনের শ্বাসরোধকারী পরিস্থিতিতে তার বাস। তাকে সেখান থেকে মুক্তি পেতে হবে, উন্মুক্ত স্থানে গিয়ে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে হবে। এভাবেই আমার রাজনীতিতে দীক্ষা। সেই রাজনীতি কোনো দলীয় রাজনীতি ছিল না। ছিল আমার চেতনায় রাজনীতির উন্মেষ। সাধারণ মানুষের দুঃখকষ্টে আমি ব্যথিত হতাম। দেশ এবং সংস্কৃতির অপমানে আমার ক্রোধ হতো। আমি ক্রমে আমার চেতনার অজান্তে পাকিস্তানবিরোধী একটি শক্ত অবস্থানে দাঁড়িয়েছিলাম। বুঝতে পেরেছিলাম যে, স্বাধীনতা ছাড়া আমাদের কোনো গতি নেই। আবহমান বাঙালির একটি চিরায়ত সংস্কৃতি আছে। এই সংস্কৃতির অন্তর্গত যেমন তার ভাষা, তার খাদ্য, তার পরিচ্ছদ, তার সামাজিক আচার, তার আন্তঃপারিবারিক সম্পর্ক এবং ধর্মীয় আচরণ, ঠিক তেমনি তার অতি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক পারস্পরিক সহনশীলতায়, অসাম্প্রদায়িক ব্যবহারে এবং বিনম্র আচরণে।
ওপরে যে বিশেষণগুলো উল্লেখ করলাম, এসব বিশেষণই বর্তমানের বাংলাদেশে বসবাসরত সব নৃগোষ্ঠীভুক্ত মানুষের জন্য প্রযোজ্য বলে আমি বিশ্বাস করি। পাকিস্তানি অনুশাসন আমাদের এসব মূল্যবোধ এবং বিশ্বাসকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করে ক্রমেই আমাদের ঠেলে দিয়েছিল এমন এক জায়গায়, যেখান থেকে ফেরার আর কোনো পথ ছিল না। আমরা ২৩ বছর পাকিস্তানের অনুশাসনে থেকে একটি উপলব্ধিতে দল-মত নির্বিশেষে দৃঢ়ভাবে অবস্থান নিয়েছিলাম যে, বাঙালির সত্তা পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের অন্তর্গত থাকতে পারে না। অতএব, ঘুরে দাঁড়িয়েছিলাম, অস্ত্র হাতে নিয়েছিলাম এবং যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছিলাম। নয় মাসের ক্ষণস্থায়ী ওই মুক্তিযুদ্ধের সময় হাতেগোনা কয়েকজন মানুষ ছাড়া আপামর সব বাংলাদেশবাসী মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন বলে আমি বিশ্বাস করি। একটি ক্লান্ত, অবসন্ন মুক্তিযোদ্ধাকে যে বৃদ্ধ মা এক গ্গ্নাস পানি তুলে দিয়েছিলেন হাতে তিনি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার সময় যে তরুণকে মাথায় হাত রেখে এক বৃদ্ধ পিতা আশীর্বাদ করেছিলেন, তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। যে বালকটি একজন আহত মুক্তিযোদ্ধার কপালের রক্ত সযত্নে মুছিয়ে দিয়েছিল সে একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিল। আমার দেখা রুস্তম নামে যে কিশোর তাজা গ্রেনেড হাতে পাকিস্তানি সৈন্যদের বাঙ্কারে 'জয় বাংলা' বলে ঝাঁপিয়ে পড়ে সব শত্রুকে নিধন করেছিল, সে নিঃসন্দেহে একজন মুক্তিযোদ্ধাই ছিল। সেই যে চেতনা, সেই আদর্শ, সেই মূল্যবোধ আজ প্রশ্নের সম্মুখীন হয় কীভাবে? অথচ হয়েছে যে, এটা তো সত্য? যুদ্ধ শেষে দেশে ফেরার পর থেকেই আমার মনে সন্দেহ ছায়া ফেলেছে যে, সবকিছু বোধহয় ঠিক নেই। যে রক্তের নদী সাঁতরে এতদূর এসে পেঁৗছেছি আমরা, পেয়েছি নিজের জন্য একটি স্বাধীন দেশ, তার বিরুদ্ধে চক্রান্ত শুরু হয়ে গেছে। এই চক্রান্তকে সার্বিক সহায়তা দিচ্ছে তারা, যারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে প্রত্যক্ষভাবে কাজ করেছিল। এদের মধ্যে ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশ এবং অবশ্যই পাকিস্তান। দুঃখের বিষয়, এই যে আমাদের বাংলাদেশের কিছু কুসন্তান সেই ফাঁদে পা দিয়ে আমাদের জাতির পিতাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে '৭৫-এর ১৫ আগস্ট। তারপর মাঝে মধ্যে সামান্য সময়ের যতি; কিন্তু বেশিরভাগ সময়ে বাংলাদেশের চেতনা, আদর্শ ও মূল্যবোধবিরোধী যারা, তারাই শাসন করেছে এই দেশ। যার ফলে আমরা প্রায় ভুলতেই বসেছি কী আদর্শ এবং চেতনা নিয়ে আমরা যুদ্ধ করেছি। কী মূল্যবোধের প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলাদশের জন্ম হয়েছিল। অতএব, যে স্বপ্ন বুকে ধরে '৭১-এ যুদ্ধে গিয়েছিলাম, জয়ী হয়ে ফিরেছিলাম নিজ বাসভূমে, সেই স্বপ্ন আজ এক দুষ্ট গ্রহ দ্বারা তাড়িত, এ কথা বলা যায় নিঃসন্দেহে। সাফল্য যদি আনতে হয়, সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন যদি ঘটাতে হয় তাহলে আবহমান বাংলার চিরায়ত মূল্যবোধকে ধারণ করে যারা, তাদের এগিয়ে আসতে হবে দেশের সব মানুষকে সঙ্গে নিয়ে একটি সফল, সভ্য এবং আত্মবিশ্বাসী দেশ প্রতিষ্ঠাকল্পে।
আলী যাকের : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments