অর্থনীতি-জবাবদিহির রাজনীতি, সুশাসনের অর্থনীতি by মামুন রশীদ
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা, জনপ্রশাসনের দক্ষতা বৃদ্ধি ও রাজনীতিতে সহনশীলতার ব্যাপারে ড. আকবর আলি খানের অবস্থান পরিষ্কার। তাঁর সর্বশেষ বই ফ্রেন্ডলি ফায়ার, হাম্পটি ডাম্পটি ডিজঅর্ডার অ্যান্ড আদার এসেইজ যেন তাঁর হূদয়ের কথারই বহিঃপ্রকাশ। অর্থনীতি ও সুশাসন যেকোনো জাতিরই মেরুদণ্ড।
আকবর আলি খানের গ্রন্থেও মূল আধেয় বা উপাদান হিসেবে আছে এই দুটি ইস্যু। লেখক দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার কথা যেমন বলেছেন, তেমনি সুচিন্তিত অর্থনৈতিক নীতিমালার অভাবটাও তুলে ধরেছেন। দেশের অর্থনীতি ও সুশাসনকে ঘিরেই মূলত প্রবন্ধগুলো আবর্তিত, যেগুলো লেখক তাঁর অভিজ্ঞতার আলোকে বেশ প্রাঞ্জল ও সাবলীল ভাষায় উপস্থাপন করেছেন। তিনি ১৯৭০ সাল থেকে অর্থনীতি ও সুশাসনবিষয়ক চালচিত্রের তুলনামূলক পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণও করেছেন।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির যখন জন্ম হয়, তখন এটি রাজনৈতিকভাবে স্বাধীন হলেও অর্থনৈতিক দিক থেকে ছিল একেবারেই বিধ্বস্তপ্রায়। তিন দশক পরে এসে অবশ্য পরিস্থিতির কমবেশি পরিবর্তন ঘটেছে। কিন্তু এখন দেশটি অর্থনৈতিকভাবে অনেকটা বিকাশমান পর্যায়ে বা ধারায় থাকলেও রাজনৈতিক দিক থেকে অস্থিরতায় নিমজ্জিত। তবে রাজনৈতিক অস্থিরতা আর প্রাকৃতিক দুর্যোগ সত্ত্বেও জনগণের মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ বেড়েছে। সমাজে বৈষম্য বাড়লেও দারিদ্র্য কমেছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। লেখক পরামর্শ দিয়েছেন, ধনী ও গরিব উভয় শ্রেণীর স্বার্থে শহরগুলোতে উল্লেখযোগ্য হারে পানি-গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবরাহের ক্ষেত্রে সেবা-পণ্যের মান ও পরিমাণ বৃদ্ধি এবং পরিবহনব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। এ ছাড়া ক্ষুধামুক্তির জন্য সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী কার্যক্রম ও খাদ্য উৎপাদন জোরদার করা প্রয়োজন।
আমাদের দেশে ক্ষমতার পালাবদল ঘটলে যে সরকারি নীতিমালা ও সিদ্ধান্ত পাল্টায়, সেটি যেমন তুলে ধরেছেন তেমনি সরকারের নেওয়া ইতিবাচক সিদ্ধান্তগুলো নিয়েও আলোচনা করেছেন তিনি। বাংলাদেশ মানবিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে সত্তরের দশকে যেখানে নিম্নপর্যায়ে অবস্থান করছিল, তা এখন মধ্যম স্তরে উন্নীত হয়েছে। এটি অবশ্যই সরকারি নীতিমালায় সঠিকতার সুবাদে সম্ভব হয়েছে। তা সত্ত্বেও, সরকার অনেক সময়ই অজ্ঞতার কারণে ফ্রেন্ডলি ফায়ার করে বা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নেয়। এ ক্ষেত্রে ইনফরমেশন গ্যাপ বা তথ্যের দুর্বলতা সরকারযন্ত্রের ভুলের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। এ ছাড়া সরকার কঠিন সমস্যা মোকাবিলা করার বিষয়টি পাশ কাটিয়ে সহজ ও জনপ্রিয় সমাধানের পথটাই বেছে নিতে পছন্দ করে। আকবর আলি খানের মতে এটি ‘বুদ্ধিবৃত্তিক প্রবঞ্চনা বা প্রতারণা’বিশেষ। তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গিটা এমন যে অজ্ঞতার বিষয়টি প্রকাশ করলে নিজের ভাবমূর্তি যেন ধুলায় মিশে যাবে! সে জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা নীতিমালা প্রণয়ন-প্রক্রিয়ায় ভুলত্রুটি রুখতে হলে তৃণমূল পর্যায়ের কর্তৃপক্ষকে শক্তিশালী করতে হবে।
লেখক সরকার বা প্রশাসনযন্ত্রের দুর্নীতিগ্রস্ত ও অযোগ্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ‘হাম্পটি ডাম্পটি ডিসঅর্ডার’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। নার্সারি শ্রেণীর বহুল জনপ্রিয় রাইম বা ছড়ায় যেমন বলা হয়েছে যে ‘হাম্পটি ডাম্পটি’ একবার ভেঙে গেলে আর জোড়া লাগে না, তেমনি এই গ্রন্থে তিনি বলতে চেয়েছেন, যেকোনো সংস্থা বা সরকারব্যবস্থা একবার মুখ থুবড়ে পড়লে পরে আর ভালোভাবে কাজ করতে পারে না। সে জন্য গ্রন্থটির প্রণেতা বেসরকারীকরণ, আউটসোর্সিংয়ের উদ্যোগ গ্রহণ করাসহ সরকারি সংস্থাগুলোতে কার্যকর সংস্কার সাধন এবং নতুন জনবলে প্রতিষ্ঠানগুলো সাজিয়ে তোলার পরামর্শ দিয়েছেন।
গ্রন্থটিতে লেখক দেশে নৈতিকতানির্ভর ব্যাংকিং কার্যক্রমের ওপরও জোর দিয়েছেন। কারণ, নীতি-নৈতিকতাবর্জিত কার্যক্রম সার্বিকভাবে ব্যাংককে অস্থিতিশীলতার দিকে নিয়ে যায়। সে জন্য লেখক কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ তদারকি সংস্থাগুলো ও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের সমন্বয়ে ব্যাংকিং কার্যক্রমের ওপর তদারকি চালানোর পরামর্শ দেন। তিনি ব্যাংকের কর্মচারী থেকে শুরু করে সর্বস্তরের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের জন্য একটি যথাযথ আচরণবিধি প্রণয়ন এবং তা কঠোরভাবে পরিপালনের পরামর্শ দিয়েছেন। নীতি-নৈতিকতাবহির্ভূত কার্যক্রম রুখতে আইনি কাঠামো জোরদার করারও পরামর্শ দেন তিনি।
লেখক গ্রামাঞ্চলে অর্থায়ন বিষয়ে একটি জরিপ পরিচালনা করে দেখতে পান যে গ্রাম থেকে শহরের দিকে নিয়ে আসা হচ্ছে অর্থ। অথচ এর বিপরীতটাই হওয়ার কথা, অর্থাৎ শহর থেকে গ্রামে অর্থ স্থানান্তর হবে, এটাই স্বাভাবিক। এ ধরনের উল্টো পরিস্থিতির কারণে পল্লি অঞ্চলের ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষক ও উদ্যোক্তারা নিদারুণভাবে ঋণসংকটে ভোগেন। গ্রামাঞ্চলে অর্থায়নের প্রবণতা কমে যাওয়ার কারণে সরকারকেই প্রধান ভিলেন মনে করেন লেখক। তিনি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর পুনর্গঠন. ব্যাংক-বিমাসহ রাষ্ট্রায়ত্ত খাত ও আইনি কাঠামোয় সংস্কার সাধন এবং আর্থিকভাবে অলাভজনক বা সম্ভাবনাহীন ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি বাতিলের সুপারিশ করেন। সংস্কার-প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার ক্ষেত্রে স্বল্প মেয়াদে খরচ ও ঝক্কিটা দৃশ্যত একটু বেশি মনে হলেও এটি দীর্ঘ মেয়াদে দারুণ ফল বয়ে আনবে বলে তিনি মনে করেন।
এই গ্রন্থে লেখক যেসব বিষয়ে সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন, তার মধ্যে অন্যতম হলো দেশের ভৌত অবকাঠামো জোরদারকরণ। নিয়মানুযায়ী মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) সাড়ে ৭ শতাংশ পরিমাণ অর্থ ভৌত অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ করা উচিত। গত ২০০৯-১০ অর্থবছরে দেশে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) জন্য ১৭০ কোটি মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করা হয়, যা প্রয়োজনের চেয়ে অনেক অনেক কম। সে কারণে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিতে (পিপিপি) বিনিয়োগ বাড়ানোর দাবি জোরালো হয়ে উঠেছে। তবে এ ক্ষেত্রে অগ্রগতির হার কম। কারণ, বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্য থাকায় তাঁরা শহরকেন্দ্রিক বিনিয়োগের পথই বেছে নেন। তাঁরা বেশ ভেবেচিন্তে তবেই ঠিক করেন কোথায় কোন খাতে বিনিয়োগ করবেন। লেখক বেসরকারি উদ্যোক্তাদের আকৃষ্ট করতে কিছু নীতিগত পরামর্শ দিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর অন্যতম পরামর্শ হলো, লালফিতার দৌরাত্ম্য কমিয়ে বিনিয়োগের পরিবেশের উন্নয়ন ঘটানো উচিত সরকারের। সংস্কারের মাধ্যমে উপযোগসেবা প্রদানকারী সরকারি সংস্থাগুলোর সেবার মান বৃদ্ধি এবং অবকাঠামোগত দুর্বলতা দূর করতে হবে। পিপিপির অপেক্ষায় না থেকে সরকারের উচিত বিদ্যুৎ ও পানি খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো। দরিদ্রদের জন্য যে ভর্তুকি দেওয়া হয়, তা নিবিড়ভাবে তদারক করতে হবে। সরকারি নীতিমালা এমনভাবে গ্রহণ করতে হবে, যা অর্থনৈতিক দক্ষতা বাড়ায় এবং সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে।
লেখক বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করতে ভোলেননি। কারণ দেশের বিচার বিভাগের সর্বস্তরে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। আদালতের কাছে যেন নিষ্পাপ মানুষের জীবন-মৃত্যু তেমন কিছু নয়। এটি যেন ভুয়া বা জাল কাগজপত্র দাখিল আর অধিকতর অর্থ উপার্জনের ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে স্থানীয় সরকারও পরিচালিত হয় এলাকার তথাকথিত এলিট বা বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নেতৃত্বে। লেখক বিচারব্যবস্থায় কম্পিউটারায়ন এবং এই খাতের ওপর অব্যাহত তদারকি ও নজরদারি রাখার বিষয়ে জোর দিয়েছেন।
রাজনৈতিক অস্থিরতা যেন বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে আছে। গ্রন্থে লেখক রাজনৈতিক অস্থিরতার মূলে পাঁচটি উৎস চিহ্নিত করে দেখিয়েছেন। এগুলো হচ্ছে: সামাজিক পুঁজির অভাব, উত্তরাধিকারের রাজনীতি, সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতা, প্যাট্রন-ক্লায়েন্ট রিলেশনশিপ বা পৃষ্ঠপোষক-গ্রাহক সম্পর্ক এবং বড় দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দলের প্রধানদের মধ্যে ‘জিরো সাম গেইম’ বা কোনো রকম কথাও না বলা বা মুখ দেখাদেখিও না থাকা। তিনি বেসরকারি সংস্থাগুলো (এনজিও) আর সুশীল সমাজকে রাজনৈতিক শত্রুতা বা বৈরিতার ঊর্ধ্বে থাকা, এনজিওর মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায়ে সামাজিক পুঁজি জোরদারকরণ এবং রাজনৈতিক দলগুলোর বংশানুক্রমিক বা উত্তরাধিকারের রাজনীতির নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বেরিয়ে আসা, দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) অধিকতর কার্যকর করে তোলা এবং রাজনৈতিক দলগুলোর পরস্পরের প্রতি সহনশীল ও উদারতা দেখানোর বিষয়ে জোরালো পরামর্শ দিয়েছেন।
আমাদের দেশের উন্নয়ন-প্রক্রিয়া সম্পর্কে নীতিনির্ধারক, পণ্ডিত-গবেষক, শিক্ষক-শিক্ষার্থী এবং যাঁরা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন বিষয়ে জানতে আগ্রহী তাঁদের সবাই এই গ্রন্থ থেকে জ্ঞান আহরণের সুযোগ পাবেন বলে আমার বিশ্বাস।
মামুন রশীদ: ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির যখন জন্ম হয়, তখন এটি রাজনৈতিকভাবে স্বাধীন হলেও অর্থনৈতিক দিক থেকে ছিল একেবারেই বিধ্বস্তপ্রায়। তিন দশক পরে এসে অবশ্য পরিস্থিতির কমবেশি পরিবর্তন ঘটেছে। কিন্তু এখন দেশটি অর্থনৈতিকভাবে অনেকটা বিকাশমান পর্যায়ে বা ধারায় থাকলেও রাজনৈতিক দিক থেকে অস্থিরতায় নিমজ্জিত। তবে রাজনৈতিক অস্থিরতা আর প্রাকৃতিক দুর্যোগ সত্ত্বেও জনগণের মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ বেড়েছে। সমাজে বৈষম্য বাড়লেও দারিদ্র্য কমেছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। লেখক পরামর্শ দিয়েছেন, ধনী ও গরিব উভয় শ্রেণীর স্বার্থে শহরগুলোতে উল্লেখযোগ্য হারে পানি-গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবরাহের ক্ষেত্রে সেবা-পণ্যের মান ও পরিমাণ বৃদ্ধি এবং পরিবহনব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। এ ছাড়া ক্ষুধামুক্তির জন্য সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী কার্যক্রম ও খাদ্য উৎপাদন জোরদার করা প্রয়োজন।
আমাদের দেশে ক্ষমতার পালাবদল ঘটলে যে সরকারি নীতিমালা ও সিদ্ধান্ত পাল্টায়, সেটি যেমন তুলে ধরেছেন তেমনি সরকারের নেওয়া ইতিবাচক সিদ্ধান্তগুলো নিয়েও আলোচনা করেছেন তিনি। বাংলাদেশ মানবিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে সত্তরের দশকে যেখানে নিম্নপর্যায়ে অবস্থান করছিল, তা এখন মধ্যম স্তরে উন্নীত হয়েছে। এটি অবশ্যই সরকারি নীতিমালায় সঠিকতার সুবাদে সম্ভব হয়েছে। তা সত্ত্বেও, সরকার অনেক সময়ই অজ্ঞতার কারণে ফ্রেন্ডলি ফায়ার করে বা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নেয়। এ ক্ষেত্রে ইনফরমেশন গ্যাপ বা তথ্যের দুর্বলতা সরকারযন্ত্রের ভুলের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। এ ছাড়া সরকার কঠিন সমস্যা মোকাবিলা করার বিষয়টি পাশ কাটিয়ে সহজ ও জনপ্রিয় সমাধানের পথটাই বেছে নিতে পছন্দ করে। আকবর আলি খানের মতে এটি ‘বুদ্ধিবৃত্তিক প্রবঞ্চনা বা প্রতারণা’বিশেষ। তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গিটা এমন যে অজ্ঞতার বিষয়টি প্রকাশ করলে নিজের ভাবমূর্তি যেন ধুলায় মিশে যাবে! সে জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা নীতিমালা প্রণয়ন-প্রক্রিয়ায় ভুলত্রুটি রুখতে হলে তৃণমূল পর্যায়ের কর্তৃপক্ষকে শক্তিশালী করতে হবে।
লেখক সরকার বা প্রশাসনযন্ত্রের দুর্নীতিগ্রস্ত ও অযোগ্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ‘হাম্পটি ডাম্পটি ডিসঅর্ডার’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। নার্সারি শ্রেণীর বহুল জনপ্রিয় রাইম বা ছড়ায় যেমন বলা হয়েছে যে ‘হাম্পটি ডাম্পটি’ একবার ভেঙে গেলে আর জোড়া লাগে না, তেমনি এই গ্রন্থে তিনি বলতে চেয়েছেন, যেকোনো সংস্থা বা সরকারব্যবস্থা একবার মুখ থুবড়ে পড়লে পরে আর ভালোভাবে কাজ করতে পারে না। সে জন্য গ্রন্থটির প্রণেতা বেসরকারীকরণ, আউটসোর্সিংয়ের উদ্যোগ গ্রহণ করাসহ সরকারি সংস্থাগুলোতে কার্যকর সংস্কার সাধন এবং নতুন জনবলে প্রতিষ্ঠানগুলো সাজিয়ে তোলার পরামর্শ দিয়েছেন।
গ্রন্থটিতে লেখক দেশে নৈতিকতানির্ভর ব্যাংকিং কার্যক্রমের ওপরও জোর দিয়েছেন। কারণ, নীতি-নৈতিকতাবর্জিত কার্যক্রম সার্বিকভাবে ব্যাংককে অস্থিতিশীলতার দিকে নিয়ে যায়। সে জন্য লেখক কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ তদারকি সংস্থাগুলো ও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের সমন্বয়ে ব্যাংকিং কার্যক্রমের ওপর তদারকি চালানোর পরামর্শ দেন। তিনি ব্যাংকের কর্মচারী থেকে শুরু করে সর্বস্তরের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের জন্য একটি যথাযথ আচরণবিধি প্রণয়ন এবং তা কঠোরভাবে পরিপালনের পরামর্শ দিয়েছেন। নীতি-নৈতিকতাবহির্ভূত কার্যক্রম রুখতে আইনি কাঠামো জোরদার করারও পরামর্শ দেন তিনি।
লেখক গ্রামাঞ্চলে অর্থায়ন বিষয়ে একটি জরিপ পরিচালনা করে দেখতে পান যে গ্রাম থেকে শহরের দিকে নিয়ে আসা হচ্ছে অর্থ। অথচ এর বিপরীতটাই হওয়ার কথা, অর্থাৎ শহর থেকে গ্রামে অর্থ স্থানান্তর হবে, এটাই স্বাভাবিক। এ ধরনের উল্টো পরিস্থিতির কারণে পল্লি অঞ্চলের ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষক ও উদ্যোক্তারা নিদারুণভাবে ঋণসংকটে ভোগেন। গ্রামাঞ্চলে অর্থায়নের প্রবণতা কমে যাওয়ার কারণে সরকারকেই প্রধান ভিলেন মনে করেন লেখক। তিনি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর পুনর্গঠন. ব্যাংক-বিমাসহ রাষ্ট্রায়ত্ত খাত ও আইনি কাঠামোয় সংস্কার সাধন এবং আর্থিকভাবে অলাভজনক বা সম্ভাবনাহীন ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি বাতিলের সুপারিশ করেন। সংস্কার-প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার ক্ষেত্রে স্বল্প মেয়াদে খরচ ও ঝক্কিটা দৃশ্যত একটু বেশি মনে হলেও এটি দীর্ঘ মেয়াদে দারুণ ফল বয়ে আনবে বলে তিনি মনে করেন।
এই গ্রন্থে লেখক যেসব বিষয়ে সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন, তার মধ্যে অন্যতম হলো দেশের ভৌত অবকাঠামো জোরদারকরণ। নিয়মানুযায়ী মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) সাড়ে ৭ শতাংশ পরিমাণ অর্থ ভৌত অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ করা উচিত। গত ২০০৯-১০ অর্থবছরে দেশে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) জন্য ১৭০ কোটি মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করা হয়, যা প্রয়োজনের চেয়ে অনেক অনেক কম। সে কারণে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিতে (পিপিপি) বিনিয়োগ বাড়ানোর দাবি জোরালো হয়ে উঠেছে। তবে এ ক্ষেত্রে অগ্রগতির হার কম। কারণ, বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্য থাকায় তাঁরা শহরকেন্দ্রিক বিনিয়োগের পথই বেছে নেন। তাঁরা বেশ ভেবেচিন্তে তবেই ঠিক করেন কোথায় কোন খাতে বিনিয়োগ করবেন। লেখক বেসরকারি উদ্যোক্তাদের আকৃষ্ট করতে কিছু নীতিগত পরামর্শ দিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর অন্যতম পরামর্শ হলো, লালফিতার দৌরাত্ম্য কমিয়ে বিনিয়োগের পরিবেশের উন্নয়ন ঘটানো উচিত সরকারের। সংস্কারের মাধ্যমে উপযোগসেবা প্রদানকারী সরকারি সংস্থাগুলোর সেবার মান বৃদ্ধি এবং অবকাঠামোগত দুর্বলতা দূর করতে হবে। পিপিপির অপেক্ষায় না থেকে সরকারের উচিত বিদ্যুৎ ও পানি খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো। দরিদ্রদের জন্য যে ভর্তুকি দেওয়া হয়, তা নিবিড়ভাবে তদারক করতে হবে। সরকারি নীতিমালা এমনভাবে গ্রহণ করতে হবে, যা অর্থনৈতিক দক্ষতা বাড়ায় এবং সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে।
লেখক বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করতে ভোলেননি। কারণ দেশের বিচার বিভাগের সর্বস্তরে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। আদালতের কাছে যেন নিষ্পাপ মানুষের জীবন-মৃত্যু তেমন কিছু নয়। এটি যেন ভুয়া বা জাল কাগজপত্র দাখিল আর অধিকতর অর্থ উপার্জনের ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে স্থানীয় সরকারও পরিচালিত হয় এলাকার তথাকথিত এলিট বা বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নেতৃত্বে। লেখক বিচারব্যবস্থায় কম্পিউটারায়ন এবং এই খাতের ওপর অব্যাহত তদারকি ও নজরদারি রাখার বিষয়ে জোর দিয়েছেন।
রাজনৈতিক অস্থিরতা যেন বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে আছে। গ্রন্থে লেখক রাজনৈতিক অস্থিরতার মূলে পাঁচটি উৎস চিহ্নিত করে দেখিয়েছেন। এগুলো হচ্ছে: সামাজিক পুঁজির অভাব, উত্তরাধিকারের রাজনীতি, সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতা, প্যাট্রন-ক্লায়েন্ট রিলেশনশিপ বা পৃষ্ঠপোষক-গ্রাহক সম্পর্ক এবং বড় দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দলের প্রধানদের মধ্যে ‘জিরো সাম গেইম’ বা কোনো রকম কথাও না বলা বা মুখ দেখাদেখিও না থাকা। তিনি বেসরকারি সংস্থাগুলো (এনজিও) আর সুশীল সমাজকে রাজনৈতিক শত্রুতা বা বৈরিতার ঊর্ধ্বে থাকা, এনজিওর মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায়ে সামাজিক পুঁজি জোরদারকরণ এবং রাজনৈতিক দলগুলোর বংশানুক্রমিক বা উত্তরাধিকারের রাজনীতির নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বেরিয়ে আসা, দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) অধিকতর কার্যকর করে তোলা এবং রাজনৈতিক দলগুলোর পরস্পরের প্রতি সহনশীল ও উদারতা দেখানোর বিষয়ে জোরালো পরামর্শ দিয়েছেন।
আমাদের দেশের উন্নয়ন-প্রক্রিয়া সম্পর্কে নীতিনির্ধারক, পণ্ডিত-গবেষক, শিক্ষক-শিক্ষার্থী এবং যাঁরা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন বিষয়ে জানতে আগ্রহী তাঁদের সবাই এই গ্রন্থ থেকে জ্ঞান আহরণের সুযোগ পাবেন বলে আমার বিশ্বাস।
মামুন রশীদ: ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক।
No comments