শিশু নাঈম-জান্নাত হত্যাকাণ্ড-পৈশাচিক উন্মত্ততার শেষ কোথায়?
পৈশাচিকতা, বর্বরতা, নিষ্ঠুরতার মাত্রা এতটাই উদ্বেগজনক রূপ নিয়েছে যে একে বলা যায় সমাজ ভয়ংকর অসুখে আক্রান্ত। বগুড়ায় অপহরণের পর ১৩ বছরের শিশু নাঈমকে যে নৃশংস কায়দায় হত্যা করা হয়েছে, তা ভাবতেও গা শিউরে ওঠে।
১১ এপ্রিল কালের কণ্ঠ এ সম্পর্কিত সচিত্র প্রতিবেদনটিতে এ প্রশ্নও দাঁড়ায়, মানুষ কি মানুষরূপী পশুদের হাতে এভাবেই প্রাণ হারাতে থাকবে? একই দিন কালের কণ্ঠে প্রকাশিত শিশু জান্নাতুল ফেরদৌসের নির্মম হত্যাকাণ্ডের খবরটিও আতঙ্কজনক পরিস্থিতিকে আরো পুষ্ট করেছে। রাজধানীর দক্ষিণখান এলাকার আশকোনার শিশু জান্নাত হত্যাকাণ্ড সমভাবেই দেশবাসীকে স্তম্ভিত করেছে।
সপ্তম শ্রেণীর শিক্ষার্থী নাঈম ছিল অত্যন্ত মেধাবী। নাঈমকে সন্ত্রাসীরা কোচিং পরীক্ষার প্রশ্নপত্র দেওয়ার কথা বলে অপহরণ করে। এর পরের ঘটনা পৈশাচিক। অপহরণকারীরা তাকে হত্যা করে ইটখোলার আগুনে পুড়িয়ে ফেলে। কয়েক দিন ধরে নাঈম নিখোঁজ ছিল। কিন্তু ৯ এপ্রিল অপহরণকারী দলের এক সদস্য কলেজছাত্র শাহাদাতকে গ্রেপ্তারের পর বেরিয়ে আসে লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ডের কাহিনী। ততক্ষণে নাঈমের রক্ত-মাংসের শরীর পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। অর্থের জন্য দুর্বৃত্তরা নাঈমকে অপহরণ করে এবং মুক্তিপণ দাবি করেও নাঈম দুর্বৃত্তদের চিনে ফেলায় তাকে শেষ করে দেওয়া হয়। পত্রপত্রিকায় প্রকাশ, নাঈমের অপহরণকারী দলের নেতা জাকারিয়া মাদকসেবী। আর জান্নাতকে অপহরণ করে পাশবিক নির্যাতনের পর হত্যা করে সবশেষে হাত-পা ভেঙে প্যাকেটে ভরে ট্রেনের বগিতে তুলে দেওয়া হয়। জান্নাতের অপহরণকারীরাও মাদকসেবী এবং তারাও অর্থের জন্যই এ নৃশংসতা ঘটিয়েছে, প্রাথমিক তদন্তে তা অনেকটাই নিশ্চিত হওয়া গেছে। নাঈম, জান্নাতই প্রথম নয়, এ রকম বর্বরোচিত ঘটনা ইতিপূর্বে আরো ঘটেছে। কিন্তু উদ্বেগজনক বিষয় হচ্ছে, নিষ্ঠুরতার ক্ষত সমাজদেহে সৃষ্টি হয়ে চলেছে আইন, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, বিবেক, মূল্যবোধ- সব কিছুর প্রতিই বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে। সিংহভাগ ঘটনার ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে মাদক নামক অভিশাপের ছায়া। মাদকের ভয়াবহ বিস্তার এবং সহজলভ্যতা প্রজন্মকে চরম সর্বনাশের কিনারায় ঠেলে দিচ্ছে- এসব ঘটনা এরই সাক্ষ্যবহ। মাদক জীবন থেকে জীবন কেড়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে কত বড় কিংবা কতটা ভয়ংকর অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে, নতুন করে এর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নিষ্প্রয়োজন। একেকটি জীবন ও পরিবার এর জন্য ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে এবং মাদকের ছোবল কিংবা অশুভ ছায়া সমাজে অন্ধকার গাঢ় করছে। এমনিতেই দেশের বিদ্যমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি মারাত্মক প্রশ্নবোধক।
নাঈম ও জান্নাতের প্রাণ যেভাবে নাশ করা হলো, এর বর্ণনা দেওয়াও ভার। আমরা স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই, যে ভয়াবহ বিষে সমাজ বিষাক্রান্ত হয়ে পড়ছে, এ থেকে পরিত্রাণের লক্ষ্যে সম্মিলিতভাবে দাঁড়াতে হবে। সামাজিক প্রতিরোধ আন্দোলন জোরদার করতে হবে। তবে সর্বাগ্রে দরকার আইন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর যথাযথ কার্যকারিতা। সন্দেহ নেই, এ ক্ষেত্রে এ সব কিছুরই ব্যর্থতার দানাটি ক্রমেই মোটা হচ্ছে বিধায় পরিস্থিতির অবনতি ঠেকানো কঠিন হয়ে পড়েছে। এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা, পর্যালোচনা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ- কোনো কিছুই এযাবৎ কম হয়নি; কিন্তু উদ্বেগজনক হলো, এর পরও প্রতিকার চিত্র বিবর্ণ। নাঈম-জান্নাতের হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তযোগ্য দণ্ড নিশ্চিত করার দায় আইনি সংস্থাগুলোর। তাদের ব্যর্থতার খতিয়ান যেন আর দীর্ঘ না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে সরকারকে। এসব ক্ষেত্রে কারোই কোনো অজুহাত দাঁড় করানোর অবকাশ নেই।
No comments