সরল গরল-তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ! by মিজানুর রহমান খান
ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অসম্মানজনকভাবে বিদায় দেওয়ার ঘটনাটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটি আমাদের নিম্ন রাজনৈতিক সংস্কৃতিরই ধারাবাহিকতা। এই কাণ্ড ঘটিয়ে ভিন্নমতকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। আনুগত্যহীনদের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির এই নিকৃষ্ট রূপটি নিয়ে আলোচনা হতেই পারে।
এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে তাজউদ্দীন আহমদের কথা। ওই সময়ে তাঁর অবস্থান অন্য সতীর্থদের মতো ছিল না। অনেক বিষয়ে তাঁর ভিন্নমত ছিল। সে জন্য তাঁকে খেসারত দিতে হয়।
ড. ইউনূস নোবেল জিতেছিলেন বলে কি রুষ্ট হন শেখ হাসিনা? ইউনূস দল গঠনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সেসব অন্যতম উপসর্গ। আসল রোগ নয়। গ্রামবাংলায় বিরল, যেখানে একজন মানি লোক আছেন যিনি স্থানীয় দলীয় এজেন্ট বা মাস্তানকে কুর্নিশ করছেন না, সেলাম ঠুকছেন না, ভেট-ভোট দিচ্ছেন না। নিরীহ নাগরিকের সর্বজনশ্রদ্ধেয় হয়ে ওঠার পরিবেশ তৈরি করে দিচ্ছে না রাষ্ট্র। রাষ্ট্রযন্ত্র শুধু মেধা ও প্রজ্ঞার জন্য কাউকে কুর্নিশ করছে এমনটা কোথাও নেই। আত্মমর্যাদাসম্পন্ন বহু ব্যক্তির বিকাশ ও সহাবস্থান আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি বেশি দিন ধারণ করতে পারে না। আমাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অনেকেই সামন্ত আমলের জমিদারের মতো। তাঁরা দেশটাকে নিজের জমিদারি মনে করেন। অজ্ঞতা ও স্বেচ্ছাচারিতা তাঁদের ধর্ম। আমরা তাকে কখনো জাতীয়তাবাদী, কখনো সাম্রাজ্যবাদবিরোধী চিহ্নিত করে আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তুলি। তাঁরা সংবিধান ও গণতন্ত্রের লেবাস বেশিক্ষণ গায়ে চাপিয়ে রাখতে পারেন না। অভ্যাস নেই। অস্বস্তি লাগে। তাই হঠাৎ হঠাৎ লেবাসটা খসে পড়ে।
ড. ইউনূসের ছায়াটা আরও প্রকাণ্ড হয়ে উঠেছিল। বিশ্ববাঙালি হওয়ার পথে তাঁর ছায়াটা দীর্ঘতর হচ্ছিল। কিন্তু তা ব্যক্তির পূজায় লাগছিল না। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ ও অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীর অসম্মানজনক অন্তর্ধানের কারণও ওই একই সুতোয় গাঁথা। আমিই শক্তি, নৈবেদ্য আমারই প্রাপ্য। প্রশ্নটা নিরঙ্কুশ আনুগত্যের। একইভাবে ড. কামাল হোসেনকে ‘বস্তি থেরাপি’ দেওয়া হয়েছিল। এভাবে আমরা আমাদের ইতিহাসে এটা দেখব যে—কি সামরিক কি বেসামরিক—একজন ব্যক্তিকে আমরা আরাধনার পাত্রে পরিণত করি। আর তাঁকে ঘিরে অন্য সবার অনন্ত আরাধনা আশা করি। অনেক জ্ঞানীগুণী তাই বড় দলে ভাত পান না। হারিস চৌধুরী ও মোসাদ্দেক আলী ফালুর মতো মাপের ব্যক্তি ভাত পান। তাঁরাই রাজনৈতিক উপদেষ্টা বা উপদেষ্টা হন। কিচেন ক্যাবিনেটে মোসাহেবদের রোশনাই বরাবর।
হাইকোর্টে শুনানি শুনছিলাম। রাষ্ট্রের ধাতব কণ্ঠ শুনলাম। রাষ্ট্র বলছে, মোদ্দা কথা, এটা বয়সের ব্যাপার। বয়সগত একটা সর্বজনীন ব্যাপার আছে। সবচেয়ে হাস্যকর ও ঠুনকো যুক্তি। আমরা ব্যক্তির জন্য সংবিধান তাঁর পায়ের মাপে করে নিতে ওস্তাদ জাতি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হবেন প্রধানমন্ত্রী, তাই একমাত্র প্রধানমন্ত্রীর হাতেই নির্বাহী ক্ষমতা সমর্পিত হলো। মুজিব হবেন রাষ্ট্রপতি, তাই সংবিধানে লেখা হলো, ধরে নিতে হবে যেন তিনি রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলেন। সামরিক ফরমানের যুগেও যেই লাউ সেই কদু। জিয়া সিএমএলএ থাকবেন, রাষ্ট্রপতি হওয়ার বাসনাও পুর্ণ করবেন। সেভাবে ফরমান পয়দা হলো। বিচারপতি সাত্তারের জন্য ষষ্ঠ সংশোধনী ও বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের জন্য আমরা একাদশ সংশোধনী পাস করেছি। বিচারপতি কে এম হাসানের জন্য এল ১৪তম সংশোধনী। এর আগে বয়সের ফাঁদ পেতে প্রধান বিচারপতি বধ করেন ‘বিশ্ববেহায়া’ এরশাদ। ড. ইউনূসের মতো প্রধান বিচারপতি কামাল উদ্দিন হোসেন আকস্মিক ‘নো-বডি’ হন।
আমরা আইনের চোখে (অ)সমতা নিশ্চিত করা জাতি। সে জন্য আমরা ইউনূসকে ‘নিয়মিত কর্মকর্তার’ ঊর্ধ্বে তুলিনি। তবে তাঁকে স্বপদে বহাল রাখতে সংবিধান সংশোধনের দরকার ছিল না। বড়জোর এক লাইনের একটি বাক্য দরকার ছিল। গ্রামীণ ব্যাংকে বিকল্প নেতৃত্ব কিংবা ক্ষুদ্রঋণ পুঁজিবাদকে প্রশ্রয় দেয় কি দেয় না; দারিদ্র্যকে, সাম্রাজ্যবাদকে মহান করল কি না সেসব বিতর্ক এখন অবান্তর। তাঁকে অপমান করার মনোভঙ্গিই প্রকট। পুরো বিষয়টি আপাদমস্তক সামন্ততান্ত্রিক।
ইউনূস একা নন। এই সমাজে আরও অনেক ইউনূস রয়েছেন, যাঁরা ভিন্নমতাবলম্বী। তাঁরা দাসখত দিতে রাজি নন, তাঁদের প্রতি এই সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছে।
আদালতে ড. কামাল হোসেন বলছিলেন, ‘যদি ব্যাংকের স্বার্থ দেখার কথা বলা হয়, তাহলে একজন সিইও (চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার) পেতে হবে। এ জন্য বিজ্ঞাপন দিয়েও ইউনূসের চেয়ে যোগ্য কাকে মিলবে?’ জবাবে রাষ্ট্র মশকরা করেছে। কিংবা মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে ‘কঠিন সত্য’। আমাদের রাষ্ট্র বলল, নেলসন ম্যান্ডেলা দ্বিতীয় মেয়াদে রাষ্ট্রপতি হননি। সোনিয়া গান্ধী শত অনুরোধেও প্রধানমন্ত্রী হননি। জ্যোতি বসুও প্রধানমন্ত্রী হননি। অথচ এর কোনোটাই ইউনূসের জন্য খাটে না। খাটে বরং তাঁদের জন্য, যাঁরা এই রাষ্ট্রের খেয়ে-পরে এই রাষ্ট্রের গণতন্ত্রের মাথা খাচ্ছে, অমরত্বের দাবি নিয়ে একই পদে গদিনশিন থাকছে—তিন দশকের বেশি সময় ধরে। আমরা হয়ে আছি চিন্তার ক্রীতদাস। দুই নেত্রী দলীয় গদি ছাড়লে তাঁদের দল কয় টুকরা হবে, সে উত্তর পাওয়া কঠিন কিছু নয়।
ম্যান্ডেলা ৭৬ বছর বয়সে রাষ্ট্রপতি হন। ৮১-তে দ্বিতীয়বার হতে চাননি। ৮৬ বছর বয়সেও মুখ্যমন্ত্রী থাকা জ্যোতি বসু ও সোনিয়ার প্রধানমন্ত্রী না হওয়ার সঙ্গে ইউনূস তুলনীয় নন। কলকাতার দৈনিক টেলিগ্রাফ এক সম্পাদকীয়তে ইউনূসকে তালিম দিয়েছে। তারা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যে, রতন টাটা (৭৫) আগামী বছর অবসর নেবেন। বাংলাদেশের বাজেটের চেয়ে বড় বাজেটের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিশ্বে অনেক আছে। সেসব সংস্থার তুখোড় সিইও হিসেবে বিশ্বে এখন অন্তত এক ডজন ব্যক্তি আছেন যাঁরা বয়সে সত্তরোর্ধ্ব। রুপার্ট মারডক আশিতেও বাসি নন। তাহলে ৭০ পেরোনো ইউনূসের জন্য বয়স বাধা হবে কেন?
আমরা আক্রান্ত ‘আমি’ নামক শব্দদূষণে। ‘আমি’, ‘আমি’, ‘আমি’। ‘আমি’ এটা করেছি। ‘আমার সরকার‘ এটা করেছে। ‘আমি’ দেশের জন্য এটা করব, ওটা করব। ‘আমরা’ আমাদের সংস্কৃতিতে নেই। সে কারণে আমরা বিশেষ দুই ব্যক্তির নেতৃত্ব মানলাম। স্রেফ অধিকতর যোগ্যতার কারণে কাউকে নেতা মানা আমাদের স্বভাবে নেই। অথচ আমরা একই সঙ্গে যোগ্যতা, শিক্ষা ও মেধার কথা বলি। সসম্মানে আমরা কাউকে বিদায় দেওয়া ভুলছি। ধারণা করি, বিদায় সংবর্ধনার কার্ডই সবচেয়ে কম ছাপা হয়। এই সংস্কৃতি ক্রমশ আরও নিম্ন ও পশ্চাদমুখী। ‘যেতে নাহি দেব হায়, তবু যেতে দিতে হয়’—এ পঙিক্ত প্রায় অনুচ্চারিত। আমরা যে যেখানে আছি, বিদায় কেউ সহজে নিতে চাই না। দিতেও চাই না।
গত বছর অর্থমন্ত্রীকে লেখা একটি চিরকুট ছাপা হয়েছে পত্রিকায়। তাতে দেখি, ইউনূস মসৃণ ক্রান্তিকাল চেয়েছেন। ক্রান্তিকালের আভিধানিক অর্থ হলো, একপর্যায় থেকে অন্য পর্যায়ে উত্তরণের মধ্যবর্তী সময়। এই সামন্ত মুলুকের ক্রান্তিকাল তো যায় না।
ইউনূস শেষতক দল করতে উৎসাহ পাননি। অথচ আমরা বিকল্প শক্তির কথা বলি। বিকল্প শক্তির উত্থান না দেখে হা-পিত্যেশ করি। আবার কেউ এগিয়ে এলে, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষিত হলে, এই আমরাই অদ্ভুত আচরণ করি। বাম-ডান যা-ই হোক, সর্বাগ্রে মতলব খুঁজি। ইউনূসকেও আমরা পত্রপাঠ অবিশ্বাস করেছি। সন্দেহ করেছি। সেটা কি অসময়ের কারণেই? সময় কবে আসবে? পাশ্চাত্য ঠেকাতে আমরা নাকি দুই নেত্রীকে বাগে রাখতে পারি। বেশি শিক্ষিত ও বিদেশি লাইন থাকা ইউনূসকে আমরা বাগে রাখতে পারব না। তাই অনেকেই তাঁকে গাছে তুলে মই সরিয়ে নেন। মাত্র চার বছর আগে ড. ইউনূস বলেছিলেন, ‘আমি নিজেকে রাজনৈতিক দল গঠন থেকে দূরে সরিয়ে নিচ্ছি। কারণ, গোড়াতে যাঁরা আমাকে এ কাজে উৎসাহ জুগিয়েছিলেন, তাঁদের উৎসাহে ভাটির টান পড়েছে।’ তিনি আরও স্বীকার করেছিলেন, জরুরি অবস্থা জারি না হলে তিনি রাজনীতিতে নামার কথা ভাবতেন না। সামরিক শাসনে আমরা তথাকথিত বহুদলীয় গণতন্ত্র পেয়েছি। আওয়ামী লীগের পুনর্জন্ম দেখেছি। সম্ভাবনাময় কেউ যদি এখন দল করেন, যাঁরা কল্পনা তৈরি করতে পারেন, তাহলে তাঁরা মার খাবেন। আমরা তাঁদের পিটিয়ে তক্তা বানাব। কারও না কারও এজেন্ট বলব।
সেই কল্পনাটা কী? আগামী সাধারণ নির্বাচন হবে। কিন্তু সেখানে আর দুটি সম্ভাবনা থাকবে না। মানুষ বাজি ধরবে না নির্দিষ্ট দুটো প্রতীকে। নৌকা ও ধানের শীষ ছাড়াও নতুন দল দাঁড়াবে। কিংবা ওই দুই দলের নেতৃত্বে বড় পরিবর্তন আসবে। যোগ্যতাসম্পন্নরা মনোনায়ন পাবেন। ছোট দলের অনেক গুণী লোক আফসোস করেন, বড় পত্রিকা তাঁদের বক্তব্য ছাপে না। কারণটা বাণিজ্যিক। জায়গা দিয়ে লাভ কী? খামোখা কে জায়গা নষ্ট করে! কারও তো মুরোদ নেই দাবার ছক পাল্টানোর। গরিবের পেটে ঋণ সয়, ঘি সয় না। আমরা কোনো ব্যক্তি বা ছোট দলকে সম্ভাবনাময় মনে করি না। সেভাবে কেউ গড়ে উঠুক, তাও চাই না। দুই বড় দল নিয়েই থাকি। কিন্তু সেখানে দুই ব্যক্তির বাইরে সম্ভাবনাময় অন্য কেউ আছেন কি? আমরা সে চিন্তা করতেও ভুলে গেছি।
আমরা কী অবলীলায় সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদের পূজারি বানালাম ইউনূসকে। তাই দ্রুতই তাঁর অবস্থা দাঁড়াল, ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি। আমরা তাঁকে তিরস্কার করলাম। পুরস্কার আমরা তাঁকে দিইনি। আমরা কতটা হীনম্মন্য, তাঁর নোবেল শান্তি পুরস্কার কেড়ে নিতে বলেছি। আজ জন কেরি ও মরিয়ার্টির প্রতিবাদের ভাষা আমাদের জাতীয় প্রতিবাদের নিনাদকে যেন ছাপিয়ে যাচ্ছে। আমাদের চেনা শাসকগোষ্ঠী এতটাই পরীক্ষিত যে, তাঁরা নাকি ‘পুঁজিবাদে’র দোসর নন। অথচ আফগানিস্তানে যুদ্ধ করতে বাংলাদেশ ভাড়া নিতে হামিদ কারাজাই লাগেনি। গ্যাস-তেলের চুক্তি আমরা জানতেও পারি না। চটজলদি ইউনূস যখন বিদায় নিলেন, তখন দুই বড় দলই অভিনন্দন জানাল। আপদ বিদায় নিয়েছে বলে তারা উভয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। বিএনপির নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ইউনূসের অপসারণকে প্রতিহিংসামূলক বলে প্রত্যাশিত বিবৃতি দিয়েছেন। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্কের জায়গাটি কি স্পষ্ট করবে বিএনপি?
ব্যাংকার ইউনূসকে আমরা এই সমাজে ৩০ বছর বাঁচতে দিয়েছি। একজন রাজনীতিক ইউনূসকে ২০০৭ সালে আমরা বাঁচতে দিয়েছি মাত্র ৬৮ দিন। সেই দিনগুলোও অবশ্য টেস্টটিউবেই কেটেছে। ময়দান তাঁকে দেখেনি। ইউনূস বলেছিলেন, প্রয়োজনে তিনি গ্রামীণ ব্যাংক ছেড়ে রাজনীতিতে নামবেন। ড. কাজী খলীকুজ্জমান বলেছিলেন, গ্রামীণ ব্যাংক ত্যাগ করা তাঁর কখনো সেভাবে হবে না। ব্যাংকে তাঁর প্রচণ্ড প্রভাব, যা রাজনীতিতে ব্যবহার করা সম্ভব। গ্রামীণ ব্যাংকের মোজাম্মেল হক বলেছিলেন, বাংলাদেশে যদি রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির সরকার থাকত, তাহলে তিনি অনেক আগেই রাজনীতিতে আসতেন। সামনের দিনগুলোতে এসব উক্তি আমরা যাচাই করতে পারব।
অনেকের চোখ আদালতের দিকে। কিন্তু প্রশ্নটা আইনগত নয়, একান্তভাবেই রাজনৈতিক। আদালতের সিদ্ধান্তে আমার আগ্রহ নেই। দি ইকোনমিস্ট ২ মার্চ লিখেছে, ‘১৯৯৭ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, প্রফেসর ইউনূস ও তাঁর প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংকের অসাধারণ কাজের জন্য তাঁরা গর্বিত। শান্তিচুক্তির পরে তাঁর ‘পারিষদ-দলের’ মদদে তিনি নোবেল জয়ের স্বপ্ন দেখেন। আর লক্ষ করেন, ইউনূস জনপ্রিয়তায় বিশ্বে তাঁর প্রয়াত পিতাকে ছাড়িয়ে গেছেন। শেখ হাসিনাকে যারা ব্যক্তিগতভাবে জানেন তাঁরা বলেন, এটা তাঁর জন্য তেতো বটিকা গেলা। তাঁর সেই তিক্ততা শত্রুতায় পরিণত হয় যখন নোবেল পাওয়ার পাঁচ মাস পরে তিনি দল গঠনের ঘোষণা দেন। তিনি সন্দেহ করেন তাঁকে সরানোর জেনারেলদের চেষ্টায় তাঁর সায় ছিল।’ সুতরাং অসুখটা সর্বগ্রাসীরূপে রাজনীতিতে। সেই অসুখের সংক্রমণ থেকে এ দেশের কেউ, কোনো প্রতিষ্ঠান বিচ্ছিন্ন নয়। ইকোনমিস্ট আদালত সম্পর্কে যে ভাষ্য দিয়েছে তার প্রবণতা সাম্প্রতিক নয়। পত্রিকাটি লিখেছে, ‘বাংলাদেশের আদালত উত্তরোত্তর সরকারসংশ্লিষ্ট বিষয়ে উদাসীন হয়ে পড়ছে। তিনি হবেন এক সাহসী বিচারক, যিনি তাঁর পদোন্নতি বরবাদ হওয়ার ঝুঁকি নিয়ে ইউনূসের সমর্থনে কোনো আদেশ দেবেন।’
এক নোবেলজয়ীকে কুপোকাত করতে রাষ্ট্র ও তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী উভয়ে আরেক নোবেলজয়ীর ওপর ভর করেছেন। ইউনূসকে অনির্দিষ্ট মেয়াদে ব্যাংকে রাখতে রেহমান সোবহান ব্যাংকের বোর্ড সভায় যথার্থ যুক্তি দেন। আদালতে রাষ্ট্রের আইনজীবী তাঁকে কটাক্ষ করেন। ‘দুই বিঘা জমি’ থেকে বলেন, ‘বাবু যতো বলে পারিষদ-দলে বলে তার শতগুণ।’ আর দীপু মনি সংবাদ সম্মেলনে আবৃত্তি করেন রবীন্দ্রনাথ। বয়সটাই যে আইনি বাধা, সেটাই তিনি বোঝান। তাঁর সুন্দর বচন শুনে মনে হবে, আহা! সরকার চক্ষুষ্মান, কিন্তু আইনের চোখ তো অন্ধ। দীপু মনি বলেন, ‘সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালোবাসিলাম, সে কখনো করে না বঞ্চনা’।
আমার বিশ্বাস, রাষ্ট্রে যোগ্যতম লোকের নেতৃত্বই ভোটাধিকার-অসেচতন সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবনমান বাড়াবে। ক্ষুদ্রঋণ অন্যতম হাতিয়ার মাত্র। তবে এখন সত্য কী? সরকারি প্রচারযন্ত্র কোটি কোটি টাকা তছরুপের গল্প শোনাচ্ছে। আমরা তা সত্য বলে বিশ্বাস করি না। শ্রদ্ধেয় রবীন্দ্রগবেষক আহমেদ রফিককে সত্য বলে বিশ্বাস করি। শনিবার তিনি আমাকে বললেন, ক্ষুদ্রঋণের পথিকৃৎ নোবেল বিজয়ী রবীন্দ্রনাথ। ইউনূসের ঋণদানের ৭৫ বছর আগের কথা। ১৯০৫ সাল। পতিসরে কৃষি ব্যাংক বসে। রবীন্দ্রনাথ শতকরা আট শতাংশ সুদে ঋণ নিতেন। কৃষকদের দিতেন চার শতাংশ বেশি সুদে। নোবেল পুরস্কারের অর্থের সিংহভাগ (এক লাখ ১২ হাজার টাকা) তিনি ওই ব্যাংকে জামানত রেখেছিলেন। জমিদার রবীন্দ্রনাথকে কেউ ‘রক্তচোষা’ বলেছিল কি না জানি না। তবে রবীন্দ্রনাথ কিন্তু ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতা রচনা করেছিলেন পতিসরেই, হয়তো কোনো উপেনের জমি কেড়ে নেওয়ার ঘটনা তাঁকে বিচলিত করেছিল।
আমি বড় রসসিক্ত হলাম। বৃৃহস্পতিবার সকালে দেখি আদালতে ইউনূসকে জব্দ করতে রবীন্দ্রনাথ, পরদিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে রবীন্দ্রনাথ। ইউনূসকে ‘গরিবের রক্তচোষা’ বলার ধরন দেখে হাসি পায়। রাজনীতিকদের দুর্নীতিগ্রস্ত বলেছিলেন তিনি। হঠাৎ আইন ‘আপন গতি’ নেয়। তাঁর বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন আদালতে স্বতঃস্ফূর্ত মামলার হিড়িক পড়েছিল। এসবের একটা সমুচিত প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে ক্ষুদ্রঋণ-গুরু রবীন্দ্রনাথকেই ধ্যান করি।
আদালতকক্ষে ড. ইউনূসের ঠিক পেছনে বসেছিলাম। রাষ্ট্র যখন বলল, ইউনূস ‘ধানাইপানাই’ করেছেন, সরকারের ৬০ ভাগ মালিকানা কমিয়ে ২৫ ভাগ করেছেন, তখন ইউনূসের এক পরিহাসসূচক অভিব্যক্তি চোখে পড়ে। পরম করুণাময়ের কাছে প্রার্থনা করি, গ্রামীণ ব্যাংক যেন কখনো আদমজীতে পরিণত না হয়। ড. ইউনূস রবীন্দ্রনাথেই সান্ত্বনা পেতে পারেন: ‘বাবু কহে হেসে, বেটা সাধুবেশে পাকা চোর অতিশয়!’ আমি শুনে হাসি, আঁখিজলে ভাসি, এই ছিল মোর ঘটে—তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
ড. ইউনূস নোবেল জিতেছিলেন বলে কি রুষ্ট হন শেখ হাসিনা? ইউনূস দল গঠনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সেসব অন্যতম উপসর্গ। আসল রোগ নয়। গ্রামবাংলায় বিরল, যেখানে একজন মানি লোক আছেন যিনি স্থানীয় দলীয় এজেন্ট বা মাস্তানকে কুর্নিশ করছেন না, সেলাম ঠুকছেন না, ভেট-ভোট দিচ্ছেন না। নিরীহ নাগরিকের সর্বজনশ্রদ্ধেয় হয়ে ওঠার পরিবেশ তৈরি করে দিচ্ছে না রাষ্ট্র। রাষ্ট্রযন্ত্র শুধু মেধা ও প্রজ্ঞার জন্য কাউকে কুর্নিশ করছে এমনটা কোথাও নেই। আত্মমর্যাদাসম্পন্ন বহু ব্যক্তির বিকাশ ও সহাবস্থান আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি বেশি দিন ধারণ করতে পারে না। আমাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অনেকেই সামন্ত আমলের জমিদারের মতো। তাঁরা দেশটাকে নিজের জমিদারি মনে করেন। অজ্ঞতা ও স্বেচ্ছাচারিতা তাঁদের ধর্ম। আমরা তাকে কখনো জাতীয়তাবাদী, কখনো সাম্রাজ্যবাদবিরোধী চিহ্নিত করে আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তুলি। তাঁরা সংবিধান ও গণতন্ত্রের লেবাস বেশিক্ষণ গায়ে চাপিয়ে রাখতে পারেন না। অভ্যাস নেই। অস্বস্তি লাগে। তাই হঠাৎ হঠাৎ লেবাসটা খসে পড়ে।
ড. ইউনূসের ছায়াটা আরও প্রকাণ্ড হয়ে উঠেছিল। বিশ্ববাঙালি হওয়ার পথে তাঁর ছায়াটা দীর্ঘতর হচ্ছিল। কিন্তু তা ব্যক্তির পূজায় লাগছিল না। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ ও অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীর অসম্মানজনক অন্তর্ধানের কারণও ওই একই সুতোয় গাঁথা। আমিই শক্তি, নৈবেদ্য আমারই প্রাপ্য। প্রশ্নটা নিরঙ্কুশ আনুগত্যের। একইভাবে ড. কামাল হোসেনকে ‘বস্তি থেরাপি’ দেওয়া হয়েছিল। এভাবে আমরা আমাদের ইতিহাসে এটা দেখব যে—কি সামরিক কি বেসামরিক—একজন ব্যক্তিকে আমরা আরাধনার পাত্রে পরিণত করি। আর তাঁকে ঘিরে অন্য সবার অনন্ত আরাধনা আশা করি। অনেক জ্ঞানীগুণী তাই বড় দলে ভাত পান না। হারিস চৌধুরী ও মোসাদ্দেক আলী ফালুর মতো মাপের ব্যক্তি ভাত পান। তাঁরাই রাজনৈতিক উপদেষ্টা বা উপদেষ্টা হন। কিচেন ক্যাবিনেটে মোসাহেবদের রোশনাই বরাবর।
হাইকোর্টে শুনানি শুনছিলাম। রাষ্ট্রের ধাতব কণ্ঠ শুনলাম। রাষ্ট্র বলছে, মোদ্দা কথা, এটা বয়সের ব্যাপার। বয়সগত একটা সর্বজনীন ব্যাপার আছে। সবচেয়ে হাস্যকর ও ঠুনকো যুক্তি। আমরা ব্যক্তির জন্য সংবিধান তাঁর পায়ের মাপে করে নিতে ওস্তাদ জাতি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হবেন প্রধানমন্ত্রী, তাই একমাত্র প্রধানমন্ত্রীর হাতেই নির্বাহী ক্ষমতা সমর্পিত হলো। মুজিব হবেন রাষ্ট্রপতি, তাই সংবিধানে লেখা হলো, ধরে নিতে হবে যেন তিনি রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলেন। সামরিক ফরমানের যুগেও যেই লাউ সেই কদু। জিয়া সিএমএলএ থাকবেন, রাষ্ট্রপতি হওয়ার বাসনাও পুর্ণ করবেন। সেভাবে ফরমান পয়দা হলো। বিচারপতি সাত্তারের জন্য ষষ্ঠ সংশোধনী ও বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের জন্য আমরা একাদশ সংশোধনী পাস করেছি। বিচারপতি কে এম হাসানের জন্য এল ১৪তম সংশোধনী। এর আগে বয়সের ফাঁদ পেতে প্রধান বিচারপতি বধ করেন ‘বিশ্ববেহায়া’ এরশাদ। ড. ইউনূসের মতো প্রধান বিচারপতি কামাল উদ্দিন হোসেন আকস্মিক ‘নো-বডি’ হন।
আমরা আইনের চোখে (অ)সমতা নিশ্চিত করা জাতি। সে জন্য আমরা ইউনূসকে ‘নিয়মিত কর্মকর্তার’ ঊর্ধ্বে তুলিনি। তবে তাঁকে স্বপদে বহাল রাখতে সংবিধান সংশোধনের দরকার ছিল না। বড়জোর এক লাইনের একটি বাক্য দরকার ছিল। গ্রামীণ ব্যাংকে বিকল্প নেতৃত্ব কিংবা ক্ষুদ্রঋণ পুঁজিবাদকে প্রশ্রয় দেয় কি দেয় না; দারিদ্র্যকে, সাম্রাজ্যবাদকে মহান করল কি না সেসব বিতর্ক এখন অবান্তর। তাঁকে অপমান করার মনোভঙ্গিই প্রকট। পুরো বিষয়টি আপাদমস্তক সামন্ততান্ত্রিক।
ইউনূস একা নন। এই সমাজে আরও অনেক ইউনূস রয়েছেন, যাঁরা ভিন্নমতাবলম্বী। তাঁরা দাসখত দিতে রাজি নন, তাঁদের প্রতি এই সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছে।
আদালতে ড. কামাল হোসেন বলছিলেন, ‘যদি ব্যাংকের স্বার্থ দেখার কথা বলা হয়, তাহলে একজন সিইও (চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার) পেতে হবে। এ জন্য বিজ্ঞাপন দিয়েও ইউনূসের চেয়ে যোগ্য কাকে মিলবে?’ জবাবে রাষ্ট্র মশকরা করেছে। কিংবা মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে ‘কঠিন সত্য’। আমাদের রাষ্ট্র বলল, নেলসন ম্যান্ডেলা দ্বিতীয় মেয়াদে রাষ্ট্রপতি হননি। সোনিয়া গান্ধী শত অনুরোধেও প্রধানমন্ত্রী হননি। জ্যোতি বসুও প্রধানমন্ত্রী হননি। অথচ এর কোনোটাই ইউনূসের জন্য খাটে না। খাটে বরং তাঁদের জন্য, যাঁরা এই রাষ্ট্রের খেয়ে-পরে এই রাষ্ট্রের গণতন্ত্রের মাথা খাচ্ছে, অমরত্বের দাবি নিয়ে একই পদে গদিনশিন থাকছে—তিন দশকের বেশি সময় ধরে। আমরা হয়ে আছি চিন্তার ক্রীতদাস। দুই নেত্রী দলীয় গদি ছাড়লে তাঁদের দল কয় টুকরা হবে, সে উত্তর পাওয়া কঠিন কিছু নয়।
ম্যান্ডেলা ৭৬ বছর বয়সে রাষ্ট্রপতি হন। ৮১-তে দ্বিতীয়বার হতে চাননি। ৮৬ বছর বয়সেও মুখ্যমন্ত্রী থাকা জ্যোতি বসু ও সোনিয়ার প্রধানমন্ত্রী না হওয়ার সঙ্গে ইউনূস তুলনীয় নন। কলকাতার দৈনিক টেলিগ্রাফ এক সম্পাদকীয়তে ইউনূসকে তালিম দিয়েছে। তারা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যে, রতন টাটা (৭৫) আগামী বছর অবসর নেবেন। বাংলাদেশের বাজেটের চেয়ে বড় বাজেটের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিশ্বে অনেক আছে। সেসব সংস্থার তুখোড় সিইও হিসেবে বিশ্বে এখন অন্তত এক ডজন ব্যক্তি আছেন যাঁরা বয়সে সত্তরোর্ধ্ব। রুপার্ট মারডক আশিতেও বাসি নন। তাহলে ৭০ পেরোনো ইউনূসের জন্য বয়স বাধা হবে কেন?
আমরা আক্রান্ত ‘আমি’ নামক শব্দদূষণে। ‘আমি’, ‘আমি’, ‘আমি’। ‘আমি’ এটা করেছি। ‘আমার সরকার‘ এটা করেছে। ‘আমি’ দেশের জন্য এটা করব, ওটা করব। ‘আমরা’ আমাদের সংস্কৃতিতে নেই। সে কারণে আমরা বিশেষ দুই ব্যক্তির নেতৃত্ব মানলাম। স্রেফ অধিকতর যোগ্যতার কারণে কাউকে নেতা মানা আমাদের স্বভাবে নেই। অথচ আমরা একই সঙ্গে যোগ্যতা, শিক্ষা ও মেধার কথা বলি। সসম্মানে আমরা কাউকে বিদায় দেওয়া ভুলছি। ধারণা করি, বিদায় সংবর্ধনার কার্ডই সবচেয়ে কম ছাপা হয়। এই সংস্কৃতি ক্রমশ আরও নিম্ন ও পশ্চাদমুখী। ‘যেতে নাহি দেব হায়, তবু যেতে দিতে হয়’—এ পঙিক্ত প্রায় অনুচ্চারিত। আমরা যে যেখানে আছি, বিদায় কেউ সহজে নিতে চাই না। দিতেও চাই না।
গত বছর অর্থমন্ত্রীকে লেখা একটি চিরকুট ছাপা হয়েছে পত্রিকায়। তাতে দেখি, ইউনূস মসৃণ ক্রান্তিকাল চেয়েছেন। ক্রান্তিকালের আভিধানিক অর্থ হলো, একপর্যায় থেকে অন্য পর্যায়ে উত্তরণের মধ্যবর্তী সময়। এই সামন্ত মুলুকের ক্রান্তিকাল তো যায় না।
ইউনূস শেষতক দল করতে উৎসাহ পাননি। অথচ আমরা বিকল্প শক্তির কথা বলি। বিকল্প শক্তির উত্থান না দেখে হা-পিত্যেশ করি। আবার কেউ এগিয়ে এলে, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষিত হলে, এই আমরাই অদ্ভুত আচরণ করি। বাম-ডান যা-ই হোক, সর্বাগ্রে মতলব খুঁজি। ইউনূসকেও আমরা পত্রপাঠ অবিশ্বাস করেছি। সন্দেহ করেছি। সেটা কি অসময়ের কারণেই? সময় কবে আসবে? পাশ্চাত্য ঠেকাতে আমরা নাকি দুই নেত্রীকে বাগে রাখতে পারি। বেশি শিক্ষিত ও বিদেশি লাইন থাকা ইউনূসকে আমরা বাগে রাখতে পারব না। তাই অনেকেই তাঁকে গাছে তুলে মই সরিয়ে নেন। মাত্র চার বছর আগে ড. ইউনূস বলেছিলেন, ‘আমি নিজেকে রাজনৈতিক দল গঠন থেকে দূরে সরিয়ে নিচ্ছি। কারণ, গোড়াতে যাঁরা আমাকে এ কাজে উৎসাহ জুগিয়েছিলেন, তাঁদের উৎসাহে ভাটির টান পড়েছে।’ তিনি আরও স্বীকার করেছিলেন, জরুরি অবস্থা জারি না হলে তিনি রাজনীতিতে নামার কথা ভাবতেন না। সামরিক শাসনে আমরা তথাকথিত বহুদলীয় গণতন্ত্র পেয়েছি। আওয়ামী লীগের পুনর্জন্ম দেখেছি। সম্ভাবনাময় কেউ যদি এখন দল করেন, যাঁরা কল্পনা তৈরি করতে পারেন, তাহলে তাঁরা মার খাবেন। আমরা তাঁদের পিটিয়ে তক্তা বানাব। কারও না কারও এজেন্ট বলব।
সেই কল্পনাটা কী? আগামী সাধারণ নির্বাচন হবে। কিন্তু সেখানে আর দুটি সম্ভাবনা থাকবে না। মানুষ বাজি ধরবে না নির্দিষ্ট দুটো প্রতীকে। নৌকা ও ধানের শীষ ছাড়াও নতুন দল দাঁড়াবে। কিংবা ওই দুই দলের নেতৃত্বে বড় পরিবর্তন আসবে। যোগ্যতাসম্পন্নরা মনোনায়ন পাবেন। ছোট দলের অনেক গুণী লোক আফসোস করেন, বড় পত্রিকা তাঁদের বক্তব্য ছাপে না। কারণটা বাণিজ্যিক। জায়গা দিয়ে লাভ কী? খামোখা কে জায়গা নষ্ট করে! কারও তো মুরোদ নেই দাবার ছক পাল্টানোর। গরিবের পেটে ঋণ সয়, ঘি সয় না। আমরা কোনো ব্যক্তি বা ছোট দলকে সম্ভাবনাময় মনে করি না। সেভাবে কেউ গড়ে উঠুক, তাও চাই না। দুই বড় দল নিয়েই থাকি। কিন্তু সেখানে দুই ব্যক্তির বাইরে সম্ভাবনাময় অন্য কেউ আছেন কি? আমরা সে চিন্তা করতেও ভুলে গেছি।
আমরা কী অবলীলায় সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদের পূজারি বানালাম ইউনূসকে। তাই দ্রুতই তাঁর অবস্থা দাঁড়াল, ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি। আমরা তাঁকে তিরস্কার করলাম। পুরস্কার আমরা তাঁকে দিইনি। আমরা কতটা হীনম্মন্য, তাঁর নোবেল শান্তি পুরস্কার কেড়ে নিতে বলেছি। আজ জন কেরি ও মরিয়ার্টির প্রতিবাদের ভাষা আমাদের জাতীয় প্রতিবাদের নিনাদকে যেন ছাপিয়ে যাচ্ছে। আমাদের চেনা শাসকগোষ্ঠী এতটাই পরীক্ষিত যে, তাঁরা নাকি ‘পুঁজিবাদে’র দোসর নন। অথচ আফগানিস্তানে যুদ্ধ করতে বাংলাদেশ ভাড়া নিতে হামিদ কারাজাই লাগেনি। গ্যাস-তেলের চুক্তি আমরা জানতেও পারি না। চটজলদি ইউনূস যখন বিদায় নিলেন, তখন দুই বড় দলই অভিনন্দন জানাল। আপদ বিদায় নিয়েছে বলে তারা উভয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। বিএনপির নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ইউনূসের অপসারণকে প্রতিহিংসামূলক বলে প্রত্যাশিত বিবৃতি দিয়েছেন। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্কের জায়গাটি কি স্পষ্ট করবে বিএনপি?
ব্যাংকার ইউনূসকে আমরা এই সমাজে ৩০ বছর বাঁচতে দিয়েছি। একজন রাজনীতিক ইউনূসকে ২০০৭ সালে আমরা বাঁচতে দিয়েছি মাত্র ৬৮ দিন। সেই দিনগুলোও অবশ্য টেস্টটিউবেই কেটেছে। ময়দান তাঁকে দেখেনি। ইউনূস বলেছিলেন, প্রয়োজনে তিনি গ্রামীণ ব্যাংক ছেড়ে রাজনীতিতে নামবেন। ড. কাজী খলীকুজ্জমান বলেছিলেন, গ্রামীণ ব্যাংক ত্যাগ করা তাঁর কখনো সেভাবে হবে না। ব্যাংকে তাঁর প্রচণ্ড প্রভাব, যা রাজনীতিতে ব্যবহার করা সম্ভব। গ্রামীণ ব্যাংকের মোজাম্মেল হক বলেছিলেন, বাংলাদেশে যদি রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির সরকার থাকত, তাহলে তিনি অনেক আগেই রাজনীতিতে আসতেন। সামনের দিনগুলোতে এসব উক্তি আমরা যাচাই করতে পারব।
অনেকের চোখ আদালতের দিকে। কিন্তু প্রশ্নটা আইনগত নয়, একান্তভাবেই রাজনৈতিক। আদালতের সিদ্ধান্তে আমার আগ্রহ নেই। দি ইকোনমিস্ট ২ মার্চ লিখেছে, ‘১৯৯৭ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, প্রফেসর ইউনূস ও তাঁর প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংকের অসাধারণ কাজের জন্য তাঁরা গর্বিত। শান্তিচুক্তির পরে তাঁর ‘পারিষদ-দলের’ মদদে তিনি নোবেল জয়ের স্বপ্ন দেখেন। আর লক্ষ করেন, ইউনূস জনপ্রিয়তায় বিশ্বে তাঁর প্রয়াত পিতাকে ছাড়িয়ে গেছেন। শেখ হাসিনাকে যারা ব্যক্তিগতভাবে জানেন তাঁরা বলেন, এটা তাঁর জন্য তেতো বটিকা গেলা। তাঁর সেই তিক্ততা শত্রুতায় পরিণত হয় যখন নোবেল পাওয়ার পাঁচ মাস পরে তিনি দল গঠনের ঘোষণা দেন। তিনি সন্দেহ করেন তাঁকে সরানোর জেনারেলদের চেষ্টায় তাঁর সায় ছিল।’ সুতরাং অসুখটা সর্বগ্রাসীরূপে রাজনীতিতে। সেই অসুখের সংক্রমণ থেকে এ দেশের কেউ, কোনো প্রতিষ্ঠান বিচ্ছিন্ন নয়। ইকোনমিস্ট আদালত সম্পর্কে যে ভাষ্য দিয়েছে তার প্রবণতা সাম্প্রতিক নয়। পত্রিকাটি লিখেছে, ‘বাংলাদেশের আদালত উত্তরোত্তর সরকারসংশ্লিষ্ট বিষয়ে উদাসীন হয়ে পড়ছে। তিনি হবেন এক সাহসী বিচারক, যিনি তাঁর পদোন্নতি বরবাদ হওয়ার ঝুঁকি নিয়ে ইউনূসের সমর্থনে কোনো আদেশ দেবেন।’
এক নোবেলজয়ীকে কুপোকাত করতে রাষ্ট্র ও তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী উভয়ে আরেক নোবেলজয়ীর ওপর ভর করেছেন। ইউনূসকে অনির্দিষ্ট মেয়াদে ব্যাংকে রাখতে রেহমান সোবহান ব্যাংকের বোর্ড সভায় যথার্থ যুক্তি দেন। আদালতে রাষ্ট্রের আইনজীবী তাঁকে কটাক্ষ করেন। ‘দুই বিঘা জমি’ থেকে বলেন, ‘বাবু যতো বলে পারিষদ-দলে বলে তার শতগুণ।’ আর দীপু মনি সংবাদ সম্মেলনে আবৃত্তি করেন রবীন্দ্রনাথ। বয়সটাই যে আইনি বাধা, সেটাই তিনি বোঝান। তাঁর সুন্দর বচন শুনে মনে হবে, আহা! সরকার চক্ষুষ্মান, কিন্তু আইনের চোখ তো অন্ধ। দীপু মনি বলেন, ‘সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালোবাসিলাম, সে কখনো করে না বঞ্চনা’।
আমার বিশ্বাস, রাষ্ট্রে যোগ্যতম লোকের নেতৃত্বই ভোটাধিকার-অসেচতন সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবনমান বাড়াবে। ক্ষুদ্রঋণ অন্যতম হাতিয়ার মাত্র। তবে এখন সত্য কী? সরকারি প্রচারযন্ত্র কোটি কোটি টাকা তছরুপের গল্প শোনাচ্ছে। আমরা তা সত্য বলে বিশ্বাস করি না। শ্রদ্ধেয় রবীন্দ্রগবেষক আহমেদ রফিককে সত্য বলে বিশ্বাস করি। শনিবার তিনি আমাকে বললেন, ক্ষুদ্রঋণের পথিকৃৎ নোবেল বিজয়ী রবীন্দ্রনাথ। ইউনূসের ঋণদানের ৭৫ বছর আগের কথা। ১৯০৫ সাল। পতিসরে কৃষি ব্যাংক বসে। রবীন্দ্রনাথ শতকরা আট শতাংশ সুদে ঋণ নিতেন। কৃষকদের দিতেন চার শতাংশ বেশি সুদে। নোবেল পুরস্কারের অর্থের সিংহভাগ (এক লাখ ১২ হাজার টাকা) তিনি ওই ব্যাংকে জামানত রেখেছিলেন। জমিদার রবীন্দ্রনাথকে কেউ ‘রক্তচোষা’ বলেছিল কি না জানি না। তবে রবীন্দ্রনাথ কিন্তু ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতা রচনা করেছিলেন পতিসরেই, হয়তো কোনো উপেনের জমি কেড়ে নেওয়ার ঘটনা তাঁকে বিচলিত করেছিল।
আমি বড় রসসিক্ত হলাম। বৃৃহস্পতিবার সকালে দেখি আদালতে ইউনূসকে জব্দ করতে রবীন্দ্রনাথ, পরদিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে রবীন্দ্রনাথ। ইউনূসকে ‘গরিবের রক্তচোষা’ বলার ধরন দেখে হাসি পায়। রাজনীতিকদের দুর্নীতিগ্রস্ত বলেছিলেন তিনি। হঠাৎ আইন ‘আপন গতি’ নেয়। তাঁর বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন আদালতে স্বতঃস্ফূর্ত মামলার হিড়িক পড়েছিল। এসবের একটা সমুচিত প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে ক্ষুদ্রঋণ-গুরু রবীন্দ্রনাথকেই ধ্যান করি।
আদালতকক্ষে ড. ইউনূসের ঠিক পেছনে বসেছিলাম। রাষ্ট্র যখন বলল, ইউনূস ‘ধানাইপানাই’ করেছেন, সরকারের ৬০ ভাগ মালিকানা কমিয়ে ২৫ ভাগ করেছেন, তখন ইউনূসের এক পরিহাসসূচক অভিব্যক্তি চোখে পড়ে। পরম করুণাময়ের কাছে প্রার্থনা করি, গ্রামীণ ব্যাংক যেন কখনো আদমজীতে পরিণত না হয়। ড. ইউনূস রবীন্দ্রনাথেই সান্ত্বনা পেতে পারেন: ‘বাবু কহে হেসে, বেটা সাধুবেশে পাকা চোর অতিশয়!’ আমি শুনে হাসি, আঁখিজলে ভাসি, এই ছিল মোর ঘটে—তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
No comments