চারদিক-দূরে নিঃশব্দে প্রাকৃতজন...by আজাদুর রহমান
পেছনে চেপে বসতেই সালেক সাহেব গিয়ার ফেলে দিলেন—এক, দুই, তিন। দিনাজপুর শহর থেকে রওনা হয়ে বিরলবাজার ফেলে দপ করেই মফস্বল। গাঁয়ের ঘ্রাণ লাগে। পিচ ছেড়ে মেঠোপথে নেমে যাই আমরা। বাঁকা অলি বেয়ে ঘন তুঁতে ছাওয়া সুড়ঙ্গপথ। চারণকবি সালেকের সঙ্গে আগে থেকেই পরিচয় ছিল।
পথের হাঙ্গামা কমে গেলে নিজ থেকেই কথা তুললেন। ‘আগের দিন আর নেই। অনটন আর সামাজিক পোড়নে কমে যাচ্ছে কড়ারা। নিখাদ খেটেল বলে বউ-বাচ্চা সমানতালে খেটে মাটিতেই জীবিকা মিলত আগে। যুগের হাওয়ায় মহাজনরা জমিদারি ছেড়ে দিলেও কিছুকাল বাপ-দাদার কর্ম ধরে মাটিতেই ছিল তারা। কিন্তু আবাদি জমি ভাগে ভাগে চলে গেলে জোন-খাটারও কায়দা থাকে না। অগত্যা ভাতের খোঁজে কে কোথায় চলে গেল! কেউ আবার অন্য জাতের মেয়ে বিয়ে করে সরে পড়ল মূলধারা থেকে। শেষপাতে এসে কোনোমতে টিম টিম করছে আঠারো ঘর।’ একটানে বলে আফসোস করে উঠলেন তিনি, ‘কোথাও আর কড়া নেই। কড়ারা কি হারিয়েই যাবে!’
বাতাসের তোড়ে সব কথা আমি ধরতে পারি না। তবু ‘হ্যাঁ’ ‘হুঁ’ করে গল্পের সুতো ধরে দিই। ততক্ষণে পুরোনো দৃশ্যগুলো পাল্টে যায়। সাইকেলসমেত বালিকার দেখা মিলছে এখন। হদ্দগাঁয়ে এসে আশ্চর্য না হয়ে উপায় নেই! পাউডারমাখা এক নারীকে দেখলাম প্যাডেল মেরে উল্টো দিকে চলে গেল। খোদ শহরে এহেন দৃশ্য একদাগে সহ্য করা না গেলেও এখানে মানানসই, সাদামাটা। গ্রামচোখেও আপত্তি নেই! গর্ত বাঁচিয়ে টালমাটালে এগিয়ে গেলে সাইকেলবালিকা ছবি হয়ে ঢেউয়ে ঢেউয়ে মিলিয়ে গেল।
আমরা দ্বিতীয় তুঁতনলের ছায়াবনে ঢুকে পড়লাম। ঝিনাইকুড়ি গ্রাম মিলল কিলো দুয়েক পর। পিড়ালি তোলা সাত-আটটা মাটির ঘর নিয়ে থ্যাবড়াপাড়া। রুপালি কড়া চিকন সাইজের বেঞ্চ পেতে দিলেন। ১৩-১৪ জন পোলাপান নিয়ে মেয়েলি পরিবেশ। অন্য পাড়ার বাচ্চারা জড়ো হলে যেমন গা টেপাটিপি করে, এরা সে রকম না। এরা কোমরে হাত রেখে কোনাকুনি দাঁড়িয়ে থাকে, কথা শোনে। শুরুতে মহিলারা খোলাসা না হলেও সহজ হতে সময় লাগল না। হাসিমুখে কুশলাদি জানতেই গল্পগুলো সোজা হয়ে মুখ থেকে মুখে লাফাতে লাগল। লাপল কড়া লাঠিতে ইঁদুর ঝুলিয়ে ফেরত এলে সুনিয়া হেসে উঠলেন, ‘আইজ মুসো রান্না হবে।’ মুসো মানে ইঁদুর। কাঁকড়া, শামুক, কুঁচিয়া, কচ্ছপ, ঝিনুক—এগুলোও কম স্বাদের নয়। বৃদ্ধা মোলানি পূজার ডালা সাজাচ্ছিলেন। কাছে এলেন। ধর্মাধর্মের কথা উঠতেই সলিমা কড়া ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, ‘হামাদের এলা পূজার সময়। হামারা দুর্গাপূজা করি না। হামরা কারমা করোয়ে, বিষহরি করোয়ে। এলা হামাদের পূজা। বাপ-দাদারা চোদ্দগুষ্টি ধরে যেভাবোতে করিয়ে হামারাও সেভাবে করিয়ে।’ দুর্গাকে যে তাঁরা আমল দেন না তা নয়। বসন্তকালে বাসন্তীরূপে দুর্গাকে থানে বসিয়ে পূজা করেন তাঁরা। হর শরতে কড়ারা মেতে ওঠেন কারমা পূজার ডালা নিয়ে। বালিতে কলাইয়ের বীজ পুঁতে দিয়ে উপোস করেন। চারা গজালে খিলকদমের ডাল কেটে মাটিতে গাঁথেন। ঢোল-মাদলের দোলে শুরু হয় ঝুমের নাচ। রাতভর আমোদ। পুরো পাড়া তখন দুলতে থাকে হাড়িয়ার নেশায়। আগাম রসদ জোগাড় করতে তাঁরা তাই প্রতিবেশীদের বাড়িতে গিয়ে পালা করে গান গান। ঢোল-করতাল-খঞ্জনি বাজিয়ে নেচে নেচে হাত পাতেন। নেচে নেচেই ফের অন্য বাড়িমুখো হন। রতন কড়া স্মৃতি হাতড়ান, ‘নাচ-গানের জন্যি ট্রেডিং (ট্রেনিং) লাগে, রেসিল (রিহার্সেল) করা লাগে।’ কেমন গান হয় জানতে চাইলে নেপাল কড়া কৃষ্ণকে ঠেলা দেন। কৃষ্ণ লাজুক মুখে নারাজ হলে বাবলি কড়া ঝামটা মারেন, ‘কোসনা ক্যানে ক, ভালো করি ক।’ অগত্যা তিনি নিচু মুখে গান ধরেন। গুন গুন করতে গিয়ে খোলামনে গলা ছেড়ে দেন—
কুলি জাগো, আখড়া জাগো
জাগো রাজবংশী রাজ হো
চিরিবিটি চিরিবিটি পারবতী লো
কুলি জাগো আখড়া জাগো হো...
আমরা গানের মানের জন্য তর্জমা খুঁজি। ‘কুলি’ মানে পাড়া, ‘আখড়া’ মানে আসর। পরে কৃষ্ণ মোদ্দা মানেটা বুঝিয়ে দেন—সবাই জাগো, রাজার মতো জাগো। আসরে যোগ দাও আর ছিটাছিটি হয়ে আনন্দ করো।
সমাজ চলে মহতকে ধরে। মহত জগেন কড়া বাড়িতে ছিলেন না। মাঠ থেকে তিনিও এতক্ষণে বাড়ি ফেরেন। গলি বেয়ে হেঁটে এলে আসরটা নতুন করে মজে ওঠে। রতন বিড়ি ধরালে ছেলেছোকরা বলে আর কোনো কথা থাকে না। প্রায় সবাই দেদার বিড়ি টানতে শুরু করেন। খানিক পরে জগেন রতনের টানা বিড়িটা চেয়ে নেন। মন খোলা রেখেও যে মুরব্বিদের মান্য করা যায়, না এলে বোঝা যেত না। আধখাওয়া বিড়িমুখে জগেন নতুন গল্প তোলেন। বিয়ের গল্প। কনের হাতে দিতে হবে সাতটা শাড়ি, সঙ্গে পুরিয়া সিঁদুর আর কোমর সাজানোর ‘ডারিয়া ঝোপা’। তারপর কলাগাছের মারোয়ায় বাঁদর ঝুলিয়ে তীর-ধনুক ধরিয়ে দিলেই বিয়ের নোটিশ পড়ে যাবে। গাঁয়ের নাপিত বরের আঙুলের চামড়া কেটে রক্ত নিয়ে আতপ চালে মিশিয়ে দেবেন। রক্তমাখা আতপ চাল মহুয়াপাতায় পেঁচিয়ে বাঁধলেই বর পথ ধরবেন। কন্যার আঙুলের রক্ত নিয়েও শাস্ত্রমন্ত্র হবে। বর উঠে পড়বেন দুলাভাইয়ের কাঁধে। ঘাড়ে চড়া ভাবি শ্যালক বরকে খিলিপান খাওয়াবে। বর এবার জোয়ালে দাঁড়িয়ে কনেকে সিঁদুর পরাবেন। খান্দা (দশের খাবার) আর বান্দাপানি (উপহার) দিয়ে শুরু হবে ঝুমের নাচ।
মারোয়ামে ঝুমের নাচ বে
হেরিয়া সবিল মিলকে পি বে।
জগেন কড়া নিরাশ মুখে বসে থাকেন। তিনি কি পারবেন জাতিসত্তাকে জাগিয়ে রাখতে, নাকি সময়ে বিলীন হয়ে যাবে আমাদের প্রাকৃতজনেরা?
বাতাসের তোড়ে সব কথা আমি ধরতে পারি না। তবু ‘হ্যাঁ’ ‘হুঁ’ করে গল্পের সুতো ধরে দিই। ততক্ষণে পুরোনো দৃশ্যগুলো পাল্টে যায়। সাইকেলসমেত বালিকার দেখা মিলছে এখন। হদ্দগাঁয়ে এসে আশ্চর্য না হয়ে উপায় নেই! পাউডারমাখা এক নারীকে দেখলাম প্যাডেল মেরে উল্টো দিকে চলে গেল। খোদ শহরে এহেন দৃশ্য একদাগে সহ্য করা না গেলেও এখানে মানানসই, সাদামাটা। গ্রামচোখেও আপত্তি নেই! গর্ত বাঁচিয়ে টালমাটালে এগিয়ে গেলে সাইকেলবালিকা ছবি হয়ে ঢেউয়ে ঢেউয়ে মিলিয়ে গেল।
আমরা দ্বিতীয় তুঁতনলের ছায়াবনে ঢুকে পড়লাম। ঝিনাইকুড়ি গ্রাম মিলল কিলো দুয়েক পর। পিড়ালি তোলা সাত-আটটা মাটির ঘর নিয়ে থ্যাবড়াপাড়া। রুপালি কড়া চিকন সাইজের বেঞ্চ পেতে দিলেন। ১৩-১৪ জন পোলাপান নিয়ে মেয়েলি পরিবেশ। অন্য পাড়ার বাচ্চারা জড়ো হলে যেমন গা টেপাটিপি করে, এরা সে রকম না। এরা কোমরে হাত রেখে কোনাকুনি দাঁড়িয়ে থাকে, কথা শোনে। শুরুতে মহিলারা খোলাসা না হলেও সহজ হতে সময় লাগল না। হাসিমুখে কুশলাদি জানতেই গল্পগুলো সোজা হয়ে মুখ থেকে মুখে লাফাতে লাগল। লাপল কড়া লাঠিতে ইঁদুর ঝুলিয়ে ফেরত এলে সুনিয়া হেসে উঠলেন, ‘আইজ মুসো রান্না হবে।’ মুসো মানে ইঁদুর। কাঁকড়া, শামুক, কুঁচিয়া, কচ্ছপ, ঝিনুক—এগুলোও কম স্বাদের নয়। বৃদ্ধা মোলানি পূজার ডালা সাজাচ্ছিলেন। কাছে এলেন। ধর্মাধর্মের কথা উঠতেই সলিমা কড়া ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, ‘হামাদের এলা পূজার সময়। হামারা দুর্গাপূজা করি না। হামরা কারমা করোয়ে, বিষহরি করোয়ে। এলা হামাদের পূজা। বাপ-দাদারা চোদ্দগুষ্টি ধরে যেভাবোতে করিয়ে হামারাও সেভাবে করিয়ে।’ দুর্গাকে যে তাঁরা আমল দেন না তা নয়। বসন্তকালে বাসন্তীরূপে দুর্গাকে থানে বসিয়ে পূজা করেন তাঁরা। হর শরতে কড়ারা মেতে ওঠেন কারমা পূজার ডালা নিয়ে। বালিতে কলাইয়ের বীজ পুঁতে দিয়ে উপোস করেন। চারা গজালে খিলকদমের ডাল কেটে মাটিতে গাঁথেন। ঢোল-মাদলের দোলে শুরু হয় ঝুমের নাচ। রাতভর আমোদ। পুরো পাড়া তখন দুলতে থাকে হাড়িয়ার নেশায়। আগাম রসদ জোগাড় করতে তাঁরা তাই প্রতিবেশীদের বাড়িতে গিয়ে পালা করে গান গান। ঢোল-করতাল-খঞ্জনি বাজিয়ে নেচে নেচে হাত পাতেন। নেচে নেচেই ফের অন্য বাড়িমুখো হন। রতন কড়া স্মৃতি হাতড়ান, ‘নাচ-গানের জন্যি ট্রেডিং (ট্রেনিং) লাগে, রেসিল (রিহার্সেল) করা লাগে।’ কেমন গান হয় জানতে চাইলে নেপাল কড়া কৃষ্ণকে ঠেলা দেন। কৃষ্ণ লাজুক মুখে নারাজ হলে বাবলি কড়া ঝামটা মারেন, ‘কোসনা ক্যানে ক, ভালো করি ক।’ অগত্যা তিনি নিচু মুখে গান ধরেন। গুন গুন করতে গিয়ে খোলামনে গলা ছেড়ে দেন—
কুলি জাগো, আখড়া জাগো
জাগো রাজবংশী রাজ হো
চিরিবিটি চিরিবিটি পারবতী লো
কুলি জাগো আখড়া জাগো হো...
আমরা গানের মানের জন্য তর্জমা খুঁজি। ‘কুলি’ মানে পাড়া, ‘আখড়া’ মানে আসর। পরে কৃষ্ণ মোদ্দা মানেটা বুঝিয়ে দেন—সবাই জাগো, রাজার মতো জাগো। আসরে যোগ দাও আর ছিটাছিটি হয়ে আনন্দ করো।
সমাজ চলে মহতকে ধরে। মহত জগেন কড়া বাড়িতে ছিলেন না। মাঠ থেকে তিনিও এতক্ষণে বাড়ি ফেরেন। গলি বেয়ে হেঁটে এলে আসরটা নতুন করে মজে ওঠে। রতন বিড়ি ধরালে ছেলেছোকরা বলে আর কোনো কথা থাকে না। প্রায় সবাই দেদার বিড়ি টানতে শুরু করেন। খানিক পরে জগেন রতনের টানা বিড়িটা চেয়ে নেন। মন খোলা রেখেও যে মুরব্বিদের মান্য করা যায়, না এলে বোঝা যেত না। আধখাওয়া বিড়িমুখে জগেন নতুন গল্প তোলেন। বিয়ের গল্প। কনের হাতে দিতে হবে সাতটা শাড়ি, সঙ্গে পুরিয়া সিঁদুর আর কোমর সাজানোর ‘ডারিয়া ঝোপা’। তারপর কলাগাছের মারোয়ায় বাঁদর ঝুলিয়ে তীর-ধনুক ধরিয়ে দিলেই বিয়ের নোটিশ পড়ে যাবে। গাঁয়ের নাপিত বরের আঙুলের চামড়া কেটে রক্ত নিয়ে আতপ চালে মিশিয়ে দেবেন। রক্তমাখা আতপ চাল মহুয়াপাতায় পেঁচিয়ে বাঁধলেই বর পথ ধরবেন। কন্যার আঙুলের রক্ত নিয়েও শাস্ত্রমন্ত্র হবে। বর উঠে পড়বেন দুলাভাইয়ের কাঁধে। ঘাড়ে চড়া ভাবি শ্যালক বরকে খিলিপান খাওয়াবে। বর এবার জোয়ালে দাঁড়িয়ে কনেকে সিঁদুর পরাবেন। খান্দা (দশের খাবার) আর বান্দাপানি (উপহার) দিয়ে শুরু হবে ঝুমের নাচ।
মারোয়ামে ঝুমের নাচ বে
হেরিয়া সবিল মিলকে পি বে।
জগেন কড়া নিরাশ মুখে বসে থাকেন। তিনি কি পারবেন জাতিসত্তাকে জাগিয়ে রাখতে, নাকি সময়ে বিলীন হয়ে যাবে আমাদের প্রাকৃতজনেরা?
No comments