ইসরাইলের আগ্রাসী নীতির নেপথ্যে by আহমেদ জামিল
ফিলিস্তিনিদের ওপর ইহুদিবাদী ইসরাইলের আগ্রাসী তত্পরতা হঠাত্ করে বেড়ে গেছে। সেই সঙ্গে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে স্বাধীন-সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনাও। এর পাশাপাশি অব্যাহত রয়েছে ফিলিস্তিনি এলাকায় অবৈধ ইহুদি বসতি নির্মাণের প্রয়াস ও উদ্যোগ।
এর জন্য দায়ী মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার প্রশাসন। শুরুতে তারা মধ্যপ্রাচ্য নীতি তথা ইসরাইল-ফিলিস্তিন ইস্যুতে একটা ভারসাম্যপূর্ণ নীতি অনুসরণ করলেও, এখন তা থেকে অনেকখানি সরে এসেছে। পূর্বসূরিদের মতো বারাক ওবামার প্রশাসনও ইসরাইল ঘেঁষা নীতি অনুসরণ করতে শুরু করেছে। মূলত: ওবামা প্রশাসনের নীতি অবস্থান পরিবর্তনের কারণে ইসরাইল আরও সাহসী হয়ে উঠেছে। যে কারণে গাজায় শুধু হামাস নয়, ইসরাইলের প্রতি অপেক্ষাকৃত নরমপন্থী হিসেবে পরিচিত ফাতাহ্’র সশস্র শাখা আল আকসা মার্টারস ব্রিগেডের ওপরও বেপরোয়া সামরিক হামলা চালাচ্ছে। অথচ মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই মুসলিম জাহানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের অংশ হিসেবে ইতিবাচক মধ্যপ্রাচ্য নীতি গ্রহণ করে প্রশংসা অর্জন করেছিলেন। গত বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক হোসেন ওবামা ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতা নিয়াহু এবং ফিলিস্তিন স্বশাসন কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক করেন। প্রেসিডেন্ট ওবামা দু’পক্ষকে শান্তি প্রক্রিয়া নতুন করে শুরু করার জন্য দু’ নেতার ওপর চাপ সৃষ্টি করেন। বিশ্লেষকদের কারও কারও অভিমত, পূর্বসূরি জর্জ ডব্লিউ বুশের মতো প্রেসিডেন্ট ওবামা মধ্যপ্রাচ্য সংঘাতকে কোনোভাবেই অবজ্ঞা করতে চান না।
বাহ্যিকভাবে হলেও প্রেসিডেন্ট ওবামা মধ্যপ্রাচ্যে কিছুটা ভারসাম্যপূর্ণ কূটনীতির কৌশল নিতে চেয়েছেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট ওবামা গত বছরের জানুয়ারিতে ক্ষমতায় আসার পরই মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রতিষ্ঠাকে তার প্রধান অগ্রাধিকার বলে ঘোষণা করেন। এর কারণ হলো প্রেসিডেন্ট ওবামা মুসলিম জাহান বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হৃত-ইমেজ পুনরুদ্ধার করতে চাচ্ছেন। প্রেসিডেন্ট ওবামা এ সত্য উপলব্ধি করতে পেরেছেন যে, অতি ইসরাইল ঘেঁষা নীতির কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আরব এবং বেশিরভাগ মুসলিম দেশে তার গ্রহণযোগ্যতা সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে ফেলেছে। আর এই সুযোগকে কাজে লাগাতে তত্পর হয়ে উঠেছে তাদের জানি দুশমন ইরান। মধ্যপ্রাচ্য তথা আরব জাহানে ইরানের ক্রমবর্ধমান প্রভাব বৃদ্ধিতে উদ্বিগ্ন ওয়াশিংটন এবং পেন্টাগন।
যে কারণে ওবামা প্রশাসন চাইছে মধ্যপ্রাচ্য সঙ্কটের দ্রুত সমাধান। এরই প্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট ওবামা প্রতিরক্ষামন্ত্রী রবার্ট গেটস, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেমস জোনস এবং মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশেষ মার্কিন দূত জর্জ মিচেলকে মধ্যপ্রাচ্য সফরে পাঠিয়েছিলেন। এমনকি একই উদ্দেশ্যে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনও মধ্যপ্রাচ্য সফরে গিয়েছিলেন। কিন্তু ওবামা, নেতানিয়াহু এবং আব্বাসের ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের মতোই বিশিষ্ট মার্কিন কর্মকর্তাদের ওইসব সফর ও বৈঠকও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে ইসরাইল কর্তৃক দখলকৃত এলাকায় ইহুদি বসতি নির্মাণ ও সম্প্রসারণের প্রশ্নে ইসরাইল সরকারের একগুঁয়েমিপনা ও অনমনীয়তার কারণে। অধিকৃত এলাকায় বসতি স্থাপন আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লংঘন।
ওবামা প্রশাসন এবং ইইউ-এর তরফ থেকে বসতি নির্মাণ ও সম্প্রসারণ বন্ধে ইসরাইল সরকারকে বার বার তাগাদা দেয়া সত্ত্বেও তেলআবিব তার প্রতি কোনো কর্ণপাতই করছে না। যা হোক, ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের সময় প্রেসিডেন্ট আব্বাস ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতা নিয়াহুর উদ্দেশে রোডম্যাপ নামে পরিচিত মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রক্রিয়ার প্রতি যথাযথ সম্মান দেখানো এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অনুযায়ী ১৯৬৭ সালের সীমান্ত বরাবর বসতি প্রত্যাহার করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী এ আহ্বান প্রত্যাখ্যান করায় মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রক্রিয়ায় অচলাবস্থা বহাল থাকে। এ মুহূর্তে ফিলিস্তিন ও ইসরাইল শান্তি প্রক্রিয়া থমকে আছে ফিলিস্তিনি এলাকায় ইহুদি বসতি নির্মাণকে কেন্দ্র করে।
ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ক্ষমতায় বসার পরপরই কোনো রাখঢাক না করে সরাসরি জানিয়ে দিয়েছিলেন; পশ্চিম তীর, গাজা উপত্যকার অধিকৃত ভূ-খণ্ডে এবং পূর্ব জেরুজালেমে ২০০৫ সাল থেকে শুরু করা ইহুদি বসতি কখনই সরানো হবে না। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী ৬ মাস বসতি নির্মাণ কাজ স্থগিতের প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবে তা মানা হচ্ছে না। শুধু তাই নয়, যে পূর্বজেরুজালেমকে ভবিষ্যত্ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানী করার কথা ঘোষণা করেছে ফিলিস্তিন স্বশাসন কর্তৃপক্ষ, সেখানেও সমানতালে চলছে ইহুদি বসতি নির্মাণ কাজ। প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, ইসরাইল ইতোমধ্যে অধিকৃত জেরুজালেমে ৯০০ বাড়ি নির্মাণ করার উদ্যোগ নিয়েছে। ইসরাইল এই বেআইনি কাজ করছে মানবাধিকার লংঘন করে। একটি ইসরাইলি মানবাধিকার সংস্থা জানিয়েছে, ইসরাইল ফিলিস্তিনিদের বাড়ি-ঘর থেকে তাড়ানোর হিংস্র নীতি আগের মতোই বহাল রেখেছে।
ওই মানবাধিকার সংস্থাটির মতে, গত বছরই ইসরাইল পূর্বজেরুজালেম থেকে বিপুলসংখ্যক ফিলিস্তিনিকে তাদের পৈতৃক বসতবাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। অর্থাত্ ইসরাইল ৪ হাজার ৫৭০ জন ফিলিস্তিনিকে তাদের নিজস্ব ঘর-বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করেছে। উল্লেখ্য, এ নিয়ে ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের সময়ে পূর্ব জেরুজালেমের মোট ফিলিস্তিনির এক-তৃতীয়াংশ মানুষকে ইসরাইল ঘর-বাড়ি থেকে বিতাড়িত করেছে। অন্যদিকে গাজায় ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ সংগঠন হামাসকে দমনের নামে ইসরাইল যে ব্যাপক গণহত্যাযজ্ঞ ও মানবাধিকার লংঘন করেছে তার নানা লোমহর্ষক তথ্য এখন বেরিয়ে আসছে। সম্প্রতি জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদে যুদ্ধাপরাধ বিষয়ে গোল্ড স্টোন রিপোর্ট অনুমোদিত হওয়াকে ফিলিস্তিনিদের জন্য নৈতিক বিজয় হিসেবে দেখা হচ্ছে। গোল্ড স্টোন রিপোর্টের ‘ইসরাইল ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ করেছে’ বলার পাশাপাশি হামাসের বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ আনা হয়েছে। এই রিপোর্ট প্রকাশের ফলে ইসরাইলের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বেড়েছে। আর ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু যুদ্ধাপরাধ সংক্রান্ত জাতিসংঘ রিপোর্টের বিরুদ্ধে লড়ার ঘোষণা দিয়েছেন।
এদিকে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু শর্তসাপেক্ষে যে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের কথা বলেছেন তার থাকবে না নিজস্ব কোনো প্রতিরক্ষাবাহিনী এবং পররাষ্ট্রনীতি। অর্থাত্ নামমাত্র স্বাধীন এ রাষ্ট্রের থাকবে না প্রকৃত কোনো সার্বভৌমত্ব। ইসরাইলের করুণার ওপর টিকে থাকতে হবে অনেকটা আশ্রিত এই ভবিষ্যত্ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রটিকে। ইসরাইল আন্তর্জাতিক নিয়মনীতি লংঘন করে এ ধরনের ধৃষ্টতা প্রদর্শন করে চলেছে মার্কিন প্রশাসনের নমনীয় অবস্থান ও নেপথ্য আস্কারা পেয়ে।
প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার প্রশাসন শুরুতে মধ্যপ্রাচ্য শান্তির স্বার্থে ইসরাইলের ওপর বেশ চাপ সৃষ্টি করলেও, পরে যুক্তরাষ্ট্রের ইহুদি লবির প্রবল চাপের মুখে সেই অবস্থান থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়। যে কারণে ওবামা প্রশাসনও ইসরাইলের ব্যাপারে তার পূর্বসূরিদের নীতিই অনুসরণ করতে শুরু করেছে। আর এ নীতি হলো ইসরাইলের স্বার্থের পক্ষে এবং আরব তথা ফিলিস্তিনিদের স্বার্থের বিপক্ষে। যার প্রমাণ মেলে অতি সম্প্রতি মার্কিন কংগ্রেসের প্রভাবশালী ডেমোক্রেট সিনেটর ট্রেড কাফম্যান জেরুজালেমে সংবাদ সম্মেলনে। তিনি জানিয়েছেন, ইসরাইলের সম্মতি ছাড়া নিরাপত্তা পরিষদের কাছে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের স্বীকৃতি আদায়ের প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্র ভেটো দেবে।
এর আগে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন জেরুজালেমে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে বৈঠকে ‘মধ্যপ্রাচ্য শান্তি আলোচনার জন্য বসতি স্থাপন বাধা নয়’ মন্তব্যের জেরে ফিলিস্তিনি ও আরবদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হলে তিনি তার মন্তব্য থেকে সরে আসতে বাধ্য হন। একটি বিষয় স্পষ্ট যে, আরব এবং ফিলিস্তিনিদের মধ্যকার অনৈক্য এবং বেশকিছু আরব রাষ্ট্রের ইরান বিরোধী অবস্থানের সুযোগকে সদ্ব্যবহার করে যাচ্ছে ইসরাইল এবং তার মুরুব্বি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো এবং ফিলিস্তিনিদের মধ্যকার ইস্পাতকঠিন ঐক্যই পারে ইসরাইল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার পরিবর্তন ঘটাতে। যাতে করে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে মোটামুটি ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে।
লেখক : কলেজ শিক্ষক ও কলাম লেখক
বাহ্যিকভাবে হলেও প্রেসিডেন্ট ওবামা মধ্যপ্রাচ্যে কিছুটা ভারসাম্যপূর্ণ কূটনীতির কৌশল নিতে চেয়েছেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট ওবামা গত বছরের জানুয়ারিতে ক্ষমতায় আসার পরই মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রতিষ্ঠাকে তার প্রধান অগ্রাধিকার বলে ঘোষণা করেন। এর কারণ হলো প্রেসিডেন্ট ওবামা মুসলিম জাহান বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হৃত-ইমেজ পুনরুদ্ধার করতে চাচ্ছেন। প্রেসিডেন্ট ওবামা এ সত্য উপলব্ধি করতে পেরেছেন যে, অতি ইসরাইল ঘেঁষা নীতির কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আরব এবং বেশিরভাগ মুসলিম দেশে তার গ্রহণযোগ্যতা সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে ফেলেছে। আর এই সুযোগকে কাজে লাগাতে তত্পর হয়ে উঠেছে তাদের জানি দুশমন ইরান। মধ্যপ্রাচ্য তথা আরব জাহানে ইরানের ক্রমবর্ধমান প্রভাব বৃদ্ধিতে উদ্বিগ্ন ওয়াশিংটন এবং পেন্টাগন।
যে কারণে ওবামা প্রশাসন চাইছে মধ্যপ্রাচ্য সঙ্কটের দ্রুত সমাধান। এরই প্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট ওবামা প্রতিরক্ষামন্ত্রী রবার্ট গেটস, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেমস জোনস এবং মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশেষ মার্কিন দূত জর্জ মিচেলকে মধ্যপ্রাচ্য সফরে পাঠিয়েছিলেন। এমনকি একই উদ্দেশ্যে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনও মধ্যপ্রাচ্য সফরে গিয়েছিলেন। কিন্তু ওবামা, নেতানিয়াহু এবং আব্বাসের ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের মতোই বিশিষ্ট মার্কিন কর্মকর্তাদের ওইসব সফর ও বৈঠকও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে ইসরাইল কর্তৃক দখলকৃত এলাকায় ইহুদি বসতি নির্মাণ ও সম্প্রসারণের প্রশ্নে ইসরাইল সরকারের একগুঁয়েমিপনা ও অনমনীয়তার কারণে। অধিকৃত এলাকায় বসতি স্থাপন আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লংঘন।
ওবামা প্রশাসন এবং ইইউ-এর তরফ থেকে বসতি নির্মাণ ও সম্প্রসারণ বন্ধে ইসরাইল সরকারকে বার বার তাগাদা দেয়া সত্ত্বেও তেলআবিব তার প্রতি কোনো কর্ণপাতই করছে না। যা হোক, ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের সময় প্রেসিডেন্ট আব্বাস ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতা নিয়াহুর উদ্দেশে রোডম্যাপ নামে পরিচিত মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রক্রিয়ার প্রতি যথাযথ সম্মান দেখানো এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অনুযায়ী ১৯৬৭ সালের সীমান্ত বরাবর বসতি প্রত্যাহার করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী এ আহ্বান প্রত্যাখ্যান করায় মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রক্রিয়ায় অচলাবস্থা বহাল থাকে। এ মুহূর্তে ফিলিস্তিন ও ইসরাইল শান্তি প্রক্রিয়া থমকে আছে ফিলিস্তিনি এলাকায় ইহুদি বসতি নির্মাণকে কেন্দ্র করে।
ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ক্ষমতায় বসার পরপরই কোনো রাখঢাক না করে সরাসরি জানিয়ে দিয়েছিলেন; পশ্চিম তীর, গাজা উপত্যকার অধিকৃত ভূ-খণ্ডে এবং পূর্ব জেরুজালেমে ২০০৫ সাল থেকে শুরু করা ইহুদি বসতি কখনই সরানো হবে না। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী ৬ মাস বসতি নির্মাণ কাজ স্থগিতের প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবে তা মানা হচ্ছে না। শুধু তাই নয়, যে পূর্বজেরুজালেমকে ভবিষ্যত্ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানী করার কথা ঘোষণা করেছে ফিলিস্তিন স্বশাসন কর্তৃপক্ষ, সেখানেও সমানতালে চলছে ইহুদি বসতি নির্মাণ কাজ। প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, ইসরাইল ইতোমধ্যে অধিকৃত জেরুজালেমে ৯০০ বাড়ি নির্মাণ করার উদ্যোগ নিয়েছে। ইসরাইল এই বেআইনি কাজ করছে মানবাধিকার লংঘন করে। একটি ইসরাইলি মানবাধিকার সংস্থা জানিয়েছে, ইসরাইল ফিলিস্তিনিদের বাড়ি-ঘর থেকে তাড়ানোর হিংস্র নীতি আগের মতোই বহাল রেখেছে।
ওই মানবাধিকার সংস্থাটির মতে, গত বছরই ইসরাইল পূর্বজেরুজালেম থেকে বিপুলসংখ্যক ফিলিস্তিনিকে তাদের পৈতৃক বসতবাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। অর্থাত্ ইসরাইল ৪ হাজার ৫৭০ জন ফিলিস্তিনিকে তাদের নিজস্ব ঘর-বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করেছে। উল্লেখ্য, এ নিয়ে ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের সময়ে পূর্ব জেরুজালেমের মোট ফিলিস্তিনির এক-তৃতীয়াংশ মানুষকে ইসরাইল ঘর-বাড়ি থেকে বিতাড়িত করেছে। অন্যদিকে গাজায় ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ সংগঠন হামাসকে দমনের নামে ইসরাইল যে ব্যাপক গণহত্যাযজ্ঞ ও মানবাধিকার লংঘন করেছে তার নানা লোমহর্ষক তথ্য এখন বেরিয়ে আসছে। সম্প্রতি জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদে যুদ্ধাপরাধ বিষয়ে গোল্ড স্টোন রিপোর্ট অনুমোদিত হওয়াকে ফিলিস্তিনিদের জন্য নৈতিক বিজয় হিসেবে দেখা হচ্ছে। গোল্ড স্টোন রিপোর্টের ‘ইসরাইল ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ করেছে’ বলার পাশাপাশি হামাসের বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ আনা হয়েছে। এই রিপোর্ট প্রকাশের ফলে ইসরাইলের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বেড়েছে। আর ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু যুদ্ধাপরাধ সংক্রান্ত জাতিসংঘ রিপোর্টের বিরুদ্ধে লড়ার ঘোষণা দিয়েছেন।
এদিকে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু শর্তসাপেক্ষে যে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের কথা বলেছেন তার থাকবে না নিজস্ব কোনো প্রতিরক্ষাবাহিনী এবং পররাষ্ট্রনীতি। অর্থাত্ নামমাত্র স্বাধীন এ রাষ্ট্রের থাকবে না প্রকৃত কোনো সার্বভৌমত্ব। ইসরাইলের করুণার ওপর টিকে থাকতে হবে অনেকটা আশ্রিত এই ভবিষ্যত্ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রটিকে। ইসরাইল আন্তর্জাতিক নিয়মনীতি লংঘন করে এ ধরনের ধৃষ্টতা প্রদর্শন করে চলেছে মার্কিন প্রশাসনের নমনীয় অবস্থান ও নেপথ্য আস্কারা পেয়ে।
প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার প্রশাসন শুরুতে মধ্যপ্রাচ্য শান্তির স্বার্থে ইসরাইলের ওপর বেশ চাপ সৃষ্টি করলেও, পরে যুক্তরাষ্ট্রের ইহুদি লবির প্রবল চাপের মুখে সেই অবস্থান থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়। যে কারণে ওবামা প্রশাসনও ইসরাইলের ব্যাপারে তার পূর্বসূরিদের নীতিই অনুসরণ করতে শুরু করেছে। আর এ নীতি হলো ইসরাইলের স্বার্থের পক্ষে এবং আরব তথা ফিলিস্তিনিদের স্বার্থের বিপক্ষে। যার প্রমাণ মেলে অতি সম্প্রতি মার্কিন কংগ্রেসের প্রভাবশালী ডেমোক্রেট সিনেটর ট্রেড কাফম্যান জেরুজালেমে সংবাদ সম্মেলনে। তিনি জানিয়েছেন, ইসরাইলের সম্মতি ছাড়া নিরাপত্তা পরিষদের কাছে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের স্বীকৃতি আদায়ের প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্র ভেটো দেবে।
এর আগে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন জেরুজালেমে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে বৈঠকে ‘মধ্যপ্রাচ্য শান্তি আলোচনার জন্য বসতি স্থাপন বাধা নয়’ মন্তব্যের জেরে ফিলিস্তিনি ও আরবদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হলে তিনি তার মন্তব্য থেকে সরে আসতে বাধ্য হন। একটি বিষয় স্পষ্ট যে, আরব এবং ফিলিস্তিনিদের মধ্যকার অনৈক্য এবং বেশকিছু আরব রাষ্ট্রের ইরান বিরোধী অবস্থানের সুযোগকে সদ্ব্যবহার করে যাচ্ছে ইসরাইল এবং তার মুরুব্বি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো এবং ফিলিস্তিনিদের মধ্যকার ইস্পাতকঠিন ঐক্যই পারে ইসরাইল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার পরিবর্তন ঘটাতে। যাতে করে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে মোটামুটি ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে।
লেখক : কলেজ শিক্ষক ও কলাম লেখক
No comments