মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি by প্রভাষ আমিন

সম্প্রতি ঢাকা সফর করে গেলেন দক্ষিণ ও মধ্য-এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবার্ট ও ব্লেক। তাঁর এ সফর নিছক একটি সফর ছিল না। তিনি এসেছিলেন ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ব্যাপারে সরকারের সঙ্গে দর কষাকষি করতে। চার দিনের সফরে সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়েছিলেন তিনি।


সেখানে সব ধরনের কূটনৈতিক শিষ্টাচার ও ভদ্রতার মুখোশ খুলে তিনি বলে দিয়েছেন, ড. ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে অপসারণের বিষয়ে সমঝোতা না হলে দুই দেশের সম্পর্কে প্রভাব পড়বে। তিনি এও বলেছেন, গ্রহণযোগ্য সমঝোতা হলে তা পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনকে বাংলাদেশ সফরে আসার ব্যাপারে উৎসাহিত করবে। সফরের প্রথম দিনেও তিনি সমঝোতার সুযোগ রয়েছে বলে উল্লেখ করে বলেছিলেন, এই সমঝোতা দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের উন্নয়নের নিয়ামক হবে। ব্লেকের সফরের শুরু ও শেষের বক্তব্য শুনে মনে হচ্ছে, তাঁর সফর সফল হয়নি। সমঝোতার আশ্বাস পাননি বলেই যাওয়ার আগে রীতিমতো হুমকি দিয়ে গেছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ব্লেকের হুমকিতে মাথা নত করে কি বাংলাদেশ ড. ইউনূসের সঙ্গে সমঝোতা করবে, না কি আইন তার নিজের গতিতে চলবে? আমরাও ড. ইউনূসের সম্মানজনক বিদায় চাই। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের চাপে সমঝোতা হলে তা ড. ইউনূসের জন্য কতটা সম্মানজনক হবে, তা কি ড. ইউনূস নিজে একবার ভেবে দেখেছেন? আর বিষয়টি আদালতে নিয়ে যাওয়ার পর সমঝোতার সুযোগ কতটা আছে, তা নিয়ে সংশয় আছে। রবার্ট ও ব্লেক সাংবাদিকদের বলেননি, কী ধরনের সমঝোতা চান তাঁরা। তাঁরা কি চান প্রধানমন্ত্রী হাইকোর্টের বিচারকদের বলে দিক, ড. ইউনূসের রিটের রায় প্রত্যাহার করে নিতে। না কি মার্কিনিদের হুমকিতে ভয় পেয়ে সব আইন-কানুন সরিয়ে রেখে ৭০ পেরোনো ড. ইউনূসকে আবার গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে বসিয়ে দেওয়া উচিত হবে। না কি ড. ইউনূসের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী তাঁকে গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে বসিয়ে দেওয়া ঠিক হবে? আমি জানি না, কী ধরনের সমঝোতা হলে ড. ইউনূসের বান্ধবী হিলারি ক্লিনটনের মান ভাঙবে, তিনি বাংলাদেশে এসে আমাদের ধন্য করবেন। আমরা যদি সংবাদ সম্মেলনে মি. ব্লেকের আবদার শুনতে পারি, তিনি কি আমার একটা অনুরোধ রাখবেন। বারাক ওবামা আমাদের খুব পছন্দের মানুষ, আমেরিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট। তিনি নির্বাচনে জিতেছেন দিন বদলের স্বপ্ন দেখিয়ে। তিনি শান্তি প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেই জিতে নিয়েছেন নোবেল পুরস্কার। এমন একজন যুগস্রষ্টাকে সারা জীবন না হোক, অন্তত তিন মেয়াদে প্রেসিডেন্ট রাখার কোনো উদ্যোগ কি নেবেন মি. ব্লেক? তাঁরা যদি নিজের দেশের আইনের ওপর অনড় থাকতে পারেন, আমরা আমাদের আইন মানতে পারব না কেন? মায়ের চেয়ে দেখি মাসির দরদ বেশি।
একাত্তরে মার্কিন জনগণ আমাদের পক্ষে থাকলেও সরকার ছিল বিপক্ষে। বাংলাদেশকে ভয় দেখাতে সপ্তম নৌবহর লেলিয়ে দেওয়ার ইতিহাসও আমরা ভুলিনি। কিন্তু স্বাধীনতার মাসে মার্কিনিদের এমন অশালীন হুমকি আমাদের ক্রুদ্ধ করে। মার্কিনিদের আচরণে আমাদের ক্রোধ হয়, ক্ষোভ হয়, রাগ হয়, জিদ হয়। কিন্তু ড. ইউনূসের আচরণে আমাদের কষ্ট হয়। তাঁকে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার পর তাঁর আন্তর্জাতিক বন্ধুরা যেভাবে বাংলাদেশের বিপক্ষে উঠেপড়ে লেগেছেন, তাতে কি ড. ইউনূসের খারাপ লাগছে না? এত দিন জেনে এসেছি, ব্যক্তির চেয়ে দেশ বড়। এখন দেখছি উল্টো। ড. ইউনূস নোবেল জিতে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশকে অনেক বড় করেছেন। কিন্তু এখন দেখছি, ড. ইউনূস বাংলাদেশের চেয়েও বড় হয়ে গেছেন! কেউ যখন নিজের ব্যাপার নিজে সামলাতে পারেন না, তখন তিনি রাগ করে অন্যদের কাছে বিচার দেন, সালিস বসান। বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে অপদস্ত হতে দেখলে আমাদের খুব খারাপ লাগে, ড. ইউনূসের কি লাগে না, এটা কি তাঁর দেশ নয়? বাধ্য হয়ে এ প্রশ্ন তুলতেই হচ্ছে, ড. ইউনূসের আনুগত্য কার কাছে_বাংলাদেশের কাছে না যুক্তরাষ্ট্রের কাছে?
যুক্তরাষ্ট্র এখন সমঝোতার কথা বলছে। কিন্তু সমঝোতার সব পথ তো বন্ধ করেছেন ড. ইউনূসই। এমন একটা কিছু হতে যাচ্ছে, সেটা অনেক দিন ধরেই টের পাওয়া যাচ্ছিল। ড. ইউনূস আরো ভালো করেই সেটা বুঝতে পেরেছিলেন। তাহলে তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের আদেশ পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন কেন। প্রকাশ্যে কিছু হওয়ার আগেই তো সমঝোতার উদ্যোগ নিতে পারতেন। তাঁর আচরণ দেখে মনে হচ্ছে, তিনি এমন একটা আদেশের অপেক্ষা করছিলেন। তাই আদেশ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সরকারের সঙ্গে কোনো সমঝোতার উদ্যোগ না নিয়ে সোজা আদালতে চলে গেলেন। আদালত থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে আপিল করার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বন্ধুদের কাছে নালিশ করেছেন। সরকারকে মোকাবিলায় তাঁর আসল শক্তি নিজের অর্জন নয়, আন্তর্জাতিক বন্ধুগোষ্ঠী। ড. ইউনূসের দেশি-বিদেশি বন্ধু-বান্ধবী, দেশের তথাকথিত সুশীল সমাজ এবং তাঁর আইনজীবীদের কথায় যুক্তির চেয়ে আবেগ বেশি। তাঁরা বারবার বলার চেষ্টা করেন, ড. ইউনূস অনেক বড়। আমরাও মানছি, তিনি অনেক বড়। আমাদের গড়পড়তা সাধারণের চেয়ে অনেক বড়। কিন্তু দেশের আইনের যুক্তির চেয়ে বড় নন, দেশের ভাবমূর্তির চেয়ে বড় অবশ্যই নন। ড. ইউনূসকে সরিয়ে দেওয়ায় যাঁরা বলছিলেন বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। আজ যখন মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী এসে বাংলাদেশকে ধমক দেন, তখন তাঁদের মাথায় দেশের ভাবমূর্তির বিষয়টি থাকে না। তাঁরা এখন চুপ কেন?
শচীন টেন্ডুলকার যখন বোঝেন তিনি আউট, তখন আর আম্পায়ারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় থাকেন না, নিজেই প্যাভিলিয়নের দিকে হাঁটা ধরেন। এ জন্যই তিনি গ্রেট, সবাই তাঁকে রীতিমতো পূজা করে। আর রিকি পন্টিং আউট জেনেও বেনিফিট অব ডাউট পাওয়ার আশায় ক্রিজে দাঁড়িয়ে থাকেন। এ জন্যই তিনি নিছক একজন 'ভালো ব্যাটসম্যান'। নোবেল জিতে ড. ইউনূস নিজেকে 'গ্রেট'দের পর্যায়ে তুলে নিয়েছেন। আমরা চাই তিনি সেখানেই থাকুন। বাংলাদেশ ব্যাংক হয়তো দেরিতে বুঝেছে, কিন্তু ড. ইউনূস তো জানেন, ১০ বছর আগেই তিনি আউট। তিনি যদি নিজে থেকেই চলে যেতেন, তাঁর গ্রেটনেস আরো বাড়ত। ড. ইউনূস বা তাঁর বন্ধুরা কী চান, বোঝা মুশকিল। ড. ইউনূস বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদার পুরস্কার নোবেল পেয়েছেন, তার চেয়েও বড় পুরস্কার সাধারণ মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন। গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ নিশ্চয়ই এর চেয়ে বড় নয়। হীরা ফেলে তিনি কেন কাচ তুলে নিতে চাইছেন, কেন নিজেকে বিতর্কিত করে নিজের অর্জনগুলো ভূলুণ্ঠিত করছেন, নিজেকে গ্রেটদের কাতার থেকে নামিয়ে আনছেন সাধারণের কাতারে? প্রিয় ড. ইউনূস আপনাকে দেখে এই দেশের নতুন প্রজন্ম স্বপ্ন দেখতে শিখেছে, দেশকে নতুন করে ভালোবাসতে শিখেছে। প্লিজ, আপনি আপনার বন্ধুদের নিবৃত্ত করুন। বাংলাদেশকে নিয়ে কাউকে ছিনিমিনি খেলতে দেবেন না। আপনার বন্ধুরা যেন আমাদের হুমকি না দেয়। তাদের বলে দেবেন, আমরা তাদের হুমকিকে ভয় পাই না। আমরা এই দেশকে প্রাণের চেয়েও ভালোবাসি।

লেখক : সাংবাদিক
probhash2000@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.