নাসরিন ট্র্যাজেডি-নিরাপদ নৌপথের নিশ্চয়তা চাই by শরিফুজ্জামান শরিফ ও জীবনানন্দ জয়ন্ত
দুর্বলতার জায়গাটি হলো, প্রতিটি দুর্ঘটনার পর একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয় এবং এই কমিটি দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি রোধে সুপারিশসহ তদন্ত প্রতিবেদন হস্তান্তর করে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশিত হয় না বা তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশগুলোর কার্যকর বাস্তবায়ন দেখা যায় না।
যদিও ২০০৯ সালে এমভি কোকো দুর্ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন আংশিক প্রকাশিত হয়েছিল নির্ধারিত সময়ের অনেক পরে। এটিই ব্যতিক্রম
আজ ৮ জুলাই এমভি নাসরিন লঞ্চ দুর্ঘটনার অষ্টম বার্ষিকী। ২০০৩ সালের এদিনে চাঁদপুরের মেঘনা-ডাকাতিয়া মোহনায় স্মরণকালের ভয়াবহ এ দুর্ঘটনায় ৪ শতাধিক নারী-পুরুষ-শিশুর অসহায় করুণ মৃত্যু হয়। আমাদের দেশে সড়ক ও নৌপথে নানা দুর্ঘটনা হরহামেশা ঘটেই চলেছে, যাতে সম্পদ ও প্রাণহানি দেখতে দেখতে আমাদের অনুভূতি অনেকটা সহনীয় হয়ে গেছে। কিন্তু 'নাসরিন' দুর্ঘটনা-পরবর্তী সময়ের নানা প্রেক্ষাপট ব্যতিক্রম ধারায় রূপ নিয়েছে। কেননা, তখনকার রাষ্ট্রীয় প্রশাসন বাধ্য হয় কতগুলো পদক্ষেপ নিতে। তারা নিহতের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার তাৎক্ষণিক কিছু ব্যবস্থা নিয়েছিল। নাসরিন দুর্ঘটনার পর দেশে নিরাপদ নৌপথের দাবিতে একটি স্থায়ী আন্দোলনের ধারা তৈরি হয়েছে। দাবিটি ক্রমশ শক্তিশালী ও জনপ্রিয় হচ্ছে। সরকারও তুলনামূলক মনোযোগ বাড়িয়েছে; যদিও সব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে সদরঘাটকেন্দ্রিক। তবে দুর্ঘটনার বিস্তার নিয়ন্ত্রণে আসেনি। এখনও প্রতিবছর দুর্ঘটনা ঘটছে। যার শেষ উদাহরণ সম্প্রতি এমভি বিপাশা দুর্ঘটনায় ৩৩ জনের মৃত্যু।
এক সময় বাংলাদেশের যোগাযোগের প্রধান পথ ছিল নৌপথ। বর্তমানে হাওর, নদী ও উপকূলবর্তী অঞ্চলের মানুষের যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম নৌপথ। এ পথ সংকুচিত হওয়ার পরেও বর্তমানে প্রায় ৬ হাজার কি.মি. বিস্তৃত। নৌপথ অধ্যুষিত অঞ্চলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে নৌপথের ওপর মানুষের নির্ভরতা দিন দিন বাড়ছে। কিন্তু নিরাপদ নৌপথ নিশ্চিত করতে পৃষ্ঠপোষকতা-আন্তরিকতা, ব্যবস্থাপনা, আইনকানুনের প্রয়োগ ও সচেতনতার মতো বিষয়গুলো যথেষ্ট গুরুত্ব পাচ্ছে না। যার প্রত্যক্ষ ফল হিসেবে বাড়ছে দুর্ঘটনা; লঞ্চ, ট্রলার ও কার্গোডুবি এবং অনেক মানুষের প্রাণহানি।
বাংলাদেশ সমুদ্র পরিবহন অধিদফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১৯৭৭ থেকে জুন ২০১০ পর্যন্ত সংঘটিত দুর্ঘটনার সংখ্যা ৩৯৬, নিহতের সংখ্যা ৪ হাজার ৪৭ এবং নিখোঁজ রয়েছেন ৩৪১ জন। এসব দুর্ঘটনার অধিকাংশই ঘটেছে দেশের উপকূলবর্তী এলাকায়। ২০০৩ সালের নাসরিন দুর্ঘটনার মাত্র কয়েকদিন আগে এমভি মিতালি লঞ্চডুবিতে ২০০ জন নিহত হয়েছিল। এরও আগে-পরে আরও অনেক দুর্ঘটনা ঘটেছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে ২০০৯ সালে বেশ কিছু বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে, সেগুলোর মধ্যে লালমোহন উপজেলায় তেঁতুলিয়া নদীতে এমভি কোকো লঞ্চডুবিতে ৮১, বরিশালের কীর্তনখোলা নদীতে এমএল ফাহমিদা হ্যাপিতে ৪১, মাটিবোঝাই ট্রলারডুবিতে ২৪ শ্রমিকের মৃত্যু উল্লেখযোগ্য।
দুর্বলতার জায়গাটি হলো, প্রতিটি দুর্ঘটনার পর একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয় এবং এই কমিটি দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি রোধে সুপারিশসহ তদন্ত প্রতিবেদন হস্তান্তর করে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশিত হয় না বা তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশগুলোর কার্যকর বাস্তবায়ন দেখা যায় না। যদিও ২০০৯ সালে এমভি কোকো দুর্ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন আংশিক প্রকাশিত হয়েছিল নির্ধারিত সময়ের অনেক পরে। এটিই ব্যতিক্রম। আন্তরিকতা, জবাবদিহিতা ও ব্যবস্থাপনার ত্রুটির ফলে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি রোধের যে প্রচেষ্টা নেওয়া উচিত তা নেওয়া হয় না বা কার্যকর করা হয় না।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, দুর্ঘটনার কারণ হলো, ত্রুটিপূর্ণ নৌযান নির্মাণ ও পরিচালনা, নিয়ন্ত্রণকারী সরকারি-বেসরকারি কর্তৃপক্ষের অনিয়ম-দুর্নীতি, বিদ্যমান আইনের প্রয়োগস্বল্পতা এবং জনসচেতনতার অভাব। কিন্তু তা নিরসনে ব্যর্থতা দূর করতে চেষ্টার অভাবটি আরও বড়।
এ রকম ব্যবস্থাপনায় দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ সহজ নয়। আমরা চাই কার্যকর উদ্যোগ, যা দ্রুততম সময়ে দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এ ক্ষেত্রে আইনি নির্দেশনা লঙ্ঘনের ফলে প্রয়োজনীয় বিভিন্ন আইনগত ব্যবস্থা যেমন কঠোরভাবে প্রয়োগ করা উচিত, তেমনি কিছু কিছু ক্ষেত্রে আইনের সংস্কারও প্রয়োজন। ক্ষতিগ্রস্তদের পেশা, বয়স, উপার্জন ক্ষমতা বিবেচনাপূর্বক ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা ইনল্যান্ড শিপিং অর্ডিন্যান্সে অন্তর্ভুক্ত করা, নৌ-চলাচল ব্যবস্থায় স্থানীয় প্রশাসনকে সম্পৃৃক্ত করা, যাত্রী পরিবহনে নিয়োজিত ট্রলার ও চালকদের সনদ প্রদান করে স্থানীয় ইঞ্জিনচালিত নৌযানের তালিকা প্রস্তুত ও সংরক্ষণ, আইনানুয়ায়ী নৌযান নির্মাণ ও পরিচালনা, বিআইডবি্লউটিএ এবং সমুদ্র পরিবহন অধিদফতরের কঠোর নজরদারি, নৌ-পুলিশ গঠন ও এলাকাভিত্তিক সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব অর্পণ, অভ্যন্তরীণ নৌযানগুলোকে মেরিন ইন্স্যুরেন্সের আওতায় নেওয়া এবং বাধ্যতামূলক যাত্রী বীমার ব্যবস্থা, বিভিন্ন ক্যাটাগরির নৌযানের (এমবি, এমএল, ওটি, এমভি ইত্যাদি) জন্য স্পষ্ট ও পৃথক নীতিমালা প্রণয়ন, নৌ-আদালত সংখ্যা বৃদ্ধি, সমুদ্র পরিবহন অধিদফতরের অর্গানোগ্রাম পরিবর্তন করে যুগোপযোগী করা, উৎসবের সময়গুলোতে যখন ঘরমুখো মানুষের ভিড় বেশি থাকে তখন সরকারি ব্যবস্থাপনায় অধিক নৌযানের ব্যবস্থা করা, রোটেশনের নামে লঞ্চগুলোতে ধারণক্ষমতার অধিক যাত্রী বহন নিয়ন্ত্রণ করা। এসব ব্যবস্থা নেওয়া গেলে দেশের নৌপথের ওপর নির্ভরশীল মানুষের জন্য নিরাপদ নৌপথ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
শরিফুজ্জামান শরিফ, জীবনানন্দ জয়ন্ত : উন্নয়ন ও মানবাধিকার কর্মী
No comments