বাঁশ-বেতের কারিগর by আকমল হোসেন

বাঁশ-বেতের সঙ্গে তাঁদের নিবিড় সম্পর্ক। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর থেকেই শুরু হয় বাঁশ কাটা, বেত তৈরি, নানা রকম পণ্য তৈরির কাজ। বাঁশ-বেতের তীক্ষ ফলায় কখনো কখনো ক্ষত হয় হাতের তালু। সেই ক্ষত একসময় শুকিয়ে যায়। আবার হয়। এই চক্রের মাঝে পড়ে আছেন হাজারো নারী-পুরুষ।


তবে বাড়িতে থাকেন বলেই হয়তো বাঁশ থেকে বেত তৈরি ও পণ্য বানানোর কাজটা নারীদের ওপরই পড়েছে। ঘুম থেকে উঠে সংসারের রান্নাবান্না থেকে শুরু করে অন্যান্য সব কাজের সঙ্গে বসতে হয় বাঁশ-বেতের জিনিসপত্র বানানোর কাজে। যুগ যুগ ধরে বাঁশ ও বেতের বিভিন্ন প্রকার জিনিসপত্র তৈরি করে আসছেন এই নারীশিল্পীরা।
মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার আদমপুর ও ইসলামপুর ইউনিয়নের ১৫-২০টি গ্রামের মানুষ বংশপরম্পরায় বাঁশ ও বেতের চাটাই, টুকরি, ডালা, কুলা, খালুই ইত্যাদি তৈরি করে আসছেন। ইসলামপুর ইউনিয়নের গুলেরহাওর (টিলাগাঁও), কানাইদেশি, কাঁঠালকান্দি, ছয়ঘরি, জাবরগাঁও, রাজকান্দি ও আদমপুর ইউনিয়নের আধকানি, কাওয়ারগলা, খাপারবাজার, কোনাগাঁও, ছনগাঁও, চাঙ্গাইচাবি, জালালপুর ও ভানুবিল গ্রামের প্রায় দুই হাজার পরিবার এই বাঁশ-বেতের সঙ্গে জড়িত। প্রায় ১০-১২ হাজার মানুষের জীবিকা এই বাঁশ-বেতের ওপর নির্ভরশীল। সংসারের গতি সচল রাখতে নারীরাই এই কাজের ভার কাঁধে নিয়েছেন। পাহাড়ে একসময় বাঁশ-বেতের প্রাচুর্য ছিল। পুরুষেরা পাহাড় থেকে বাঁশ কেটে নিয়ে এসেছেন। তা থেকে পুরুষদের পাশাপাশি নারীরা বেত তৈরি ও পণ্য উৎপাদন করে বাজারে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেছেন। তাঁদের চাওয়া-পাওয়া খুব বেশি না হওয়ায় তাতে কোনো সমস্যা হয়নি।
কিন্তু কী করে যেন তাঁদের চোখের সামনে পাহাড় বদলে গেছে। সেই সময়টি আর নেই। বাঁশ এখন তাঁদের কাছে দুর্লভ হয়ে উঠেছে। তাঁদের জীবিকার উপায় এখন হুমকিতে পড়েছে। আধকানি গ্রামের কুতুবুন বেগম (৪০) বলেন, ‘আমরা টুকরি-ডালা বানাই। স্বামী বাঁশ এনে দেন। কিন্তু অখন বাঁশ মিলে না।’ কাঁঠালকান্দি গ্রামের মিনা বেগম বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। কিন্তু টাকাপয়সা দিয়া কুলাই উঠতে পারছি না। টাকার জন্য বাঁশ-বেত কিনতে পারি না। অভাবে দিন যায় আমরার। বাচ্চাকাচ্চারেও পড়ালেখা করাইতাম পারি না। বছরের পর বছর ধরি আমরার অও (এই) একই রকম দিন যায়।’ জালালপুর গ্রামের আইরুন বেগম (৪৫) বলেন, ‘নয় বছর আগে স্বামী মারা গেছইন (গেছেন)। এর পর থাকি বেতর (বেতের) কাজ করি, ভাইর সংসারে থাকি কোনো রকম চলরাম (চলছি)। কিন্তু এতা দিয়া কোনোভাবে কোনো কিছু করার সামর্থ্য নাই (এসব দিয়ে কোনোভাবে কিছু করা যাচ্ছে না)। এ ছাড়া আর কিছু করারও উপায় নাই।’ রোকেয়া বেগম বলেন, ‘ফরেস্টে (বন বিভাগ) বাঁশ-বেত ধরলে ১০ টাকা। দা ধরলে ৫০ টাকা দিতে অয় (হয়)। আড়াই শ টাকা দিয়ে একটা বাঁশ কিনি। তিন শ টাকায় জিনিস বিক্রি করি। ৫০ টাকা লাভ অয়। এতা দিয়া (এই টাকা দিয়ে) সংসার চলে না।’ একই কথা আধকানির শুকুরজান বেগম, শামসুন্নাহার বেগম, কোলনির রুজিনা বেগম, আকলিমুন বেগম, পূর্ব জালালপুরের আনোয়ারা বেগম, কাওয়ারগলার জয়তুন বিবিসহ অনেকের। কারিগরেরা জানান, এখন একদিকে বাঁশের সমস্যা, অন্যদিকে পুঁজির সমস্যা। যে মহাজন তাঁদের কাছ থেকে পণ্য নেন, তাঁর কাছ থেকে আগাম টাকা নিলে ১৫০ টাকার পণ্য ১০০ টাকায় দিতে হয়। বাঁশ-বেত কারিগর সমবায় সমিতির সংগঠক রিসান আহমদ বলেন, ‘এলাকার বাঁশ ও বেতের কারিগরেরা মূলধন না থাকার কারণে ঠিকমতো পণ্য বাজারে বিক্রি করতে পারে না। মহাজনদের কাছে তাদের তৈরি পণ্য বিক্রি করতে হচ্ছে। এতে তারা প্রকৃত লাভটা পায় না। এ ছাড়া বাঁশ ও বেতের দাম অনেক বেড়ে গেছে। এই কারিগরদের কাছে টিকে থাকার ক্ষেত্রে এখন মূলধনই বড় বাধা হয়ে উঠেছে।’
বাঁশ-বেত কারিগর সমবায় সমিতির উদ্যোগে ৩ ফেব্রুয়ারি আদমপুর ইউনিয়নে একটি সমাবেশের আয়োজন করা হয়। সেখানে কয়েক শ বাঁশ-বেতের নারী কারিগর উপস্থিত হয়েছিলেন। সমাবেশের সভাপতি লোকগবেষক আহমদ সিরাজ এই কারিগরদের পেশার উন্নয়ন ও বিকাশের লক্ষ্যে কারিগরদের পুঁজি প্রদান, উৎপাদিত পণ্য বাজারজাতের সুযোগ সৃষ্টি, পাহাড় থেকে বাঁশ-বেত সংগ্রহ ও প্রকৃত মূল্যপ্রাপ্তির সুযোগ সৃষ্টি, সামাজিক বনায়নের সুযোগ প্রদান, বেতশিল্পের মান উন্নয়ন, আধুনিকায়ন ও নকশার প্রশিক্ষণ প্রদান, বিশেষ স্থানে কেন্দ্র স্থাপন, পরিবেশবান্ধব পণ্য হিসেবে সরকারি প্রচার, বাঁশ ও বেতশিল্পীদের হয়রানি না করার দাবি জানান।
আদমপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান সাব্বির আহমদ ভুঁইয়া বলেন, কারিগরেরা যাতে পাহাড় থেকে বাঁশ-বেত পেতে পারে, এ জন্য বন বিভাগ ও স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কমলগঞ্জ উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান খন্দকার মোহাম্মদ হোসেন বলেন, ‘কুটিরশিল্প এখন হুমকিতে। পেশা হিসেবে এটাকে আঁকড়ে না রেখে বিকল্প পেশার কথা নতুন করে ভাবতে হবে।’
অর্থনীতিবিদ এম এম আকাশ বলেন, ‘কারও ওপর নির্ভর না করে সমবায়ের মাধ্যমে নিজেরা পণ্য উৎপাদন ও বিক্রির ব্যবস্থা করতে পারে। এতে মহাজন যে লাভটা করে, তা নিজেদের মধ্যে থাকবে।’

No comments

Powered by Blogger.