সমঝোতা হলে বিরোধী দল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল আনতে পারে-সাক্ষাৎকার by মওদুদ আহমদ
সাক্ষাৎকার গ্রহণ :সুভাষ সাহা ও লোটন একরাম ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। বাংলাদেশের সাবেক উপ-রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী। তিনি বিএনপি এবং জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম। বাংলাদেশের তিনি প্রথম পোস্টমাস্টার জেনারেল ছিলেন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কুইন এলিজাবেথ হাউস (১৯৯৩), হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল
অ্যাফেয়ার্স এবং ফেয়ার ব্যাংক রাশিয়া সেন্টার (১৯৯৮), হেইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউটের (১৯৭৬, ১৯৮০, ১৯৯৬) ফেলো ব্যারিস্টার মওদুদ ছয়বার বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। বাংলাদেশের রাজনীতি, সামরিক শাসন নিয়ে তার কয়েকটি গ্রন্থ রয়েছে। এবার একুশের বইমেলায়ও 'বাংলাদেশ :এ স্টাডি অফ দি ডেমোক্রেটিক রেজিমস' নামে তার একটি বই আসছে
সমকাল : সংসদকে কার্যকর করতে বিরোধী দলের সংসদীয় কার্যক্রমে অংশ নেওয়া প্রয়োজন। আবার ওয়াকআউট করাও তাদের অধিকার। কিন্তু বিরোধী দল হিসেবে আপনাদের লাগাতারভাবে সংসদ বর্জন কি গণতান্ত্রিক ও সংসদীয় রীতিসম্মত?
মওদুদ : না, সাধারণত রীতিসম্মত নয়। এটা রাজনৈতিক সংস্কৃতির খারাপ দিক। গত ১৮ বছর ধরে এ সংস্কৃতি চলছে। '৯১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পরাজিত হওয়ার পর টানা সংসদ বর্জনের রেওয়াজ শুরু করে। '৯৪-৯৫ সালে দু'বছর সংসদ বর্জন করে তারা। এভাবেই এটা সংস্কৃতিতে রূপ পায়। তাই বলে আমি লাগাতার সংসদ বর্জন জাস্টিফাই করছি না।
সমকাল : বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া অনেকবার বলেছেন, নির্বাচনে হেরে গেলেও সংসদ অধিবেশন বর্জন করবেন না। কিন্তু আপনারা লাগাতার সংসদ অধিবেশনে যোগদান থেকে বিরত থাকায় সংসদ কীভাবে কার্যকর হবে?
মওদুদ : সংসদ বর্জনকে আমি পছন্দ করি না। তবে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া নবম সংসদের প্রথম অধিবেশনের শুরুতে যোগ দিয়ে বলেছেন, সংখ্যার দিক দিয়ে বিরোধী দল ছোট হলেও সংসদীয় গণতন্ত্রকে মজবুত করতে সরকারকে সহযোগিতা করতে চাই। দুঃখের সঙ্গে বলছি, সংসদকে নিয়ে তিনটি বিষয়ে হতাশ হয়েছি। প্রথমত, সংসদে বিরোধী দল মুলতবি প্রস্তাব ও জনগুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করতে চাইলেও এর কোনোটি গৃহীত হয়নি।
দ্বিতীয়ত, জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়া সম্পর্কে কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য দিয়ে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করে নিচুমনের পরিচয় দিয়েছে সরকারি দল। এ নিয়ে সমঝোতা হলো এবং স্পিকার রুলিং দিয়েছিলেন কাউকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করে কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য না রাখতে। একদিন পর আবার একজন মন্ত্রী বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সম্পর্কে কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য দিয়ে আক্রমণ করেছেন। আসলে সরকারি দল বিরোধী দলকে সংসদে রাখতে রাজি নয়। এ নিয়ে নতুন করে তিক্ততা শুরু হওয়ায় অনেকদিন আমরা সংসদে যাইনি।
তৃতীয়ত, আমরা সরকারের কাছে সহনশীলতা আশা করেছিলাম। সরকার বিরোধী দলের ব্যাপারে সহনশীল, নমনীয় এবং যথাযথ সম্মান দিয়ে সংসদকে কার্যকর করবে। দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, সরকারি দল তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়নি বিরোধী দলকে সংসদে ফেরানোর। অথচ বিরোধী দল প্রথম সারিতে আসন কেড়ে নেওয়ার পরও সহনশীলতার পরিচয় দিয়ে সংসদে ফিরেছিল।
সমকাল : সংসদে বিরোধী দল বিভিন্ন ইস্যুতে বেসরকারি বিল আনছে না কেন? জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে তর্ক-বিতর্ক হলে টেলিভিশনের মাধ্যমে দেশবাসী তা দেখবেন। আপনারা এ সুযোগ কাজে লাগাচ্ছেন না কেন?
মওদুদ : সংসদে বিল আনার সুযোগ সীমিত। সংসদে বিধি মোতাবেক চলতে হয়। স্পিকারেরও কিছু করার থাকে না। 'পয়েন্ট অব অর্ডারে' কিছুটা সুযোগ থাকলেও তা সবাই পান না। নোটিশের ওপর আলোচনা হলেও একটি নোটিশও গৃহীত হয়নি। সংসদে বিরোধী দলকে কথা বলতে দেওয়া হয় না। নোটিশ যেখানে গৃহীত হয় না, সেখানে অন্য আলোচনার সুযোগ খুবই কম। সরকার যদি সহনশীল হতো স্পিকারও নমনীয় হতেন। অন্যথায় বাস্তব কারণে স্পিকারের পক্ষে কিছু করার থাকে না।
সরকারি দল বিরোধী দলকে সংসদে এসে কথা বলতে বলে ঠিকই, কিন্তু এটা 'মিন' করে না। এ বিষয়ে সরকারি দলের 'মনস্থির' হয়ে আছে। সংসদ কার্যকর করার বিষয়টি সরকারি দলের মনমানসিকতার ওপর নির্ভর করে। সরকারি দল মনে করে, বিরোধী দল ছাড়াই সংসদ কার্যকর হবে! বেসরকারি বিল গ্রহণ বিরোধী দলের দূরের কথা, সরকারি দলের একটিও গৃহীত হয়নি। সংসদীয় কমিটিতে বিবেচনার জন্য বিলটি গেলে আর ফিরে আসে না।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির পুনর্বহাল বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ব্যবস্থার জন্য সরকারি দল বিল আনতে অসুবিধা বোধ করলে আমরা বিল আনতে পারি। সে ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সমঝোতা প্রয়োজন। তারা যদি বলেন, আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করেছি, এখন আবার বিল আনতে চাই না। আপনারা একটি বিল উত্থাপন করেন। অন্যথায় আমাদের বিল উত্থাপন করে লাভ হবে না। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সরকারি দল তা নাকচ করে দেবে।
সমকাল : বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে 'অন্তর্বর্তীকালীন' সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবি করেছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার আর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কি এক? খালেদা জিয়ার এই বক্তব্য কি সরকার-বিরোধী দলের মধ্যে 'সমঝোতার' লক্ষণ?
মওদুদ : আসলে বিরোধীদলীয় নেতা 'মূল বিষয়' থেকে একটুও সরে যাননি। আমরা কোনো দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করব না। খালেদা জিয়া বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যাপারে সরকারের যদি কোনো অনীহা থাকে তাহলে এই 'শব্দ' ব্যবহার না করে 'অন্তর্বর্তী' বা 'অস্থায়ী' বা অন্য যে কোনো নামে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে হবে।
সমকাল : রাষ্ট্রপতিকে প্রধান উপদেষ্টা করে দু'দল থেকে ৫ জন করে উপদেষ্টা নিয়োগের ব্যাপারে গণমাধ্যমে লেখালেখি চলছে। এ বিষয়ে আপনার অভিমত কী?
মওদুদ : ১৯৯৫ সালে স্যার নিনিয়ান সমঝোতা করতে আসার পর রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীকে প্রধান উপদেষ্টা করে দু'দল থেকে ৫ জন করে ১০ জন উপদেষ্টা করার বিষয়ে প্রস্তাব করেছিল বিএনপি। তখন আওয়ামী লীগ তা প্রত্যাখ্যান করেছে। আসলে দলীয় রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অধীনে দু'দল থেকে উপদেষ্টা নিয়োগ দিয়ে 'তত্ত্বাবধায়ক' বা 'অন্তর্বর্তীকালীন' যে নামেই সরকার গঠন করা হোক, তা হবে কার্যত 'ডাবল দলীয়' সরকার।
সমকাল : মার্কিন নবনিযুক্ত রাষ্ট্রদূত মজিনা সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সংলাপ অনুষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তার কথা বলছেন। আপনাদের কাছে মার্কিন দূতের তরফে কোনো সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব এসেছে কি?
মওদুদ : ১৯৯৫ সালে দেখেছি, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো একদলীয় নির্বাচন সমর্থন করেনি। তারা রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চেয়েছেন। এবারও অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য 'শক্ত' অবস্থান নিয়েছেন তারা। একতরফা নির্বাচন গ্রহণযোগ্য নয় বলে অভিমত দিয়েছেন পশ্চিমারা। মার্কিন রাষ্ট্রদূত আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপিকে কোনো প্রস্তাব দেননি। সরকারকে সমঝোতার প্রস্তাব দিতে হবে।
সমকাল : তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ব্যাপারে বিএনপি নতুন কোনো ফর্মুলা দেবে কি-না?
মওদুদ : আগে সরকারকে ফর্মুলা দিতে হবে। কীভাবে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে চায়, তা তাদের আগে উত্থাপন করতে হবে।
সমকাল : নির্বাচন কমিশন গঠনে রাষ্ট্রপতির আহ্বানে সাড়া দিয়ে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে আপনারা সংলাপে যোগ দিয়েছেন। এখন নির্বাচন কমিশন গঠনের পর তাকে অবৈধ ও অসাংবিধানিক আখ্যায়িত করছেন কেন?
মওদুদ : আমরা দায়িত্বশীল দল হিসেবে রাষ্ট্রপতির আমন্ত্রণে সাড়া দিয়েছি। সংলাপে যোগ দিয়ে আমরা বলেছি, নির্বাচন কমিশন গঠনের ব্যাপারে আমরা উৎসাহিত নই। আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল হওয়া উচিত।
'৭১ সালের পর এখনও পর্যন্ত কোনো দলীয় সরকারের অধীনে ইসি নিরপেক্ষ ও স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেনি। বিদায়ী সিইসি এটিএম শামসুল হুদাও তা বলে গেছেন। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপে আমরা সেই বিষয়টি তুলে ধরেছি।
সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদে আছে, এ বিষয়ে সংসদে একটি আইন পাস করতে পারে সরকার। সে আইন অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দেবেন। অথচ সংসদকে পাস কাটিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে 'সার্চ কমিটি' গঠন হয়েছে। সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদে সুস্পষ্টভাবে বলা আছে, রাষ্ট্রপতির এককভাবে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দেওয়ার ক্ষমতা নেই। সে কারণে নতুন এ নিয়োগ অবৈধ ও অসাংবিধানিক। সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদে বলা আছে, রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ ছাড়া বাকি সব নিয়োগ প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে সম্পন্ন করবেন। আমাদের জানা মতে, রাষ্ট্রপতি প্রকাশ্যে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করেননি। বিচারপতিদের সম্পর্কে কিছু বলতে চাই না। বাকি যে কয়েকজন সদস্য ছিলেন তারা আওয়ামী লীগের লোক। তাদের অতীত দেখলে তা পরিষ্কার হয়ে যাবে।
নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব জনবল কম। মূলত নির্বাচনী কাজ করেন প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও পুলিশ সদস্যরা। কাজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। আওয়ামী লীগ-বিএনপি যে দলই ক্ষমতায় থাকে নিজেদের মতো করে প্রশাসন সাজিয়ে ক্ষমতা ছাড়ে। যাতে নির্বাচনে সুফল পাওয়া যায়। তাই বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমেদ, বিচারপতি হাবিবুর রহমান ও বিচারপতি লতিফুর রহমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রশাসনে ব্যাপক পরিবর্তন করেন।
সমকাল : সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্বাচন কমিশন গঠন সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তাই ইসি গঠন করে সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করা হয়েছে। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী?
মওদুদ : আগে প্রধানমন্ত্রীকে বলতে হবে, সংবিধান সংশোধন করে আগামী নির্বাচন নির্দলীয় সরকারের অধীনে সম্পন্ন হবে। তাহলে কেবল নির্বাচন কমিশন গঠনের ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যেহেতু প্রধানমন্ত্রী সে ধরনের কোনো ঘোষণা দেননি। কাজেই এ মুহূর্তে ইসি গঠনকে আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি না। সংবিধান সংশোধন করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ৫ বছর মেয়াদ শেষ হওয়ার পরের ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচনের বিষয়টি যুক্ত করতে হবে। আর তখনই নির্দলীয় একটি সরকার গঠন করতে হবে। এর আগে সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিধানটি সংবিধান থেকে বাদ দিতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে সংলাপের আহ্বান করলে আমরা সাড়া দেব।
সমকাল : ১২ মার্চ বিএনপির মহাসমাবেশের দিন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ পাল্টা কর্মসূচি দিয়ে মাঠে থাকার ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে বিকল্প আন্দোলনের কোনো কৌশল নেবে?
মওদুদ : সরকারের নানা ব্যর্থতায় জনগণ ক্ষুব্ধ। বিষয়টি টের পেয়ে সরকার পরিকল্পিতভাবে উস্কানিমূলক বক্তব্য দেওয়া শুরু করেছে। বিএনপিকে মহাসমাবেশ করতে দেবে না বলে হুমকি দিচ্ছে। কোনো গণতান্ত্রিক সরকার এ ধরনের আচরণ করতে পারে না। তারা ২৯ জানুয়ারি নাশকতার আশঙ্কা থেকে পাল্টা কর্মসূচির কথা বলেছিল, তাহলে ৩০ জানুয়ারি কেন আবার একই দিন পাল্টা কর্মসূচি দিল? আসলে তারা মানুষকে ভয় পায়। ১২ মার্চ ঐতিহাসিক মহাসমাবেশ হবে। তারা যত বাধাবিঘ্নের হুমকি দিক গণজোয়ারে সব ভেসে যাবে। আসলে সরকারি দলের মূল উদ্দেশ্য হলো_ আমাদের মহাসমাবেশ যাতে কম সফল হয়। এর মাধ্যমে আওয়ামী লীগ একটি ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক দলের চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ ঘটাল।
সমকাল : নির্বাচিত সরকারকে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে গণআন্দোলনের মাধ্যমে পতন ঘটানোর বক্তব্য গণতান্ত্রিক রীতিসম্মত হচ্ছে কি?
মওদুদ : আমরা শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক কর্মসূচির মাধ্যমে সরকারের পতন চাই। সরকারের ব্যর্থতার কারণেই তাদের পতন হবে। আমরা কেন সংঘাতের পথে যাব? গণতান্ত্রিকভাবে শান্তিপূর্ণ ও অহিংস কর্মসূচি দিয়ে গণআন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটানো হবে।
সমকাল : ১৮ ডিসেম্বর বিএনপির উগ্রপন্থি কিছু নেতাকর্মীর রাজধানীতে 'চোরাগোপ্তা' হামলার পর থেকে সরকার সতর্কতা হিসেবে পাল্টা কর্মসূচি দিয়ে মাঠে থাকছে বলে দাবি করা হচ্ছে। আপনার অভিমত কী?
মওদুদ : এটা সঠিক নয়। তারা জনগণকে ভয় পায় বলেই পাল্টা কর্মসূচি দিচ্ছে। ২৯ জানুয়ারি পাল্টা কর্মসূচি দিয়ে জনপ্রিয়তা কমেছে। আগামী ১২ মার্চ পাল্টা কর্মসূচি দিয়ে তাদের জনপ্রিয়তা আরও কমবে।
সমকাল : সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃত্ব বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের আন্দোলনকে যুদ্ধাপরাধ বা মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্তদের বিচার কাজ বাধাগ্রস্ত বা ভণ্ডুল করার অপচেষ্টা আখ্যায়িত করছেন। যুদ্ধাপরাধের বিরুদ্ধে বিএনপি শক্ত অবস্থান নিচ্ছে না কেন?
মওদুদ : জনগণ চায় তাদের মৌলিক সমস্যাগুলোর সমাধান, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন, শেয়ার কলেঙ্কারির বিচার, মূল্যস্ফীতি হ্রাস, বিনিয়োগ বাড়ানো, ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে দেশ পরিচালনা বন্ধ ইত্যাদি। সরকার মানুষকে বিভ্রান্ত করতে বিএনপির বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ করছে। মানুষ এসব বিশ্বাস করে না।
সমকাল :সংসদে সংশোধিত আকারে অর্পিত সম্পত্তি আইন রহিতকরণ বিল পাস হওয়ার পর আপনার দলের কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায়নি। বিষয়টিকে আপনারা এড়িয়ে গেলেন কেন?
মওদুদ : আমরা বিষয়টি বাস্তবায়ন কীভাবে হয়, তা দেখতে চাই। কারণ, অর্পিত সম্পত্তি দখল করেছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। তাছাড়া আওয়ামী লীগ গতবারের শাসনামলে অর্পিত সম্পত্তির সমস্যাটি সমাধান করেনি কেন? এখন চাপের মুখে তারা বিলটি পাস করেছে ঠিক, আসলে এটা তারা কার্যকর করতে পারবে না। কারণ '৭২ সালে কারা এসব সম্পত্তি দখল করেছে_ তা সবাই জানেন।
সমকাল :একটি ব্যর্থ সেনা ক্যুর সঙ্গে ধর্মীয় অগ্রবাদীরা জড়িত বলে জানানো হয়েছে। সম্প্রতি প্রতিরক্ষা বিষয়ক সংসদীয় কমিটি সামরিক বাহিনীকে উগ্র রাজনৈতিক মতবাদের প্রভাবমুক্ত থাকার কথা বলেছে। এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কী?
মওদুদ : সরকারের একটা অংশ কল্পিত সেনা অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত। এটি বিডিআর হত্যাকাণ্ডের ধারাবাহিকতার একটি অংশ। মূল উদ্দেশ্য সেনাবাহিনীকে দুর্বল করা। সেনাবাহিনীকে করা মানে রাষ্ট্রকে দুর্বল করা। আমরা জানতে পেরেছি, কথিত সেনা অভ্যুত্থানের নাম করে অনেক সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শান্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
সমকাল : সংসদের চলতি অধিবেশনে বিএনপি যোগ দেবে?
মওদুদ :খুব সম্ভব যোগ দেব। ১২ মার্চের মহাসমাবেশের পর এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব। এ ব্যাপারে আমাদের মনোভাব ইতিবাচক।
সমকাল : ১২ মার্চের মহাসমাবেশ থেকে কি নতুন কর্মসূচি দেওয়া হবে?
মওদুদ : সুনির্দিষ্টভাবে এখনও সিদ্ধান্ত হয়নি। ওই মহাসমাবেশ থেকে আমরা দুটি লক্ষ্য অর্জন করব। এক. সরকারের প্রতি জনগণের অনাস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে। দুই. সরকারকে পদত্যাগের দাবি জানানো হবে।
সমকাল : আপনারা নির্বাচন কমিশন গঠন অসাংবিধানিক বললেও অনেক সংবিধান বিশেষজ্ঞ বলছেন, এটা সংবিধান মোতাবেকই হয়েছে। তাহলে কোনটি সঠিক?
মওদুদ : আমি ওইসব সংবিধান বিশেষজ্ঞকে বলব, তারা যেন সংবিধানের ৪৮(৩) ধারাটি ভালোভাবে দেখে নন। প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশ ছাড়া রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশন নিয়োগ দিতে পারেন কি-না?
সমকাল : নবগঠিত নির্বাচন কমিশন গঠন সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
মওদুদ : অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, যাদের নিয়ে ইসি গঠন করা হয়েছে তারা অতি নিম্নমানের সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। যুগ্ম সচিব, উপসচিব পদমর্যাদায় জেলা জজদের পর্যায়ের কর্মকর্তা দিয়ে গঠন ইসিকে অবনমন করা হয়েছে। এতে কমিশনের মান ক্ষুণ্ন হয়েছে। কেন করেছে তা সকলেই জানেন। সরকার যা বলবে ওই অযোগ্য ব্যক্তিরা তা করবেন।
সমকাল : দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হলে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও তার বড় ছেলে তারেক রহমান আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণে অযোগ্য ঘোষণার আশঙ্কা করছেন কেউ কেউ। আপনার অভিমত কী?
মওদুদ : এ ধরনের কর্মপরিকল্পনা ও হীনমনত্য কোনো দিন কার্যকর হবে না।
সমকাল : আপনাকে ধন্যবাদ।
মওদুদ : সমকাল পাঠকদের ধন্যবাদ।
সমকাল : সংসদকে কার্যকর করতে বিরোধী দলের সংসদীয় কার্যক্রমে অংশ নেওয়া প্রয়োজন। আবার ওয়াকআউট করাও তাদের অধিকার। কিন্তু বিরোধী দল হিসেবে আপনাদের লাগাতারভাবে সংসদ বর্জন কি গণতান্ত্রিক ও সংসদীয় রীতিসম্মত?
মওদুদ : না, সাধারণত রীতিসম্মত নয়। এটা রাজনৈতিক সংস্কৃতির খারাপ দিক। গত ১৮ বছর ধরে এ সংস্কৃতি চলছে। '৯১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পরাজিত হওয়ার পর টানা সংসদ বর্জনের রেওয়াজ শুরু করে। '৯৪-৯৫ সালে দু'বছর সংসদ বর্জন করে তারা। এভাবেই এটা সংস্কৃতিতে রূপ পায়। তাই বলে আমি লাগাতার সংসদ বর্জন জাস্টিফাই করছি না।
সমকাল : বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া অনেকবার বলেছেন, নির্বাচনে হেরে গেলেও সংসদ অধিবেশন বর্জন করবেন না। কিন্তু আপনারা লাগাতার সংসদ অধিবেশনে যোগদান থেকে বিরত থাকায় সংসদ কীভাবে কার্যকর হবে?
মওদুদ : সংসদ বর্জনকে আমি পছন্দ করি না। তবে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া নবম সংসদের প্রথম অধিবেশনের শুরুতে যোগ দিয়ে বলেছেন, সংখ্যার দিক দিয়ে বিরোধী দল ছোট হলেও সংসদীয় গণতন্ত্রকে মজবুত করতে সরকারকে সহযোগিতা করতে চাই। দুঃখের সঙ্গে বলছি, সংসদকে নিয়ে তিনটি বিষয়ে হতাশ হয়েছি। প্রথমত, সংসদে বিরোধী দল মুলতবি প্রস্তাব ও জনগুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করতে চাইলেও এর কোনোটি গৃহীত হয়নি।
দ্বিতীয়ত, জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়া সম্পর্কে কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য দিয়ে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করে নিচুমনের পরিচয় দিয়েছে সরকারি দল। এ নিয়ে সমঝোতা হলো এবং স্পিকার রুলিং দিয়েছিলেন কাউকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করে কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য না রাখতে। একদিন পর আবার একজন মন্ত্রী বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সম্পর্কে কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য দিয়ে আক্রমণ করেছেন। আসলে সরকারি দল বিরোধী দলকে সংসদে রাখতে রাজি নয়। এ নিয়ে নতুন করে তিক্ততা শুরু হওয়ায় অনেকদিন আমরা সংসদে যাইনি।
তৃতীয়ত, আমরা সরকারের কাছে সহনশীলতা আশা করেছিলাম। সরকার বিরোধী দলের ব্যাপারে সহনশীল, নমনীয় এবং যথাযথ সম্মান দিয়ে সংসদকে কার্যকর করবে। দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, সরকারি দল তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়নি বিরোধী দলকে সংসদে ফেরানোর। অথচ বিরোধী দল প্রথম সারিতে আসন কেড়ে নেওয়ার পরও সহনশীলতার পরিচয় দিয়ে সংসদে ফিরেছিল।
সমকাল : সংসদে বিরোধী দল বিভিন্ন ইস্যুতে বেসরকারি বিল আনছে না কেন? জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে তর্ক-বিতর্ক হলে টেলিভিশনের মাধ্যমে দেশবাসী তা দেখবেন। আপনারা এ সুযোগ কাজে লাগাচ্ছেন না কেন?
মওদুদ : সংসদে বিল আনার সুযোগ সীমিত। সংসদে বিধি মোতাবেক চলতে হয়। স্পিকারেরও কিছু করার থাকে না। 'পয়েন্ট অব অর্ডারে' কিছুটা সুযোগ থাকলেও তা সবাই পান না। নোটিশের ওপর আলোচনা হলেও একটি নোটিশও গৃহীত হয়নি। সংসদে বিরোধী দলকে কথা বলতে দেওয়া হয় না। নোটিশ যেখানে গৃহীত হয় না, সেখানে অন্য আলোচনার সুযোগ খুবই কম। সরকার যদি সহনশীল হতো স্পিকারও নমনীয় হতেন। অন্যথায় বাস্তব কারণে স্পিকারের পক্ষে কিছু করার থাকে না।
সরকারি দল বিরোধী দলকে সংসদে এসে কথা বলতে বলে ঠিকই, কিন্তু এটা 'মিন' করে না। এ বিষয়ে সরকারি দলের 'মনস্থির' হয়ে আছে। সংসদ কার্যকর করার বিষয়টি সরকারি দলের মনমানসিকতার ওপর নির্ভর করে। সরকারি দল মনে করে, বিরোধী দল ছাড়াই সংসদ কার্যকর হবে! বেসরকারি বিল গ্রহণ বিরোধী দলের দূরের কথা, সরকারি দলের একটিও গৃহীত হয়নি। সংসদীয় কমিটিতে বিবেচনার জন্য বিলটি গেলে আর ফিরে আসে না।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির পুনর্বহাল বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ব্যবস্থার জন্য সরকারি দল বিল আনতে অসুবিধা বোধ করলে আমরা বিল আনতে পারি। সে ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সমঝোতা প্রয়োজন। তারা যদি বলেন, আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করেছি, এখন আবার বিল আনতে চাই না। আপনারা একটি বিল উত্থাপন করেন। অন্যথায় আমাদের বিল উত্থাপন করে লাভ হবে না। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সরকারি দল তা নাকচ করে দেবে।
সমকাল : বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে 'অন্তর্বর্তীকালীন' সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবি করেছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার আর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কি এক? খালেদা জিয়ার এই বক্তব্য কি সরকার-বিরোধী দলের মধ্যে 'সমঝোতার' লক্ষণ?
মওদুদ : আসলে বিরোধীদলীয় নেতা 'মূল বিষয়' থেকে একটুও সরে যাননি। আমরা কোনো দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করব না। খালেদা জিয়া বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যাপারে সরকারের যদি কোনো অনীহা থাকে তাহলে এই 'শব্দ' ব্যবহার না করে 'অন্তর্বর্তী' বা 'অস্থায়ী' বা অন্য যে কোনো নামে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে হবে।
সমকাল : রাষ্ট্রপতিকে প্রধান উপদেষ্টা করে দু'দল থেকে ৫ জন করে উপদেষ্টা নিয়োগের ব্যাপারে গণমাধ্যমে লেখালেখি চলছে। এ বিষয়ে আপনার অভিমত কী?
মওদুদ : ১৯৯৫ সালে স্যার নিনিয়ান সমঝোতা করতে আসার পর রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীকে প্রধান উপদেষ্টা করে দু'দল থেকে ৫ জন করে ১০ জন উপদেষ্টা করার বিষয়ে প্রস্তাব করেছিল বিএনপি। তখন আওয়ামী লীগ তা প্রত্যাখ্যান করেছে। আসলে দলীয় রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর অধীনে দু'দল থেকে উপদেষ্টা নিয়োগ দিয়ে 'তত্ত্বাবধায়ক' বা 'অন্তর্বর্তীকালীন' যে নামেই সরকার গঠন করা হোক, তা হবে কার্যত 'ডাবল দলীয়' সরকার।
সমকাল : মার্কিন নবনিযুক্ত রাষ্ট্রদূত মজিনা সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সংলাপ অনুষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তার কথা বলছেন। আপনাদের কাছে মার্কিন দূতের তরফে কোনো সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব এসেছে কি?
মওদুদ : ১৯৯৫ সালে দেখেছি, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো একদলীয় নির্বাচন সমর্থন করেনি। তারা রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চেয়েছেন। এবারও অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য 'শক্ত' অবস্থান নিয়েছেন তারা। একতরফা নির্বাচন গ্রহণযোগ্য নয় বলে অভিমত দিয়েছেন পশ্চিমারা। মার্কিন রাষ্ট্রদূত আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপিকে কোনো প্রস্তাব দেননি। সরকারকে সমঝোতার প্রস্তাব দিতে হবে।
সমকাল : তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ব্যাপারে বিএনপি নতুন কোনো ফর্মুলা দেবে কি-না?
মওদুদ : আগে সরকারকে ফর্মুলা দিতে হবে। কীভাবে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে চায়, তা তাদের আগে উত্থাপন করতে হবে।
সমকাল : নির্বাচন কমিশন গঠনে রাষ্ট্রপতির আহ্বানে সাড়া দিয়ে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে আপনারা সংলাপে যোগ দিয়েছেন। এখন নির্বাচন কমিশন গঠনের পর তাকে অবৈধ ও অসাংবিধানিক আখ্যায়িত করছেন কেন?
মওদুদ : আমরা দায়িত্বশীল দল হিসেবে রাষ্ট্রপতির আমন্ত্রণে সাড়া দিয়েছি। সংলাপে যোগ দিয়ে আমরা বলেছি, নির্বাচন কমিশন গঠনের ব্যাপারে আমরা উৎসাহিত নই। আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল হওয়া উচিত।
'৭১ সালের পর এখনও পর্যন্ত কোনো দলীয় সরকারের অধীনে ইসি নিরপেক্ষ ও স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেনি। বিদায়ী সিইসি এটিএম শামসুল হুদাও তা বলে গেছেন। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপে আমরা সেই বিষয়টি তুলে ধরেছি।
সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদে আছে, এ বিষয়ে সংসদে একটি আইন পাস করতে পারে সরকার। সে আইন অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দেবেন। অথচ সংসদকে পাস কাটিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে 'সার্চ কমিটি' গঠন হয়েছে। সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদে সুস্পষ্টভাবে বলা আছে, রাষ্ট্রপতির এককভাবে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দেওয়ার ক্ষমতা নেই। সে কারণে নতুন এ নিয়োগ অবৈধ ও অসাংবিধানিক। সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদে বলা আছে, রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ ছাড়া বাকি সব নিয়োগ প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে সম্পন্ন করবেন। আমাদের জানা মতে, রাষ্ট্রপতি প্রকাশ্যে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করেননি। বিচারপতিদের সম্পর্কে কিছু বলতে চাই না। বাকি যে কয়েকজন সদস্য ছিলেন তারা আওয়ামী লীগের লোক। তাদের অতীত দেখলে তা পরিষ্কার হয়ে যাবে।
নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব জনবল কম। মূলত নির্বাচনী কাজ করেন প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও পুলিশ সদস্যরা। কাজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। আওয়ামী লীগ-বিএনপি যে দলই ক্ষমতায় থাকে নিজেদের মতো করে প্রশাসন সাজিয়ে ক্ষমতা ছাড়ে। যাতে নির্বাচনে সুফল পাওয়া যায়। তাই বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমেদ, বিচারপতি হাবিবুর রহমান ও বিচারপতি লতিফুর রহমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রশাসনে ব্যাপক পরিবর্তন করেন।
সমকাল : সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্বাচন কমিশন গঠন সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তাই ইসি গঠন করে সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করা হয়েছে। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী?
মওদুদ : আগে প্রধানমন্ত্রীকে বলতে হবে, সংবিধান সংশোধন করে আগামী নির্বাচন নির্দলীয় সরকারের অধীনে সম্পন্ন হবে। তাহলে কেবল নির্বাচন কমিশন গঠনের ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যেহেতু প্রধানমন্ত্রী সে ধরনের কোনো ঘোষণা দেননি। কাজেই এ মুহূর্তে ইসি গঠনকে আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি না। সংবিধান সংশোধন করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ৫ বছর মেয়াদ শেষ হওয়ার পরের ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচনের বিষয়টি যুক্ত করতে হবে। আর তখনই নির্দলীয় একটি সরকার গঠন করতে হবে। এর আগে সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিধানটি সংবিধান থেকে বাদ দিতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে সংলাপের আহ্বান করলে আমরা সাড়া দেব।
সমকাল : ১২ মার্চ বিএনপির মহাসমাবেশের দিন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ পাল্টা কর্মসূচি দিয়ে মাঠে থাকার ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে বিকল্প আন্দোলনের কোনো কৌশল নেবে?
মওদুদ : সরকারের নানা ব্যর্থতায় জনগণ ক্ষুব্ধ। বিষয়টি টের পেয়ে সরকার পরিকল্পিতভাবে উস্কানিমূলক বক্তব্য দেওয়া শুরু করেছে। বিএনপিকে মহাসমাবেশ করতে দেবে না বলে হুমকি দিচ্ছে। কোনো গণতান্ত্রিক সরকার এ ধরনের আচরণ করতে পারে না। তারা ২৯ জানুয়ারি নাশকতার আশঙ্কা থেকে পাল্টা কর্মসূচির কথা বলেছিল, তাহলে ৩০ জানুয়ারি কেন আবার একই দিন পাল্টা কর্মসূচি দিল? আসলে তারা মানুষকে ভয় পায়। ১২ মার্চ ঐতিহাসিক মহাসমাবেশ হবে। তারা যত বাধাবিঘ্নের হুমকি দিক গণজোয়ারে সব ভেসে যাবে। আসলে সরকারি দলের মূল উদ্দেশ্য হলো_ আমাদের মহাসমাবেশ যাতে কম সফল হয়। এর মাধ্যমে আওয়ামী লীগ একটি ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক দলের চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ ঘটাল।
সমকাল : নির্বাচিত সরকারকে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে গণআন্দোলনের মাধ্যমে পতন ঘটানোর বক্তব্য গণতান্ত্রিক রীতিসম্মত হচ্ছে কি?
মওদুদ : আমরা শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক কর্মসূচির মাধ্যমে সরকারের পতন চাই। সরকারের ব্যর্থতার কারণেই তাদের পতন হবে। আমরা কেন সংঘাতের পথে যাব? গণতান্ত্রিকভাবে শান্তিপূর্ণ ও অহিংস কর্মসূচি দিয়ে গণআন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটানো হবে।
সমকাল : ১৮ ডিসেম্বর বিএনপির উগ্রপন্থি কিছু নেতাকর্মীর রাজধানীতে 'চোরাগোপ্তা' হামলার পর থেকে সরকার সতর্কতা হিসেবে পাল্টা কর্মসূচি দিয়ে মাঠে থাকছে বলে দাবি করা হচ্ছে। আপনার অভিমত কী?
মওদুদ : এটা সঠিক নয়। তারা জনগণকে ভয় পায় বলেই পাল্টা কর্মসূচি দিচ্ছে। ২৯ জানুয়ারি পাল্টা কর্মসূচি দিয়ে জনপ্রিয়তা কমেছে। আগামী ১২ মার্চ পাল্টা কর্মসূচি দিয়ে তাদের জনপ্রিয়তা আরও কমবে।
সমকাল : সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃত্ব বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের আন্দোলনকে যুদ্ধাপরাধ বা মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্তদের বিচার কাজ বাধাগ্রস্ত বা ভণ্ডুল করার অপচেষ্টা আখ্যায়িত করছেন। যুদ্ধাপরাধের বিরুদ্ধে বিএনপি শক্ত অবস্থান নিচ্ছে না কেন?
মওদুদ : জনগণ চায় তাদের মৌলিক সমস্যাগুলোর সমাধান, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন, শেয়ার কলেঙ্কারির বিচার, মূল্যস্ফীতি হ্রাস, বিনিয়োগ বাড়ানো, ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে দেশ পরিচালনা বন্ধ ইত্যাদি। সরকার মানুষকে বিভ্রান্ত করতে বিএনপির বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ করছে। মানুষ এসব বিশ্বাস করে না।
সমকাল :সংসদে সংশোধিত আকারে অর্পিত সম্পত্তি আইন রহিতকরণ বিল পাস হওয়ার পর আপনার দলের কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায়নি। বিষয়টিকে আপনারা এড়িয়ে গেলেন কেন?
মওদুদ : আমরা বিষয়টি বাস্তবায়ন কীভাবে হয়, তা দেখতে চাই। কারণ, অর্পিত সম্পত্তি দখল করেছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। তাছাড়া আওয়ামী লীগ গতবারের শাসনামলে অর্পিত সম্পত্তির সমস্যাটি সমাধান করেনি কেন? এখন চাপের মুখে তারা বিলটি পাস করেছে ঠিক, আসলে এটা তারা কার্যকর করতে পারবে না। কারণ '৭২ সালে কারা এসব সম্পত্তি দখল করেছে_ তা সবাই জানেন।
সমকাল :একটি ব্যর্থ সেনা ক্যুর সঙ্গে ধর্মীয় অগ্রবাদীরা জড়িত বলে জানানো হয়েছে। সম্প্রতি প্রতিরক্ষা বিষয়ক সংসদীয় কমিটি সামরিক বাহিনীকে উগ্র রাজনৈতিক মতবাদের প্রভাবমুক্ত থাকার কথা বলেছে। এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কী?
মওদুদ : সরকারের একটা অংশ কল্পিত সেনা অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত। এটি বিডিআর হত্যাকাণ্ডের ধারাবাহিকতার একটি অংশ। মূল উদ্দেশ্য সেনাবাহিনীকে দুর্বল করা। সেনাবাহিনীকে করা মানে রাষ্ট্রকে দুর্বল করা। আমরা জানতে পেরেছি, কথিত সেনা অভ্যুত্থানের নাম করে অনেক সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শান্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
সমকাল : সংসদের চলতি অধিবেশনে বিএনপি যোগ দেবে?
মওদুদ :খুব সম্ভব যোগ দেব। ১২ মার্চের মহাসমাবেশের পর এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব। এ ব্যাপারে আমাদের মনোভাব ইতিবাচক।
সমকাল : ১২ মার্চের মহাসমাবেশ থেকে কি নতুন কর্মসূচি দেওয়া হবে?
মওদুদ : সুনির্দিষ্টভাবে এখনও সিদ্ধান্ত হয়নি। ওই মহাসমাবেশ থেকে আমরা দুটি লক্ষ্য অর্জন করব। এক. সরকারের প্রতি জনগণের অনাস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে। দুই. সরকারকে পদত্যাগের দাবি জানানো হবে।
সমকাল : আপনারা নির্বাচন কমিশন গঠন অসাংবিধানিক বললেও অনেক সংবিধান বিশেষজ্ঞ বলছেন, এটা সংবিধান মোতাবেকই হয়েছে। তাহলে কোনটি সঠিক?
মওদুদ : আমি ওইসব সংবিধান বিশেষজ্ঞকে বলব, তারা যেন সংবিধানের ৪৮(৩) ধারাটি ভালোভাবে দেখে নন। প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশ ছাড়া রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশন নিয়োগ দিতে পারেন কি-না?
সমকাল : নবগঠিত নির্বাচন কমিশন গঠন সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
মওদুদ : অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, যাদের নিয়ে ইসি গঠন করা হয়েছে তারা অতি নিম্নমানের সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। যুগ্ম সচিব, উপসচিব পদমর্যাদায় জেলা জজদের পর্যায়ের কর্মকর্তা দিয়ে গঠন ইসিকে অবনমন করা হয়েছে। এতে কমিশনের মান ক্ষুণ্ন হয়েছে। কেন করেছে তা সকলেই জানেন। সরকার যা বলবে ওই অযোগ্য ব্যক্তিরা তা করবেন।
সমকাল : দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হলে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও তার বড় ছেলে তারেক রহমান আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণে অযোগ্য ঘোষণার আশঙ্কা করছেন কেউ কেউ। আপনার অভিমত কী?
মওদুদ : এ ধরনের কর্মপরিকল্পনা ও হীনমনত্য কোনো দিন কার্যকর হবে না।
সমকাল : আপনাকে ধন্যবাদ।
মওদুদ : সমকাল পাঠকদের ধন্যবাদ।
No comments