ছাত্ররাজনীতি-সব ঘটনা বিচ্ছিন্ন ভাবা ঠিক নয় by আবদুল মান্নান
গত বুধবার ৮ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামী ছাত্রশিবির ও ছাত্রলীগের মধ্যে সংঘটিত সংঘর্ষে দুজন ছাত্র নিহত হয়েছে। ছাত্রশিবির ওই দুজনকে তাদের নেতা ও কর্মী বলে দাবি করেছে। এই সংবাদ ইতিমধ্যে গণমাধ্যমের কল্যাণে দেশের মানুষ জেনে গেছেন। যথারীতি বিভিন্ন সংবাদপত্র ও কিছু কিছু বিশ্লেষক ঘটনার নিন্দা করে সম্পাদকীয় ও মন্তব্য প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
আমি নিজেও দু-একটি পত্রিকায় এ প্রসঙ্গে আমার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছি এবং ঘটনার নিন্দা করেছি। আমার পেশাগত জীবনের তিন যুগ, যা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কেটেছে। বর্তমানে আমি এই বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটে চ্যান্সেলরের একজন প্রতিনিধি। ঘটনার পরদিন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন একটি জরুরি সিন্ডিকেট সভা আহ্বান করে এবং সেই সভায় আমিসহ সব সিন্ডিকেট সদস্যই উপস্থিত ছিলেন, শুধু একজন ছাড়া। তিনি সিনেট প্রতিনিধি এবং বেশ কয়েক বছর ধরে সিন্ডিকেট সভায় উপস্থিত থাকেন না। সাধারণত জরুরি সিন্ডিকেট সভায় সব সিন্ডিকেট সদস্য উপস্থিত থাকতে পারেন না। এদিন সবার উপস্থিতি এটাই প্রমাণ করে সবাই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মঙ্গল কামনা করেন। সিন্ডিকেট সভা যখন চলছিল তখন আনুমানিক বেলা পাঁচটায় খবর আসে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় লাগোয়া নন্দীরহাট গ্রামে স্থানীয় দুটি পাড়ার মধ্যে একটি ছোটখাটো সংঘর্ষ হয়েছে এবং দুশ্চিন্তার কারণ হলো এই সংঘর্ষের কারণে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। অথচ নন্দীরহাট ও তৎসংলগ্ন এলাকায় সব সম্প্রদায়ের মানুষ শত বছর ধরে অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে বাস করে আসছে। এ প্রসঙ্গে পরে আসছি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ২৪ বছরে ১৭ জন ছাত্র নিহত হয়েছে এবং তার বেশির ভাগই হয়েছে একটি ছাত্রসংগঠনের সন্ত্রাসীদের হাতে। সব মৃত্যুই দুঃখজনক। যারা মৃত্যুবরণ করেছে তাদের অভিভাবকেরা তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করতে পাঠিয়েছিল, লাশ হয়ে বাড়ি ফেরার জন্য নয়। দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, এসব অকালমৃত্যুর অনেকগুলোই আমাকে প্রত্যক্ষ করতে হয়েছে। অন্তত একটি ঘটনায় আমিসহ আমার অনেক সহকর্মী ছাত্র নামধারী দুর্বৃত্তদের হাতে আহত হয়েছি। আমার বাড়িতে বোমা পড়েছে, আমাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। যখন কোনো শিক্ষাঙ্গনে ছাত্রসংগঠনগুলোর মাঝে হানাহানি হয় বা রক্তপাতের ঘটনা ঘটে তাৎক্ষণিকভাবে মিডিয়া ছাত্রসংগঠন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও সরকারের ওপর একতরফাভাবে দোষ চাপায়। কিন্তু এসব ঘটনার পেছনের অনেক ঘটনা অনুল্লেখ থেকে যায়, যা সাধারণ মানুষ কখনো জানতে পারে না। পত্রপত্রিকায় পাঠক যা পড়ে বা ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় যা দেখে বা শোনে তা দিয়ে তারা পুরো ঘটনা সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়ার চেষ্টা করে, যা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অর্ধসত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত।
বাংলাদেশে তিনটি প্রধান ছাত্রসংগঠন আছে ছাত্রলীগ, ছাত্রদল ও ছাত্রশিবির। এ ছাড়া কিছু বাম ছাত্রসংগঠন আছে। সাধারণত তাদের তেমন কোনো কর্মকাণ্ড পরিলক্ষিত হয় না। তবে তাদের শৃঙ্খলাবোধ প্রশংসনীয়। ছাত্র বেতন বৃদ্ধি হলে তাদের প্রতিবাদ চোখে পড়ে। প্রথম দুটি দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের ‘আদর্শে’ দীক্ষিত ছাত্রসংগঠন হলেও তাদের ওপর মূল দলের তেমন নিয়ন্ত্রণ নেই, নেই কোনো চেইন অব কমান্ড। উচ্ছৃঙ্খলতাই এদের প্রধান বৈশিষ্ট্য। বর্তমানে ছাত্রলীগ নামধারী কিছু দুর্বৃত্তের কারণে অনেকগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ।
কিন্তু ইসলামী ছাত্রশিবির একেবারেই ব্যতিক্রম। এদের সাংগঠনিক কাঠামো পুরোনো দিনের কমিউনিস্ট পার্টির চেয়েও বেশি রেজিমেন্টেড এবং দলের স্তরবিন্যাস একেবারেই সুনির্দিষ্ট। এদের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এরা তাদের মূল দল জামায়াতের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। জামায়াতের নির্দেশের বাইরে তারা এক কদমও এগোবে না। প্রত্যেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তাদের পরামর্শক বা মুরব্বি হিসেবে কাজ করার জন্য বেশ কিছু শিক্ষক নিয়োজিত থাকেন এবং সাধারণত তাঁরা পার্টি থেকে একটা মোটা অঙ্কের মাসোহারাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পান। অন্য কোনো ছাত্রসংগঠনের ক্ষেত্রে এমন ব্যবস্থা নেই। কোনো শিক্ষাঙ্গনে শিবিরের সঙ্গে সংঘাত হলে প্রথমে চেষ্টা করা হয় এই শিক্ষক-পরামর্শকদের সঙ্গে কথা বলার। অথচ বাইরে এসব সংবাদ কদাচিৎ প্রচারিত হয়। অনেক সময় দেখা যায় জামায়াত তাদের কোনো এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে তাদের এই ছাত্রসংগঠনটিকে অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে ব্যবহার করে, যা বাইরের মানুষের পক্ষে জানা সম্ভব হয় না। অনেক সময় আবার কোনো কোনো স্বার্থান্বেষী মহলও কিছু ছাত্রসংগঠনকে তাদের স্বার্থ উদ্ধার করার জন্য ব্যবহার করে থাকে। যেমন কোনো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন শিক্ষকের ইচ্ছা হলো তাঁর ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হওয়া প্রয়োজন কিন্তু বর্তমান উপাচার্যের প্রতি যেহেতু সরকার আস্থাশীল সেহেতু তাঁর পক্ষে ওই পদে নিয়োগ সহজ নয়। তিনি অনেক সময় তাঁর অনুগত সহকর্মীদের সহায়তায় ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু বিপথগামী ছাত্রনেতাকে ব্যবহার করে বিশ্ববিদ্যালয়কে অস্থিতিশীল করার অপচেষ্টা করেন। যদিও এমন অঘটন ঘটানোর অপচেষ্টাকারীর সংখ্যা তেমন বড় নয়, তথাপি এ রকম দু-একজনের অপকর্মেই একটি বিশ্ববিদ্যালয় অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে আর সেই ব্যক্তিটি ঘোলা পানিতে মাছ শিকারে নেমে পড়তে পারেন এবং কখনো কখনো সফলও হতে পারেন। এমন ঘটনা অতীতে বাংলাদেশের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটতে দেখা গেছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে যাওয়া দুঃখজনক ঘটনা হঠাৎ ঘটে যাওয়া কোনো বিষয় বলে মনে হয় না। ওই দিনের ঘটনা সম্পর্কে ৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত জরুরি সিন্ডিকেটে প্রক্টর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন। সেই প্রতিবেদন পড়ে এবং বেশ কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শীর সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে পুরো ঘটনা পূর্বপরিকল্পিত ছিল। কয়েক দিন আগে খেলার মাঠে তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে দুই ছাত্র কথা-কাটাকাটি করেছেন। একজন ছাত্রশিবিরের ও অন্যজন ছাত্রলীগের সমর্থক। এরপর ঘটনার দিন ইসলামের ইতিহাস বিভাগের শ্রেণীকক্ষে অন্য দুজন কথা-কাটাকাটি করেছেন এবং একজন অন্যজনকে আঘাত করেছেন। এর কিছু সময় পর ছাত্রশিবিরের একটি মিছিল ইসলামের ইতিহাস বিভাগের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। ঘটনার কথা শুনে উপাচার্য স্বয়ং তাঁর দপ্তর থেকে নেমে মিছিলটির সামনে এসে তাদের ফিরে যেতে অনুরোধ করেন, যা উপাচার্যরা সচরাচর করেন না। এটি তিনি তাঁর দায়িত্ববোধ থেকে করেছেন। কিন্তু মিছিলে অংশগ্রহণকারীরা উপাচার্যের কথায় কর্ণপাত না করে ইসলামের ইতিহাস বিভাগের দিকে চলে যায়। এর কিছুক্ষণ পরই ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানে হঠাৎ করে সংঘাত শুরু হয় এবং দ্রুত ছড়িয়ে পরে, যা পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়া সম্ভব নয়। এর ফলে দুজন ছাত্রের নির্মম মৃত্যু। ক্যাম্পাসে সে সময় ৪০ জনের মতো পুলিশ কর্মরত ছিল। এটি সত্য এই সংখ্যা এই বিশাল ক্যাম্পাসের জন্য মোটেও পর্যাপ্ত নয়। কিন্তু অনেকে এই মত প্রকাশ করেছেন, যে কজন ছিল তারা যদি তাৎক্ষণিক অ্যাকশনে যেত তাহলে হয়তো ঘটনা বেশিদূর নাও যেতে পারত। বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট একটি তদন্ত কমিটি করেছে। কমিটি নিশ্চয় বিষয়টি খতিয়ে দেখবে।
এবার দ্বিতীয় ঘটনাটিতে আসি। অনেকে বলবেন বিষয়টা কাকতালীয়। আমি তা বলতে রাজি নই, কারণ যে এলাকায় ঘটনার সূত্রপাত সেই এলাকাটিকে আমি দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে চিনি। আমার চেয়ে বেশি চেনেন এমন সব মানুষের সঙ্গেও আমি দুদিন কথা বলেছি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একেবার দোরগোড়ায় নন্দীরহাট গ্রাম। শত বছর ধরে এখানে হিন্দু-মুসলমান পাশাপাশি অত্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে বাস করে আসছে। এখানে মসজিদে যেমন আজান দিয়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ হয়, ঠিক তেমনি প্রায় অর্ধডজন মন্দিরে ভক্তরা সকাল-সন্ধ্যা পূজা দেয়। এলাকার ময়রাদের মিষ্টি না হলে মুসলমানদের বাড়িতে বিয়েশাদির অনুষ্ঠান হয় না। আবার মুসলমানদের খেতে কাজ না করলে অনেক হিন্দুর বাড়িতে রান্না চড়ে না। মোটামুটি দু-একটি বাড়ি ছাড়া এলাকার অধিকাংশ পরিবারই নিম্নমধ্যবিত্ত ও দরিদ্র। ঠিক এমন একটি অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ এলাকায় কিছু লোক ৯ ফেব্রুয়ারি অপরাহ্নে কিছু মন্দিরে হামলা করল—এই অভিযোগ এনে মসজিদে জোহরের নামাজের সময় লোকনাথ ব্রহ্মচারী সেবাশ্রমের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা ঢোল বাধ্য বাজিয়েছে। পরে পুলিশ এসে উভয় পক্ষকে শান্ত করে এবং পরদিন বিষয়টির একটি ফায়সালা হবে বলে ঠিক হয়। কিন্তু পরদিন এই গুজব রটে যে রাতে কে বা কারা মসজিদে পাথর ছুড়েছে। এরপর শুক্রবার দিনের বেলায় নন্দীরহাট থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে হাটহাজারী পর্যন্ত অনেকগুলো মন্দির ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ভাঙচুর করা হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, যারা এ অপকর্মে অংশ নিয়েছে তারা প্রায় সবাই বহিরাগত। ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ়। যে ঘটনা কখনো ঘটেনি তা হঠাৎ এখন কেন ঘটবে, তাও মসজিদে পাথর ছোড়ার মতো একটি চরম গর্হিত কাজ? নামাজের সময় মসজিদের কাছে বাধ্য বাজানো নিশ্চয় একটা নিন্দনীয় কাজ। তবে রাতে মসজিদে ঢিল ছুড়বে, এটি মোটেও বিশ্বাসযোগ্য নয়। প্রথমদিকে স্থানীয় সংসদ সদস্য, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এবং এমনকি স্থানীয় বিএনপির নেতারাও চেষ্টা করে এ হাঙ্গামা থামাতে ব্যর্থ হন। পরে পর্যাপ্ত পুলিশ, র্যাব এবং সবশেষে বিজিবি আসে এবং ১৪৪ ধারা জারি করে পরিস্থিতি আয়ত্তে আনে। একবাক্যে সবাই স্বীকার করেছে যারা এই দুদিন এমন একটি শান্তিপূর্ণ এলাকায় ধর্মীয় অনুভূতিকে উসকানি দিয়ে পরিস্থিতি ঘোলাটে করতে চেয়েছিল তাদের উদ্দেশ্য কী ছিল? ইসলামী ছাত্রশিবির চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনাকে কেন্দ্র করে নন্দীরহাটের ঘটনার সূত্রপাতের দিন চট্টগ্রাম শহরে আধবেলা হরতালের নামে বেশ অনেকগুলো গাড়ি ভাঙচুর করেছে। তারা কোনো কোনো এলাকায় যুদ্ধাপরাধীদের দায়ে তাদের অভিযুক্ত নেতাদের মুক্তি দাবি করেছে। সবকিছু একসঙ্গে করলে সহজে এই উপসংহারে আসা যাবে যে এসব কোনো অপকর্মই হঠাৎ ঘটে যাওয়া কোনো বিষয় ছিল না। সবকিছুর পেছনে সুপরিকল্পিত প্রস্তুতি ছিল এবং উদ্দেশ্য একটাই, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করা। সরকার যদি দেয়ালের লিখন পড়তে ব্যর্থ হয় তাহলে বিপদ অবশ্যম্ভাবী। আর যেসব সাংবাদিক বন্ধু এ ধরনের ঘটনা নিয়ে রিপোর্ট করেন তাঁদের রিপোর্টগুলো যদি আরও একটু অনুসন্ধানী হয় তা হলে পাঠক অনেক বিভ্রান্তি হতে রেহাই পাবে।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ২৪ বছরে ১৭ জন ছাত্র নিহত হয়েছে এবং তার বেশির ভাগই হয়েছে একটি ছাত্রসংগঠনের সন্ত্রাসীদের হাতে। সব মৃত্যুই দুঃখজনক। যারা মৃত্যুবরণ করেছে তাদের অভিভাবকেরা তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করতে পাঠিয়েছিল, লাশ হয়ে বাড়ি ফেরার জন্য নয়। দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, এসব অকালমৃত্যুর অনেকগুলোই আমাকে প্রত্যক্ষ করতে হয়েছে। অন্তত একটি ঘটনায় আমিসহ আমার অনেক সহকর্মী ছাত্র নামধারী দুর্বৃত্তদের হাতে আহত হয়েছি। আমার বাড়িতে বোমা পড়েছে, আমাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। যখন কোনো শিক্ষাঙ্গনে ছাত্রসংগঠনগুলোর মাঝে হানাহানি হয় বা রক্তপাতের ঘটনা ঘটে তাৎক্ষণিকভাবে মিডিয়া ছাত্রসংগঠন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও সরকারের ওপর একতরফাভাবে দোষ চাপায়। কিন্তু এসব ঘটনার পেছনের অনেক ঘটনা অনুল্লেখ থেকে যায়, যা সাধারণ মানুষ কখনো জানতে পারে না। পত্রপত্রিকায় পাঠক যা পড়ে বা ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় যা দেখে বা শোনে তা দিয়ে তারা পুরো ঘটনা সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়ার চেষ্টা করে, যা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অর্ধসত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত।
বাংলাদেশে তিনটি প্রধান ছাত্রসংগঠন আছে ছাত্রলীগ, ছাত্রদল ও ছাত্রশিবির। এ ছাড়া কিছু বাম ছাত্রসংগঠন আছে। সাধারণত তাদের তেমন কোনো কর্মকাণ্ড পরিলক্ষিত হয় না। তবে তাদের শৃঙ্খলাবোধ প্রশংসনীয়। ছাত্র বেতন বৃদ্ধি হলে তাদের প্রতিবাদ চোখে পড়ে। প্রথম দুটি দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের ‘আদর্শে’ দীক্ষিত ছাত্রসংগঠন হলেও তাদের ওপর মূল দলের তেমন নিয়ন্ত্রণ নেই, নেই কোনো চেইন অব কমান্ড। উচ্ছৃঙ্খলতাই এদের প্রধান বৈশিষ্ট্য। বর্তমানে ছাত্রলীগ নামধারী কিছু দুর্বৃত্তের কারণে অনেকগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ।
কিন্তু ইসলামী ছাত্রশিবির একেবারেই ব্যতিক্রম। এদের সাংগঠনিক কাঠামো পুরোনো দিনের কমিউনিস্ট পার্টির চেয়েও বেশি রেজিমেন্টেড এবং দলের স্তরবিন্যাস একেবারেই সুনির্দিষ্ট। এদের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এরা তাদের মূল দল জামায়াতের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। জামায়াতের নির্দেশের বাইরে তারা এক কদমও এগোবে না। প্রত্যেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তাদের পরামর্শক বা মুরব্বি হিসেবে কাজ করার জন্য বেশ কিছু শিক্ষক নিয়োজিত থাকেন এবং সাধারণত তাঁরা পার্টি থেকে একটা মোটা অঙ্কের মাসোহারাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পান। অন্য কোনো ছাত্রসংগঠনের ক্ষেত্রে এমন ব্যবস্থা নেই। কোনো শিক্ষাঙ্গনে শিবিরের সঙ্গে সংঘাত হলে প্রথমে চেষ্টা করা হয় এই শিক্ষক-পরামর্শকদের সঙ্গে কথা বলার। অথচ বাইরে এসব সংবাদ কদাচিৎ প্রচারিত হয়। অনেক সময় দেখা যায় জামায়াত তাদের কোনো এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে তাদের এই ছাত্রসংগঠনটিকে অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে ব্যবহার করে, যা বাইরের মানুষের পক্ষে জানা সম্ভব হয় না। অনেক সময় আবার কোনো কোনো স্বার্থান্বেষী মহলও কিছু ছাত্রসংগঠনকে তাদের স্বার্থ উদ্ধার করার জন্য ব্যবহার করে থাকে। যেমন কোনো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন শিক্ষকের ইচ্ছা হলো তাঁর ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হওয়া প্রয়োজন কিন্তু বর্তমান উপাচার্যের প্রতি যেহেতু সরকার আস্থাশীল সেহেতু তাঁর পক্ষে ওই পদে নিয়োগ সহজ নয়। তিনি অনেক সময় তাঁর অনুগত সহকর্মীদের সহায়তায় ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু বিপথগামী ছাত্রনেতাকে ব্যবহার করে বিশ্ববিদ্যালয়কে অস্থিতিশীল করার অপচেষ্টা করেন। যদিও এমন অঘটন ঘটানোর অপচেষ্টাকারীর সংখ্যা তেমন বড় নয়, তথাপি এ রকম দু-একজনের অপকর্মেই একটি বিশ্ববিদ্যালয় অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে আর সেই ব্যক্তিটি ঘোলা পানিতে মাছ শিকারে নেমে পড়তে পারেন এবং কখনো কখনো সফলও হতে পারেন। এমন ঘটনা অতীতে বাংলাদেশের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটতে দেখা গেছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে যাওয়া দুঃখজনক ঘটনা হঠাৎ ঘটে যাওয়া কোনো বিষয় বলে মনে হয় না। ওই দিনের ঘটনা সম্পর্কে ৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত জরুরি সিন্ডিকেটে প্রক্টর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন। সেই প্রতিবেদন পড়ে এবং বেশ কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শীর সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে পুরো ঘটনা পূর্বপরিকল্পিত ছিল। কয়েক দিন আগে খেলার মাঠে তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে দুই ছাত্র কথা-কাটাকাটি করেছেন। একজন ছাত্রশিবিরের ও অন্যজন ছাত্রলীগের সমর্থক। এরপর ঘটনার দিন ইসলামের ইতিহাস বিভাগের শ্রেণীকক্ষে অন্য দুজন কথা-কাটাকাটি করেছেন এবং একজন অন্যজনকে আঘাত করেছেন। এর কিছু সময় পর ছাত্রশিবিরের একটি মিছিল ইসলামের ইতিহাস বিভাগের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। ঘটনার কথা শুনে উপাচার্য স্বয়ং তাঁর দপ্তর থেকে নেমে মিছিলটির সামনে এসে তাদের ফিরে যেতে অনুরোধ করেন, যা উপাচার্যরা সচরাচর করেন না। এটি তিনি তাঁর দায়িত্ববোধ থেকে করেছেন। কিন্তু মিছিলে অংশগ্রহণকারীরা উপাচার্যের কথায় কর্ণপাত না করে ইসলামের ইতিহাস বিভাগের দিকে চলে যায়। এর কিছুক্ষণ পরই ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানে হঠাৎ করে সংঘাত শুরু হয় এবং দ্রুত ছড়িয়ে পরে, যা পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়া সম্ভব নয়। এর ফলে দুজন ছাত্রের নির্মম মৃত্যু। ক্যাম্পাসে সে সময় ৪০ জনের মতো পুলিশ কর্মরত ছিল। এটি সত্য এই সংখ্যা এই বিশাল ক্যাম্পাসের জন্য মোটেও পর্যাপ্ত নয়। কিন্তু অনেকে এই মত প্রকাশ করেছেন, যে কজন ছিল তারা যদি তাৎক্ষণিক অ্যাকশনে যেত তাহলে হয়তো ঘটনা বেশিদূর নাও যেতে পারত। বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট একটি তদন্ত কমিটি করেছে। কমিটি নিশ্চয় বিষয়টি খতিয়ে দেখবে।
এবার দ্বিতীয় ঘটনাটিতে আসি। অনেকে বলবেন বিষয়টা কাকতালীয়। আমি তা বলতে রাজি নই, কারণ যে এলাকায় ঘটনার সূত্রপাত সেই এলাকাটিকে আমি দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে চিনি। আমার চেয়ে বেশি চেনেন এমন সব মানুষের সঙ্গেও আমি দুদিন কথা বলেছি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একেবার দোরগোড়ায় নন্দীরহাট গ্রাম। শত বছর ধরে এখানে হিন্দু-মুসলমান পাশাপাশি অত্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে বাস করে আসছে। এখানে মসজিদে যেমন আজান দিয়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ হয়, ঠিক তেমনি প্রায় অর্ধডজন মন্দিরে ভক্তরা সকাল-সন্ধ্যা পূজা দেয়। এলাকার ময়রাদের মিষ্টি না হলে মুসলমানদের বাড়িতে বিয়েশাদির অনুষ্ঠান হয় না। আবার মুসলমানদের খেতে কাজ না করলে অনেক হিন্দুর বাড়িতে রান্না চড়ে না। মোটামুটি দু-একটি বাড়ি ছাড়া এলাকার অধিকাংশ পরিবারই নিম্নমধ্যবিত্ত ও দরিদ্র। ঠিক এমন একটি অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ এলাকায় কিছু লোক ৯ ফেব্রুয়ারি অপরাহ্নে কিছু মন্দিরে হামলা করল—এই অভিযোগ এনে মসজিদে জোহরের নামাজের সময় লোকনাথ ব্রহ্মচারী সেবাশ্রমের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা ঢোল বাধ্য বাজিয়েছে। পরে পুলিশ এসে উভয় পক্ষকে শান্ত করে এবং পরদিন বিষয়টির একটি ফায়সালা হবে বলে ঠিক হয়। কিন্তু পরদিন এই গুজব রটে যে রাতে কে বা কারা মসজিদে পাথর ছুড়েছে। এরপর শুক্রবার দিনের বেলায় নন্দীরহাট থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে হাটহাজারী পর্যন্ত অনেকগুলো মন্দির ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ভাঙচুর করা হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, যারা এ অপকর্মে অংশ নিয়েছে তারা প্রায় সবাই বহিরাগত। ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ়। যে ঘটনা কখনো ঘটেনি তা হঠাৎ এখন কেন ঘটবে, তাও মসজিদে পাথর ছোড়ার মতো একটি চরম গর্হিত কাজ? নামাজের সময় মসজিদের কাছে বাধ্য বাজানো নিশ্চয় একটা নিন্দনীয় কাজ। তবে রাতে মসজিদে ঢিল ছুড়বে, এটি মোটেও বিশ্বাসযোগ্য নয়। প্রথমদিকে স্থানীয় সংসদ সদস্য, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এবং এমনকি স্থানীয় বিএনপির নেতারাও চেষ্টা করে এ হাঙ্গামা থামাতে ব্যর্থ হন। পরে পর্যাপ্ত পুলিশ, র্যাব এবং সবশেষে বিজিবি আসে এবং ১৪৪ ধারা জারি করে পরিস্থিতি আয়ত্তে আনে। একবাক্যে সবাই স্বীকার করেছে যারা এই দুদিন এমন একটি শান্তিপূর্ণ এলাকায় ধর্মীয় অনুভূতিকে উসকানি দিয়ে পরিস্থিতি ঘোলাটে করতে চেয়েছিল তাদের উদ্দেশ্য কী ছিল? ইসলামী ছাত্রশিবির চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনাকে কেন্দ্র করে নন্দীরহাটের ঘটনার সূত্রপাতের দিন চট্টগ্রাম শহরে আধবেলা হরতালের নামে বেশ অনেকগুলো গাড়ি ভাঙচুর করেছে। তারা কোনো কোনো এলাকায় যুদ্ধাপরাধীদের দায়ে তাদের অভিযুক্ত নেতাদের মুক্তি দাবি করেছে। সবকিছু একসঙ্গে করলে সহজে এই উপসংহারে আসা যাবে যে এসব কোনো অপকর্মই হঠাৎ ঘটে যাওয়া কোনো বিষয় ছিল না। সবকিছুর পেছনে সুপরিকল্পিত প্রস্তুতি ছিল এবং উদ্দেশ্য একটাই, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করা। সরকার যদি দেয়ালের লিখন পড়তে ব্যর্থ হয় তাহলে বিপদ অবশ্যম্ভাবী। আর যেসব সাংবাদিক বন্ধু এ ধরনের ঘটনা নিয়ে রিপোর্ট করেন তাঁদের রিপোর্টগুলো যদি আরও একটু অনুসন্ধানী হয় তা হলে পাঠক অনেক বিভ্রান্তি হতে রেহাই পাবে।
আবদুল মান্নান: সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments