বৃত্তের ভেতরে বৃত্ত-মানুষপাচার : কাটে না আঁধার by দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু
বাংলাদেশ থেকে নারী-শিশুপাচারের উদ্বেগজনক পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয়েছে পুলিশের এক সম্মেলনে। পুলিশ সংস্কার কর্মসূচির আওতায় 'বাংলাদেশ পুলিশের টেকসই সংস্কার : আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতার আলোকে কর্মকৌশল' শীর্ষক ওই সম্মেলনে ইউনিসেফের বরাত দিয়ে ইউএনডিপির ভারপ্রাপ্ত কান্ট্রি ডিরেক্টর বলেছেন, বাংলাদেশ থেকে গত ১০ বছরে তিন লাখ নারী ও শিশু পাচার করে ভারতে নেওয়া হয়েছে। একই সময়ে পাকিস্তানে পাচার হয়েছে দুই লাখ নারী-শিশু।
এদের সিংহভাগেরই বয়স ১২ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। হিসাব অনুযায়ী, প্রতি মাসে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৪০০ নারী-শিশু পাচার হয়ে যাচ্ছে। তারা আন্তর্জাতিক ও দেশীয় পাচারকারীদের শিকারে পরিণত হয়ে করুণ পরিণতি বরণ করছে। এ সম্পর্কিত একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন জাতীয় একটি দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছিল ২০০৯ সালে। সেই প্রতিবেদনে বলা হয়, গত পাঁচ বছরে প্রায় ৮৭ হাজার পাচার হওয়া শিশুকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। অন্যদিকে ২০০৯-১০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক নারী ও শিশুপাচারবিষয়ক প্রতিবেদনে বলা হয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মানুষপাচারের ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। মানুষপাচার রোধে বাংলাদেশ এরই মধ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেও এ অপরাধের সঙ্গে যুক্তদের শাস্তি নিশ্চিত করার বিষয়টি একেবারেই বিবর্ণ। এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না, মূল হোতাদের শনাক্ত করে আইনের হাতে সোপর্দ করে দৃষ্টান্তযোগ্য প্রতিকার নিশ্চিত করা যায়নি বলেই মানুষপাচারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় এখনো দ্বিতীয়।
২০১০ সালের ২১ অক্টোবর 'অভিনব কায়দায় নারী পাচার, ডজনখানেক প্রতিষ্ঠান শনাক্ত'_শিরোনামে দৈনিক জনকণ্ঠে প্রকাশিত প্রতিবেদনে যে তথ্যচিত্র ফুটে উঠেছিল তাও ছিল উদ্বেগজনক এবং সেই পরিস্থিতি থেকে যে উত্তরণ সম্ভব হয়নি, বিদ্যমান পরিস্থিতি এ সাক্ষ্যই বহন করছে। এ দেশে ব্যক্তি বা মহলবিশেষ নিজেদের আখের গোছাতে যেকোনো হীনকর্ম সাধনে উন্মত্ত। আইন-কানুন, সভ্যতা-মানবতা এদের কাছে একেবারেই তুচ্ছ। বলতেই হয়, তাদের খুঁটির জোরও শক্ত। যদি তা-ই না হয় তবে সব কিছুর প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে তারা এত বেপরোয়া হয়ে ওঠে কিভাবে? ওই প্রতিবেদনেই বলা হয়েছিল, অভিনব কায়দায় নারী পাচার হচ্ছে বিভিন্ন দেশে। নারীপাচারের সঙ্গে ডজনখানেক প্রতিষ্ঠানকে শনাক্ত করা হয়েছিল বটে, কিন্তু এর পরও প্রতিকারচিত্র বড় বেশি বিবর্ণ। নারীপাচারের ঘটনা এ দেশে নতুন কিছু নয়, কিন্তু উত্তরোত্তর পাচারের কৌশল পাল্টে যাচ্ছে। বিতর্ক নেই, এই অপকর্ম বেগবান হওয়ার অন্যতম প্রেক্ষাপট দারিদ্র্য। দারিদ্র্যের কশাঘাত তীব্র এবং আবারও বলতে হয়, প্রতিকারের দৃষ্টান্ত উজ্জ্বল না হওয়ায় এমন হীনকর্ম সমাজদেহে কালো ছায়া ফেলছে এবং এর ভবিষ্যৎ যে আরো অনেক বেশি অন্ধকার, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাটা সেখানেই। অভিযোগ আছে, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের দরিদ্র পরিবারের নারীদের কব্জা করতে পাচারকারী চক্রের নিজস্ব এজেন্ট রয়েছে এবং তাদের প্রতারণার জাল অনেক বিস্তৃত। জনকণ্ঠের ওই প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ ছিল, ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার মোহাম্মদ শহীদুল্লাহও বিষয়টির সত্যতা স্বীকার করেন। জনশক্তি রপ্তানির নামে একটি শক্তিশালী চক্র নিত্য ঘটিয়ে চলেছে সভ্যতা-মানবতাবিরোধী এমন অপকর্ম। এর বাইরে ভিন্ন কায়দায়ও তারা এমন হীনকর্ম চালাচ্ছে। জনশক্তি রপ্তানির নামে কত বিচিত্র কায়দায় এমন কাণ্ডকীর্তি চলছে, এর খোঁজ-খবর কে রাখে! আরো অভিযোগ আছে, দরিদ্র পরিবারের সুন্দরী নারীরা এদের টার্গেট এবং প্রতারণার ফাঁদ পেতে ওই নারীদের প্রথমে ঢাকায় আনা হয়, এরপর পাচার করা হয় বিভিন্ন দেশে। ফলে শুধু যে জীবনই ধসে যাচ্ছে তা-ই নয়, বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তিও মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ছে। যাঁরা প্রতারণার ফাঁদে পড়েছেন বা পড়ছেন, তাঁরা যখন বিষয়টি বুঝতে পারেন এবং এও বুঝতে পারেন তাঁদের জীবন বিক্রি হয়ে গেছে এবং এ বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেন তখন তাঁদের হত্যা করা হয়_এমন অভিযোগও আছে।
শুধু নারী নয়, এ দেশ থেকে পুরুষও পাচার হচ্ছে এই প্রতারক চক্রের খপ্পরে পড়ে। কিন্তু নারী-শিশুর ক্ষেত্রে বিষয়টি চরম অমানবিকভাবে ফুটে উঠছে। মানুষকে পণ্য করে ফায়দা লুটছে_এমন মানুষ নামধারী অমানুষরা আমাদের সমাজের মধ্যে দিব্যি ভালো মানুষের মতো ঘোরাফেরা করছে! তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা যাচ্ছে না! মানুষপাচারকারীদের বেপরোয়া দৌরা@ে@@@্যর তালিকায় বাংলাদেশ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে আছে, তাও নতুন খবর নয়। কঠোর আইন থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে মানুষপাচারের ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলেছে_এটি অবশ্যই প্রশ্নবোধক। সমস্যাটি একদিকে সামাজিক, অন্যদিকে মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। ১৯৯৯ সালে সার্ক দেশগুলোর মধ্যে নারী-শিশু পাচারবিরোধী কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু এর কোনো সুফল আজ পর্যন্ত পরিলক্ষিত হয়নি। সার্ক দেশগুলো নারী-শিশুপাচার রোধে সম্মিলিতভাবে উদ্যোগ নেওয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করলেও কার্যক্ষেত্রে তা তেমনভাবে পরিলক্ষিত হয়নি। ২০০৮ সালে গ্লোবাল নিউজের এক অনুসন্ধানী পরিসংখ্যানে দেখানো হয়েছে, প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে গড়ে ২০ হাজারেরও অধিক নারী-শিশু পাচার হচ্ছে। নারী-শিশুপাচার রোধে কঠোর শাস্তির বিধান থাকলেও পাচার থেমে নেই। মাঝেমধ্যে এ অপকর্মে জড়িত কেউ কেউ ধরা পড়লেও পাচারের সঙ্গে জড়িত 'গডফাদার' শ্রেণীর লোকেরা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থাকছে। আর মুখ্যত এ কারণেই বিষয়টি আজ জাতীয় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে।
দেশের প্রচলিত আইনের সংশোধন ছাড়া নারী-শিশুপাচার প্রতিরোধ সম্ভব নয়, নানা মহল থেকে এমন কথা এর মধ্যে বহুবারই বলা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় কি শুধু আইন দিয়ে ঠেকানো সম্ভব? এ প্রশ্নের জবাব তো জটিল কিছু নয়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বে দিন দিন পাচারের ধরন ও কৌশল পাল্টাচ্ছে। এ ব্যাপারে ভিকটিম ও সাক্ষীর নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং পাচার প্রতিরোধে রিক্রুুটিং এজেন্টদের আইনের আওতায় নিয়ে আসাসহ ১১ দফা সুপারিশ নিকট অতীতে বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির পক্ষ থেকে পেশ করা হয়েছিল। আমরা জানি না বিষয়টি এখন কোন পর্যায়ে আছে। বিস্ময়কর হলো, প্রচলিত আইন অনুযায়ী ভিকটিমকেই মামলা প্রমাণ করতে হয়। কিন্তু অন্যান্য দেশে আসামিকেই প্রমাণ করতে হয় সে নিরপরাধ। বাংলাদেশে অভিযোগকারী একদিকে নির্যাতিত-প্রতারিত, অন্যদিকে তাকে দিন যাপন করতে হয় আসামির হুমকির মুখে, নিরাপত্তাহীনভাবে! এই যে উৎকট চিত্র, তা নিরাপদ সমাজ গড়ার কিংবা ভুক্তভোগীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বড় ধরনের প্রতিকূলতা হিসেবে বিদ্যমান।
দারিদ্র্যপীড়িত এ দেশে অনেকেই সজ্ঞানে কিংবা অজ্ঞানে পড়ছেন পাচারকারী চক্রের ফাঁদে। এর সঙ্গে একশ্রেণীর ট্রাভেল এজেন্সির রয়েছে যোগসাজশ। অভিযোগ আছে, তারা নিয়মিত খোঁজ রাখে কোথায় কোন পরিবারে অসহায় নারী কিংবা কিশোরী পারিবারিক কলহ-নির্যাতনসহ অর্থনৈতিক টানাপড়েনের শিকার, কে বা কারা স্বামী কর্তৃক নির্যাতিত, অবহেলিত ও পরিত্যক্ত। অতঃপর দালালের মাধ্যমে এসব নারী ও কিশোরীর কাছে রাখা হয় ভালো চাকরি, উন্নত জীবনযাপনসহ লোভনীয় রোজগারের প্রস্তাব। দেশীয়, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী চক্রের সঙ্গে যোগাযোগকারী এই দালালরা বিস্তৃত সীমান্ত, এমনকি বিমানবন্দর দিয়েও মানুষপাচার করে থাকে। তবে নারী পাচারের ক্ষেত্রে তারা তৎপর বেশি। আরো অভিযোগ আছে_পুলিশ, কাস্টমস, সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষের অসাধুদের সহযোগিতাও তারা লাভ করছে। ভুক্তভোগীদের অভিজ্ঞতা বড় লোমহর্ষক। বাংলাদেশের নারীর এমন দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে নিকট অতীতে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে মার্কিন মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদনেও। নারীপাচার রোধে ২০০৪ সালে পুলিশের অতিরিক্ত আইজির নেতৃত্বে যে সেলটি গঠিত হয়েছিল, তা সক্রিয় আছে কি না এ-ও অজানা। নারীপাচার-সংক্রান্ত মামলারও তেমন অগ্রগতি হয় না_এমন দৃষ্টান্তও সামনেই আছে। ফলে সহজেই পার পেয়ে যায় পাচারকারী চক্রের সদস্যরা।
পাচার একটি জাতীয় সমস্যা। পাচার যেকোনো বয়সের যে কেউ হতে পারে। তবে আমাদের দেশে সাধারণত বেশির ভাগ পাচার হয়ে থাকে শিশু, কিশোরী ও নারী। আরো উদ্বেগজনক হলো, সাম্প্রতিক সময়ে রুট পরিবর্তনের পাশাপাশি মানুষপাচারের ধরনেও পরিবর্তন এসেছে, এ কথা আগেই বলা হয়েছে। পাচারকারীদের কৌশলের কারণে কঠিন হয়ে যাচ্ছে পাচারের ঘটনাগুলোর শনাক্তকরণও। বড় ধরনের তথ্য ঘাটতি রয়েছে পাচারের সংজ্ঞার মূল্যায়ন নিয়েও। আইনের মারপ্যাঁচে অহরহ ছাড় পেয়ে যাচ্ছে দালাল নামধারী পাচারকারীরা। পাচার হওয়ার পর শিশু ও নারীরা প্রাচীনকালের শৃঙ্খলিত দাস-দাসীদের চেয়েও মানবেতর জীবনযাপন করে, এমন তথ্যচিত্রও আমরা দেখেছি পত্রপত্রিকায়। অনেক ক্ষেত্রে মৃত্যুরও মুখোমুখি হচ্ছে এই হতভাগ্যরা। প্রশ্ন হচ্ছে, এর অবসান কি দুরূহ?
আইনের শাসন, ন্যায়বিচার, রাষ্ট্রশক্তি কিংবা প্রশাসনের দায়বদ্ধতা-জবাবদিহিতা এসব বিষয় নিশ্চিত করার তাগিদ নানা মহল থেকে এযাবৎ কম উচ্চারিত হয়নি। এখনো হচ্ছে। কিন্তু বিষয়টি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, বকাউল্লারা বকছেন আর শোনাউল্লারা কেবলই শুনছেন! একটি দেশ বা সমাজে অশুভ কিংবা সমাজবিরোধী শক্তি দাপিয়ে বেড়াবে আর এর বিপরীতে রাষ্ট্রশক্তি কিংবা প্রশাসনের কিছুই করার থাকবে না_তা তো হতে পারে না। জননিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রশক্তি আর প্রশাসনের বড় দায়_এটি স্মরণ করিয়ে দেওয়া অনাবশ্যক। মানুষ পণ্যের মতো বেচাকেনার উপকরণ হবে, তা এই সভ্যকালে অচিন্তনীয়। এই দেশ, এই সমাজ অপশক্তির অভয়ারণ্য_এমন ভাবনার অবসান ঘটানোর দায়দায়িত্ব যাঁদের, তাঁরা স্ব-স্ব দায়িত্ব-কর্তব্য পালনে কতটা নিষ্ঠ, এ প্রশ্নও ওঠে। আলোচনা-পর্যালোচনা, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম ইত্যাদি সমস্যা সমাধানের দাওয়াই নয়_রোগ নির্ণয়ের সহায়ক শক্তি হতে পারে মাত্র। দাওয়াই হলো আইনি পদক্ষেপ, প্রশাসনিক কর্মতৎপরতা আর দায়িত্বশীলদের দায়িত্ব-কর্তব্য পালনে নিষ্ঠ হওয়া। তা না হলে আঁধার কাটবে না কখনো।
লেখক : সাংবাদিক
deba_bishnu@yahoo.com
২০১০ সালের ২১ অক্টোবর 'অভিনব কায়দায় নারী পাচার, ডজনখানেক প্রতিষ্ঠান শনাক্ত'_শিরোনামে দৈনিক জনকণ্ঠে প্রকাশিত প্রতিবেদনে যে তথ্যচিত্র ফুটে উঠেছিল তাও ছিল উদ্বেগজনক এবং সেই পরিস্থিতি থেকে যে উত্তরণ সম্ভব হয়নি, বিদ্যমান পরিস্থিতি এ সাক্ষ্যই বহন করছে। এ দেশে ব্যক্তি বা মহলবিশেষ নিজেদের আখের গোছাতে যেকোনো হীনকর্ম সাধনে উন্মত্ত। আইন-কানুন, সভ্যতা-মানবতা এদের কাছে একেবারেই তুচ্ছ। বলতেই হয়, তাদের খুঁটির জোরও শক্ত। যদি তা-ই না হয় তবে সব কিছুর প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে তারা এত বেপরোয়া হয়ে ওঠে কিভাবে? ওই প্রতিবেদনেই বলা হয়েছিল, অভিনব কায়দায় নারী পাচার হচ্ছে বিভিন্ন দেশে। নারীপাচারের সঙ্গে ডজনখানেক প্রতিষ্ঠানকে শনাক্ত করা হয়েছিল বটে, কিন্তু এর পরও প্রতিকারচিত্র বড় বেশি বিবর্ণ। নারীপাচারের ঘটনা এ দেশে নতুন কিছু নয়, কিন্তু উত্তরোত্তর পাচারের কৌশল পাল্টে যাচ্ছে। বিতর্ক নেই, এই অপকর্ম বেগবান হওয়ার অন্যতম প্রেক্ষাপট দারিদ্র্য। দারিদ্র্যের কশাঘাত তীব্র এবং আবারও বলতে হয়, প্রতিকারের দৃষ্টান্ত উজ্জ্বল না হওয়ায় এমন হীনকর্ম সমাজদেহে কালো ছায়া ফেলছে এবং এর ভবিষ্যৎ যে আরো অনেক বেশি অন্ধকার, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাটা সেখানেই। অভিযোগ আছে, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের দরিদ্র পরিবারের নারীদের কব্জা করতে পাচারকারী চক্রের নিজস্ব এজেন্ট রয়েছে এবং তাদের প্রতারণার জাল অনেক বিস্তৃত। জনকণ্ঠের ওই প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ ছিল, ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার মোহাম্মদ শহীদুল্লাহও বিষয়টির সত্যতা স্বীকার করেন। জনশক্তি রপ্তানির নামে একটি শক্তিশালী চক্র নিত্য ঘটিয়ে চলেছে সভ্যতা-মানবতাবিরোধী এমন অপকর্ম। এর বাইরে ভিন্ন কায়দায়ও তারা এমন হীনকর্ম চালাচ্ছে। জনশক্তি রপ্তানির নামে কত বিচিত্র কায়দায় এমন কাণ্ডকীর্তি চলছে, এর খোঁজ-খবর কে রাখে! আরো অভিযোগ আছে, দরিদ্র পরিবারের সুন্দরী নারীরা এদের টার্গেট এবং প্রতারণার ফাঁদ পেতে ওই নারীদের প্রথমে ঢাকায় আনা হয়, এরপর পাচার করা হয় বিভিন্ন দেশে। ফলে শুধু যে জীবনই ধসে যাচ্ছে তা-ই নয়, বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তিও মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ছে। যাঁরা প্রতারণার ফাঁদে পড়েছেন বা পড়ছেন, তাঁরা যখন বিষয়টি বুঝতে পারেন এবং এও বুঝতে পারেন তাঁদের জীবন বিক্রি হয়ে গেছে এবং এ বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেন তখন তাঁদের হত্যা করা হয়_এমন অভিযোগও আছে।
শুধু নারী নয়, এ দেশ থেকে পুরুষও পাচার হচ্ছে এই প্রতারক চক্রের খপ্পরে পড়ে। কিন্তু নারী-শিশুর ক্ষেত্রে বিষয়টি চরম অমানবিকভাবে ফুটে উঠছে। মানুষকে পণ্য করে ফায়দা লুটছে_এমন মানুষ নামধারী অমানুষরা আমাদের সমাজের মধ্যে দিব্যি ভালো মানুষের মতো ঘোরাফেরা করছে! তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা যাচ্ছে না! মানুষপাচারকারীদের বেপরোয়া দৌরা@ে@@@্যর তালিকায় বাংলাদেশ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে আছে, তাও নতুন খবর নয়। কঠোর আইন থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে মানুষপাচারের ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলেছে_এটি অবশ্যই প্রশ্নবোধক। সমস্যাটি একদিকে সামাজিক, অন্যদিকে মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। ১৯৯৯ সালে সার্ক দেশগুলোর মধ্যে নারী-শিশু পাচারবিরোধী কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু এর কোনো সুফল আজ পর্যন্ত পরিলক্ষিত হয়নি। সার্ক দেশগুলো নারী-শিশুপাচার রোধে সম্মিলিতভাবে উদ্যোগ নেওয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করলেও কার্যক্ষেত্রে তা তেমনভাবে পরিলক্ষিত হয়নি। ২০০৮ সালে গ্লোবাল নিউজের এক অনুসন্ধানী পরিসংখ্যানে দেখানো হয়েছে, প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে গড়ে ২০ হাজারেরও অধিক নারী-শিশু পাচার হচ্ছে। নারী-শিশুপাচার রোধে কঠোর শাস্তির বিধান থাকলেও পাচার থেমে নেই। মাঝেমধ্যে এ অপকর্মে জড়িত কেউ কেউ ধরা পড়লেও পাচারের সঙ্গে জড়িত 'গডফাদার' শ্রেণীর লোকেরা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থাকছে। আর মুখ্যত এ কারণেই বিষয়টি আজ জাতীয় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে।
দেশের প্রচলিত আইনের সংশোধন ছাড়া নারী-শিশুপাচার প্রতিরোধ সম্ভব নয়, নানা মহল থেকে এমন কথা এর মধ্যে বহুবারই বলা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় কি শুধু আইন দিয়ে ঠেকানো সম্ভব? এ প্রশ্নের জবাব তো জটিল কিছু নয়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বে দিন দিন পাচারের ধরন ও কৌশল পাল্টাচ্ছে। এ ব্যাপারে ভিকটিম ও সাক্ষীর নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং পাচার প্রতিরোধে রিক্রুুটিং এজেন্টদের আইনের আওতায় নিয়ে আসাসহ ১১ দফা সুপারিশ নিকট অতীতে বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির পক্ষ থেকে পেশ করা হয়েছিল। আমরা জানি না বিষয়টি এখন কোন পর্যায়ে আছে। বিস্ময়কর হলো, প্রচলিত আইন অনুযায়ী ভিকটিমকেই মামলা প্রমাণ করতে হয়। কিন্তু অন্যান্য দেশে আসামিকেই প্রমাণ করতে হয় সে নিরপরাধ। বাংলাদেশে অভিযোগকারী একদিকে নির্যাতিত-প্রতারিত, অন্যদিকে তাকে দিন যাপন করতে হয় আসামির হুমকির মুখে, নিরাপত্তাহীনভাবে! এই যে উৎকট চিত্র, তা নিরাপদ সমাজ গড়ার কিংবা ভুক্তভোগীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বড় ধরনের প্রতিকূলতা হিসেবে বিদ্যমান।
দারিদ্র্যপীড়িত এ দেশে অনেকেই সজ্ঞানে কিংবা অজ্ঞানে পড়ছেন পাচারকারী চক্রের ফাঁদে। এর সঙ্গে একশ্রেণীর ট্রাভেল এজেন্সির রয়েছে যোগসাজশ। অভিযোগ আছে, তারা নিয়মিত খোঁজ রাখে কোথায় কোন পরিবারে অসহায় নারী কিংবা কিশোরী পারিবারিক কলহ-নির্যাতনসহ অর্থনৈতিক টানাপড়েনের শিকার, কে বা কারা স্বামী কর্তৃক নির্যাতিত, অবহেলিত ও পরিত্যক্ত। অতঃপর দালালের মাধ্যমে এসব নারী ও কিশোরীর কাছে রাখা হয় ভালো চাকরি, উন্নত জীবনযাপনসহ লোভনীয় রোজগারের প্রস্তাব। দেশীয়, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী চক্রের সঙ্গে যোগাযোগকারী এই দালালরা বিস্তৃত সীমান্ত, এমনকি বিমানবন্দর দিয়েও মানুষপাচার করে থাকে। তবে নারী পাচারের ক্ষেত্রে তারা তৎপর বেশি। আরো অভিযোগ আছে_পুলিশ, কাস্টমস, সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষের অসাধুদের সহযোগিতাও তারা লাভ করছে। ভুক্তভোগীদের অভিজ্ঞতা বড় লোমহর্ষক। বাংলাদেশের নারীর এমন দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে নিকট অতীতে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে মার্কিন মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদনেও। নারীপাচার রোধে ২০০৪ সালে পুলিশের অতিরিক্ত আইজির নেতৃত্বে যে সেলটি গঠিত হয়েছিল, তা সক্রিয় আছে কি না এ-ও অজানা। নারীপাচার-সংক্রান্ত মামলারও তেমন অগ্রগতি হয় না_এমন দৃষ্টান্তও সামনেই আছে। ফলে সহজেই পার পেয়ে যায় পাচারকারী চক্রের সদস্যরা।
পাচার একটি জাতীয় সমস্যা। পাচার যেকোনো বয়সের যে কেউ হতে পারে। তবে আমাদের দেশে সাধারণত বেশির ভাগ পাচার হয়ে থাকে শিশু, কিশোরী ও নারী। আরো উদ্বেগজনক হলো, সাম্প্রতিক সময়ে রুট পরিবর্তনের পাশাপাশি মানুষপাচারের ধরনেও পরিবর্তন এসেছে, এ কথা আগেই বলা হয়েছে। পাচারকারীদের কৌশলের কারণে কঠিন হয়ে যাচ্ছে পাচারের ঘটনাগুলোর শনাক্তকরণও। বড় ধরনের তথ্য ঘাটতি রয়েছে পাচারের সংজ্ঞার মূল্যায়ন নিয়েও। আইনের মারপ্যাঁচে অহরহ ছাড় পেয়ে যাচ্ছে দালাল নামধারী পাচারকারীরা। পাচার হওয়ার পর শিশু ও নারীরা প্রাচীনকালের শৃঙ্খলিত দাস-দাসীদের চেয়েও মানবেতর জীবনযাপন করে, এমন তথ্যচিত্রও আমরা দেখেছি পত্রপত্রিকায়। অনেক ক্ষেত্রে মৃত্যুরও মুখোমুখি হচ্ছে এই হতভাগ্যরা। প্রশ্ন হচ্ছে, এর অবসান কি দুরূহ?
আইনের শাসন, ন্যায়বিচার, রাষ্ট্রশক্তি কিংবা প্রশাসনের দায়বদ্ধতা-জবাবদিহিতা এসব বিষয় নিশ্চিত করার তাগিদ নানা মহল থেকে এযাবৎ কম উচ্চারিত হয়নি। এখনো হচ্ছে। কিন্তু বিষয়টি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, বকাউল্লারা বকছেন আর শোনাউল্লারা কেবলই শুনছেন! একটি দেশ বা সমাজে অশুভ কিংবা সমাজবিরোধী শক্তি দাপিয়ে বেড়াবে আর এর বিপরীতে রাষ্ট্রশক্তি কিংবা প্রশাসনের কিছুই করার থাকবে না_তা তো হতে পারে না। জননিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রশক্তি আর প্রশাসনের বড় দায়_এটি স্মরণ করিয়ে দেওয়া অনাবশ্যক। মানুষ পণ্যের মতো বেচাকেনার উপকরণ হবে, তা এই সভ্যকালে অচিন্তনীয়। এই দেশ, এই সমাজ অপশক্তির অভয়ারণ্য_এমন ভাবনার অবসান ঘটানোর দায়দায়িত্ব যাঁদের, তাঁরা স্ব-স্ব দায়িত্ব-কর্তব্য পালনে কতটা নিষ্ঠ, এ প্রশ্নও ওঠে। আলোচনা-পর্যালোচনা, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম ইত্যাদি সমস্যা সমাধানের দাওয়াই নয়_রোগ নির্ণয়ের সহায়ক শক্তি হতে পারে মাত্র। দাওয়াই হলো আইনি পদক্ষেপ, প্রশাসনিক কর্মতৎপরতা আর দায়িত্বশীলদের দায়িত্ব-কর্তব্য পালনে নিষ্ঠ হওয়া। তা না হলে আঁধার কাটবে না কখনো।
লেখক : সাংবাদিক
deba_bishnu@yahoo.com
No comments