কৃষিবিদ দিবস এবং বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন by ড. জীবন কৃষ্ণ বিশ্বাস
কৃষির আবিষ্কার না হলে মানুষ সভ্য হতো না, এ কথা আজ জোর দিয়েই বলা যায়। অথচ আদিমতম এই পেশাটি আমাদের দেশে আগে তেমন কল্কে পায়নি। এই পেশার ধারক-বাহক যে সব সাধারণ মানুষ, সমাজে তাদের এই কিছুকাল আগেও অচ্ছ্যুৎ করে রাখা হয়েছিল। এমনকি তাদের জন্য প্রযোজ্য চাষা শব্দটিকে গালি হিসেবে ব্যবহার করা হতো।
এদের (চাষিদের) যাঁরা কিছুটা বুদ্ধিবৃত্তিক ও প্রায়োগিক জ্ঞান দিয়ে সাহায্য করার জন্য পাশে থাকার চেষ্টা করতেন, সেই মানুষগুলোও সমাজে বেশ ব্রাত্য ছিলেন বলা যায়। তাই ঊনবিংশ শতাব্দীর একপর্যায়ে কিছু কিছু মানবদরদির চেষ্টায় কৃষি নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু হলেও কাজের কাজ তেমন কিছুই হয়নি। তার পরও কিছু মানুষ কাজ ভালোবাসেন। তাঁরাই একভাবে টেনেটুনে আমাদের ঐতিহ্যগত কৃষিকে বিগত শতকের সত্তর দশকের দোরগোড়ায় এনে হাজির করেন। তবে এই কৃষির সামর্থ্য আমাদের বর্ধিষ্ণু জনসংখ্যার জন্য একেবারেই অপ্রতুল ছিল। তাই অভাব ছিল আমাদের নিত্যসঙ্গী। দেশে তখন সাত কোটির মতো মানুষ। অথচ ২০-৩০ লাখ টনের মতো খাদ্য ঘাটতি। এমনি সময় পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্য নীতির কারণে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থা একেবারে সঙ্গিন। বঙ্গবন্ধু তখন তার বজ্রকণ্ঠ নিয়ে হাজির হন। আমরা স্বাধীনতা লাভ করি। সদ্য স্বাধীন দেশে তখন হাজারো সমস্যা। তবে এসব সমস্যার ভিড়ে ভাতের অভাবের কোনো তুলনা চলে না। তাঁর (বঙ্গবন্ধুর) ভাবনায় ছিল, 'আমাদের গোটা কৃষিব্যবস্থায় বিপ্লবের সূচনা অত্যাবশ্যক।' তিনি ঘোষণা দিলেন, 'কৃষিব্যবস্থাকে অবশ্যই আধুনিকীকরণ করতে হবে। প্রাকৃতিক সম্পদের সর্বাধিক উন্নয়নের জন্য বৈজ্ঞানিক তৎপরতা চালাতে হবে।' ইতিমধ্যে দু-একটি উচ্চ ফলনশীল গম এবং ধানের জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। তত দিনে ড. নরমাল বরলগের সবুজ বিপ্লবের ঢেউ এসে গেছে উপমহাদেশে। এই ঢেউয়ে ভারত গম উৎপাদনে অনেকখানি এগিয়ে যায়। পাকিস্তানও কিছুটা। বলা যায়, এই সাফল্যই বরলগের নবেল শান্তি পুরস্কারের অনেকখানি পাথেয় জোগায়। আর এ বিষয়টি বোধ হয় বঙ্গবন্ধুর মনে ধরেছিল। তাই স্বাধীনতার পর পরই তিনি সম্ভাবনাময় সবুজ বিপ্লবের গুরুত্ব বুঝতে মোটেই দেরি করেননি। বলতে হয়, বাঙালিকে নিয়ে তাঁর প্রথম স্বপ্ন ছিল স্বাধীনতা। আর দ্বিতীয় স্বপ্ন ছিল ধনেজনে সমৃদ্ধ সোনার বাংলা। যেখানে কেউ না খেয়ে কষ্ট পাবে না।
তাঁর সবুজ বিপ্লবের শুরুটা ছিল অভিনব। স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গেই বিধ্বস্ত অর্থনীতির মধ্যে তিনি গ্রামের ২২ লাখ চাষি পরিবারকে পুনর্বাসনের কাজে হাত দেন। তাদের বিনামূল্যে বীজ, সার, কীটনাশক ও আনুষঙ্গিক উপকরণ সরবরাহের ব্যবস্থা করেন। ১৯৭৩ সালের মধ্যেই ৪০ হাজার লো-লিফট পাম্প, দুই হাজার ৯০০ গভীর ও তিন হাজার অগভীর নলকূপ বসানো হয়। বিনামূল্যে বা নামমাত্র মূল্যে ১৯৭২ সালে ১৬ হাজার ১২৫ টন উচ্চ ফলনশীল ধান, ৪৪ টন পাটের বীজ, এক হাজার ৩৭ টন গমের বীজ বিতরণের ব্যবস্থা করেন। এ ছাড়া পাকিস্তান আমলে ঋণগ্রস্ত চাষিদের নামে জারি করা ১০ লাখের ওপর সার্টিফিকেট মামলা উঠিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করেন। সঙ্গে সঙ্গে বকেয়া সুদসহ তাবৎ ঋণ মাফ করে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। কৃষিপণ্য, বিশেষ করে ধান, পাট এবং আখের ন্যায্যমূল্যপ্রাপ্তির লক্ষ্যে নূ্যনতম মূল্য বেঁধে দেওয়া হয়। গরিব চাষিদের রেশনের ব্যবস্থা করা হয়। তাদের ছেলেমেয়েদের বিনা বেতনে ও সরকারি খরচে পড়াশোনার ব্যবস্থা করা হয়। ভূমিহীন চাষিদের মধ্যে ভূমি দানের লক্ষ্যে বড় চাষিদের জন্য ১০০ বিঘা পরিমাণ জমির সিলিং বেঁধে দেওয়া হয়। ফলে বড় চাষিরা ইচ্ছে করলেও আর ১০০ বিঘার বেশি জমি রাখতে পারবে না বলে ঠিক করা হয়। একই সঙ্গে ৩৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মাফ করে দেওয়া হয়। ১৯৭০ সালে সারা দেশে সেচের আওতাধীন জমির পরিমাণ ছিল ২৬ লাখ একর। ১৯৭৫ সালে এই পরিমাণ দাঁড়ায় ৩৬ লাখ একরে। ১৯৬৯-৭০ সালের তুলনায় ১৯৭৩-৭৪ সালে রাসায়নিক সার ৭৪ শতাংশ, কীটনাশক ৪০ শতাংশ, উচ্চ ফলনশীল বীজ ব্যবহারের পরিমাণ ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। কৃষি গবেষণার ক্ষেত্রে বিশেষ জোর দেওয়া হয়। (আমার স্বপ্ন, আমার সংগ্রাম, শেখ হাসিনা, বেবী মওদুদ সম্পাদিত গ্রন্থ থেকে)। ১৯৭৩ সালে পার্লামেন্টারি অ্যাক্ট-১০-এর মাধ্যমে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) একটি পূর্ণাঙ্গ গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবে আইনগত বৈধতা লাভ করে। প্রতিষ্ঠানটি কয়েক বছরের মধ্যে একটি অনন্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বীকৃতি লাভ করে। বর্তমানে ব্রি চারটি হাইব্রিড ধানসহ মোট ৬০টি আধুনিক ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে। ফলে জনসংখ্যা দুই গুণের বেশি বাড়লেও চালের উৎপাদন বেড়েছে তিন গুণেরও বেশি। অবিরত খাদ্য সমস্যায় ভুগতে থাকা আমাদের দেশ এখন ভাতের অভাব প্রায় মিটিয়ে ফেলেছে। সহজ কথায়, এখন আর কেউ ভাতের অভাবে কষ্ট পায় না। একই সঙ্গে কৃষি, পাট, ইক্ষু ও চা গবেষণাসহ মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ গবেষণায়ও লক্ষ্যযোগ্য উন্নতি ঘটে গেছে। হয়তো এই উন্নয়ন সব ক্ষেত্রে একই মাত্রায় ঘটেনি। তবুও উন্নয়ন যে ঘটেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আর এসব উন্নয়নের কলকাঠি যার হাতে ছিল, তিনি আর কেউ নন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি কৃষি, কৃষক এবং কৃষিবিদদের যথাযোগ্য মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তিনি ছিলেন মাটির সন্তান। তাঁর জীবনের শুরু গ্রামে। ফলে কৃষি এবং কৃষককে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ তাঁর হয়েছিল।
কৃষি ও কৃষককে নিয়ে তাঁর চিন্তাভাবনার কথা কিছুটা বলেছি। কৃষিবিদদের মর্যাদা দানের বিষয়টি একটু খোলসা করে বলতে হয়। আগে কৃষিবিদ অর্থাৎ কৃষি গ্র্যাজুয়েটরা প্রথম শ্রেণীর মর্যাদা পেতেন না। তাই কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর পরই ১৯৬৪ সালে কৃষিবিদ ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা যথাযথ মর্যাদার দাবিতে বেশ তৎপর হয়ে ওঠেন। এই দাবির প্রতি অন্য পেশাজীবীরাও একসময় সমর্থন জানান। কিন্তু দাবিটি তখন আমলে নেওয়া হয়নি। তবে কৃষিবিদ বা কৃষি ছাত্ররা কখনো হাল ছেড়ে দেননি। হয়তো বা তাঁরা সময়ের অপেক্ষায় ছিলেন। স্বাধীনতার পর আবার তাঁরা তৎপর হন। বাকসু নির্বাচনে পূর্ণ প্যানেল জয়ের পর বঙ্গবন্ধুর আমন্ত্রণে নেতৃবৃন্দ তাঁর সঙ্গে দেখা করেন ১৪ জুন, ১৯৭২। তাঁদের পুরোভাগের কয়েকজনের মধ্যে অন্যতম ছিলেন তৎকালীন বাকসুর সহসভাপতি নজিবর রহমান এবং সাধারণ সম্পাদক ড. আবদুর রাজ্জাক (বর্তমান সরকারের খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী)। তাঁদের অনুরোধে তিনি ১৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৩ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনে সম্মত হন। তা ছিল নির্বাচনী সফরের একপর্যায়ে সময় করে নেওয়া সফর। কিন্তু ওই সফরে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে তিনি নির্বাচনসংক্রান্ত একটি কথাও বলেননি। সেখানে তিনি তাঁর স্বভাবসিদ্ধ একটি ভাষণ দিয়েছিলেন। যার প্রথম অংশে ছিল_আমাদের স্বাধীনতার পটভূমি কিভাবে রচিত হয় তা নিয়ে। আর পরের অংশ ছিল কৃষি এবং কৃষি উন্নয়ন নিয়ে দিকনির্দেশনা প্রদান। আর এই দিকনির্দেশনা কৃষিবিদদের জন্য আজও এক অনন্য দলিল হয়ে আছে। এখানেই তিনি কৃষিবিদদের যথাযথ মর্যাদা দেওয়ার কথা বলে গেছেন। ওই ভাষণে তিনি বলেছিলেন, 'আমার ভাইয়েরা যে অভিনন্দন দিয়েছেন তাতে লেখা হয়েছে, অন্যান্য ইঞ্জিনিয়ার-ডাক্তারদের যে মর্যাদা; কৃষি গ্র্যাজুয়েটদেরও সে মর্যাদা দিতে হবে।' পরেই তিনি জোর দিয়ে বলেছিলেন, 'মর্যাদা দিতে কোনো আপত্তি আমার নেই।' বঙ্গবন্ধু সে কথা রেখেছিলেন। অন্য পেশাজীবীদের মতো কৃষিবিদরা চাকরি ক্ষেত্রে প্রথম শ্রেণীর মর্যাদা পেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁকে হত্যা করার পর যারা ক্ষমতায় আসে, তারা আবার কৃষিবিদদের অবমূল্যায়ন করার চেষ্টা করে।
বঙ্গবন্ধু যেদিন কৃষিবিদদের জন্য ওই ঐতিহাসিক ঘোষণাটি দেন, সেদিন ছিল ১৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৩। এরপর বিভিন্ন ধারার রাজনীতির ডামাডোলে এই বিশেষ দিনটিকে মনে করার কোনো ব্যবস্থা করা যায়নি। অবশেষে 'কৃষিবিদ ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ'-এর মহাসচিব কৃষিবিদ আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিমের (জাতীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব) একান্ত চেষ্টায় এই দিনটিকে 'কৃষিবিদ দিবস' হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং ২০১১-এ যথাযোগ্য মর্যাদায় দিনটিকে কৃষিবিদ দিবস হিসেবে পালন করা হয়। ২০১২ সালেও একইভাবে দিনটি উদ্যাপন করা হয়েছে। আশা করি, এভাবেই অনাদিকাল ধরে এই দিবসটিকে স্মরণ করা হবে। ছড়াকার, বিখ্যাত আমলা এবং বিচারক অন্নদা শংকর রায় বঙ্গবন্ধুর উদ্দেশে নিবেদিত ছড়ায় বলেছিলেন_'যত দিন রবে পদ্মা মেঘনা গৌরী যমুনা বহমান/তত দিন রবে কীর্তি তোমার, শেখ মুজিবুর রহমান।' কৃষিবিদদের মর্যাদা প্রদান তাঁর অনেক কীর্তির মধ্যে একটি। আমরা কৃষিবিদরা একান্তভাবেই বিশ্বাস করি, এটিও পদ্মা-যমুনা-গড়াই-মেঘনার মতো সতত বহমান থাকবে।
লেখক : পরিচালক (প্রশাসন ও সাধারণ পরিচর্যা),
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট
তাঁর সবুজ বিপ্লবের শুরুটা ছিল অভিনব। স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গেই বিধ্বস্ত অর্থনীতির মধ্যে তিনি গ্রামের ২২ লাখ চাষি পরিবারকে পুনর্বাসনের কাজে হাত দেন। তাদের বিনামূল্যে বীজ, সার, কীটনাশক ও আনুষঙ্গিক উপকরণ সরবরাহের ব্যবস্থা করেন। ১৯৭৩ সালের মধ্যেই ৪০ হাজার লো-লিফট পাম্প, দুই হাজার ৯০০ গভীর ও তিন হাজার অগভীর নলকূপ বসানো হয়। বিনামূল্যে বা নামমাত্র মূল্যে ১৯৭২ সালে ১৬ হাজার ১২৫ টন উচ্চ ফলনশীল ধান, ৪৪ টন পাটের বীজ, এক হাজার ৩৭ টন গমের বীজ বিতরণের ব্যবস্থা করেন। এ ছাড়া পাকিস্তান আমলে ঋণগ্রস্ত চাষিদের নামে জারি করা ১০ লাখের ওপর সার্টিফিকেট মামলা উঠিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করেন। সঙ্গে সঙ্গে বকেয়া সুদসহ তাবৎ ঋণ মাফ করে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। কৃষিপণ্য, বিশেষ করে ধান, পাট এবং আখের ন্যায্যমূল্যপ্রাপ্তির লক্ষ্যে নূ্যনতম মূল্য বেঁধে দেওয়া হয়। গরিব চাষিদের রেশনের ব্যবস্থা করা হয়। তাদের ছেলেমেয়েদের বিনা বেতনে ও সরকারি খরচে পড়াশোনার ব্যবস্থা করা হয়। ভূমিহীন চাষিদের মধ্যে ভূমি দানের লক্ষ্যে বড় চাষিদের জন্য ১০০ বিঘা পরিমাণ জমির সিলিং বেঁধে দেওয়া হয়। ফলে বড় চাষিরা ইচ্ছে করলেও আর ১০০ বিঘার বেশি জমি রাখতে পারবে না বলে ঠিক করা হয়। একই সঙ্গে ৩৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মাফ করে দেওয়া হয়। ১৯৭০ সালে সারা দেশে সেচের আওতাধীন জমির পরিমাণ ছিল ২৬ লাখ একর। ১৯৭৫ সালে এই পরিমাণ দাঁড়ায় ৩৬ লাখ একরে। ১৯৬৯-৭০ সালের তুলনায় ১৯৭৩-৭৪ সালে রাসায়নিক সার ৭৪ শতাংশ, কীটনাশক ৪০ শতাংশ, উচ্চ ফলনশীল বীজ ব্যবহারের পরিমাণ ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। কৃষি গবেষণার ক্ষেত্রে বিশেষ জোর দেওয়া হয়। (আমার স্বপ্ন, আমার সংগ্রাম, শেখ হাসিনা, বেবী মওদুদ সম্পাদিত গ্রন্থ থেকে)। ১৯৭৩ সালে পার্লামেন্টারি অ্যাক্ট-১০-এর মাধ্যমে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) একটি পূর্ণাঙ্গ গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবে আইনগত বৈধতা লাভ করে। প্রতিষ্ঠানটি কয়েক বছরের মধ্যে একটি অনন্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বীকৃতি লাভ করে। বর্তমানে ব্রি চারটি হাইব্রিড ধানসহ মোট ৬০টি আধুনিক ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে। ফলে জনসংখ্যা দুই গুণের বেশি বাড়লেও চালের উৎপাদন বেড়েছে তিন গুণেরও বেশি। অবিরত খাদ্য সমস্যায় ভুগতে থাকা আমাদের দেশ এখন ভাতের অভাব প্রায় মিটিয়ে ফেলেছে। সহজ কথায়, এখন আর কেউ ভাতের অভাবে কষ্ট পায় না। একই সঙ্গে কৃষি, পাট, ইক্ষু ও চা গবেষণাসহ মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ গবেষণায়ও লক্ষ্যযোগ্য উন্নতি ঘটে গেছে। হয়তো এই উন্নয়ন সব ক্ষেত্রে একই মাত্রায় ঘটেনি। তবুও উন্নয়ন যে ঘটেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আর এসব উন্নয়নের কলকাঠি যার হাতে ছিল, তিনি আর কেউ নন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি কৃষি, কৃষক এবং কৃষিবিদদের যথাযোগ্য মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তিনি ছিলেন মাটির সন্তান। তাঁর জীবনের শুরু গ্রামে। ফলে কৃষি এবং কৃষককে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ তাঁর হয়েছিল।
কৃষি ও কৃষককে নিয়ে তাঁর চিন্তাভাবনার কথা কিছুটা বলেছি। কৃষিবিদদের মর্যাদা দানের বিষয়টি একটু খোলসা করে বলতে হয়। আগে কৃষিবিদ অর্থাৎ কৃষি গ্র্যাজুয়েটরা প্রথম শ্রেণীর মর্যাদা পেতেন না। তাই কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর পরই ১৯৬৪ সালে কৃষিবিদ ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা যথাযথ মর্যাদার দাবিতে বেশ তৎপর হয়ে ওঠেন। এই দাবির প্রতি অন্য পেশাজীবীরাও একসময় সমর্থন জানান। কিন্তু দাবিটি তখন আমলে নেওয়া হয়নি। তবে কৃষিবিদ বা কৃষি ছাত্ররা কখনো হাল ছেড়ে দেননি। হয়তো বা তাঁরা সময়ের অপেক্ষায় ছিলেন। স্বাধীনতার পর আবার তাঁরা তৎপর হন। বাকসু নির্বাচনে পূর্ণ প্যানেল জয়ের পর বঙ্গবন্ধুর আমন্ত্রণে নেতৃবৃন্দ তাঁর সঙ্গে দেখা করেন ১৪ জুন, ১৯৭২। তাঁদের পুরোভাগের কয়েকজনের মধ্যে অন্যতম ছিলেন তৎকালীন বাকসুর সহসভাপতি নজিবর রহমান এবং সাধারণ সম্পাদক ড. আবদুর রাজ্জাক (বর্তমান সরকারের খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী)। তাঁদের অনুরোধে তিনি ১৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৩ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনে সম্মত হন। তা ছিল নির্বাচনী সফরের একপর্যায়ে সময় করে নেওয়া সফর। কিন্তু ওই সফরে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে তিনি নির্বাচনসংক্রান্ত একটি কথাও বলেননি। সেখানে তিনি তাঁর স্বভাবসিদ্ধ একটি ভাষণ দিয়েছিলেন। যার প্রথম অংশে ছিল_আমাদের স্বাধীনতার পটভূমি কিভাবে রচিত হয় তা নিয়ে। আর পরের অংশ ছিল কৃষি এবং কৃষি উন্নয়ন নিয়ে দিকনির্দেশনা প্রদান। আর এই দিকনির্দেশনা কৃষিবিদদের জন্য আজও এক অনন্য দলিল হয়ে আছে। এখানেই তিনি কৃষিবিদদের যথাযথ মর্যাদা দেওয়ার কথা বলে গেছেন। ওই ভাষণে তিনি বলেছিলেন, 'আমার ভাইয়েরা যে অভিনন্দন দিয়েছেন তাতে লেখা হয়েছে, অন্যান্য ইঞ্জিনিয়ার-ডাক্তারদের যে মর্যাদা; কৃষি গ্র্যাজুয়েটদেরও সে মর্যাদা দিতে হবে।' পরেই তিনি জোর দিয়ে বলেছিলেন, 'মর্যাদা দিতে কোনো আপত্তি আমার নেই।' বঙ্গবন্ধু সে কথা রেখেছিলেন। অন্য পেশাজীবীদের মতো কৃষিবিদরা চাকরি ক্ষেত্রে প্রথম শ্রেণীর মর্যাদা পেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁকে হত্যা করার পর যারা ক্ষমতায় আসে, তারা আবার কৃষিবিদদের অবমূল্যায়ন করার চেষ্টা করে।
বঙ্গবন্ধু যেদিন কৃষিবিদদের জন্য ওই ঐতিহাসিক ঘোষণাটি দেন, সেদিন ছিল ১৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৩। এরপর বিভিন্ন ধারার রাজনীতির ডামাডোলে এই বিশেষ দিনটিকে মনে করার কোনো ব্যবস্থা করা যায়নি। অবশেষে 'কৃষিবিদ ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ'-এর মহাসচিব কৃষিবিদ আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিমের (জাতীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব) একান্ত চেষ্টায় এই দিনটিকে 'কৃষিবিদ দিবস' হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং ২০১১-এ যথাযোগ্য মর্যাদায় দিনটিকে কৃষিবিদ দিবস হিসেবে পালন করা হয়। ২০১২ সালেও একইভাবে দিনটি উদ্যাপন করা হয়েছে। আশা করি, এভাবেই অনাদিকাল ধরে এই দিবসটিকে স্মরণ করা হবে। ছড়াকার, বিখ্যাত আমলা এবং বিচারক অন্নদা শংকর রায় বঙ্গবন্ধুর উদ্দেশে নিবেদিত ছড়ায় বলেছিলেন_'যত দিন রবে পদ্মা মেঘনা গৌরী যমুনা বহমান/তত দিন রবে কীর্তি তোমার, শেখ মুজিবুর রহমান।' কৃষিবিদদের মর্যাদা প্রদান তাঁর অনেক কীর্তির মধ্যে একটি। আমরা কৃষিবিদরা একান্তভাবেই বিশ্বাস করি, এটিও পদ্মা-যমুনা-গড়াই-মেঘনার মতো সতত বহমান থাকবে।
লেখক : পরিচালক (প্রশাসন ও সাধারণ পরিচর্যা),
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট
No comments