স্মরণ-সার্জেন্ট জহুরুল হক : একাত্তরের আগের মুক্তিযোদ্ধা by মো. জাহাঙ্গীর হোসেন
'রাম যদি হেরে যেত, রামায়ণ লেখা হতো/রাবণ দেবতা হতো সেখানে।'- নচিকেতার একটি বিখ্যাত গানের মধ্যকার দুটি লাইন। আর এর সূত্র ধরেই বলা যায়, যদি বাংলাদেশ স্বাধীন না হতো, তাহলে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বলে আমরা যাঁকে ভোট দিয়ে প্রমাণিত করেছি, তিনি অখণ্ড পাকিস্তানের হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে হয়তো পরিচিতি পেতেন। এক নেতার এক আঙুলের ইশারায় কোটি প্রাণ একসঙ্গে জেগে ওঠার ফল আমরা পেয়েছিলাম। মাত্র ৯ মাসের
যুদ্ধেই কোটি মানুষের স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি। অবশ্য এমনি এমনি পাইনি, জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তানদের প্রাণের বিনিময়ে পেয়েছিলাম এই বুক ফুলিয়ে শ্বাস নেওয়ার মতো স্বাধীনতার স্বাদ। সেসব বীরেরই একজন সার্জেন্ট জহুরুল হক। জন্ম ১৯৩৫ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি, নোয়াখালী জেলার সোনাপুর গ্রামে। ১৯৫৩ সালে তিনি নোয়াখালী জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। ওই একই বছর পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে যোগ দেন এবং কালক্রমে সার্জেন্ট পদে উন্নীত হন। ১৯৬৭ সালে কর্মরত অবস্থায় তিনি গ্রেপ্তার হন। তাঁকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক রাখা হয়। এর কিছুদিন পর ১৯৬৮ সালের ৬ জানুয়ারি দুইজন সিএসপি অফিসারসহ ২৮ জন গ্রেপ্তার হন। তাঁদের গ্রেপ্তার সম্পর্কে সরকারি প্রেসনোটে উল্লেখ করা হয়, 'গত মাসে (১৯৬৭ সালের ডিসেম্বরে) পূর্ব পাকিস্তানে উদ্ঘাটিত জাতীয় স্বার্থবিরোধী এক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার অভিযোগে এদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।' তৎকালীন পাকিস্তান সরকার এই ষড়যন্ত্রকে 'আগরতলা ষড়যন্ত্র' হিসেবে অভিহিত করে। একই অভিযোগে ১৯৬৮ সালের ১৭ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকেও গ্রেপ্তার করা হয়। ওই মামলায় মোট ৩৫ জনকে আসামি করা হয়, যাঁদের মধ্যে অবশ্যই প্রথম আসামি ছিলেন বঙ্গবন্ধু। আর ১৭ নম্বর আসামি ছিলেন সার্জেন্ট জহুরুল হক। প্রথমে জহুরুল হকসহ অন্যদের 'দেশরক্ষা আইন' থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। পরে 'আর্মি, নেভি অ্যান্ড এয়ারফোর্স' আইনে অভিযুক্ত দেখিয়ে সেন্ট্রাল জেল থেকে কুর্মিটোলা সেনানিবাসে স্থানান্তর করা হয়। ১৯৬৮ সালের ১৯ জুন মামলাটির শুনানি শুরু হয়। এর মধ্যে আসাদের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে দেশে প্রবল গণ-অভ্যুত্থানের চাপে পড়ে আইয়ুব খান আগরতলা মামলা তুলে নিতে বাধ্য হয়। ঠিক এই সময়ই কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্টে মর্মান্তিক একটি ঘটনা ঘটে। সার্জেন্ট জহুরুল হক বন্দি অবস্থায় তাঁর প্রহরার দায়িত্বে থাকা পাকিস্তানি সৈন্যের হাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন। ১৯৬৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় সৈনিকদের খাবারের উচ্ছিষ্ট সংগ্রহের জন্য বাঙালি শিশুরা ভিড় করে। এতে অবাঙালি সৈনিকরা শিশুদের ধরে বন্দিশিবিরের সামনে এনে অমানবিক অত্যাচার শুরু করে। কয়েকজন বন্দি এতে তীব্র প্রতিবাদ জানালে হাবিলদার মঞ্জুর শাহ বন্দিদের নিজ নিজ কামরায় যেতে নির্দেশ দেয়। কিন্তু সার্জেন্ট জহুরুল হক তা অমান্য করে মঞ্জুর শাহ্র সঙ্গে বাগ্বিতণ্ডা করেন। এতে মঞ্জুর ক্ষিপ্ত হয়ে রাইফেলের বেয়নেট লাগিয়ে সার্জেন্টের দিকে এগিয়ে আসে। কিন্তু সার্জেন্ট জহুরুল হক পাশ কাটিয়ে আক্রমণকারীর হাত থেকে রাইফেল নিয়ে তা হাতে করে বিজয়ী বীরের মতো কামরার সামনে এসে তা ফেরত দেন। পরদিন সকালে, অর্থাৎ ১৫ ফেব্রুয়ারি জহুরুল হক তাঁর কামরা থেকে বের হলে মঞ্জুর শাহ তাঁকে গুলি করে। গুলি তাঁর পেটে বিদ্ধ হয়। সঙ্গে সঙ্গে সিএমএইচে নেওয়া সত্ত্বেও আর শেষরক্ষা হয়নি। রাত ৯টা ৫৫ মিনিটে এই বীর আমাদের ছেড়ে চলে যান। স্বাধীনতার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় সার্জেন্ট জহুরুল হক হল। তাঁর সহকর্মীদের মতে, তাঁকে কোনো দিন কাঁদতে বা মাথা নত করতে দেখা যায়নি। তিনি সাঁতার কাটা, খেলাধুলা, ছবি তোলা, ছবি আঁকা, কাঠের কাজ ইত্যাদিতে পারদর্শী ছিলেন। তাঁর আঁকা চিত্রকর্ম জাতীয় জাদুঘরে সযত্নে রাখা আছে। আর তাঁর স্মৃতিও যেন বাংলাদেশের মানুষের মনে হাজার বছর ধরে থাকে।
মো. জাহাঙ্গীর হোসেন
মো. জাহাঙ্গীর হোসেন
No comments