অকুতোভয় দ্রোহী আহমদ শরীফ by ইলু ইলিয়াস
বিশ দশকের বাংলাদেশে প্রথা-অতিক্রমী দ্রোহী-দীপান্বিত মননশীলতার অনুশীলন মানবকল্যাণকামী স্বর্গীয় চিন্তা-চৈতন্যের অকুতোভয় অভিপ্রকাশের ইতিহাসে অধ্যাপক ড. আহমদ শরীফ শুধু অত্যুজ্জ্বল নাম নয়_ এক অনন্য অধ্যায়। তিনি অধ্যাপনায় নিয়োজিত ছিলেন প্রায় আটত্রিশ বছর।
সাহিত্য-সমাজ ইতিহাস গবেষণা ও স্বকীয় চিন্তা-চৈতন্যের অবিরল অভিপ্রকাশে নিমগ্ন ছিলেন আমৃত্যু-অর্ধশত বছর। মধ্যযুগের সাহিত্য-গবেষণা ও ইতিহাস পুনর্নির্মাণে তিনি ছিলেন অদ্বিতীয়। সুদীর্ঘকালের অধ্যাপনায় ও বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধজুড়ে মুক্তচিন্তার অকুতোভয় অভিপ্রকাশেও ছিলেন অনন্য। অধ্যাপনার দীপ্তি ও গভীরতায় ছিলেন সক্রেটিস, ডিরোজিওতুল্য। ব্যক্তিত্বের ঋজুতায় তার অবস্থান নির্ণীত হয় বিদ্যাসাগরের পাশে, দ্রোহের প্রচণ্ডতায় নৈকট্য স্থাপিত হয় নজরুলের সঙ্গে। উল্লেখ্য, নজরুলের 'বিদ্রোহী' কবিতার প্রকাশ সালেই জন্ম হয় আহমদ শরীফের।
আহমদ শরীফের জন্ম ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের ১৩ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া থানার অন্তর্গত সুচক্রীদণ্ডী গ্রামে। বাঙালি জাতিসত্তার এক অনন্য প্রহরী, প্রখ্যাত পণ্ডিত ও পুঁথি সংগ্রাহক আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ ছিলেন তার ফুফা। চলি্লশের দশকের শেষ দিকে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের জন্য রেজিস্ট্রারের মাধ্যমে আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের কাছে তার সংগ্রহীত পুঁথিগুলো পর্যাপ্ত অর্থমূল্যে প্রাপ্তির আবেদন জানান। তিনি সিদ্ধান্ত নেন পুঁথিগুলো দান করে দেবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে।
সাহিত্যবিশারদের সংগৃহীত পাঁচশ' সাতানব্বইটি পুঁথির সঙ্গে ১৯৫০-এর ডিসেম্বরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন আহমদ শরীফ। সেদিন কি কেউ এ সত্য উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ তার সংগৃহীত অমূল্য পুঁথিগুলোর সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করেছিলেন একজন অমূল্য আহমদ শরীফকেও। ১৯৫০-এর ডিসেম্বর 'রিসার্চ অ্যাসিস্টেন্ট' পদে যোগদান করলেও প্রকৃতপক্ষে আহমদ শরীফের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সূচনাও সেই সময় থেকে। গবেষণাকর্মের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে শ্রেণীকক্ষে পাঠদানও ছিল তার কাজের অঙ্গ। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বেশ কালক্ষেপণ করে তাকে শিক্ষক পদে নিয়োগ দেয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত স্বীয় যোগ্যতা, অনন্য প্রজ্ঞা ও পাণ্ডিত্যে অলঙ্কৃত করেন তিনি শিক্ষকতা কর্মের সব পদই; সে সঙ্গে চার-চারবার হন কলা অনুষদের নির্বাচিত ডিন; নির্বাচিত হন শিক্ষক সমিতির সভাপতিও, পালন করেন বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যানের দায়িত্বও। উপরন্তু তাকে কেন্দ্র করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গড়ে ওঠে মুক্ত জ্ঞানচর্চার একটি গতিময় ঘরানা।
কেমন শিক্ষক ছিলেন অধ্যাপক ড. আহমদ শরীফ? এ জিজ্ঞাসার জবাব শোনা যাক তারই কৃতী ছাত্র এ দেশের খ্যাতিমান বহুমাত্রিক লেখক, বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক ড. হুমায়ুন আজাদের ভাষ্যে_ 'চেয়ারে বসে তিনি নাম ডাকেন, তারপর এদিক-ওদিক পায়চারি করতে করতে কলাভবনকে কাঁপিয়ে বক্তৃতা দেন। পাঠ্যপুস্তক পেরিয়ে যান মুহূর্তে। আবার যখন ফিরে আসেন দৌলতউজির বাহরাম খান বা আলাওল, বড় চণ্ডীদাসের কালে, তখন আমরা সভ্যতা ও ইতিহাসের বড় বড় যুগ তার সঙ্গে যাপন করে এসেছি। এর মাঝে তিরস্কৃত হয়েছেন অনেক প্রাতঃস্মরণীয়, বাতিল হয়ে গেছেন বহু মহাপুরুষ, বন্যায় ভেসে গেছে অনেক সংস্কার, ভাঙা কুঁড়েঘরের মতো নড়বড়ে হয়ে পড়েছে বহুভাষী বিশ্বাস। কথা বলেন অনর্গল স্রোতে, মাঝে মধ্যে বিশেষ বিশেষ শব্দের ওপর ভারী জোর দিয়ে ও টেনে। ...বুঝে ফেলেছিলাম অধ্যাপক আহমদ শরীফ কোনো সবাক পাঠ্যপুস্তক নন যা পরিচ্ছন্নভাবে মুদ্রিত হয়ে আছে দু'চারখানা বইয়ে, তা অবিকল ধ্বনিত করার জন্য ঘণ্টা বাজতে না বাজতেই ক্লাসে আসেননি অধ্যাপক আহমদ শরীফ। জ্ঞানার্থীর চেতনা ধরে ঝাঁকুনি দেয়াই তার অভ্যাস।' হুমায়ুন আজাদের এই ভাষ্যের অনুরূপ প্রতিধ্বনি অন্যরূপে, অন্যভাবে পাওয়া যায় অধ্যাপক আহমদ কবির, অধ্যাপক গোলাম মুরশিদ, অধ্যাপক সেলিম আল দীন, এমনকি আহমদ শরীফের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা জীবনের প্রথম পর্যায়ের ছাত্র_ এদেশের প্রায় সর্বমান্য অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামানের রচনা ভাষ্যেও। তার এই মুক্তচিন্তার ঝরনাপ্রবাহে অবিরাম স্নাত হতে থাকে কলাভবনের লাউঞ্জের প্রতিদিনকার দ্বিপ্রাহরিক এবং সান্ধ্য একাডেমীখ্যাত ফুলার রোডের আবাসিক এলাকার 'গুড়ি'র আড্ডা_ যেখানে তাকে ঘিরে জড়ো হতো দ্রোহী গবেষক, প্রগতিশীল সমাজচিন্তাবিদ, অবিরাম প্রশ্নমুখর প্রথাবিরোধী তরুণ যুবক, সে সঙ্গে তার গবেষণা ও রচনারাজি। এভাবে আহমদ শরীফের অধ্যাপনা অপরিমেয় জ্ঞান-প্রজ্ঞা-পাণ্ডিত্য শেষ অবধি শ্রেণীকক্ষের সীমা অতিক্রম করে বৃহৎ পরিসরে স্পর্শ ও আলোকিত করে দেশ ও দেশের মানুষকে।
লেখালেখি শুরু হয়েছিল চলি্লশের দশকের সূচনাপর্বে, ছাত্রজীবনেই উল্লেখযোগ্য প্রথম প্রবন্ধ 'ভাষা বিভ্রাট' প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম কলেজ ম্যাগাজিনে। প্রথমদিকে তিনি অধিকতর মনোনিবেশ করেন আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের দানকৃত মধ্যযুগের পুঁথিগুলোর সম্পাদনা ও গবেষণায় এবং নিজস্ব একটি পুঁথি সংগ্রহশালা গড়ে তোলায়ও। এই নিজস্ব পুঁথি সংগ্রহশালার অধিকাংশ পুঁথির সংগ্রাহক ছিলেন চট্টগ্রামের আরেক খ্যাতিমান পুঁথি সংগ্রাহক, সাহিত্যবিশারদের শিষ্য আবদুল সাত্তার চৌধুরী। মধ্যযুগ বিষয়ে আহমদ শরীফের নিরন্তর গবেষণার প্রথম ফসল প্রকাশিত হয় ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে বাংলা একাডেমী থেকে দৌলতউজির বাহরাম খানের 'লায়লী-মজনু' এবং এটি বাংলা একাডেমীর প্রথম প্রকাশনা। অতঃপর একে একে প্রকাশিত হতে থাকে তার সম্পাদিত-গবেষণালব্ধ ভাষা-বিশ্লেষণসহ মধ্যযুগের রচনাগুলো। অপসৃত হতে থাকে মধ্যযুগের সাহিত্যে, সমাজ, সংস্কৃতি ও ইতিহাস বিষয়ক জমাটবাঁধা বহু অন্ধকার, স্পষ্ট হয়ে ওঠে বাংলা সাহিত্যের ও সমাজ-সংস্কৃতির ইতিহাস পুনর্গঠনের সম্ভাবনা। আহমদ শরীফের পাণ্ডিত্যকে স্বীকার করে নেন সবাই। কিন্তু বড় বেশি কৃপণভাবে আহমদ শরীফ পণ্ডিত বটে, তবে মধ্যযুগের। কিন্তু ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে তার প্রথম প্রবন্ধগ্রন্থ 'বিচিত চিন্তা' প্রকাশের পর ঘটে যায় এরূপ পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন।
অতঃপর প্রবল জলপ্রপাত ও বন্যার মতো ভাষ্য-বিশ্লেষণসহ সম্পাদিত গ্রন্থরাজির পাশাপাশি প্রকাশিত হতে থাকে তার একের পর এক মৌলিক গ্রন্থরাজি। 'সাহিত্য ও সংস্কৃতি চিন্তা' (১৯৬৯), 'স্বদেশ অন্বেষা' (১৯৭০), 'সৈয়দ সুলতান তাঁর গ্রন্থাবলী ও তাঁর যুগ' (১৯৭২), 'যুগ-যন্ত্রণা' (১৯৭৪), 'কালিক ভাবনা' (১৯৭৪), 'বাঙালী ও বাঙলা সাহিত্য (১৯৭৮, ১৯৮৩) 'প্রত্যয় ও প্রত্যাশা' (১৯৭৯), 'কালের দর্পণে স্বদেশ' (১৯৮৫), 'বাঙালির চিন্তা-চেতনার বিবর্তণের ধারা' (১৯৮৭), 'মানবতা ও গণমুক্তি' (১৯৯০) প্রভৃতি। আমৃত্যু লেখালেখিতে সচল আহমদ শরীফের এরূপ মৌলিক গ্রন্থের সংখ্যা অর্ধশত, সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় অনুরূপ। আহমদ শরীফের রচনারাজির উপজীব্য অনেক-সাহিত্য, সমাজ, ভাষা, সংস্কৃতি, নৃতত্ত্ব, পুরাতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব, ধর্ম, দর্শন, ইতিহাস, রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সমকালীন জনজীবনের সংস্কার বিশ্বাসসহ আরও নানা প্রসঙ্গ। কিন্তু সবকিছুর অন্তরালে প্রধান হয়ে ওঠে ইহজাগতিক এষণা ইতিহাসবোধ। আর এই ইহজাগতিক এষণায় উদ্ভাসিত হয়ে অসাধারণ মানব-মহত্ত্ব-ইতিহাসবোধে সঞ্চারিত হয় আঙ্গালিত্বের অপূর্ব ব্যঞ্জনা। ফলে তার রচনাবলি হয়ে ওঠে বাঙালি জাতির এক অমূল্য সম্পদ।
আহমদ শরীফের জন্ম ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের ১৩ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া থানার অন্তর্গত সুচক্রীদণ্ডী গ্রামে। বাঙালি জাতিসত্তার এক অনন্য প্রহরী, প্রখ্যাত পণ্ডিত ও পুঁথি সংগ্রাহক আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ ছিলেন তার ফুফা। চলি্লশের দশকের শেষ দিকে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের জন্য রেজিস্ট্রারের মাধ্যমে আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের কাছে তার সংগ্রহীত পুঁথিগুলো পর্যাপ্ত অর্থমূল্যে প্রাপ্তির আবেদন জানান। তিনি সিদ্ধান্ত নেন পুঁথিগুলো দান করে দেবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে।
সাহিত্যবিশারদের সংগৃহীত পাঁচশ' সাতানব্বইটি পুঁথির সঙ্গে ১৯৫০-এর ডিসেম্বরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন আহমদ শরীফ। সেদিন কি কেউ এ সত্য উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ তার সংগৃহীত অমূল্য পুঁথিগুলোর সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করেছিলেন একজন অমূল্য আহমদ শরীফকেও। ১৯৫০-এর ডিসেম্বর 'রিসার্চ অ্যাসিস্টেন্ট' পদে যোগদান করলেও প্রকৃতপক্ষে আহমদ শরীফের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সূচনাও সেই সময় থেকে। গবেষণাকর্মের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে শ্রেণীকক্ষে পাঠদানও ছিল তার কাজের অঙ্গ। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বেশ কালক্ষেপণ করে তাকে শিক্ষক পদে নিয়োগ দেয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত স্বীয় যোগ্যতা, অনন্য প্রজ্ঞা ও পাণ্ডিত্যে অলঙ্কৃত করেন তিনি শিক্ষকতা কর্মের সব পদই; সে সঙ্গে চার-চারবার হন কলা অনুষদের নির্বাচিত ডিন; নির্বাচিত হন শিক্ষক সমিতির সভাপতিও, পালন করেন বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যানের দায়িত্বও। উপরন্তু তাকে কেন্দ্র করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গড়ে ওঠে মুক্ত জ্ঞানচর্চার একটি গতিময় ঘরানা।
কেমন শিক্ষক ছিলেন অধ্যাপক ড. আহমদ শরীফ? এ জিজ্ঞাসার জবাব শোনা যাক তারই কৃতী ছাত্র এ দেশের খ্যাতিমান বহুমাত্রিক লেখক, বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক ড. হুমায়ুন আজাদের ভাষ্যে_ 'চেয়ারে বসে তিনি নাম ডাকেন, তারপর এদিক-ওদিক পায়চারি করতে করতে কলাভবনকে কাঁপিয়ে বক্তৃতা দেন। পাঠ্যপুস্তক পেরিয়ে যান মুহূর্তে। আবার যখন ফিরে আসেন দৌলতউজির বাহরাম খান বা আলাওল, বড় চণ্ডীদাসের কালে, তখন আমরা সভ্যতা ও ইতিহাসের বড় বড় যুগ তার সঙ্গে যাপন করে এসেছি। এর মাঝে তিরস্কৃত হয়েছেন অনেক প্রাতঃস্মরণীয়, বাতিল হয়ে গেছেন বহু মহাপুরুষ, বন্যায় ভেসে গেছে অনেক সংস্কার, ভাঙা কুঁড়েঘরের মতো নড়বড়ে হয়ে পড়েছে বহুভাষী বিশ্বাস। কথা বলেন অনর্গল স্রোতে, মাঝে মধ্যে বিশেষ বিশেষ শব্দের ওপর ভারী জোর দিয়ে ও টেনে। ...বুঝে ফেলেছিলাম অধ্যাপক আহমদ শরীফ কোনো সবাক পাঠ্যপুস্তক নন যা পরিচ্ছন্নভাবে মুদ্রিত হয়ে আছে দু'চারখানা বইয়ে, তা অবিকল ধ্বনিত করার জন্য ঘণ্টা বাজতে না বাজতেই ক্লাসে আসেননি অধ্যাপক আহমদ শরীফ। জ্ঞানার্থীর চেতনা ধরে ঝাঁকুনি দেয়াই তার অভ্যাস।' হুমায়ুন আজাদের এই ভাষ্যের অনুরূপ প্রতিধ্বনি অন্যরূপে, অন্যভাবে পাওয়া যায় অধ্যাপক আহমদ কবির, অধ্যাপক গোলাম মুরশিদ, অধ্যাপক সেলিম আল দীন, এমনকি আহমদ শরীফের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা জীবনের প্রথম পর্যায়ের ছাত্র_ এদেশের প্রায় সর্বমান্য অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামানের রচনা ভাষ্যেও। তার এই মুক্তচিন্তার ঝরনাপ্রবাহে অবিরাম স্নাত হতে থাকে কলাভবনের লাউঞ্জের প্রতিদিনকার দ্বিপ্রাহরিক এবং সান্ধ্য একাডেমীখ্যাত ফুলার রোডের আবাসিক এলাকার 'গুড়ি'র আড্ডা_ যেখানে তাকে ঘিরে জড়ো হতো দ্রোহী গবেষক, প্রগতিশীল সমাজচিন্তাবিদ, অবিরাম প্রশ্নমুখর প্রথাবিরোধী তরুণ যুবক, সে সঙ্গে তার গবেষণা ও রচনারাজি। এভাবে আহমদ শরীফের অধ্যাপনা অপরিমেয় জ্ঞান-প্রজ্ঞা-পাণ্ডিত্য শেষ অবধি শ্রেণীকক্ষের সীমা অতিক্রম করে বৃহৎ পরিসরে স্পর্শ ও আলোকিত করে দেশ ও দেশের মানুষকে।
লেখালেখি শুরু হয়েছিল চলি্লশের দশকের সূচনাপর্বে, ছাত্রজীবনেই উল্লেখযোগ্য প্রথম প্রবন্ধ 'ভাষা বিভ্রাট' প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম কলেজ ম্যাগাজিনে। প্রথমদিকে তিনি অধিকতর মনোনিবেশ করেন আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের দানকৃত মধ্যযুগের পুঁথিগুলোর সম্পাদনা ও গবেষণায় এবং নিজস্ব একটি পুঁথি সংগ্রহশালা গড়ে তোলায়ও। এই নিজস্ব পুঁথি সংগ্রহশালার অধিকাংশ পুঁথির সংগ্রাহক ছিলেন চট্টগ্রামের আরেক খ্যাতিমান পুঁথি সংগ্রাহক, সাহিত্যবিশারদের শিষ্য আবদুল সাত্তার চৌধুরী। মধ্যযুগ বিষয়ে আহমদ শরীফের নিরন্তর গবেষণার প্রথম ফসল প্রকাশিত হয় ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে বাংলা একাডেমী থেকে দৌলতউজির বাহরাম খানের 'লায়লী-মজনু' এবং এটি বাংলা একাডেমীর প্রথম প্রকাশনা। অতঃপর একে একে প্রকাশিত হতে থাকে তার সম্পাদিত-গবেষণালব্ধ ভাষা-বিশ্লেষণসহ মধ্যযুগের রচনাগুলো। অপসৃত হতে থাকে মধ্যযুগের সাহিত্যে, সমাজ, সংস্কৃতি ও ইতিহাস বিষয়ক জমাটবাঁধা বহু অন্ধকার, স্পষ্ট হয়ে ওঠে বাংলা সাহিত্যের ও সমাজ-সংস্কৃতির ইতিহাস পুনর্গঠনের সম্ভাবনা। আহমদ শরীফের পাণ্ডিত্যকে স্বীকার করে নেন সবাই। কিন্তু বড় বেশি কৃপণভাবে আহমদ শরীফ পণ্ডিত বটে, তবে মধ্যযুগের। কিন্তু ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে তার প্রথম প্রবন্ধগ্রন্থ 'বিচিত চিন্তা' প্রকাশের পর ঘটে যায় এরূপ পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন।
অতঃপর প্রবল জলপ্রপাত ও বন্যার মতো ভাষ্য-বিশ্লেষণসহ সম্পাদিত গ্রন্থরাজির পাশাপাশি প্রকাশিত হতে থাকে তার একের পর এক মৌলিক গ্রন্থরাজি। 'সাহিত্য ও সংস্কৃতি চিন্তা' (১৯৬৯), 'স্বদেশ অন্বেষা' (১৯৭০), 'সৈয়দ সুলতান তাঁর গ্রন্থাবলী ও তাঁর যুগ' (১৯৭২), 'যুগ-যন্ত্রণা' (১৯৭৪), 'কালিক ভাবনা' (১৯৭৪), 'বাঙালী ও বাঙলা সাহিত্য (১৯৭৮, ১৯৮৩) 'প্রত্যয় ও প্রত্যাশা' (১৯৭৯), 'কালের দর্পণে স্বদেশ' (১৯৮৫), 'বাঙালির চিন্তা-চেতনার বিবর্তণের ধারা' (১৯৮৭), 'মানবতা ও গণমুক্তি' (১৯৯০) প্রভৃতি। আমৃত্যু লেখালেখিতে সচল আহমদ শরীফের এরূপ মৌলিক গ্রন্থের সংখ্যা অর্ধশত, সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় অনুরূপ। আহমদ শরীফের রচনারাজির উপজীব্য অনেক-সাহিত্য, সমাজ, ভাষা, সংস্কৃতি, নৃতত্ত্ব, পুরাতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব, ধর্ম, দর্শন, ইতিহাস, রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সমকালীন জনজীবনের সংস্কার বিশ্বাসসহ আরও নানা প্রসঙ্গ। কিন্তু সবকিছুর অন্তরালে প্রধান হয়ে ওঠে ইহজাগতিক এষণা ইতিহাসবোধ। আর এই ইহজাগতিক এষণায় উদ্ভাসিত হয়ে অসাধারণ মানব-মহত্ত্ব-ইতিহাসবোধে সঞ্চারিত হয় আঙ্গালিত্বের অপূর্ব ব্যঞ্জনা। ফলে তার রচনাবলি হয়ে ওঠে বাঙালি জাতির এক অমূল্য সম্পদ।
No comments