চারদিক-সূর্যের আলো সয় না যাদের
বছর ছয়েক আগের কথা। মো. তারেকুজ্জামান খান ও লতিফা আক্তার দম্পতির একমাত্র মেয়ে শ্রাবণী জামান সবেমাত্র হাঁটতে শিখেছে। সারা দিন এঘর-ওঘর ঘুরে বেড়ায়। মুগ্ধ চোখে সে দৃশ্য উপভোগ করেন বাবা-মা। কিন্তু কেন জানি শ্রাবণী বারান্দায় গেলেই ছুটে ফিরে আসে; সূর্যের আলোর ছোঁয়াটুকু সইতে পারে না।
শ্রাবণীর বাবা তারেকুজ্জামান খান বলছিলেন, ‘একটা সময় আমরা জোর করে শ্রাবণীকে বাইরে নিয়ে যেতাম। ভাবতাম, সূর্যের আলোয় বেরোতে বেরোতে অস্বস্তি কেটে যাবে। কিন্তু ধীরে ধীরে ওর কষ্ট বাড়ল। সুস্থ বাচ্চা নিয়ে ঘরের বাইরে বেরোতাম, ফিরতাম গায়ে ফোসকা নিয়ে। শুরু হলো ছোটাছুটি। চিকিৎসকেরা জানালেন, ও জেরোডার্মা পিগমেনটোসাম নামের এক দুরারোগ্য রোগে ভুগছে।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের ডিন এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, সূর্যের আলোর অতিবেগুনি রশ্মি থেকে এ রোগের উৎপত্তি। রোগটির প্রাথমিক লক্ষণ হলো, সূর্যের আলোয় গেলে শরীরে ও মুখমণ্ডলে ফোসকা বা কালো দাগ পড়া, চোখ লাল হয়ে যাওয়া ইত্যাদি। একপর্যায়ে এই শিশুরা ত্বকের ক্যানসারে আক্রান্ত হয়। এ রোগে আক্রান্ত রোগী যত দিন বেঁচে থাকে, তত দিন তাকে সূর্যের আলো সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে চলতে হয়। রোগটা কখনো সারে না।
চিকিৎসকেরা বলেন, এক্সপি রোগে আক্রান্ত শিশুরা তাদের মা-বাবার কাছ থেকে রোগের জিন পেয়ে থাকে। শ্রাবণীর মা-বাবা দুজনই এ জিনটির বাহক ছিলেন। তবে তাঁদের শরীরে রোগটির প্রকাশ দেখা যায়নি। প্রকাশ ঘটেছে সন্তানদের শরীরে। শ্রাবণীর পর মো. তারেকুজ্জামান খান ও লতিফা আক্তার দম্পতির একটি ছেলে জন্ম নেয়। সাড়ে তিন বছর বয়সী মনীমুজ্জামান খানও একই রোগে আক্রান্ত।
সারা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে এ রোগে শিশুরা আক্রান্ত হচ্ছে, মারাও যাচ্ছে। কিন্তু আক্রান্তের সংখ্যা এত কম যে তাদের বেঁচে থাকার আকুতি সবার কানে পৌঁছায় না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ১০ লাখে একজনের এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যেসব সম্প্রদায়ে আত্মীয়ের মধ্যে বিয়ে হওয়ার ঐতিহ্য আছে, সেসব সম্প্রদায়ে এ রোগটিতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও বেশি। বাংলাদেশে এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা কত, সে সম্পর্কে কোনো তথ্য নেই। রোগাক্রান্তদের সহযোগিতার জন্য কোনো ফোরামও নেই।
তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ব্যক্তি-উদ্যোগে জেরোডার্মা পিগমেনটোসাম সোসাইটি গড়ে উঠেছে। অলাভজনক এই সংগঠনটি এক্সপি রোগে আক্রান্তদের একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরির চেষ্টা করছে। সংগঠনটি বলছে, নিকারাগুয়া, পেরু, ভেনেজুয়েলা, গুয়াতেমালা, কিউবা, ইউক্রেন, তানজানিয়া, তিউনিসিয়া, হন্ডুরাস, পুয়ের্তোরিকো ও মরক্কো থেকে আক্রান্ত শিশুর পরিবার সাহায্য চেয়েছে। আক্রান্ত এই শিশুদের জরুরি ভিত্তিতে বিশেষ ধরনের পোশাক, টুপি ও সানগ্লাস দরকার; অতিবেগুনি রশ্মি থেকে সুরক্ষিত আবাসনের ব্যবস্থা করা জরুরি। কিন্তু সুরক্ষার পদ্ধতিটি খুবই ব্যয়বহুল।
শ্রাবণীর বাবা-মা বলেন, তাঁরা তাঁদের সন্তানদের পুরোপুরি সুরক্ষা দিতে পারছেন না। শ্রাবণীর মা লতিফা আক্তার বলছিলেন, ‘কতক্ষণ আমি বাচ্চা দুটোকে অন্ধকারে আটকে রাখব, বলুন? সারা দিন ওরা আমাদের বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় থাকে। এমনও হয়েছে, আমি বাড়ি ফিরছি—এ আনন্দে বারান্দায় বেরিয়ে মুখে ফোসকা পড়ে গেছে। কাঁদতে কাঁদতে ওরা ঘরে ফিরেছে।’
শ্রাবণী, মনীম এখন কেমন আছে? জানা গেল, এক্সপি রোগটি শ্রাবণীর শরীরে এখন পাকাপোক্তভাবে বাসা বেঁধেছে। সারা গায়ে ছোপ-ছাপ দাগ। ওর চোখেও পর্দা পড়ে গিয়েছিল। অস্ত্রোপচার করে সেটি সরানো হয়েছে। আবারও চোখে রক্ত জমাট বেঁধেছে। ধীরে ধীরে শারীরিকভাবে অক্ষম হয়ে পড়ছে সে; শ্রবণশক্তিও কমে গেছে। উন্নয়নকর্মী বাবা আর স্বাস্থ্য সহকারী মা দুই সন্তানকে নিয়ে ছোটাছুটি করছেন। বাংলাদেশের শীর্ষ আটজন চর্মরোগ-বিশেষজ্ঞ, পাঁচজন চক্ষু-বিশেষজ্ঞ ও তিনজন হোমিওচিকিৎসক এ শিশু দুটির চিকিৎসা করেছেন। কিন্তু কেউই দিতে পারেননি কোনো ভরসা।
বাবা তারেকুজ্জামান বলছিলেন, ‘আমার মেয়েটা স্কুলের সব পরীক্ষায় প্রথম হয়। কিন্তু ওর সঙ্গে আজকাল কেউ আর মিশতে চায় না। কেন মিশতে চাইছে না—সে কথা বাবা হয়ে ওকে ভেঙে বলতে পারি না। আমি কী করব বলতে পারেন? আমার জীবন দিয়ে যদি বাচ্চা দুটোকে আমি বাঁচাতে পারতাম!’
শেখ সাবিহা আলম
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের ডিন এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, সূর্যের আলোর অতিবেগুনি রশ্মি থেকে এ রোগের উৎপত্তি। রোগটির প্রাথমিক লক্ষণ হলো, সূর্যের আলোয় গেলে শরীরে ও মুখমণ্ডলে ফোসকা বা কালো দাগ পড়া, চোখ লাল হয়ে যাওয়া ইত্যাদি। একপর্যায়ে এই শিশুরা ত্বকের ক্যানসারে আক্রান্ত হয়। এ রোগে আক্রান্ত রোগী যত দিন বেঁচে থাকে, তত দিন তাকে সূর্যের আলো সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে চলতে হয়। রোগটা কখনো সারে না।
চিকিৎসকেরা বলেন, এক্সপি রোগে আক্রান্ত শিশুরা তাদের মা-বাবার কাছ থেকে রোগের জিন পেয়ে থাকে। শ্রাবণীর মা-বাবা দুজনই এ জিনটির বাহক ছিলেন। তবে তাঁদের শরীরে রোগটির প্রকাশ দেখা যায়নি। প্রকাশ ঘটেছে সন্তানদের শরীরে। শ্রাবণীর পর মো. তারেকুজ্জামান খান ও লতিফা আক্তার দম্পতির একটি ছেলে জন্ম নেয়। সাড়ে তিন বছর বয়সী মনীমুজ্জামান খানও একই রোগে আক্রান্ত।
সারা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে এ রোগে শিশুরা আক্রান্ত হচ্ছে, মারাও যাচ্ছে। কিন্তু আক্রান্তের সংখ্যা এত কম যে তাদের বেঁচে থাকার আকুতি সবার কানে পৌঁছায় না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ১০ লাখে একজনের এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যেসব সম্প্রদায়ে আত্মীয়ের মধ্যে বিয়ে হওয়ার ঐতিহ্য আছে, সেসব সম্প্রদায়ে এ রোগটিতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও বেশি। বাংলাদেশে এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা কত, সে সম্পর্কে কোনো তথ্য নেই। রোগাক্রান্তদের সহযোগিতার জন্য কোনো ফোরামও নেই।
তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ব্যক্তি-উদ্যোগে জেরোডার্মা পিগমেনটোসাম সোসাইটি গড়ে উঠেছে। অলাভজনক এই সংগঠনটি এক্সপি রোগে আক্রান্তদের একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরির চেষ্টা করছে। সংগঠনটি বলছে, নিকারাগুয়া, পেরু, ভেনেজুয়েলা, গুয়াতেমালা, কিউবা, ইউক্রেন, তানজানিয়া, তিউনিসিয়া, হন্ডুরাস, পুয়ের্তোরিকো ও মরক্কো থেকে আক্রান্ত শিশুর পরিবার সাহায্য চেয়েছে। আক্রান্ত এই শিশুদের জরুরি ভিত্তিতে বিশেষ ধরনের পোশাক, টুপি ও সানগ্লাস দরকার; অতিবেগুনি রশ্মি থেকে সুরক্ষিত আবাসনের ব্যবস্থা করা জরুরি। কিন্তু সুরক্ষার পদ্ধতিটি খুবই ব্যয়বহুল।
শ্রাবণীর বাবা-মা বলেন, তাঁরা তাঁদের সন্তানদের পুরোপুরি সুরক্ষা দিতে পারছেন না। শ্রাবণীর মা লতিফা আক্তার বলছিলেন, ‘কতক্ষণ আমি বাচ্চা দুটোকে অন্ধকারে আটকে রাখব, বলুন? সারা দিন ওরা আমাদের বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় থাকে। এমনও হয়েছে, আমি বাড়ি ফিরছি—এ আনন্দে বারান্দায় বেরিয়ে মুখে ফোসকা পড়ে গেছে। কাঁদতে কাঁদতে ওরা ঘরে ফিরেছে।’
শ্রাবণী, মনীম এখন কেমন আছে? জানা গেল, এক্সপি রোগটি শ্রাবণীর শরীরে এখন পাকাপোক্তভাবে বাসা বেঁধেছে। সারা গায়ে ছোপ-ছাপ দাগ। ওর চোখেও পর্দা পড়ে গিয়েছিল। অস্ত্রোপচার করে সেটি সরানো হয়েছে। আবারও চোখে রক্ত জমাট বেঁধেছে। ধীরে ধীরে শারীরিকভাবে অক্ষম হয়ে পড়ছে সে; শ্রবণশক্তিও কমে গেছে। উন্নয়নকর্মী বাবা আর স্বাস্থ্য সহকারী মা দুই সন্তানকে নিয়ে ছোটাছুটি করছেন। বাংলাদেশের শীর্ষ আটজন চর্মরোগ-বিশেষজ্ঞ, পাঁচজন চক্ষু-বিশেষজ্ঞ ও তিনজন হোমিওচিকিৎসক এ শিশু দুটির চিকিৎসা করেছেন। কিন্তু কেউই দিতে পারেননি কোনো ভরসা।
বাবা তারেকুজ্জামান বলছিলেন, ‘আমার মেয়েটা স্কুলের সব পরীক্ষায় প্রথম হয়। কিন্তু ওর সঙ্গে আজকাল কেউ আর মিশতে চায় না। কেন মিশতে চাইছে না—সে কথা বাবা হয়ে ওকে ভেঙে বলতে পারি না। আমি কী করব বলতে পারেন? আমার জীবন দিয়ে যদি বাচ্চা দুটোকে আমি বাঁচাতে পারতাম!’
শেখ সাবিহা আলম
No comments