চরাচর-বিলুপ্তির পথে খেঁকশিয়াল by আলম শাইন
দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপ থেকে ভারত, বাংলাদেশ, মিসর ইথিওপিয়া এবং গোটা উত্তর আফ্রিকার বিশাল অঞ্চলজুড়ে শিয়ালের বিস্তৃতি। তবে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন বর্ণের, বিভিন্ন আকারের খেঁকশিয়াল পরিলক্ষিত হয়। বাংলাদেশের খেঁকশিয়াল আকারে দেশীয় কুকুরের সমান। আকৃতিতেও তদ্রূপ। বর্ণের ক্ষেত্রে কিছুটা অমিল রয়েছে।
কুকুর যেমন বিভিন্ন বর্ণের হয়, শিয়ালের ক্ষেত্রে তা হয় না। অবশ্য বাংলাদেশের শিয়ালের ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য। দেশীয় শিয়াল শুধু লালচে বর্ণের হয়। একই বর্ণের কুকুর থেকে শিয়ালকে বাছাই করার উপায় শুধু দুটি। এক, শিয়ালের মুখের গঠন লম্বাটে। দুই, শিয়ালের লেজের গোছা বেশ মোটা। এরা নিশাচর প্রাণী এবং দলবদ্বূভাবে বসবাস করে। দিনে জঙ্গলে লুকিয়ে থাকলেও রাতের আঁধারে ফাঁকা মাঠে বিচরণ করতে ভালোবাসে এবং দলের সবাই মিলেমিশে সমস্বরে 'হুক্কা হুয়া' রবে চেঁচাতে পছন্দ করে। আমাদের শিশুসাহিত্যের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত শিয়াল চরিত্র। শিয়াল ছাড়া যেন শিশুসাহিত্য জমেই না। তার পরও মানুষ চেনে শিয়ালকে শত্রু হিসেবে। কেন এমন ভাবে, তা বোধগম্য নয়। তবে একটা কারণ খুঁজে পাওয়া গেছে আর তা হচ্ছে, চৌর্যবৃত্তি। হাঁস, মুরগি নিধনসহ ছাগল, গরুর বাছুরকে আক্রমণ করতে ওরা দ্বিধা করে না। এত কিছুর পরও শিয়ালের গুরুত্ব আমাদের কাছে কোনো অংশেই কম নয়। প্রথমত, এরা পচা-গলা সাবাড় করে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে। দ্বিতীয়ত, ওদের ধরে উপার্জন করে মানুষ নামের অমানুষরা। চিকিৎসাবিজ্ঞানের এত উন্নতির পরও ভ্রান্ত ধারণার পরিবর্তন হয়নি। কিছু অসাধু মানুষের কুসংস্কার বিশ্বাসের কারণে বাতব্যথায় আক্রান্ত রোগীরা শিয়ালের মাংস খেতে মরিয়া হয়ে ওঠে, যদিও এর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে কি না জানা যায় না। আর সেই সুযোগটি গ্রহণ করে মানুষরূপী অমানুষরা। তারা দলবদ্বূ হয়ে লাঠিসোঁটা নিয়ে শিয়াল অবস্থানের সম্ভাব্য স্থানে হামলা করে তাদের শিকার করে। অতঃপর লাঠিপেটা করে একপর্যায়ে গলায় ছুরি বসিয়ে দেয়। তারপর প্রকাশ্য দিবালোকে 'শিয়ালের মাংস' বলে প্রচার করে। এই চিত্র শুধু গ্রামগঞ্জেই নয়, শহরাঞ্চলেও শিয়ালের মাংস বিক্রি করতে দেখা গেছে। সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জের শহীদনগর ব্রিজের গোড়ায় প্রকাশ্যে শিয়ালের মাংস বিক্রি করতে দেখা গেছে (প্রতিবেদক নিজের চোখে তা অবলোকন করেছেন)। প্রমাণস্বরূপ, বিক্রেতা শিয়ালের কাটা মুণ্ডুটা পাশে রেখে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করছেন। প্রকাশ্য দিবালোকে এমনটি ঘটার অন্যতম কারণ, বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইনের দুর্বলতা। ১৯৭৪ সালের প্রণীত বিদ্যমান বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইনে শাস্তির বিধান সর্বনিম্ন ৫০০ টাকা ও সর্বোচ্চ দুই হাজার টাকা জরিমানা। আর খুব বেশি হলে ছয় মাস থেকে দুই বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড। তবে সুখবরটি হচ্ছে, বন্য প্রাণী সংরক্ষণের নতুন আইনের ২০১০ সালের খসড়াটি মতামতের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়েছে। প্রস্তাবে রয়েছে, বাঘ হত্যা করলে সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকা জরিমানা ও ১২ বছরের কারাদণ্ডের বিধান। এ ছাড়া অন্য সব বন্য প্রাণী শিকার করলে অথবা আইন লঙ্ঘন করলে সর্বনিম্ন ৫০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা জরিমানা এবং চার থেকে সাত বছর কারাদণ্ডের কথা বলা আছে। প্রস্তাবটি আইনে পরিণত হলে শুধু শিয়ালই নয়, অনেক বিপন্ন বন্য প্রাণী রক্ষা পাবে। এ ক্ষেত্রে আইন হলেই চলবে না, তার প্রয়োগও হতে হবে যথাযথ। না হলে আগামী দশকের মধ্যেই অনেক বন্য প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
আলম শাইন
No comments