ভাষা চেতনা-ভাষা আন্দোলনের পশ্চাৎপট ও ভবিষ্যতের আন্দোলন by আবু সাঈদ খান
এখন দু'একটা ব্যতিক্রম ছাড়া আর বাংলায় আমন্ত্রণলিপি পাই না। বিয়ের নিমন্ত্রণপত্র ইংরেজিতে না হলে যেন আভিজাত্য প্রমাণিত হয় না। এই হীনম্মন্যতাবোধ থেকে না বেরোতে পারলে বাংলা ভাষার উৎকর্ষ কি আদৌ সম্ভব? বাংলা ভাষার সমৃদ্ধি আনতে দরকার গবেষণা, বিজ্ঞান প্রযুক্তির উপযুক্ত শব্দ নির্মাণের উদ্যোগ।
তার আগে চাই মাতৃভাষার প্রতি মমত্ববোধ, যা মূর্ত হয়েছিল একুশের মিছিলে। তদুপরি বাংলাভাষা প্রাকৃতজনের ভাষা। সেই অতি সাধারণজনের সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক মুক্তি যতদিন না আসবে, ততদিন থামবে না একুশের সংগ্রাম
মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি মতাদর্শকে বিদায় দিয়েছি আমরা। কিন্তু অবচেতনভাবে হলেও আমাদের ইতিহাস যেন সেই মানসিক-কাঠামোর মধ্যে বন্দি আজও। মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসের বয়ানও ১৯৪৭ থেকে একাত্তরের মধ্যে ঘুরপাক খায়। প্রাক-সাতচলি্লশ কালের গর্বিত ইতিহাস উল্লেখেও কার্পণ্য দেখা যায়। এটি সত্য যে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর নতুন আঙ্গিকে আমাদের মুক্তি সংগ্রাম সূচিত হয়েছিল। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তন্দ্রাচ্ছন্ন বাঙালি গা-ঝাড়া দিয়ে ওঠে, শিকড়ের সন্ধানে প্রবৃত্ত হয়। বাংলার মুসলমানরা প্রতিবেশী হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানের সঙ্গে মানসিক নৈকট্যবোধ করে। খসে পড়ে দ্বিজাতিতত্ত্বের কৃত্রিম অবয়ব। মুসলিম সম্প্রদায়ের এই আত্মজাগৃতির ফলেই ধারাবাহিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে প্রস্ফুটিত হয় ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবোধ। আর তার চূড়ান্ত পরিণতি একাত্তরের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। এ নিয়ে দ্বিমতের সুযোগ নেই। কিন্তু বিপত্তি হচ্ছে মুক্তি সংগ্রামকে কেবল পাকিস্তানের পটভূমিতে দেখার প্রবণতা। এটি মনেপ্রাণে ধারণ করার বিষয় যে, আমাদের মুক্তি সংগ্রাম ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় সূচিত হয়েছে। '৪৮ থেকে একাত্তরের সংগ্রাম ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতাবিরোধী বীরত্বগাথারই সম্প্রসারিত রূপ। ভাষা নিয়ে বিতর্ক ও সংগ্রামের সূত্রপাত ঘটেছিল ব্রিটিশ ভারতেই।
বাঙালি মুসলমানের ভাষা কী, কী হবে তাদের শিক্ষার মাধ্যম_ এ ব্যাপারে মুসলিম নেতা ও বুদ্ধিজীবীদের সুস্পষ্ট বিভাজনরেখা দেখা দিয়েছিল তখন। মুসলমানদের সামগ্রিক অবস্থা নিরূপণে ১৮৮২ সালে গঠিত হান্টার কমিশনে এ ব্যাপারে তিনটি মত দেখা যায়।
প্রথমত সৈয়দ আমীর আলীর মত ছিল, মুসলমান ছাত্ররা ইংরেজি শিখুক, তবে তাদের মাতৃভাষা হবে উর্দু। দ্বিতীয়ত, নবাব আবদুল লতিফের মত_ অভিজাত মুসলমানরা ইংরেজি শিখবে, তবে শিক্ষার মাধ্যম হবে অভিজাত শ্রেণীর ভাষা উর্দু এবং দরিদ্র অভিজাত মুসলমানদের তাদের মাতৃভাষায় শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। তৃতীয়ত, মুর্শিদাবাদ এস্টেটের দেওয়ান ফাজলে রাবি্বর দাবি ছিল_ আরব, ইরান, খোরাসান থেকে মুসলমানরা এসেছে। ধর্মান্তরিত মুসলমানের সংখ্যা নামমাত্র। ফলে স্থানীয় ভাষায় শিক্ষার প্রয়োজন নেই। অভিজাত শ্রেণীর ভাষা অর্থাৎ উর্দুই হবে একমাত্র শিক্ষার মাধ্যম।
ভেদনীতিতে বিশ্বাসী ইংরেজরা তাদের স্বার্থেই পদক্ষেপ নিয়েছে এবং মুসলমানদের জন্য মাদ্রাসা শিক্ষা চালু করেছে। যদিও এ মতের প্রতি ব্রিটিশ শাসকরা পক্ষপাত দেখালেও বাস্তব সত্য হচ্ছে, বাংলার সিংহভাগ মুসলমান মাতৃভাষা পরিত্যাগ করে উর্দুকে ঘরে ঠাঁই দেয়নি। তারা বাংলা বুলিকে ধরে রেখেছে। জারি-সারি, ভাটিয়ালি, রাখালি রচনা করে বাংলা ভাষাকে সজীব করেছে।
সেদিন বিভ্রান্ত মুসলিম নেতারা বিস্মৃত হয়েছিলেন যে, মধ্য যুগেও আলাওল, সৈয়দ সুলতান, দৌলত কাজীরা এই বাংলা কাব্যচর্চার অনন্য স্বাক্ষর রেখেছিলেন। ঊনবিংশ শতাব্দীতে মীর মশাররফ হোসেন, বেগম রোকেয়া প্রমুখ বাংলা ভাষায় সাহিত্য রচনায় নিয়োজিত ছিলেন। তবে প্রগতিশীল দুটি উদ্যোগ সাম্প্রদায়িক ভেদবৃদ্ধির সব কারসাজি ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিল। একটি কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি এবং অপরটি ঢাকায় 'শিখা' সাময়িকপত্রকে কেন্দ্র করে শিখাগোষ্ঠী।
বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির মুখপাত্র 'বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা' কেবল মুসলমানদের পত্রিকা ছিল না। সুপণ্ডিত ও ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও মোহম্মদ মোজাম্মেল সম্পাদিত এই পত্রিকায় অমুসলিমদের লেখা প্রকাশিত হতো। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, মোজাম্মেল হক, কাজী নজরুল ইসলাম, মুজফ্ফর আহমেদ, মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন প্রমুখ মুসলিম লেখকের সঙ্গে পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়, মোহিতলাল মজুমদার, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় এসে আড্ডায় মিলিত হতেন। এটি হয়ে দাঁড়িয়েছিল হিন্দু-মুসলিম কবি-সাহিত্যিকদের মিলনকেন্দ্র। কাজী নজরুল ইসলামের উত্থানের পেছনে এই সমিতির অবদান অনস্বীকার্য। ঢাকার শিখাগোষ্ঠী ছিল সব প্রকার কূপমণ্ডূকতার বিরুদ্ধে এক সাহসী অভিযাত্রা। আবুল হুসেন, আবদুল ওদুদ, আবুল ফজল, কাজী মোতাহার হোসেন প্রমুখের উদার মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি মুসলিম তরুণদের আকৃষ্ট করেছিল। বাংলা ভাষা ও সাংস্কৃতিক চেতনায় তাদের শাণিত করেছিল।
এর বিপরীত মওলানা আকরম খাঁ সম্পাদিত দৈনিক আজাদ ও ফজলুল হক সেলবর্ষী সম্পাদিত দৈনিক তকবীরসহ কতিপয় পত্রিকা সাম্প্রদায়িক ভেদনীতি প্রচার অব্যাহত রাখলেও ঢাকা ও কলকাতায় ত্রিশের দশকেই মুসলমান লেখক-শিল্পী তো বটেই, ব্যাপক সাধারণ শিক্ষিত মানুষ অসাম্প্রদায়িক, মানবিক ও স্বাদেশিক চেতনায় উদ্বেলিত হয়েছে। তাদের কাছে মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার প্রতি ছিল অকৃত্রিম ভালোবাসা। তখন এই প্রগতিশীল লেখকরা বাংলা ভাষার সাম্প্রদায়িকীকরণ, জোর করে আরবি-ফার্সি ঢোকানোর বিরুদ্ধেও সোচ্চার ছিলেন। তারা বিশ্বাস করেছেন যে, বাংলা হিন্দু-মুসলিমের জন্মভূমি, ভাষাও উভয় সম্প্রদায়ের_ তা খণ্ডিত করার কোনো অধিকার কারও নেই। এর প্রকাশ দেখি ১৯২৯ সালে মুসলমান সাহিত্য সম্মেলনে। এতে প্রধান অতিথির ভাষণে কবি কায়কোবাদ বলেছিলেন, 'বঙ্গভাষা যে বঙ্গীয় মুসলমানদের মাতৃভাষা, এ সম্বন্ধে বোধহয় এখন আর দ্বিমত নাই। অন্তত অধিকাংশ বঙ্গীয় মুসলমান এ কথা একবাক্যে স্বীকার করেন। অল্পসংখ্যক যাহারা করেন না, তাহারা এখনও উর্দুর স্বপ্নে বিভোর হইয়া আছেন। দীর্ঘ নিদ্রার পর তাঁহারা গা-ঝাড়া দিয়া উঠেন, এবারও সেরূপ কিছু আয়োজন দেখা যায়। কিন্তু তাহাতে ভয় বা আশঙ্কার কোনো কারণ নাই। প্রকৃতির নিয়মকে উল্টাইয়া দিয়া উর্দু কোনরূপেই বাংলার মুসলিম জনসাধারণের ভাষা হইতে পারিবে না। উহা কয়েকজন ভাববিলাসীর ভাষা হইতে পারে, ইহার বেশি কিছু নয়। আমাদের স্মরণ রাখিতে হইবে, বাংলা কেবল মুসলমানদের মাতৃভাষা নয়, আমাদের জন্মভূমির ভাষা। ইহার উপর হিন্দু-মুসলমানের তুল্য অধিকার।'
বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির আরেকটি সভার উল্লেখ জরুরি। ১৯৪০ সালের ৩১ মার্চে আল্লামা ইকবালের স্মরণসভায় সভাপতি আবদুর রহমান সিদ্দিকী বাঙালি মুসলমান বক্তাদের বাংলায় বক্তৃতা করতে দেবেন না বলে ঘোষণা দেন। এও বলেন যে, যারা উর্দু জানেন না, তারা সভা থেকে বেরিয়ে যেতে পারেন। তখন সভায় হট্টগোল হয়। আজিজুর রহমান নামে এক ছাত্র আহত হন। বাধ্য হয়ে সভাপতি সভাস্থল ত্যাগ করেন। তখন বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির সম্পাদক হবীবুল্লাহ বাহার বলেন, 'সমবেত জনমণ্ডলীর অধিকাংশ বাঙালি, অতএব এই সভায় বঙ্গভাষার অধিকার অবিসম্বাদিত।' ওই সভায় ৯২ বছর বয়স্ক মুহম্মদ ইয়াসিন কাজী সাহিত্যরত্ন বলেন, 'বাঙালি আরবি, উর্দু, ইংরেজি যে ভাষাতেই পাণ্ডিত্য লাভ করুন, তাহারা চিরদিন স্বপ্ন দেখিবেন বাংলায়।' আহত ছাত্র আজিজুর রহমান বলেন, 'যে নির্যাতন আমাকে সহ্য করিতে হইয়াছে, তাহা সমস্ত বাঙালির উপর নির্যাতন।' তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, 'অবাঙালির শোষণ-নির্যাতন বাংলা আর কতদিন সহ্য করিবে?'
ওই সভার আমন্ত্রিত বক্তা কবি অমিয় চক্রবর্তী এ ঘটনায় আনন্দিত ও উৎসাহিত হয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে চিঠিতে লিখেছিলেন, 'সেদিন মুসলমান সভায় গিয়ে এই কাণ্ড। খুব ভাল লাগল যে, বাঙালি মুসলমান_ সাহিত্যিক ছাত্র এবং সাধারণ আপিস-দোকানের কত লোক_ বাংলা ভাষা ছাড়তে রাজি নয়। কবি ইকবালের নামে সাহিত্যসভা, সেখানে আমাদের সকলের স্থান, সভাপতি জোর করে রাজনীতি ঢোকাবেন।' সেদিন কবিগুরুর কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, জানি না। তবে তিনি নিশ্চয়ই অনুধাবন করেছিলেন, শত বিভ্রান্তির মুখেও পশ্চাৎপদ মুসলিম জনগোষ্ঠী বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে পরম মমতায় ধরে রেখেছেন, কিছুতেই তা ছাড়বে না। এ প্রসঙ্গে বলা আবশ্যক, ১৯৩৭ সালে বঙ্গীয় আইন পরিষদে বহু ইংরেজি না-জানা সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন, যার বেশিরভাগ ছিলেন মুসলিম ও তফসিল সম্প্রদায়ভুক্ত। তখন তাদের বাংলায় দেওয়া বক্তৃতা কার্যবিবরণীভুক্ত হতো না। কেবল দলনেতা তার বক্তৃতায় ইংরেজি না জানা দলীয় সদস্যদের বক্তব্যের যে অংশটুকু ইংরেজিতে অনুবাদ করে বলতেন, সেটুকু কার্যবিবরণীতে ঠাঁই পেত। সেদিন তারা বাংলাকে আইনসভার ভাষার মর্যাদা দেওয়ার দাবি তুলেছিলেন।
এটি অস্বীকার করা যাবে না যে, জনমনে বাংলা ভাষার প্রতি মমত্ববোধ সঞ্চিত ছিল, '৪৮-'৫২তে তা প্রকাশিত হয়েছে। তারা মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসার পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছে। গড়েছে ফেব্রুয়ারির ইতিহাস।
একুশে ফেব্রুয়ারির পথ ধরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এসেছে, একুশ আন্তর্জাতিক ভাষা দিবসের মর্যাদা লাভ করেছে। বাংলাকে জাতিসংঘের দাফতরিক ভাষা করার প্রস্তাব উঠেছে। তা সত্ত্বেও কি আমরা বলতে পারি যে, বাংলা ভাষার সংগ্রাম শেষ হয়েছে?
বাংলাদেশের ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলগুলোতে বাংলা ভাষা উপেক্ষিত। মাদ্রাসাগুলোতে পরিশীলিত বাংলা পড়ানোর আয়োজন নেই। ধনাঢ্য পরিবারে একদা উর্দু ঢুকেছিল, সে স্থান এখন পেয়েছে ইংরেজি। সঙ্গত কারণেই ইংরেজি শিখতে হবে। কিন্তু তা বাংলাভাষার বিকল্প হতে পারে না। আমি বুঝতে পারি না যে, বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা হওয়ার পর কেন এখনও ইংরেজির দাপট রয়েছে! আন্তর্জাতিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে ইংরেজির বিকল্প নেই। কিন্তু দেশের অভ্যন্তরে কেন ইংরেজি বয়ানে চিঠি চালাচালি হয়? বাংলা কেন আদালতের ভাষা হতে পারছে না?
এটি বিস্ময়ের ব্যাপার যে, এখন দু'একটা ব্যতিক্রম ছাড়া আর বাংলায় আমন্ত্রণলিপি পাই না। বিয়ের নিমন্ত্রণপত্র ইংরেজিতে না হলে যেন আভিজাত্য প্রমাণিত হয় না। এই হীনম্মন্যতাবোধ থেকে না বেরোতে পারলে বাংলা ভাষার উৎকর্ষ কি আদৌ সম্ভব? বাংলা ভাষার সমৃদ্ধি আনতে দরকার গবেষণা, বিজ্ঞান প্রযুক্তির উপযুক্ত শব্দ নির্মাণের উদ্যোগ। তার আগে চাই মাতৃভাষার প্রতি মমত্ববোধ, যা মূর্ত হয়েছিল একুশের মিছিলে। তদুপরি বাংলাভাষা প্রাকৃতজনের ভাষা। সেই অতি সাধারণজনের সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক মুক্তি যতদিন না আসবে, ততদিন থামবে না একুশের সংগ্রাম।
আবু সাঈদ খান : সাংবাদিক
ask_bangla71@yahoo.com
www.abusayeedkhan.com
মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি মতাদর্শকে বিদায় দিয়েছি আমরা। কিন্তু অবচেতনভাবে হলেও আমাদের ইতিহাস যেন সেই মানসিক-কাঠামোর মধ্যে বন্দি আজও। মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসের বয়ানও ১৯৪৭ থেকে একাত্তরের মধ্যে ঘুরপাক খায়। প্রাক-সাতচলি্লশ কালের গর্বিত ইতিহাস উল্লেখেও কার্পণ্য দেখা যায়। এটি সত্য যে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর নতুন আঙ্গিকে আমাদের মুক্তি সংগ্রাম সূচিত হয়েছিল। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তন্দ্রাচ্ছন্ন বাঙালি গা-ঝাড়া দিয়ে ওঠে, শিকড়ের সন্ধানে প্রবৃত্ত হয়। বাংলার মুসলমানরা প্রতিবেশী হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানের সঙ্গে মানসিক নৈকট্যবোধ করে। খসে পড়ে দ্বিজাতিতত্ত্বের কৃত্রিম অবয়ব। মুসলিম সম্প্রদায়ের এই আত্মজাগৃতির ফলেই ধারাবাহিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে প্রস্ফুটিত হয় ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবোধ। আর তার চূড়ান্ত পরিণতি একাত্তরের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। এ নিয়ে দ্বিমতের সুযোগ নেই। কিন্তু বিপত্তি হচ্ছে মুক্তি সংগ্রামকে কেবল পাকিস্তানের পটভূমিতে দেখার প্রবণতা। এটি মনেপ্রাণে ধারণ করার বিষয় যে, আমাদের মুক্তি সংগ্রাম ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় সূচিত হয়েছে। '৪৮ থেকে একাত্তরের সংগ্রাম ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতাবিরোধী বীরত্বগাথারই সম্প্রসারিত রূপ। ভাষা নিয়ে বিতর্ক ও সংগ্রামের সূত্রপাত ঘটেছিল ব্রিটিশ ভারতেই।
বাঙালি মুসলমানের ভাষা কী, কী হবে তাদের শিক্ষার মাধ্যম_ এ ব্যাপারে মুসলিম নেতা ও বুদ্ধিজীবীদের সুস্পষ্ট বিভাজনরেখা দেখা দিয়েছিল তখন। মুসলমানদের সামগ্রিক অবস্থা নিরূপণে ১৮৮২ সালে গঠিত হান্টার কমিশনে এ ব্যাপারে তিনটি মত দেখা যায়।
প্রথমত সৈয়দ আমীর আলীর মত ছিল, মুসলমান ছাত্ররা ইংরেজি শিখুক, তবে তাদের মাতৃভাষা হবে উর্দু। দ্বিতীয়ত, নবাব আবদুল লতিফের মত_ অভিজাত মুসলমানরা ইংরেজি শিখবে, তবে শিক্ষার মাধ্যম হবে অভিজাত শ্রেণীর ভাষা উর্দু এবং দরিদ্র অভিজাত মুসলমানদের তাদের মাতৃভাষায় শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। তৃতীয়ত, মুর্শিদাবাদ এস্টেটের দেওয়ান ফাজলে রাবি্বর দাবি ছিল_ আরব, ইরান, খোরাসান থেকে মুসলমানরা এসেছে। ধর্মান্তরিত মুসলমানের সংখ্যা নামমাত্র। ফলে স্থানীয় ভাষায় শিক্ষার প্রয়োজন নেই। অভিজাত শ্রেণীর ভাষা অর্থাৎ উর্দুই হবে একমাত্র শিক্ষার মাধ্যম।
ভেদনীতিতে বিশ্বাসী ইংরেজরা তাদের স্বার্থেই পদক্ষেপ নিয়েছে এবং মুসলমানদের জন্য মাদ্রাসা শিক্ষা চালু করেছে। যদিও এ মতের প্রতি ব্রিটিশ শাসকরা পক্ষপাত দেখালেও বাস্তব সত্য হচ্ছে, বাংলার সিংহভাগ মুসলমান মাতৃভাষা পরিত্যাগ করে উর্দুকে ঘরে ঠাঁই দেয়নি। তারা বাংলা বুলিকে ধরে রেখেছে। জারি-সারি, ভাটিয়ালি, রাখালি রচনা করে বাংলা ভাষাকে সজীব করেছে।
সেদিন বিভ্রান্ত মুসলিম নেতারা বিস্মৃত হয়েছিলেন যে, মধ্য যুগেও আলাওল, সৈয়দ সুলতান, দৌলত কাজীরা এই বাংলা কাব্যচর্চার অনন্য স্বাক্ষর রেখেছিলেন। ঊনবিংশ শতাব্দীতে মীর মশাররফ হোসেন, বেগম রোকেয়া প্রমুখ বাংলা ভাষায় সাহিত্য রচনায় নিয়োজিত ছিলেন। তবে প্রগতিশীল দুটি উদ্যোগ সাম্প্রদায়িক ভেদবৃদ্ধির সব কারসাজি ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিল। একটি কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি এবং অপরটি ঢাকায় 'শিখা' সাময়িকপত্রকে কেন্দ্র করে শিখাগোষ্ঠী।
বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির মুখপাত্র 'বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা' কেবল মুসলমানদের পত্রিকা ছিল না। সুপণ্ডিত ও ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও মোহম্মদ মোজাম্মেল সম্পাদিত এই পত্রিকায় অমুসলিমদের লেখা প্রকাশিত হতো। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, মোজাম্মেল হক, কাজী নজরুল ইসলাম, মুজফ্ফর আহমেদ, মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন প্রমুখ মুসলিম লেখকের সঙ্গে পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়, মোহিতলাল মজুমদার, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় এসে আড্ডায় মিলিত হতেন। এটি হয়ে দাঁড়িয়েছিল হিন্দু-মুসলিম কবি-সাহিত্যিকদের মিলনকেন্দ্র। কাজী নজরুল ইসলামের উত্থানের পেছনে এই সমিতির অবদান অনস্বীকার্য। ঢাকার শিখাগোষ্ঠী ছিল সব প্রকার কূপমণ্ডূকতার বিরুদ্ধে এক সাহসী অভিযাত্রা। আবুল হুসেন, আবদুল ওদুদ, আবুল ফজল, কাজী মোতাহার হোসেন প্রমুখের উদার মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি মুসলিম তরুণদের আকৃষ্ট করেছিল। বাংলা ভাষা ও সাংস্কৃতিক চেতনায় তাদের শাণিত করেছিল।
এর বিপরীত মওলানা আকরম খাঁ সম্পাদিত দৈনিক আজাদ ও ফজলুল হক সেলবর্ষী সম্পাদিত দৈনিক তকবীরসহ কতিপয় পত্রিকা সাম্প্রদায়িক ভেদনীতি প্রচার অব্যাহত রাখলেও ঢাকা ও কলকাতায় ত্রিশের দশকেই মুসলমান লেখক-শিল্পী তো বটেই, ব্যাপক সাধারণ শিক্ষিত মানুষ অসাম্প্রদায়িক, মানবিক ও স্বাদেশিক চেতনায় উদ্বেলিত হয়েছে। তাদের কাছে মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার প্রতি ছিল অকৃত্রিম ভালোবাসা। তখন এই প্রগতিশীল লেখকরা বাংলা ভাষার সাম্প্রদায়িকীকরণ, জোর করে আরবি-ফার্সি ঢোকানোর বিরুদ্ধেও সোচ্চার ছিলেন। তারা বিশ্বাস করেছেন যে, বাংলা হিন্দু-মুসলিমের জন্মভূমি, ভাষাও উভয় সম্প্রদায়ের_ তা খণ্ডিত করার কোনো অধিকার কারও নেই। এর প্রকাশ দেখি ১৯২৯ সালে মুসলমান সাহিত্য সম্মেলনে। এতে প্রধান অতিথির ভাষণে কবি কায়কোবাদ বলেছিলেন, 'বঙ্গভাষা যে বঙ্গীয় মুসলমানদের মাতৃভাষা, এ সম্বন্ধে বোধহয় এখন আর দ্বিমত নাই। অন্তত অধিকাংশ বঙ্গীয় মুসলমান এ কথা একবাক্যে স্বীকার করেন। অল্পসংখ্যক যাহারা করেন না, তাহারা এখনও উর্দুর স্বপ্নে বিভোর হইয়া আছেন। দীর্ঘ নিদ্রার পর তাঁহারা গা-ঝাড়া দিয়া উঠেন, এবারও সেরূপ কিছু আয়োজন দেখা যায়। কিন্তু তাহাতে ভয় বা আশঙ্কার কোনো কারণ নাই। প্রকৃতির নিয়মকে উল্টাইয়া দিয়া উর্দু কোনরূপেই বাংলার মুসলিম জনসাধারণের ভাষা হইতে পারিবে না। উহা কয়েকজন ভাববিলাসীর ভাষা হইতে পারে, ইহার বেশি কিছু নয়। আমাদের স্মরণ রাখিতে হইবে, বাংলা কেবল মুসলমানদের মাতৃভাষা নয়, আমাদের জন্মভূমির ভাষা। ইহার উপর হিন্দু-মুসলমানের তুল্য অধিকার।'
বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির আরেকটি সভার উল্লেখ জরুরি। ১৯৪০ সালের ৩১ মার্চে আল্লামা ইকবালের স্মরণসভায় সভাপতি আবদুর রহমান সিদ্দিকী বাঙালি মুসলমান বক্তাদের বাংলায় বক্তৃতা করতে দেবেন না বলে ঘোষণা দেন। এও বলেন যে, যারা উর্দু জানেন না, তারা সভা থেকে বেরিয়ে যেতে পারেন। তখন সভায় হট্টগোল হয়। আজিজুর রহমান নামে এক ছাত্র আহত হন। বাধ্য হয়ে সভাপতি সভাস্থল ত্যাগ করেন। তখন বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির সম্পাদক হবীবুল্লাহ বাহার বলেন, 'সমবেত জনমণ্ডলীর অধিকাংশ বাঙালি, অতএব এই সভায় বঙ্গভাষার অধিকার অবিসম্বাদিত।' ওই সভায় ৯২ বছর বয়স্ক মুহম্মদ ইয়াসিন কাজী সাহিত্যরত্ন বলেন, 'বাঙালি আরবি, উর্দু, ইংরেজি যে ভাষাতেই পাণ্ডিত্য লাভ করুন, তাহারা চিরদিন স্বপ্ন দেখিবেন বাংলায়।' আহত ছাত্র আজিজুর রহমান বলেন, 'যে নির্যাতন আমাকে সহ্য করিতে হইয়াছে, তাহা সমস্ত বাঙালির উপর নির্যাতন।' তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, 'অবাঙালির শোষণ-নির্যাতন বাংলা আর কতদিন সহ্য করিবে?'
ওই সভার আমন্ত্রিত বক্তা কবি অমিয় চক্রবর্তী এ ঘটনায় আনন্দিত ও উৎসাহিত হয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে চিঠিতে লিখেছিলেন, 'সেদিন মুসলমান সভায় গিয়ে এই কাণ্ড। খুব ভাল লাগল যে, বাঙালি মুসলমান_ সাহিত্যিক ছাত্র এবং সাধারণ আপিস-দোকানের কত লোক_ বাংলা ভাষা ছাড়তে রাজি নয়। কবি ইকবালের নামে সাহিত্যসভা, সেখানে আমাদের সকলের স্থান, সভাপতি জোর করে রাজনীতি ঢোকাবেন।' সেদিন কবিগুরুর কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, জানি না। তবে তিনি নিশ্চয়ই অনুধাবন করেছিলেন, শত বিভ্রান্তির মুখেও পশ্চাৎপদ মুসলিম জনগোষ্ঠী বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে পরম মমতায় ধরে রেখেছেন, কিছুতেই তা ছাড়বে না। এ প্রসঙ্গে বলা আবশ্যক, ১৯৩৭ সালে বঙ্গীয় আইন পরিষদে বহু ইংরেজি না-জানা সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন, যার বেশিরভাগ ছিলেন মুসলিম ও তফসিল সম্প্রদায়ভুক্ত। তখন তাদের বাংলায় দেওয়া বক্তৃতা কার্যবিবরণীভুক্ত হতো না। কেবল দলনেতা তার বক্তৃতায় ইংরেজি না জানা দলীয় সদস্যদের বক্তব্যের যে অংশটুকু ইংরেজিতে অনুবাদ করে বলতেন, সেটুকু কার্যবিবরণীতে ঠাঁই পেত। সেদিন তারা বাংলাকে আইনসভার ভাষার মর্যাদা দেওয়ার দাবি তুলেছিলেন।
এটি অস্বীকার করা যাবে না যে, জনমনে বাংলা ভাষার প্রতি মমত্ববোধ সঞ্চিত ছিল, '৪৮-'৫২তে তা প্রকাশিত হয়েছে। তারা মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসার পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছে। গড়েছে ফেব্রুয়ারির ইতিহাস।
একুশে ফেব্রুয়ারির পথ ধরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এসেছে, একুশ আন্তর্জাতিক ভাষা দিবসের মর্যাদা লাভ করেছে। বাংলাকে জাতিসংঘের দাফতরিক ভাষা করার প্রস্তাব উঠেছে। তা সত্ত্বেও কি আমরা বলতে পারি যে, বাংলা ভাষার সংগ্রাম শেষ হয়েছে?
বাংলাদেশের ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলগুলোতে বাংলা ভাষা উপেক্ষিত। মাদ্রাসাগুলোতে পরিশীলিত বাংলা পড়ানোর আয়োজন নেই। ধনাঢ্য পরিবারে একদা উর্দু ঢুকেছিল, সে স্থান এখন পেয়েছে ইংরেজি। সঙ্গত কারণেই ইংরেজি শিখতে হবে। কিন্তু তা বাংলাভাষার বিকল্প হতে পারে না। আমি বুঝতে পারি না যে, বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা হওয়ার পর কেন এখনও ইংরেজির দাপট রয়েছে! আন্তর্জাতিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে ইংরেজির বিকল্প নেই। কিন্তু দেশের অভ্যন্তরে কেন ইংরেজি বয়ানে চিঠি চালাচালি হয়? বাংলা কেন আদালতের ভাষা হতে পারছে না?
এটি বিস্ময়ের ব্যাপার যে, এখন দু'একটা ব্যতিক্রম ছাড়া আর বাংলায় আমন্ত্রণলিপি পাই না। বিয়ের নিমন্ত্রণপত্র ইংরেজিতে না হলে যেন আভিজাত্য প্রমাণিত হয় না। এই হীনম্মন্যতাবোধ থেকে না বেরোতে পারলে বাংলা ভাষার উৎকর্ষ কি আদৌ সম্ভব? বাংলা ভাষার সমৃদ্ধি আনতে দরকার গবেষণা, বিজ্ঞান প্রযুক্তির উপযুক্ত শব্দ নির্মাণের উদ্যোগ। তার আগে চাই মাতৃভাষার প্রতি মমত্ববোধ, যা মূর্ত হয়েছিল একুশের মিছিলে। তদুপরি বাংলাভাষা প্রাকৃতজনের ভাষা। সেই অতি সাধারণজনের সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক মুক্তি যতদিন না আসবে, ততদিন থামবে না একুশের সংগ্রাম।
আবু সাঈদ খান : সাংবাদিক
ask_bangla71@yahoo.com
www.abusayeedkhan.com
No comments