প্রতিবেশীর কারণে দূর দেশেও ক্ষুণ্ন ভাবমূর্তি-সীমান্ত পরিস্থিতি by তারেক শামসুর রেহমান
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত নিয়ে নানা সমস্যা রয়েছে। এটা নিয়ে অতীতে দু'দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ে একাধিক বৈঠক হয়েছে। কিন্তু সীমান্ত নির্যাতনের হার কমছে না_ উদ্বেগের কারণ এটাই। আজ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল কিংবা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতো আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো যখন সীমান্ত নির্যাতন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে, তখন বিষয়টিকে হালকাভাবে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
আজ ভারতীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দুঃখ প্রকাশ করে প্রকারান্তরে 'দোষ' স্বীকার করে নিলেন। তার এই সৎসাহসের জন্য তিনি নিঃসন্দেহে ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। তিনি বাংলাদেশের জনগণের সমর্থন ও ভালোবাসা পাবেন, যদি তিনি এই নির্যাতন বন্ধে কার্যকর কোনো কর্মসূচি হাতে নেন। দুঃখ প্রকাশ করে হাবিবুর রহমানের সম্মান ফিরিয়ে দেওয়া যাবে না। আস্থা অর্জন করতে হলে নিতে হবে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা
ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরম বিএসএফ কর্তৃক চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাংলাদেশি যুবক হাবিবুর রহমানকে উলঙ্গ করে অত্যাচারের ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন। হাবিবুর রহমানের ঘটনাটি বহুল আলোচিত। ভারতীয় টিভি চ্যানেলে হাবিবুর রহমানের অত্যাচারের দৃশ্য সম্প্রচারিত হলে তাতে খোদ ভারতেও ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। ভারতীয় মানবাধিকার কমিশন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওপর রুল জারি করে। ভারতীয় প্রভাবশালী দৈনিক হিন্দু ক্ষমা চাওয়ারও আহ্বান জানায়। নিউইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ হাবিবের ওপর অত্যাচারের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিচার দাবি করেছে। ইতিমধ্যে হাবিবকে অত্যাচারের সঙ্গে জড়িত ৮ জন বিএসএফ সদস্যকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এর পরপরই ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দুঃখ প্রকাশ করলেন। কিন্তু এই দুঃখ প্রকাশই যথেষ্ট নয়। অতীতেও বিএসএফের পক্ষ থেকে দুঃখ প্রকাশ করা হয়েছিল। কিন্তু তারপরও হত্যা, অপহরণ ও অত্যাচারের ঘটনা একের পর এক ঘটেই চলেছে। এটা বন্ধ করা যাচ্ছে না। আরও দুঃখজনক খবর হচ্ছে, হাবিবুরের অত্যাচারের ঘটনা নিয়ে বাংলাদেশের গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজ যখন তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছিল, তখন আমাদের স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফ যা বলেছেন, তা ছিল অনাকাঙ্ক্ষিত। তিনি বলেছিলেন, সীমান্তে যা কিছু ঘটছে তা নিয়ে রাষ্ট্র চিন্তিত নয়। সব কাজ ফেলে শুধু এদিকে দৃষ্টি দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা আছে বলেও সরকার মনে করে না। তার এই বক্তব্য ২১ জানুয়ারি এভাবেই ছাপা হয়েছিল পত্রপত্রিকায়। রাষ্ট্রের একজন নাগরিক যখন নির্যাতনের শিকার হন, তখন জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে তার এভাবে কথা বলা শোভন হয়নি। নিশ্চয় 'সব কাজ ফেলে' রাষ্ট্র সীমান্ত সমস্যা নিয়ে পড়ে থাকবে না। কিন্তু একজন নাগরিক সীমান্তে আক্রান্ত হলে এটা দেখার দায়িত্ব রাষ্ট্রের।
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত নিয়ে নানা সমস্যা রয়েছে। এটা নিয়ে অতীতে দু'দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ে একাধিক বৈঠক হয়েছে। কিন্তু সীমান্ত নির্যাতনের হার কমছে না_ উদ্বেগের কারণ এটাই। আজ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল কিংবা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতো আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো যখন সীমান্ত নির্যাতন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে, তখন বিষয়টিকে হালকাভাবে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আজ ভারতীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দুঃখ প্রকাশ করে প্রকারান্তরে 'দোষ' স্বীকার করে নিলেন। তার এই সৎসাহসের জন্য তিনি নিঃসন্দেহে ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। তিনি বাংলাদেশের জনগণের সমর্থন ও ভালোবাসা পাবেন, যদি তিনি এই নির্যাতন বন্ধে কার্যকর কোনো কর্মসূচি হাতে নেন। দুঃখ প্রকাশ করে হাবিবুর রহমানের সম্মান ফিরিয়ে দেওয়া যাবে না। আস্থা অর্জন করতে হলে নিতে হবে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা।
বিএসএফের নির্যাতন আজ চরম পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। হাবিবুর রহমানের ওপর নির্মম অত্যাচারের রেশ কাটতে না কাটতে গত ২৬ জানুয়ারি ছাপা হয়েছে আরেকটি সংবাদ_ কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারী সীমান্তে বাংলাদেশি আবদুল লতিফ লেবুর লাশ ফেরত দিয়েছে ভারতীয় পুলিশ। সরকারের এটা বড় ব্যর্থতা যে, সরকার এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করতে পারছে না। বাংলাদেশের দুর্বল পররাষ্ট্রনীতির কারণে বিএসএফ এই সুযোগটি নিচ্ছে। দুঃখজনক হচ্ছে এটাই যে, বর্তমান সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর ভারতকে একের পর এক সুযোগ দেওয়ার পরও বিনিময়ে আমরা পাচ্ছি বাংলাদেশিদের লাশ। এটা কোন ধরনের বন্ধুত্বের নিদর্শন, এটা সহজেই অনুমান করা যায়। সত্যিকার অর্থেই ভারত বাংলাদেশকে একটি বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে গণ্য করে কি-না_ সেটা এখন বড় প্রশ্ন। বাংলাদেশকে তাদের প্রয়োজন নানা কারণে। প্রায় ১৬ কোটি মানুষের দেশের এই জনগোষ্ঠী ভারতের জন্য বিশাল একটা 'বাজার'। ভারত দেখবে তাদের স্বার্থ। তাই প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বাংলাদেশে এসে সীমান্তে হত্যা বন্ধ হবে বলে আশ্বাস দিলেও তা আদৌ কার্যকর হয়নি। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী আদৌ সীমান্ত হত্যা বন্ধে কোনো নির্দেশ দেননি। দিলে হাবিব বা লেবু হত্যার মতো ঘটনা ঘটত না। সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী, গত এক যুগে বিএসএফের হাতে প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় ১০০৬ জন বাংলাদেশি। খুব সূক্ষ্মভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, বাংলাদেশ ছাড়া ভারতের সীমান্ত রয়েছে মিয়ানমার, পাকিস্তান, ভুটান, নেপাল ও চীনের সঙ্গে। শ্রীলংকার সঙ্গে সরাসরি সীমান্ত না থাকলেও শ্রীলংকার সীমান্ত খুব বেশি দূরে নয়। কিন্তু কোনো একটি সীমান্তে কি এ ধরনের হত্যাকাণ্ড কখনও হয়েছে? চোরাকারবারের অভিযোগ তোলা হয়। কিন্তু ভারত-নেপাল সীমান্ত কিংবা ভারত-মিয়ানমার সীমান্তে চোরাকারবারি বা মাদক ব্যবসায়ীদের তৎপরতা কম নয়। তাহলে ওই সব সীমান্তে ভারত হত্যাকাণ্ড চালায় না কেন? এখানেই এসে যায় মূল প্রশ্নটি। আসলে ভারত বাংলাদেশকে সমমর্যাদার দৃষ্টিতে দেখে না। আমাদের ব্যর্থতা এখানেই যে, আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব এই সমমর্যাদা নিশ্চিত করতে পারেনি। কাঁটাতারের বেড়ায় যখন কিশোরী ফেলানীর লাশ ঝুলে ছিল, সেদিন এর প্রতিবাদ করতে সাহস পর্যন্ত পাননি আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিরা। এই 'ব্যর্থতা' বহির্বিশ্বে আমাদের ভাবমূর্তি যথেষ্ট নষ্ট করেছে। আমরা অবশ্যই ভারতের বন্ধুত্ব চাই। বাংলাদেশের উন্নয়নে ভারত বড় ভূমিকা রাখতে পারে_ এটাই আমরা মনে করি। কিন্তু এই 'বন্ধুত্ব' এখন যেন একতরফা হয়ে যাচ্ছে। গত ২৬ জানুয়ারি সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে একটি সংবাদ_ তাতে বলা হয়েছে, ভারতকে দ্রুত চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহার করতে দেওয়ার জন্য একজন উপদেষ্টার নেতৃত্বে (ড. মসিউর রহমান) একটি কমিটি গঠিত হয়েছে। এর কাজ চলছে। অর্থাৎ এখানেও দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার একটি তাগিদ। একই দিন কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় ছাপা হয়েছে আরেকটি সংবাদ_ গত সেপ্টেম্বরে ভারতীয় প্রধানন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরের সময় যে ছিটমহল বিনিময় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তা আদৌ ভারতীয় মন্ত্রিসভায় উত্থাপিত হয়নি এবং অনুমোদিতও হয়নি। কেননা এতে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিজেপির আপত্তি রয়েছে। এর অর্থ কী? চুক্তি হলো, কিন্তু তা কার্যকর করল না ভারত। কিন্তু আমরা নদীকে 'হত্যা' করে বাঁধ দিয়ে ভারতের ৪২ চাকার যান চলাচলের সুযোগ করে দিয়েছি। এভাবে পৃথিবীর কোথাও নদীতে বাঁধ দেওয়া হয় এটা চিন্তাও করা যায় না। কোনো আইনই এই 'নদী হত্যা'কে সমর্থন করে না। অথচ আমরা করলাম। আমাদের স্বার্থ এতে কী? দুঃখ লাগে এ কারণে যে, কোনো 'মন্ত্রী' সাহস করে 'নদী হত্যা' বন্ধের কথা বললেন না। কোথায় আমাদের পরিবেশমন্ত্রী?
আজ যখন তরুণ হাবিবুর রহমানের উলঙ্গ ও বিএসএফ কর্তৃক অত্যাচার ও নির্যাতনের ভিডিও দেখি, তখন ভাবি_ ভারতীয় সীমান্তরক্ষীরা কি পারবে একজন চীনা নাগরিক কিংবা 'চিরশত্রু' একজন পাকিস্তানি নাগরিককে এভাবে পেটাতে? সেই সাহস কি তাদের আছে? বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই সাহস তারা পায় কোথায়? আমাদের দুর্বল পররাষ্ট্রনীতিই বিএসএফকে এই 'সাহস' জুগিয়েছে। আমরা প্রতিনিয়ত বিএসএফের নির্যাতনের শিকার হচ্ছি। সীমান্তে এখন লাশের মিছিল। কিন্তু ক্ষমতাবান মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফ যখন বলেন, রাষ্ট্র এটা নিয়ে চিন্তিত নয়, তখন হিসাবটা ঠিক মেলে না। সৈয়দ আশরাফ পড়াশোনা করা মানুষ। ব্রিটেনে দীর্ঘদিন ছিলেন। তার বিদেশিনী স্ত্রীও থাকেন ব্রিটেনে। ব্রিটেনের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য, সাংবিধানিক কর্তৃত্ব ইত্যাদি অনেকের চেয়ে তার ভালো জানার কথা। রাষ্ট্র জনগণের অধিকারকে কতটুকু নিশ্চয়তা দেয় এবং যা সংবিধানের লিপিবদ্ধ, সে সম্পর্কে সৈয়দ আশরাফ ভালোই জানেন। সংবিধানের ১৫ নম্বর অনুচ্ছেদে নাগরিকের অধিকার রক্ষায় রাষ্ট্রের ভূমিকার কথা বলা হয়েছে। ৩২ নম্বর অনুচ্ছেদে রয়েছে জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার রক্ষার কথা। তখন একজন হাবিবুর রহমান, একজন আবদুল লতিফ লেবুর 'হত্যাকাণ্ড' তাদের অধিকার খর্ব করে। রাষ্ট্র এ ক্ষেত্রে নিশ্চুপ থাকতে পারে না। কিন্তু সৈয়দ আশরাফের বক্তব্য একরকম ঔদ্ধত্যের শামিল। তার এই বক্তব্য শুধু নিন্দনীয় নয়, বরং অপরাধও।
প্রফেসর ড. তারেক শামসুর রেহমান : শিক্ষক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরম বিএসএফ কর্তৃক চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাংলাদেশি যুবক হাবিবুর রহমানকে উলঙ্গ করে অত্যাচারের ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন। হাবিবুর রহমানের ঘটনাটি বহুল আলোচিত। ভারতীয় টিভি চ্যানেলে হাবিবুর রহমানের অত্যাচারের দৃশ্য সম্প্রচারিত হলে তাতে খোদ ভারতেও ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। ভারতীয় মানবাধিকার কমিশন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওপর রুল জারি করে। ভারতীয় প্রভাবশালী দৈনিক হিন্দু ক্ষমা চাওয়ারও আহ্বান জানায়। নিউইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ হাবিবের ওপর অত্যাচারের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিচার দাবি করেছে। ইতিমধ্যে হাবিবকে অত্যাচারের সঙ্গে জড়িত ৮ জন বিএসএফ সদস্যকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এর পরপরই ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দুঃখ প্রকাশ করলেন। কিন্তু এই দুঃখ প্রকাশই যথেষ্ট নয়। অতীতেও বিএসএফের পক্ষ থেকে দুঃখ প্রকাশ করা হয়েছিল। কিন্তু তারপরও হত্যা, অপহরণ ও অত্যাচারের ঘটনা একের পর এক ঘটেই চলেছে। এটা বন্ধ করা যাচ্ছে না। আরও দুঃখজনক খবর হচ্ছে, হাবিবুরের অত্যাচারের ঘটনা নিয়ে বাংলাদেশের গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজ যখন তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছিল, তখন আমাদের স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফ যা বলেছেন, তা ছিল অনাকাঙ্ক্ষিত। তিনি বলেছিলেন, সীমান্তে যা কিছু ঘটছে তা নিয়ে রাষ্ট্র চিন্তিত নয়। সব কাজ ফেলে শুধু এদিকে দৃষ্টি দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা আছে বলেও সরকার মনে করে না। তার এই বক্তব্য ২১ জানুয়ারি এভাবেই ছাপা হয়েছিল পত্রপত্রিকায়। রাষ্ট্রের একজন নাগরিক যখন নির্যাতনের শিকার হন, তখন জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে তার এভাবে কথা বলা শোভন হয়নি। নিশ্চয় 'সব কাজ ফেলে' রাষ্ট্র সীমান্ত সমস্যা নিয়ে পড়ে থাকবে না। কিন্তু একজন নাগরিক সীমান্তে আক্রান্ত হলে এটা দেখার দায়িত্ব রাষ্ট্রের।
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত নিয়ে নানা সমস্যা রয়েছে। এটা নিয়ে অতীতে দু'দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ে একাধিক বৈঠক হয়েছে। কিন্তু সীমান্ত নির্যাতনের হার কমছে না_ উদ্বেগের কারণ এটাই। আজ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল কিংবা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতো আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো যখন সীমান্ত নির্যাতন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে, তখন বিষয়টিকে হালকাভাবে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আজ ভারতীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দুঃখ প্রকাশ করে প্রকারান্তরে 'দোষ' স্বীকার করে নিলেন। তার এই সৎসাহসের জন্য তিনি নিঃসন্দেহে ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। তিনি বাংলাদেশের জনগণের সমর্থন ও ভালোবাসা পাবেন, যদি তিনি এই নির্যাতন বন্ধে কার্যকর কোনো কর্মসূচি হাতে নেন। দুঃখ প্রকাশ করে হাবিবুর রহমানের সম্মান ফিরিয়ে দেওয়া যাবে না। আস্থা অর্জন করতে হলে নিতে হবে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা।
বিএসএফের নির্যাতন আজ চরম পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। হাবিবুর রহমানের ওপর নির্মম অত্যাচারের রেশ কাটতে না কাটতে গত ২৬ জানুয়ারি ছাপা হয়েছে আরেকটি সংবাদ_ কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারী সীমান্তে বাংলাদেশি আবদুল লতিফ লেবুর লাশ ফেরত দিয়েছে ভারতীয় পুলিশ। সরকারের এটা বড় ব্যর্থতা যে, সরকার এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করতে পারছে না। বাংলাদেশের দুর্বল পররাষ্ট্রনীতির কারণে বিএসএফ এই সুযোগটি নিচ্ছে। দুঃখজনক হচ্ছে এটাই যে, বর্তমান সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর ভারতকে একের পর এক সুযোগ দেওয়ার পরও বিনিময়ে আমরা পাচ্ছি বাংলাদেশিদের লাশ। এটা কোন ধরনের বন্ধুত্বের নিদর্শন, এটা সহজেই অনুমান করা যায়। সত্যিকার অর্থেই ভারত বাংলাদেশকে একটি বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে গণ্য করে কি-না_ সেটা এখন বড় প্রশ্ন। বাংলাদেশকে তাদের প্রয়োজন নানা কারণে। প্রায় ১৬ কোটি মানুষের দেশের এই জনগোষ্ঠী ভারতের জন্য বিশাল একটা 'বাজার'। ভারত দেখবে তাদের স্বার্থ। তাই প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বাংলাদেশে এসে সীমান্তে হত্যা বন্ধ হবে বলে আশ্বাস দিলেও তা আদৌ কার্যকর হয়নি। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী আদৌ সীমান্ত হত্যা বন্ধে কোনো নির্দেশ দেননি। দিলে হাবিব বা লেবু হত্যার মতো ঘটনা ঘটত না। সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী, গত এক যুগে বিএসএফের হাতে প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় ১০০৬ জন বাংলাদেশি। খুব সূক্ষ্মভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, বাংলাদেশ ছাড়া ভারতের সীমান্ত রয়েছে মিয়ানমার, পাকিস্তান, ভুটান, নেপাল ও চীনের সঙ্গে। শ্রীলংকার সঙ্গে সরাসরি সীমান্ত না থাকলেও শ্রীলংকার সীমান্ত খুব বেশি দূরে নয়। কিন্তু কোনো একটি সীমান্তে কি এ ধরনের হত্যাকাণ্ড কখনও হয়েছে? চোরাকারবারের অভিযোগ তোলা হয়। কিন্তু ভারত-নেপাল সীমান্ত কিংবা ভারত-মিয়ানমার সীমান্তে চোরাকারবারি বা মাদক ব্যবসায়ীদের তৎপরতা কম নয়। তাহলে ওই সব সীমান্তে ভারত হত্যাকাণ্ড চালায় না কেন? এখানেই এসে যায় মূল প্রশ্নটি। আসলে ভারত বাংলাদেশকে সমমর্যাদার দৃষ্টিতে দেখে না। আমাদের ব্যর্থতা এখানেই যে, আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব এই সমমর্যাদা নিশ্চিত করতে পারেনি। কাঁটাতারের বেড়ায় যখন কিশোরী ফেলানীর লাশ ঝুলে ছিল, সেদিন এর প্রতিবাদ করতে সাহস পর্যন্ত পাননি আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিরা। এই 'ব্যর্থতা' বহির্বিশ্বে আমাদের ভাবমূর্তি যথেষ্ট নষ্ট করেছে। আমরা অবশ্যই ভারতের বন্ধুত্ব চাই। বাংলাদেশের উন্নয়নে ভারত বড় ভূমিকা রাখতে পারে_ এটাই আমরা মনে করি। কিন্তু এই 'বন্ধুত্ব' এখন যেন একতরফা হয়ে যাচ্ছে। গত ২৬ জানুয়ারি সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে একটি সংবাদ_ তাতে বলা হয়েছে, ভারতকে দ্রুত চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহার করতে দেওয়ার জন্য একজন উপদেষ্টার নেতৃত্বে (ড. মসিউর রহমান) একটি কমিটি গঠিত হয়েছে। এর কাজ চলছে। অর্থাৎ এখানেও দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার একটি তাগিদ। একই দিন কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় ছাপা হয়েছে আরেকটি সংবাদ_ গত সেপ্টেম্বরে ভারতীয় প্রধানন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরের সময় যে ছিটমহল বিনিময় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তা আদৌ ভারতীয় মন্ত্রিসভায় উত্থাপিত হয়নি এবং অনুমোদিতও হয়নি। কেননা এতে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিজেপির আপত্তি রয়েছে। এর অর্থ কী? চুক্তি হলো, কিন্তু তা কার্যকর করল না ভারত। কিন্তু আমরা নদীকে 'হত্যা' করে বাঁধ দিয়ে ভারতের ৪২ চাকার যান চলাচলের সুযোগ করে দিয়েছি। এভাবে পৃথিবীর কোথাও নদীতে বাঁধ দেওয়া হয় এটা চিন্তাও করা যায় না। কোনো আইনই এই 'নদী হত্যা'কে সমর্থন করে না। অথচ আমরা করলাম। আমাদের স্বার্থ এতে কী? দুঃখ লাগে এ কারণে যে, কোনো 'মন্ত্রী' সাহস করে 'নদী হত্যা' বন্ধের কথা বললেন না। কোথায় আমাদের পরিবেশমন্ত্রী?
আজ যখন তরুণ হাবিবুর রহমানের উলঙ্গ ও বিএসএফ কর্তৃক অত্যাচার ও নির্যাতনের ভিডিও দেখি, তখন ভাবি_ ভারতীয় সীমান্তরক্ষীরা কি পারবে একজন চীনা নাগরিক কিংবা 'চিরশত্রু' একজন পাকিস্তানি নাগরিককে এভাবে পেটাতে? সেই সাহস কি তাদের আছে? বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই সাহস তারা পায় কোথায়? আমাদের দুর্বল পররাষ্ট্রনীতিই বিএসএফকে এই 'সাহস' জুগিয়েছে। আমরা প্রতিনিয়ত বিএসএফের নির্যাতনের শিকার হচ্ছি। সীমান্তে এখন লাশের মিছিল। কিন্তু ক্ষমতাবান মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফ যখন বলেন, রাষ্ট্র এটা নিয়ে চিন্তিত নয়, তখন হিসাবটা ঠিক মেলে না। সৈয়দ আশরাফ পড়াশোনা করা মানুষ। ব্রিটেনে দীর্ঘদিন ছিলেন। তার বিদেশিনী স্ত্রীও থাকেন ব্রিটেনে। ব্রিটেনের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য, সাংবিধানিক কর্তৃত্ব ইত্যাদি অনেকের চেয়ে তার ভালো জানার কথা। রাষ্ট্র জনগণের অধিকারকে কতটুকু নিশ্চয়তা দেয় এবং যা সংবিধানের লিপিবদ্ধ, সে সম্পর্কে সৈয়দ আশরাফ ভালোই জানেন। সংবিধানের ১৫ নম্বর অনুচ্ছেদে নাগরিকের অধিকার রক্ষায় রাষ্ট্রের ভূমিকার কথা বলা হয়েছে। ৩২ নম্বর অনুচ্ছেদে রয়েছে জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার রক্ষার কথা। তখন একজন হাবিবুর রহমান, একজন আবদুল লতিফ লেবুর 'হত্যাকাণ্ড' তাদের অধিকার খর্ব করে। রাষ্ট্র এ ক্ষেত্রে নিশ্চুপ থাকতে পারে না। কিন্তু সৈয়দ আশরাফের বক্তব্য একরকম ঔদ্ধত্যের শামিল। তার এই বক্তব্য শুধু নিন্দনীয় নয়, বরং অপরাধও।
প্রফেসর ড. তারেক শামসুর রেহমান : শিক্ষক জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
No comments