স্মরণ-শেষ শিখাটি নিভে গেল by আবুল মোমেন
পঞ্চাশের দশকে চট্টগ্রামে একটি সাংস্কৃতিক জাগরণের সূচনা হয়েছিল। এর মূল সংগঠক ছিলেন কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী, যিনি পরিণত বয়সে এসে একুশের প্রথম কবিতার লেখক খ্যাতি পেয়েছিলেন। এই কর্মযজ্ঞে অভিভাবকের ভূমিকা পালন করেছেন সাহিত্যিক আবুল ফজল। প্রেরণা দিয়ে এতে গতিবেগ সঞ্চার করেছিলেন শিল্পী কলিম শরাফী।
সংগীতগুণী অচিন্ত্য চক্রবর্তী, মলয় ঘোষ দস্তিদার, হরিপ্রসন্ন পাল প্রমুখ একে সচল রেখেছিলেন এবং সমৃদ্ধ করেছেন। তখনকার কলেজছাত্র ও নাট্যশিল্পী মাহবুব হাসান এই জাগরণের একজন সৈনিক ছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে সেই জাগরণের শেষ শিখাটি নিভে গেল।
১৯৫১ সালে চট্টগ্রামে আয়োজিত হয় সাংস্কৃতিক সম্মেলন। এতে প্রবীণ গবেষক আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মূল সভাপতির ভাষণে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভ্রান্ত ধর্মান্ধ চেতনা থেকে বেরিয়ে অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতিচেতনা ধারণ করে বাঙালিকে জাগার ও এগোবার আহ্বান জানান। এ থেকেই শুরু হলো দ্বিজাতিতত্ত্বভিত্তিক প্রতিক্রিয়াশীল পাকিস্তানি রাজনীতি থেকে বেরিয়ে এসে বাঙালির চিরায়ত অসাম্প্রদায়িক মানবিক চেতনায় ঘুরে দাঁড়ানোর প্রক্রিয়া। চট্টগ্রামের পর ১৯৫৩ সালে কুমিল্লায়, পরের বছর ঢাকায়, ১৯৫৭ সালে মওলানা ভাসানীর উদ্যোগে কাগমারীতে বড় আকারের সাংস্কৃতিক সম্মেলন এবং ১৯৬১ সালে সামরিক শাসনের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ঢাকা-চট্টগ্রামে সাড়ম্বরে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপনের মধ্য দিয়ে বাঙালির আত্ম-আবিষ্কারের ধারাটি জোরদার হয়। মাহবুব হাসান বরাবর এই ধারার বর্তিকা ও পতাকাবাহী সৈনিকের ভূমিকা পালন করে গেছেন।
মাহবুব হাসান চট্টগ্রামের মানুষ নন, তাঁরা যশোরের মানুষ। তাঁর পিতামহ বিখ্যাত মুসলিম চিন্তাবিদ মুন্সী মেহেরুল্লাহর খ্যাতি কালের উজান বেয়ে এখনো টিকে আছে। বাবা মোহাম্মদ মোহসিন ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। আর বাবার বদলির চাকরির সূত্রে মাহবুব হাসান জন্মের পর অর্থাৎ ১৯৩০ থেকে ১৯৪৯ পর্যন্ত উত্তর ও পূর্ববঙ্গের নানা জেলা শহরে কাটিয়েছেন। সিরাজগঞ্জে তাঁর স্কুলজীবন শুরু, আর ’৪৭ সালে ফেনী থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষা পাস করেন। ১৯৪৯ সালে চট্টগ্রামে এলেন, বাবাও অবসর নিয়ে এখানে স্থায়ী বাসিন্দা হলেন। আর মাহবুব হাসান সেই থেকে চট্টগ্রামবাসী। দীর্ঘ ৬২ বছরের বসবাসে তিনি এই শহরের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের তরুণ কর্মী থেকে বর্ষীয়ান অভিভাবকে পরিণত হয়েছিলেন।
মাহবুব ভাই মূলত ছিলেন নাট্যশিল্পী, মঞ্চনাটকের সফল অভিনেতা। সে আমলে শিক্ষিত পরিবারে অভিনয়কে সুনজরে দেখা হতো না। ফলে জীবনের মূল যে কর্মক্ষেত্র তিনি বেছে নিয়েছিলেন, তা বজায় রাখা ছিল তাঁর জীবনসংগ্রামের প্রথম ধাপ। আর প্রথম জীবনেই যুক্ত হয়েছিলেন মাহবুব উল আলম চৌধুরী, কলিম শরাফীদের মতো বাম চিন্তার প্রগতিশীল সংগঠকদের সঙ্গে। তাঁরা ছিলেন প্রান্তিক নবনাট্য সংঘের সদস্য। এটি বিখ্যাত ভারতীয় গণনাট্য সংঘের আদলে ও আদর্শে গড়ে উঠেছিল। চট্টগ্রাম থেকে গান ও নাটকের বিরাট দল নিয়ে তাঁরা জয় করেছিলেন কুমিল্লা, ঢাকা ও কাগমারী সম্মেলন। চট্টগ্রামের সংগীতশিল্পী ও নাট্যকর্মীদের নাম সে সময় দেশের প্রগতিশীল মহলে মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছিল।
জীবনপ্রভাতের এই দিগ্দর্শন থেকে মাহবুব ভাই আর বিচ্যুত হননি। ১৯৬৩ সাল থেকে চট্টগ্রাম বেতারের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর সরাসরি সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে না জড়ালেও তাঁর আদর্শ ও ভাবনার জগতে কোনো পরিবর্তন আসেনি।
১৯৭১ সালে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে মাহবুব ভাই ঠিকই বিক্ষুব্ধ শিল্পী-সাহিত্যিকদের সঙ্গে থাকলেন, লালদীঘির মাঠ ও প্যারেড মাঠে প্রতিবাদী নাটকে ঠিকই অংশ নিলেন। আর বাংলাদেশে যখন মঞ্চনাটক ঘিরে গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের ঢেউ চট্টগ্রামেও লাগে, তখন তিনি তাতেও এসে যুক্ত হন। মমতাজউদ্দীন আহমদ, জিয়া হায়দার এবং আরও দু-একজন বয়োজ্যেষ্ঠ ছাড়া মাহবুব হাসানই বয়স্ক অভিনয়শিল্পী, যিনি নবকালের নবতরঙ্গে শরিক হন। সে যোগ বয়সের সঙ্গে সঙ্গে ততটা প্রত্যক্ষ না থাকলেও, ক্রমেই দৃঢ় হয়েছে আত্মিক-আদর্শিক বন্ধনে।
সেই পঞ্চাশের দশক থেকেই এ দেশ অনেক রকম রাজনৈতিক ভাঙাগড়া, উত্থানপতন ও টানাপোড়েনের ভেতর দিয়ে গেছে। এটাও আমরা জানি, এ দেশে কোনো রাজনৈতিক আন্দোলনই সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল না, বরং সাংস্কৃতিক অঙ্গন থেকেই বরাবর আন্দোলনের সূচনা হয়েছে। এ দেশে সংস্কৃতিকর্মীরা হলো ভ্যানগার্ড, অগ্রসেনা। মাহবুব হাসান বরাবর একজন অগ্রসেনা, কালে কালে হয়ে ওঠেন উত্তরকালের অগ্রসেনাদের অভিভাবক।
মাহবুব হাসান দুই শতাধিক মঞ্চনাটকে অভিনয় করেছেন, শত শত বেতার নাটকে অংশ নিয়েছেন, বেতারে প্রযোজনা ও পরিচালনা করেছেন অনেক নাটক। লিখেছেন অন্তত অর্ধশত বেতার নাটক। তাঁর কণ্ঠস্বর ছিল ভরাট ও ভারী, আবৃত্তি করতেন চমৎকার।
এ কথা না বললে নয় যে আজকের কালে এসেও মাহবুব হাসান নিজের খ্যাতি-প্রতিষ্ঠা নিয়ে ভাবেননি, পাওয়া না-পাওয়া নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করতে কখনো শুনিনি। অর্থবিত্তের ধান্ধা কখনো করেননি। একটু বঞ্চিত, একটু উপেক্ষিতই ছিলেন বলা যায়। মৃত্যুর পরে হলেও এই গুণী শিল্পীর সম্মানসহ সব প্রাপ্য দিতে আমরা—সরকার, সংস্কৃতিজগৎ এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন—যেন বিলম্ব বা কার্পণ্য না করি।
মাহবুব হাসানের মৃত্যুতে সমৃদ্ধ এক ঐতিহ্যের আলো যেন নিভে গেল, উন্নত আদর্শের এক বৃক্ষ যেন হারিয়ে গেল, এই বিভ্রান্ত পথহারা সমাজের সংস্কৃতির এক অবিচল নিষ্ঠাবান অভিভাবক চলে গেলেন।
পরিণত বয়সে মৃত্যুর এই শোক হয়তো সামলে ওঠা যাবে, কিন্তু যে শূন্যতা তৈরি হলো, তা কীভাবে পূরণ হবে, সেটাই ভাবনার বিষয়।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
১৯৫১ সালে চট্টগ্রামে আয়োজিত হয় সাংস্কৃতিক সম্মেলন। এতে প্রবীণ গবেষক আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মূল সভাপতির ভাষণে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভ্রান্ত ধর্মান্ধ চেতনা থেকে বেরিয়ে অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতিচেতনা ধারণ করে বাঙালিকে জাগার ও এগোবার আহ্বান জানান। এ থেকেই শুরু হলো দ্বিজাতিতত্ত্বভিত্তিক প্রতিক্রিয়াশীল পাকিস্তানি রাজনীতি থেকে বেরিয়ে এসে বাঙালির চিরায়ত অসাম্প্রদায়িক মানবিক চেতনায় ঘুরে দাঁড়ানোর প্রক্রিয়া। চট্টগ্রামের পর ১৯৫৩ সালে কুমিল্লায়, পরের বছর ঢাকায়, ১৯৫৭ সালে মওলানা ভাসানীর উদ্যোগে কাগমারীতে বড় আকারের সাংস্কৃতিক সম্মেলন এবং ১৯৬১ সালে সামরিক শাসনের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ঢাকা-চট্টগ্রামে সাড়ম্বরে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপনের মধ্য দিয়ে বাঙালির আত্ম-আবিষ্কারের ধারাটি জোরদার হয়। মাহবুব হাসান বরাবর এই ধারার বর্তিকা ও পতাকাবাহী সৈনিকের ভূমিকা পালন করে গেছেন।
মাহবুব হাসান চট্টগ্রামের মানুষ নন, তাঁরা যশোরের মানুষ। তাঁর পিতামহ বিখ্যাত মুসলিম চিন্তাবিদ মুন্সী মেহেরুল্লাহর খ্যাতি কালের উজান বেয়ে এখনো টিকে আছে। বাবা মোহাম্মদ মোহসিন ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। আর বাবার বদলির চাকরির সূত্রে মাহবুব হাসান জন্মের পর অর্থাৎ ১৯৩০ থেকে ১৯৪৯ পর্যন্ত উত্তর ও পূর্ববঙ্গের নানা জেলা শহরে কাটিয়েছেন। সিরাজগঞ্জে তাঁর স্কুলজীবন শুরু, আর ’৪৭ সালে ফেনী থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষা পাস করেন। ১৯৪৯ সালে চট্টগ্রামে এলেন, বাবাও অবসর নিয়ে এখানে স্থায়ী বাসিন্দা হলেন। আর মাহবুব হাসান সেই থেকে চট্টগ্রামবাসী। দীর্ঘ ৬২ বছরের বসবাসে তিনি এই শহরের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের তরুণ কর্মী থেকে বর্ষীয়ান অভিভাবকে পরিণত হয়েছিলেন।
মাহবুব ভাই মূলত ছিলেন নাট্যশিল্পী, মঞ্চনাটকের সফল অভিনেতা। সে আমলে শিক্ষিত পরিবারে অভিনয়কে সুনজরে দেখা হতো না। ফলে জীবনের মূল যে কর্মক্ষেত্র তিনি বেছে নিয়েছিলেন, তা বজায় রাখা ছিল তাঁর জীবনসংগ্রামের প্রথম ধাপ। আর প্রথম জীবনেই যুক্ত হয়েছিলেন মাহবুব উল আলম চৌধুরী, কলিম শরাফীদের মতো বাম চিন্তার প্রগতিশীল সংগঠকদের সঙ্গে। তাঁরা ছিলেন প্রান্তিক নবনাট্য সংঘের সদস্য। এটি বিখ্যাত ভারতীয় গণনাট্য সংঘের আদলে ও আদর্শে গড়ে উঠেছিল। চট্টগ্রাম থেকে গান ও নাটকের বিরাট দল নিয়ে তাঁরা জয় করেছিলেন কুমিল্লা, ঢাকা ও কাগমারী সম্মেলন। চট্টগ্রামের সংগীতশিল্পী ও নাট্যকর্মীদের নাম সে সময় দেশের প্রগতিশীল মহলে মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছিল।
জীবনপ্রভাতের এই দিগ্দর্শন থেকে মাহবুব ভাই আর বিচ্যুত হননি। ১৯৬৩ সাল থেকে চট্টগ্রাম বেতারের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর সরাসরি সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে না জড়ালেও তাঁর আদর্শ ও ভাবনার জগতে কোনো পরিবর্তন আসেনি।
১৯৭১ সালে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে মাহবুব ভাই ঠিকই বিক্ষুব্ধ শিল্পী-সাহিত্যিকদের সঙ্গে থাকলেন, লালদীঘির মাঠ ও প্যারেড মাঠে প্রতিবাদী নাটকে ঠিকই অংশ নিলেন। আর বাংলাদেশে যখন মঞ্চনাটক ঘিরে গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের ঢেউ চট্টগ্রামেও লাগে, তখন তিনি তাতেও এসে যুক্ত হন। মমতাজউদ্দীন আহমদ, জিয়া হায়দার এবং আরও দু-একজন বয়োজ্যেষ্ঠ ছাড়া মাহবুব হাসানই বয়স্ক অভিনয়শিল্পী, যিনি নবকালের নবতরঙ্গে শরিক হন। সে যোগ বয়সের সঙ্গে সঙ্গে ততটা প্রত্যক্ষ না থাকলেও, ক্রমেই দৃঢ় হয়েছে আত্মিক-আদর্শিক বন্ধনে।
সেই পঞ্চাশের দশক থেকেই এ দেশ অনেক রকম রাজনৈতিক ভাঙাগড়া, উত্থানপতন ও টানাপোড়েনের ভেতর দিয়ে গেছে। এটাও আমরা জানি, এ দেশে কোনো রাজনৈতিক আন্দোলনই সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল না, বরং সাংস্কৃতিক অঙ্গন থেকেই বরাবর আন্দোলনের সূচনা হয়েছে। এ দেশে সংস্কৃতিকর্মীরা হলো ভ্যানগার্ড, অগ্রসেনা। মাহবুব হাসান বরাবর একজন অগ্রসেনা, কালে কালে হয়ে ওঠেন উত্তরকালের অগ্রসেনাদের অভিভাবক।
মাহবুব হাসান দুই শতাধিক মঞ্চনাটকে অভিনয় করেছেন, শত শত বেতার নাটকে অংশ নিয়েছেন, বেতারে প্রযোজনা ও পরিচালনা করেছেন অনেক নাটক। লিখেছেন অন্তত অর্ধশত বেতার নাটক। তাঁর কণ্ঠস্বর ছিল ভরাট ও ভারী, আবৃত্তি করতেন চমৎকার।
এ কথা না বললে নয় যে আজকের কালে এসেও মাহবুব হাসান নিজের খ্যাতি-প্রতিষ্ঠা নিয়ে ভাবেননি, পাওয়া না-পাওয়া নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করতে কখনো শুনিনি। অর্থবিত্তের ধান্ধা কখনো করেননি। একটু বঞ্চিত, একটু উপেক্ষিতই ছিলেন বলা যায়। মৃত্যুর পরে হলেও এই গুণী শিল্পীর সম্মানসহ সব প্রাপ্য দিতে আমরা—সরকার, সংস্কৃতিজগৎ এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন—যেন বিলম্ব বা কার্পণ্য না করি।
মাহবুব হাসানের মৃত্যুতে সমৃদ্ধ এক ঐতিহ্যের আলো যেন নিভে গেল, উন্নত আদর্শের এক বৃক্ষ যেন হারিয়ে গেল, এই বিভ্রান্ত পথহারা সমাজের সংস্কৃতির এক অবিচল নিষ্ঠাবান অভিভাবক চলে গেলেন।
পরিণত বয়সে মৃত্যুর এই শোক হয়তো সামলে ওঠা যাবে, কিন্তু যে শূন্যতা তৈরি হলো, তা কীভাবে পূরণ হবে, সেটাই ভাবনার বিষয়।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
No comments