দেশহীন মানুষের কথা-শতবর্ষী রেইনট্রি ও মানুষের লোভ by সঞ্জীব দ্রং
এখন মন খুব খারাপ। বিরিশিরির এই পথে কতবার হেঁটেছি আমি, হিসাব করতে পারব না। পথের ধারে সারি সারি বিশাল রেইনট্রি। বহু দূর থেকে এই বৃক্ষরাজি দেখা যায়। যাঁরা বিরিশিরি বেড়াতে গেছেন, তাঁদের নিশ্চয়ই মনে আছে এই রেইনট্রিগুলোর কথা।
খুব কষ্ট হচ্ছে এই ভেবে যে বিরিশিরির ১০০ বছরের বেশি পুরোনো রেইনট্রিগুলো রাষ্ট্রযন্ত্র ও মানুষের লোভের কাছে এখন মৃত্যুপথযাত্রী। ইতিমধ্যে দুটি গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। যাঁরা এই গাছ কাটার সঙ্গে যুক্ত, তাঁরা এত ক্ষমতাধর যে আশপাশের মানুষ শুধু অসহায় চেয়ে আছে। খ্রিষ্টান মিশনের আদিবাসীরা এখানে-ওখানে অসহায়ের মতো ফোন করছেন, আকুতি জানাচ্ছেন।
সরকার ও প্রশাসনের সামনেই ঘটছে এই সর্বনাশা বৃক্ষ হত্যাযজ্ঞ। প্রশাসনের প্রত্যক্ষ সহায়তা ছাড়া এত অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে এসব হতে পারে না। অথচ ১০০ বছর ধরে যে বিরিশিরি মিশন চার্চ কর্তৃপক্ষ এসব গাছ লালন-পালন করেছে, তারা কিছুই জানে না।
প্রথম আলো প্রতিবেদন করেছে, ‘নেত্রকোনা জেলার সুসং-দুর্গাপুরের শান্তছায়াসুনিবিড় দুর্গাপুর-ঝাঞ্জাইল সড়ক দিনকয়েক ধরে কুঠারের শব্দে প্রকম্পিত। এই কুঠার না থামলে রাস্তাটি তার শত বছরের ছায়াসুনিবিড় চরিত্র হারাবে। কারণ, সড়কের ৬২টি গাছ কাটা হচ্ছে। এর মধ্যে ২৬টি শতবর্ষী। শহরের ঐতিহ্য আর স্মৃতিবাহী এসব গাছের আকস্মিক এই পরিণতি মানতে পারছে না এলাকার মানুষ।...৬২টি গাছের মধ্যে ২৬ নম্বর গাছের ডালপালা ও শিকড় কাটা হচ্ছিল গতকাল। তাৎক্ষণিক মেপে দেখা গেল, গাছটির গোড়ার ব্যাস ১৯ ফুটের বেশি। কাণ্ডের প্রথম ভাগ লম্বায় প্রায় ১৫ ফুট। ডালগুলোই বড়সড় গাছের গোড়ার মতো মোটা। প্রায় সব কটি গাছই এমন বিশালাকারের।’
প্রশাসনের হস্তক্ষেপে আপাতত গাছ কাটা বন্ধ থাকলেও ভবিষ্যতে কী হবে, কেউ বলতে পারে না। কেননা, গাছ কর্তনকারীরা অনেক বেশি ক্ষমতাবান। আমরা বিষয়টির প্রতি প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করি।
গারো ব্যাপ্টিস্ট কনভেনশনের (জিবিসি) সাধারণ সম্পাদক রেভারেন্ড লিটন ম্রং আমাকে ফোন করেছিলেন। আজ থেকে ১২০ বছর আগে ১৮৯০ সালে এখানে অস্ট্রেলিয়ান ব্যাপ্টিস্ট মিশনারিরা আসেন। তখন এখানে রাস্তাঘাট ছিল না। বিদেশি মিশনারি ও গারোরা এই গাছগুলো লাগান। জমিও মিশনেরই। পরবর্তী সময় রাস্তার জন্য তাঁরা জায়গা ছেড়ে দেন। রেভারেন্ড লিটন ম্রং প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা লোকমুখে জানতে পারি, জেলা পরিষদ এসব গাছ বিক্রি করেছে। ৫ অক্টোবর আমরা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের উকিল নোটিশ করি। ৭ অক্টোবর হাইকোর্টে রিট করি। ১১ অক্টোবর আদালত গাছ ও জমির বিষয়ে স্থিতাবস্থা জারি করেন। আদালতের আদেশের কপি ফ্যাক্সযোগে ইউএনওর দপ্তর এবং থানায় পাঠিয়েছি। কিন্তু গাছ কাটা বন্ধ হচ্ছে না।’
বিরিশিরির টানে কত মানুষ সেখানে বেড়াতে যান। প্রকৃতিপ্রেমী সৌন্দর্যপিয়াসী মানুষ। যাঁরা বিরিশিরি দেখেননি, তাঁদের জানাই, বিরিশিরির পাশে গারো পাহাড় থেকে নেমে আসা সোমেশ্বরী নদী, উত্তরে মেঘালয়ের পাহাড়, বিরিশিরিকে মাঝখানে রেখে নদী বয়ে গেছে দুই দিকে। এই পাহাড়ি নদীর স্বচ্ছ জলধারা আমাদের সম্পদ। এই রেইনট্রিগুলো উজাড় হলে বিরিশিরি তার সৌন্দর্য হারাবে, এ কথা সবাই স্বীকার করবেন। গ্রামীণফোনের বিজ্ঞাপনচিত্রে এই বিরিশিরির অপরূপ দৃশ্য দেখা যায়।
সরকার পরিবেশ রক্ষা, বন সংরক্ষণ, সবুজের কথা মুখে বলছে। জলবায়ু পরিবর্তনে ভয়ের কথা বলছে, বিদেশি অর্থের দিকে চেয়ে আছে। আর অন্যত্র চলছে শতবর্ষের বৃক্ষরাজি ধ্বংসের লীলাখেলা। প্রশাসন শুধু নীরবই নয়, সহযোগী শক্তি। এ অবস্থায় জেমস ক্যামেরনের অ্যাভাটার চলচ্চিত্রের দৃশ্য চোখে ভাসে। চলচ্চিত্রে আদিবাসীরা একটি প্রকাণ্ড বৃক্ষকে পূজা করত, মানত। বাইরের স্কাই পিপল এসে সেখানে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। ব্যাপক ধ্বংসাত্মক যুদ্ধের শেষে আদিবাসী মানুষের জয় হয়। প্রকৃতি ও প্রাণীরা তাদের শক্তি নিয়ে আদিবাসী মানুষের পাশে দাঁড়ায়। স্কাই পিপল ও যান্ত্রিক শক্তির পরাজয় ঘটে। অশুভ শক্তির প্রতীক এলিয়েনরা ফিরে যায়। কিছু ভালো এলিয়েন থেকে যায় আদিবাসী মানুষের সঙ্গে।
আসুন, আমরা সবাই মিলে অর্থলিপ্সু কতিপয় মানুষের থাবা থেকে বৃক্ষ, পরিবেশ ও ধরিত্রী রক্ষা করি। এখানে আনন্দ মোহন কলেজ, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও নেত্রকোনা-ময়মনসিংহের পরিবেশবাদী মানুষ ও তরুণসমাজ নিশ্চয় এগিয়ে আসবেন।
সঞ্জীব দ্রং: কলাম লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী।
sanjeebdrong@gmail.com
No comments