প্রতিকারহীন সড়ক-সন্ত্রাস by এস এম আব্রাহাম লিংকন
দেশে ১১ হাজার ৮০০ কিলোমিটার মহাসড়কে প্রতিদিন যে পরিমাণ মৃত্যু সংঘটিত হচ্ছে, তা ভয়াবহ। চট্টগ্রামে অর্ধশতাধিক কিশোরের মৃত্যু-মিছিল কি শুধুই দুর্ঘটনা? এগুলো কি হত্যা নয়? দুর্ঘটনার ওপর কারো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। কোনো চালক যদি পাহাড়ি পথ অতিক্রম করতে গিয়ে হঠাৎ পাহাড়ধসের শিকার হন, তাকে দুর্ঘটনা বলব; কিন্তু যিনি গাড়ি চালাতে জানেন না কিংবা নিতান্তই আনকোরা, তাঁকে দিয়ে যখন একটি গাড়ি চালানো হয়,
তিনি যখন প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার অভাবে দুর্ঘটনার সৃষ্টি করেন, তখন তাকে কী বলব? নিশ্চয়ই দুর্ঘটনা বলা যাবে না। একটি দুর্ঘটনায় চালক, মালিক বা কোনো কর্তৃপক্ষের ভূমিকা থাকে না। বিষয়টি অনেকটা আকস্মিক ও প্রাকৃতিক। কিন্তু যখন এর সঙ্গে অবহেলা যুক্ত হয় তখন তাকে দুর্ঘটনা বলা যাবে না। একটি দুর্ঘটনা তখনই আর দুর্ঘটনা থাকে না, যখন এর সঙ্গে যুক্ত হয় চালকের অবহেলা, অসর্তকতা, যান্ত্রিক ত্রুটি, অদক্ষতা, মুনাফালোভী মনোভাব, সর্বোপরি নিজের দায়িত্বের প্রতি অসৎ মনোবৃত্তি।
নিয়ম বা দায়িত্ব পালন করা হয় না বলেই প্রতিদিন সড়কে এ প্রাণ হরণ। আমরা ড্রাইভিং লাইসেন্স দিচ্ছি প্রয়োজনীয় শিক্ষা প্রদান ব্যতিরেকেই, লোভের বশবর্তী হয়ে সামান্য অর্থের বিনিময়ে। একবারও বিবেচনা করছি না, যাকে লাইসেন্স দিলাম সে কতটুকু যোগ্য? আজ লাইসেন্স পাওয়ার যোগ্যতা অর্থ_শিক্ষা বা অভিজ্ঞতা নয়।
সর্বশেষ পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, দেশে নিবন্ধিত গাড়ির সংখ্যা ১৫ লাখ, কিন্তু বিআরটিএ ড্রাইভিং লাইসেন্স ইস্যু করেছে সাড়ে ৯ লাখেরও বেশি। এই হিসাব অনুযায়ী রাস্তায় গাড়ি চলার কথা সাড়ে ৯ লাখ; কিন্তু ১৫ লাখ গাড়ি চলছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী বৈধ চালকের সংকট সাড়ে পাঁচ লাখ। বৈধ চালকের অভাবে গাড়িগুলো কি বন্ধ আছে? রাস্তাঘাটের চিত্র দেখলেই বোঝা যায়, সেগুলো গ্যারেজে বন্দি নেই। তাহলে সেগুলো চলছে কেমন করে? অবশ্যই হাতুড়ে ড্রাইভার দিয়ে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রতিদিন রাস্তায় গাড়ি চালায় সাড়ে পাঁচ লাখ ভুয়া ও অদক্ষ ড্রাইভার। বিষয়টি কি বিপজ্জনক নয়? একজন যাত্রীর তো ড্রাইভারের লাইসেন্স পরীক্ষা করে গাড়িতে ওঠার সংস্কৃতি আমাদের দেশে নেই। সেটি অধিকারের পর্যায়ে থাকলেও সামাজিক-সংস্কৃতির কারণে মনে করি, সেটি সভ্যতার পরিচায়ক নয়। এসব হাতুড়ে ড্রাইভারের কাঁধে ভর করে আমরা পাড়ি দিই মাইলের পর মাইল। গাড়িতে চড়ে আমরা যে বাড়ি ফিরতে পারি_এটি অনেক বড় পাওয়া। সে অর্থে আমরা অবশ্যই ভাগ্যবান। যারা ফিরতে পারি না তারা তো দুর্ভাগ্যের শিকার। তাদের দুর্ভাগ্যের দায় কে নেবে? প্রতিদিন যাঁরা পথ-দুর্ঘটনায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন, তাঁরা আমার বিবেচনায় খুন হচ্ছেন। এ খুনের দায় একা ড্রাইভারের নয়, এই অপরাধটি একটি টিমওয়ার্কের ফসল। এর দায় কোনোভাবেই এড়াতে পারে না যাঁরা ভুয়া ড্রাইভারদের হাতে গাড়ির স্টিয়ারিং ধরার সুযোগ দিচ্ছেন। যে মালিক লোভের কারণে কম মজুরিতে একজন ভুয়া বা শিক্ষানবিস ড্রাইভারকে নিয়োগ দেন তার দায় এড়ানো যাবে না। গাড়ি যে শুধু অদক্ষ চালকের অসর্তকতার ফলে দুর্ঘটনার শিকার হয় তা নয়, কিছু কিছু ক্ষেত্রে গাড়ির ফিটনেস না থাকার কারণে চালকের প্রচুর অভিজ্ঞতা ও যোগ্যতা থাকার পরও পথহত্যার শিকার হয় অনেক যাত্রী।
আমাদের দেশে গাড়ি দুর্ঘটনার হার বিশ্বের সর্বোচ্চ। যেখানে প্রতি ১০ হাজার গাড়িতে মৃত্যুহার সিঙ্গাপুরে ৮ দশমিক ৩, নিউজিল্যান্ডে ৪ ও অস্ট্রেলিয়ায় ৩ দশমিক ৪ সেখানে, ইউনিসেফের তথ্যমতে, বাংলাদেশে এ হার ১৬৯ জন।
আমাদের দেশে পথ-দুর্ঘটনায় ২০১০ সালের জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি, ২০১১ পর্যন্ত পথখুনের শিকার হয়েছে চার হাজার ৩৬৫ জন। আহত হয়েছে ছয় হাজার ২৪৫ জন, যাদের অনেকেই জীবনের মতো পঙ্গু হয়েছে। পঙ্গুত্ববরণই শুধু নয়, আর্থিকভাবেও পর্যুদস্ত হয়েছে পথ-দুর্ঘটনার শিকার প্রায় ১২ হাজার পরিবার। এ সংখ্যাটি মোট পথ-দুর্ঘটনার অর্ধেকেরও কম। কারণ সব দুর্ঘটনা থানায় রেকর্ড হয় না। থানায় আসার আগেই মিটমাট হয়ে যায়। দু-চারজন প্রভাবশালী মারা গেলে খবর হয় নতুবা সবই ম্যানেজ! উত্তরবঙ্গে মোটর মালিকদের মারা যাওয়ার কেস ২০ হাজার টাকায় মিটে যায়। গরিব হলে আরো কম। আমাদের দেশে দুর্ঘটনার ১৭টি কারণ দাঁড় করিয়েছে বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট। তার মধ্যে প্রথম কারণটিই হচ্ছে, অদক্ষ ও প্রশিক্ষণবিহীন চালক। গাড়ির এই বেপরোয়া গতি নিয়ন্ত্রণে যুগোপযোগী কোনো আইন প্রণীত হয়নি। যেসব আইন আছে তা ১৮৬০ সালে লর্ড মেকলে প্রণীত। মেকলের পেনাল কোডের অধিকাংশ অপরাধ ও তার প্রতিকার ভারতীয় সংস্কৃতির বিবেচনায় প্রণীত হলেও বাবুদের গাড়ি চালানোর ফলে পথ-দুর্ঘটনার শিকার হয়ে কারো মৃত্যু হলে বা বেপরোয়া ড্রাইভের ফলে কোনো ক্ষতি হলে, জখম হলে, তার জন্য লঘুদণ্ডের বিধান করেছিল। কারণ যাঁদের গাড়ি ছিল এবং যাঁরা গাড়ি পরিচালনা করতেন তাঁরা সবাই না হলেও ৯০ শতাংশই ছিলেন ইংরেজ বেনিয়া বা তাদের অনুগত। ফলে শ্রেণীগত স্বার্থে ইংরেজরা দণ্ডবিধিতে পথ-দুর্ঘটনার শাস্তিকে নামমাত্র করেছিল। যেমন পেনাল কোডের ৩০৪-খ ধারায় বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি বেপরোয়াভাবে বা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে জনপথে যান বা অশ্ব চালিয়ে কোনো ব্যক্তির মৃত্যু ঘটান, সেই ব্যক্তি যেকোনো বর্ণনার কারাদণ্ডে, যার মেয়াদ তিন বছর পর্যন্ত হতে পারে বা অর্থদণ্ডে বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। ২৭৯ ধারায় বলা আছে, কোনো ব্যক্তি জনপথে এমন বেপরোয়াভাবে বা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে কোনো যান চালায় বা অশ্বারোহণ করে, যাতে মানুষের জীবন বিপন্ন হতে পারে, অন্য কোনো ব্যক্তিকে আহত বা জখম করার আশঙ্কা থাকে, তিনি তিন বছর কারাদণ্ড বা এক থেকে তিন হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং ৩৩৮-ক ধারায় বলা আছে, যে ব্যক্তি বেপরোয়াভাবে বা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে গণপথে গাড়ি বা অশ্ব চালিয়ে কোনো ব্যক্তিকে গুরুতর আঘাত করেন, যাতে মনুষ্য জীবন ও ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বিঘ্ন হয়, সেই ব্যক্তি যেকোনো বর্ণনার কারাদণ্ডে, যার মেয়াদ দুই বছর পর্যন্ত হতে পারে বা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। হত্যার মতো ঘটনা থাকার পরও এই বিধি তিনটিতে কোথাও অধিক কারাবাস নেই, এমনকি যে কারাবাসের কথা বলা আছে, তাও বিনাশ্রম। উলি্লখিত তিনটি অপরাধই জামিনযোগ্য করে অপরাধীদের মুক্তির পাকাপোক্ত ব্যবস্থা করা হয়েছে, কারণ সে যুগে বিচারক এবং অপরাধী উভয় ছিলেন প্রায় একই গোত্রভুক্ত প্রভু শ্রেণীর। নিজেদের রক্ষার জন্য সেদিনের প্রণীত আইন আজকের যুগে অচল। এ ধরনের নামমাত্র আইন সমাজে বিদ্যমান। আইনের প্রতি অবজ্ঞা শুরু থেকেই, কারণ আইনটি সাজার দিক থেকে হালকা এবং প্রকৃতির দিক থেকে জামিনযোগ্য। তা ছাড়া ওই বিধি তিনটিতে কোনো সহযোগী অপরাধীর সাজার ব্যবস্থা নেই। এসব কারণে পথ-দুর্ঘটনা নিবৃত্তিতে বিদ্যমান আইন অচল ও হাস্যকর।
যিনি ফিটনেসবিহীন লক্কড়ঝক্কড় গাড়ি জোর করে রাস্তায় নামান, সে মালিক কেন আইনের আওতায় আসবেন না? আমাদের যানের মালিককে আইনের আওতায় আনা জরুরি। প্রচলিত আইনে সেকেলে দণ্ড বৃদ্ধি করে পথ-দুর্ঘটনায় হত্যার অপরাধকে জামিন ও আপস অযোগ্য করা। যে জনপথে ভুয়া ড্রাইভার, অদক্ষ চালক কিংবা ফিটনেসবিহীন গাড়ি দুর্ঘটনার শিকার হয়ে প্রাণহানি ঘটাবে, সে রাস্তার দায়িত্বে থাকা হাইওয়ে বা বেঙ্গল পুলিশ যারা দায়িত্বে থাকবে তাদের এবং ক্ষেত্রবিশেষে যারা ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় চলতে দিয়েছে তাদেরও সহযোগী অপরাধী হিসেবে আইনের আওতায় নিয়ে আসা। সংশ্লিষ্ট যারা দায়িত্ব পালন করতে গাফিলাতি করেছে তাদের গাফিলাতির ফলে যদি কোনো যাত্রী বা পথচারীর ক্ষতি হয়, মৃত্যু হয়, তবে মালিকসহ তাদের আয় বা সম্পদ থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের বিধান করা।
একই সঙ্গে প্রয়োজন পথ সার্ভিসের সঙ্গে যুক্ত বিশাল জনশক্তির মূল্যবোধগত পরিবর্তন, ড্রাইভিং পেশায় শিক্ষিতদের প্রবেশে উৎসাহকরণ, জিও-এনজিওগুলোর পথ সার্ভিসের সঙ্গে যুক্তদের বিশেষত ড্রাইভার, কন্ডাক্টর, মালিকদের পেশাগত ও নৈতিকতা শিক্ষা দেওয়া; তাদের দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তর করা দরকার। এখানে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা জরুরি।
আমাদের পথ-দুর্ঘটনার বেশির ভাগ কারণ গাড়িচালকদের অসচেতনতা। যেহেতু বাস ও ট্রাকের ৯৯ শতাংশ চালকই প্রশিক্ষণবিহীন, সেহেতু তাদের প্রশিক্ষণ জরুরি। যে পাঁচ লাখ ভুয়া চালক আছে, কিন্তু রাস্তায় চলমান, তাদের ট্রেনিং দিয়ে দক্ষ করে যোগ্য করে নেওয়া। যেসব ড্রাইভার ২০ বা ৩০ বছর পেশাগত জীবনে দুর্ঘটনামুক্ত থাকবে, তাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে পুরস্কৃত করা। আমাদের এ মুহূর্তে মূল্যবোধ গড়ে তোলা জরুরি যেন একজন গাড়িচালক অবশ্যই মনে করে যাত্রীসেবার মধ্যে মালিকের মুনাফা বিদ্যমান। অবশ্যই মালিকের স্বার্থ দেখবে, তবে তা নিজের ও যাত্রীর জীবনকে বাদ দিয়ে নয়। ভারতের দ্বিতীয় ভগবানখ্যাত বিশিষ্ট শল্যচিকিৎসক দেবী শেঠির একটি উদ্ধৃতি এ ধরনের, 'আমি যখন কোনো শিশুকে অপারেশন থিয়েটারে অপারেশনের জন্য নিই, তখন মনে করি, মা তাঁর পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ আমার হাতে তুলে দিলেন, সে সম্পদ মায়ের কাছে সুস্থভাবে ফিরিয়ে দেওয়া আমার প্রধানতম কর্তব্য।' আমাদের গাড়িচালকরা যদি এই মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি জীবনে গ্রহণ করতে পারে, তবে আমরা, যাত্রীরা, পরিত্রাণ পাব সড়কপথে নিত্য খুনের হাত থেকে।
লেখক : সাবেক ছাত্রনেতা, আইনজীবী ও কলামিস্ট
নিয়ম বা দায়িত্ব পালন করা হয় না বলেই প্রতিদিন সড়কে এ প্রাণ হরণ। আমরা ড্রাইভিং লাইসেন্স দিচ্ছি প্রয়োজনীয় শিক্ষা প্রদান ব্যতিরেকেই, লোভের বশবর্তী হয়ে সামান্য অর্থের বিনিময়ে। একবারও বিবেচনা করছি না, যাকে লাইসেন্স দিলাম সে কতটুকু যোগ্য? আজ লাইসেন্স পাওয়ার যোগ্যতা অর্থ_শিক্ষা বা অভিজ্ঞতা নয়।
সর্বশেষ পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, দেশে নিবন্ধিত গাড়ির সংখ্যা ১৫ লাখ, কিন্তু বিআরটিএ ড্রাইভিং লাইসেন্স ইস্যু করেছে সাড়ে ৯ লাখেরও বেশি। এই হিসাব অনুযায়ী রাস্তায় গাড়ি চলার কথা সাড়ে ৯ লাখ; কিন্তু ১৫ লাখ গাড়ি চলছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী বৈধ চালকের সংকট সাড়ে পাঁচ লাখ। বৈধ চালকের অভাবে গাড়িগুলো কি বন্ধ আছে? রাস্তাঘাটের চিত্র দেখলেই বোঝা যায়, সেগুলো গ্যারেজে বন্দি নেই। তাহলে সেগুলো চলছে কেমন করে? অবশ্যই হাতুড়ে ড্রাইভার দিয়ে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রতিদিন রাস্তায় গাড়ি চালায় সাড়ে পাঁচ লাখ ভুয়া ও অদক্ষ ড্রাইভার। বিষয়টি কি বিপজ্জনক নয়? একজন যাত্রীর তো ড্রাইভারের লাইসেন্স পরীক্ষা করে গাড়িতে ওঠার সংস্কৃতি আমাদের দেশে নেই। সেটি অধিকারের পর্যায়ে থাকলেও সামাজিক-সংস্কৃতির কারণে মনে করি, সেটি সভ্যতার পরিচায়ক নয়। এসব হাতুড়ে ড্রাইভারের কাঁধে ভর করে আমরা পাড়ি দিই মাইলের পর মাইল। গাড়িতে চড়ে আমরা যে বাড়ি ফিরতে পারি_এটি অনেক বড় পাওয়া। সে অর্থে আমরা অবশ্যই ভাগ্যবান। যারা ফিরতে পারি না তারা তো দুর্ভাগ্যের শিকার। তাদের দুর্ভাগ্যের দায় কে নেবে? প্রতিদিন যাঁরা পথ-দুর্ঘটনায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন, তাঁরা আমার বিবেচনায় খুন হচ্ছেন। এ খুনের দায় একা ড্রাইভারের নয়, এই অপরাধটি একটি টিমওয়ার্কের ফসল। এর দায় কোনোভাবেই এড়াতে পারে না যাঁরা ভুয়া ড্রাইভারদের হাতে গাড়ির স্টিয়ারিং ধরার সুযোগ দিচ্ছেন। যে মালিক লোভের কারণে কম মজুরিতে একজন ভুয়া বা শিক্ষানবিস ড্রাইভারকে নিয়োগ দেন তার দায় এড়ানো যাবে না। গাড়ি যে শুধু অদক্ষ চালকের অসর্তকতার ফলে দুর্ঘটনার শিকার হয় তা নয়, কিছু কিছু ক্ষেত্রে গাড়ির ফিটনেস না থাকার কারণে চালকের প্রচুর অভিজ্ঞতা ও যোগ্যতা থাকার পরও পথহত্যার শিকার হয় অনেক যাত্রী।
আমাদের দেশে গাড়ি দুর্ঘটনার হার বিশ্বের সর্বোচ্চ। যেখানে প্রতি ১০ হাজার গাড়িতে মৃত্যুহার সিঙ্গাপুরে ৮ দশমিক ৩, নিউজিল্যান্ডে ৪ ও অস্ট্রেলিয়ায় ৩ দশমিক ৪ সেখানে, ইউনিসেফের তথ্যমতে, বাংলাদেশে এ হার ১৬৯ জন।
আমাদের দেশে পথ-দুর্ঘটনায় ২০১০ সালের জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি, ২০১১ পর্যন্ত পথখুনের শিকার হয়েছে চার হাজার ৩৬৫ জন। আহত হয়েছে ছয় হাজার ২৪৫ জন, যাদের অনেকেই জীবনের মতো পঙ্গু হয়েছে। পঙ্গুত্ববরণই শুধু নয়, আর্থিকভাবেও পর্যুদস্ত হয়েছে পথ-দুর্ঘটনার শিকার প্রায় ১২ হাজার পরিবার। এ সংখ্যাটি মোট পথ-দুর্ঘটনার অর্ধেকেরও কম। কারণ সব দুর্ঘটনা থানায় রেকর্ড হয় না। থানায় আসার আগেই মিটমাট হয়ে যায়। দু-চারজন প্রভাবশালী মারা গেলে খবর হয় নতুবা সবই ম্যানেজ! উত্তরবঙ্গে মোটর মালিকদের মারা যাওয়ার কেস ২০ হাজার টাকায় মিটে যায়। গরিব হলে আরো কম। আমাদের দেশে দুর্ঘটনার ১৭টি কারণ দাঁড় করিয়েছে বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট। তার মধ্যে প্রথম কারণটিই হচ্ছে, অদক্ষ ও প্রশিক্ষণবিহীন চালক। গাড়ির এই বেপরোয়া গতি নিয়ন্ত্রণে যুগোপযোগী কোনো আইন প্রণীত হয়নি। যেসব আইন আছে তা ১৮৬০ সালে লর্ড মেকলে প্রণীত। মেকলের পেনাল কোডের অধিকাংশ অপরাধ ও তার প্রতিকার ভারতীয় সংস্কৃতির বিবেচনায় প্রণীত হলেও বাবুদের গাড়ি চালানোর ফলে পথ-দুর্ঘটনার শিকার হয়ে কারো মৃত্যু হলে বা বেপরোয়া ড্রাইভের ফলে কোনো ক্ষতি হলে, জখম হলে, তার জন্য লঘুদণ্ডের বিধান করেছিল। কারণ যাঁদের গাড়ি ছিল এবং যাঁরা গাড়ি পরিচালনা করতেন তাঁরা সবাই না হলেও ৯০ শতাংশই ছিলেন ইংরেজ বেনিয়া বা তাদের অনুগত। ফলে শ্রেণীগত স্বার্থে ইংরেজরা দণ্ডবিধিতে পথ-দুর্ঘটনার শাস্তিকে নামমাত্র করেছিল। যেমন পেনাল কোডের ৩০৪-খ ধারায় বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি বেপরোয়াভাবে বা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে জনপথে যান বা অশ্ব চালিয়ে কোনো ব্যক্তির মৃত্যু ঘটান, সেই ব্যক্তি যেকোনো বর্ণনার কারাদণ্ডে, যার মেয়াদ তিন বছর পর্যন্ত হতে পারে বা অর্থদণ্ডে বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। ২৭৯ ধারায় বলা আছে, কোনো ব্যক্তি জনপথে এমন বেপরোয়াভাবে বা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে কোনো যান চালায় বা অশ্বারোহণ করে, যাতে মানুষের জীবন বিপন্ন হতে পারে, অন্য কোনো ব্যক্তিকে আহত বা জখম করার আশঙ্কা থাকে, তিনি তিন বছর কারাদণ্ড বা এক থেকে তিন হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং ৩৩৮-ক ধারায় বলা আছে, যে ব্যক্তি বেপরোয়াভাবে বা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে গণপথে গাড়ি বা অশ্ব চালিয়ে কোনো ব্যক্তিকে গুরুতর আঘাত করেন, যাতে মনুষ্য জীবন ও ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বিঘ্ন হয়, সেই ব্যক্তি যেকোনো বর্ণনার কারাদণ্ডে, যার মেয়াদ দুই বছর পর্যন্ত হতে পারে বা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। হত্যার মতো ঘটনা থাকার পরও এই বিধি তিনটিতে কোথাও অধিক কারাবাস নেই, এমনকি যে কারাবাসের কথা বলা আছে, তাও বিনাশ্রম। উলি্লখিত তিনটি অপরাধই জামিনযোগ্য করে অপরাধীদের মুক্তির পাকাপোক্ত ব্যবস্থা করা হয়েছে, কারণ সে যুগে বিচারক এবং অপরাধী উভয় ছিলেন প্রায় একই গোত্রভুক্ত প্রভু শ্রেণীর। নিজেদের রক্ষার জন্য সেদিনের প্রণীত আইন আজকের যুগে অচল। এ ধরনের নামমাত্র আইন সমাজে বিদ্যমান। আইনের প্রতি অবজ্ঞা শুরু থেকেই, কারণ আইনটি সাজার দিক থেকে হালকা এবং প্রকৃতির দিক থেকে জামিনযোগ্য। তা ছাড়া ওই বিধি তিনটিতে কোনো সহযোগী অপরাধীর সাজার ব্যবস্থা নেই। এসব কারণে পথ-দুর্ঘটনা নিবৃত্তিতে বিদ্যমান আইন অচল ও হাস্যকর।
যিনি ফিটনেসবিহীন লক্কড়ঝক্কড় গাড়ি জোর করে রাস্তায় নামান, সে মালিক কেন আইনের আওতায় আসবেন না? আমাদের যানের মালিককে আইনের আওতায় আনা জরুরি। প্রচলিত আইনে সেকেলে দণ্ড বৃদ্ধি করে পথ-দুর্ঘটনায় হত্যার অপরাধকে জামিন ও আপস অযোগ্য করা। যে জনপথে ভুয়া ড্রাইভার, অদক্ষ চালক কিংবা ফিটনেসবিহীন গাড়ি দুর্ঘটনার শিকার হয়ে প্রাণহানি ঘটাবে, সে রাস্তার দায়িত্বে থাকা হাইওয়ে বা বেঙ্গল পুলিশ যারা দায়িত্বে থাকবে তাদের এবং ক্ষেত্রবিশেষে যারা ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় চলতে দিয়েছে তাদেরও সহযোগী অপরাধী হিসেবে আইনের আওতায় নিয়ে আসা। সংশ্লিষ্ট যারা দায়িত্ব পালন করতে গাফিলাতি করেছে তাদের গাফিলাতির ফলে যদি কোনো যাত্রী বা পথচারীর ক্ষতি হয়, মৃত্যু হয়, তবে মালিকসহ তাদের আয় বা সম্পদ থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের বিধান করা।
একই সঙ্গে প্রয়োজন পথ সার্ভিসের সঙ্গে যুক্ত বিশাল জনশক্তির মূল্যবোধগত পরিবর্তন, ড্রাইভিং পেশায় শিক্ষিতদের প্রবেশে উৎসাহকরণ, জিও-এনজিওগুলোর পথ সার্ভিসের সঙ্গে যুক্তদের বিশেষত ড্রাইভার, কন্ডাক্টর, মালিকদের পেশাগত ও নৈতিকতা শিক্ষা দেওয়া; তাদের দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তর করা দরকার। এখানে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা জরুরি।
আমাদের পথ-দুর্ঘটনার বেশির ভাগ কারণ গাড়িচালকদের অসচেতনতা। যেহেতু বাস ও ট্রাকের ৯৯ শতাংশ চালকই প্রশিক্ষণবিহীন, সেহেতু তাদের প্রশিক্ষণ জরুরি। যে পাঁচ লাখ ভুয়া চালক আছে, কিন্তু রাস্তায় চলমান, তাদের ট্রেনিং দিয়ে দক্ষ করে যোগ্য করে নেওয়া। যেসব ড্রাইভার ২০ বা ৩০ বছর পেশাগত জীবনে দুর্ঘটনামুক্ত থাকবে, তাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে পুরস্কৃত করা। আমাদের এ মুহূর্তে মূল্যবোধ গড়ে তোলা জরুরি যেন একজন গাড়িচালক অবশ্যই মনে করে যাত্রীসেবার মধ্যে মালিকের মুনাফা বিদ্যমান। অবশ্যই মালিকের স্বার্থ দেখবে, তবে তা নিজের ও যাত্রীর জীবনকে বাদ দিয়ে নয়। ভারতের দ্বিতীয় ভগবানখ্যাত বিশিষ্ট শল্যচিকিৎসক দেবী শেঠির একটি উদ্ধৃতি এ ধরনের, 'আমি যখন কোনো শিশুকে অপারেশন থিয়েটারে অপারেশনের জন্য নিই, তখন মনে করি, মা তাঁর পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ আমার হাতে তুলে দিলেন, সে সম্পদ মায়ের কাছে সুস্থভাবে ফিরিয়ে দেওয়া আমার প্রধানতম কর্তব্য।' আমাদের গাড়িচালকরা যদি এই মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি জীবনে গ্রহণ করতে পারে, তবে আমরা, যাত্রীরা, পরিত্রাণ পাব সড়কপথে নিত্য খুনের হাত থেকে।
লেখক : সাবেক ছাত্রনেতা, আইনজীবী ও কলামিস্ট
No comments