কালান্তরের কড়চা-বঙ্গবন্ধু কেন তাঁকে চাকরিটি দিতে পারেননি তার আসল তথ্য তিনি চেপে গেছেন by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
মিথ্যাচারের জবাবে-৩ আজকের লেখার শুরুতে আমার পাঠকদের কাছে একটি সবিনয় নিবেদন জানাই, বিবিসি রেডিও, লন্ডনের সাবেক সাংবাদিক সিরাজুর রহমানের একটি লেখার (ঢাকার নয়া দিগন্ত পত্রিকায় ৮ জুলাই শুক্রবারের সংখ্যায় প্রকাশিত) তথ্য ও মন্তব্য সম্পর্কে আমার লেখাটি দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে।
সহৃদয় পাঠকদের অনেকে ভাবতে পারেন, আমার বিরুদ্ধে সিরাজুর রহমান তাঁর লেখায় যে ব্যক্তিগত আক্রমণ চালিয়েছেন, আমি বুঝি সেই আক্রমণের বিরুদ্ধে পাল্টা আক্রমণ চালানোর জন্য এই দীর্ঘ লেখা লিখছি। আমার নিবেদন, এই দীর্ঘ লেখার উদ্দেশ্য তা নয়।
সিরাজুর রহমান যদি তাঁর লেখাটি আমার প্রতি ব্যক্তিগত ও অসত্য মন্তব্য করার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতেন, যা তিনি অতীতেও করেছেন, তাহলে আমি এবারেও তাঁর বিরুদ্ধে কলম ধরতাম না। কিন্তু তিনি আমার বিরুদ্ধে মিথ্যাচারেই তাঁর লেখাটি সীমাবদ্ধ রাখেননি, তিনি জাতির জনক ও স্বাধীনতার স্থপতির ভাবমূর্তি এবং মুক্তিযুদ্ধের সময়ের অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার ওপর জঘন্য মিথ্যাচারের কালিমা লেপন করেছেন এবং একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থক কাগজে প্রকাশ করেছেন এবং স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত এবং তাদের দোসর বিএনপির অপপ্রচারগুলোকে স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস বলে চালানোর চেষ্টা করেছেন। এ কাজে বিবিসি রেডিওর বাংলা বিভাগের সাবেক অস্থায়ী বা ভারপ্রাপ্ত প্রধান হিসেবে নিজের পরিচয়কে বারবার ব্যবহার করে বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মকে বিভ্রান্ত ও প্রভাবিত করার চেষ্টা করছেন।
সম্প্রতি তিনি লন্ডনের 'গার্ডিয়ান' পত্রিকায় চিঠিপত্র কলামে পাকিস্তানের জেল থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পথে লন্ডনে অবস্থানের সময়ে কোনো কোনো ঘটনাকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ডাহা মিথ্যার রঙে রঞ্জিত করে প্রকাশ করেছেন (অবশ্য 'গার্ডিয়ানে' সঙ্গে সঙ্গে তার প্রতিবাদও ছাপা হয়েছে)। তাতেও বিবিসি রেডিওর বাংলা বিভাগের সাবেক ভারপ্রাপ্ত প্রধানের পরিচয়টি তিনি ব্যবহার করেছেন। যিনি নিজেকে বাংলাদেশের একজন গুরুত্বপূর্ণ সাংবাদিক বলে দাবি করেন এবং 'গায়ে মানে না আপনি মোড়ল' সেজে বসে আছেন, তিনি সেই সাংবাদিকতার পরিচয়ে তাঁর চিঠিটা 'গার্ডিয়ানে' না পাঠিয়ে বিবিসির চাকরি ছাড়ার পরও সেই পরিচয় ব্যবহার করে চিঠি পাঠাতে গেলেন কেন? তাঁর চালাকিটা স্পষ্ট। বিবিসির পরিচয় ছাড়া তাঁর চিঠিটা গার্ডিয়ানে ছাপা হতো না। তাঁর কোনো সাংবাদিক খ্যাতি লন্ডনে যেমন নেই, তেমনি তাঁর নিজের দেশেও নেই। জামায়াতি পত্রিকা ছাড়া কোনো জাতীয় দৈনিকে তাঁর লেখা ছাপা হয় না।
তবু তাঁর মিথ্যা কথনগুলোর প্রতিবাদ হওয়া প্রয়োজন। জাতীয় ইতিহাসের এই বিকৃতি এবং জাতীয় নেতাদের চরিত্রহননের এই ক্রমাগত অপচেষ্টা রোধ করা না গেলে আমাদের নতুন ও তরুণ প্রজন্ম বিভ্রান্ত হবে এবং সে জন্য আমরা দায়ী হব। আমার ব্যক্তিগত চরিত্রহননে দেশ ও জাতির কোনো ক্ষতি হবে না, কিন্তু জাতির ইতিহাস ও জাতীয় ব্যক্তিত্বদের নিয়ে দেশদ্রোহমূলক মিথ্যা প্রচার দেশ ও জাতির অপূরণীয় ক্ষতি করবে। তার ওপর এই মিথ্যা প্রচার চলছে বিবিসির সাইনবোর্ডের ঢালের আড়ালে। সুতরাং ইতিহাসভিত্তিক সত্যোদ্ঘাটনে আমার লেখাটি একটু বড় হচ্ছে। এ জন্য পাঠকদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
১৯৭৪ সালে অসুস্থ স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য লন্ডনে আসার সময় আমি একেবারে পথের ফকির ছিলাম এবং তাঁর কাছে বিবিসির একটি চাকরির আশায় ধরনা দিয়েছিলাম এবং আমার ইংরেজি, বাংলা ভালো নয়; উচ্চারণ শুদ্ধ নয়, এ জন্য চাকরি দিতে না পেরে খুচরো কাজের খুদকুড়ো দিয়ে কিছু আর্থিক সংস্থানের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন, জন্ম-মিথ্যাবাদী (নড়ৎহ-ষধরৎ) না হলে এসব কথা কারো পক্ষে লেখা বা বলা সম্ভব নয়। আমার সম্পর্কে এই মিথ্যা এবং আরো কয়েকটি মিথ্যা সম্পর্কে আমি পরে সংক্ষেপে জবাব দেব। প্রথমে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে এবং পরবর্তীকালে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ সম্পর্কে তাঁর প্রচণ্ড বিদ্বেষ পোষণ এবং অনবরত কুৎসা রটনার আসল কারণটি উল্লেখ করব। ইচ্ছা ছিল না এত দীর্ঘকাল পর এসব নোংরা মিথ্যার জঞ্জাল ঘাঁটি। কিন্তু সিরাজুর রহমানই আমাকে বাধ্য করলেন।
আগেই বলেছি, সিরাজুর রহমান দীর্ঘকাল বিবিসি রেডিওর বাংলা বিভাগে চাকরি করেছেন বটে, কিন্তু যোগ্যতার বিচারে বিবিসিতে তাঁর চাকরি হয়নি এবং দীর্ঘকাল তাঁকে চাকরিতে রাখতে বাধ্য হলেও বিবিসি কর্তৃপক্ষ তাঁর যোগ্যতা ও দক্ষতা সম্পর্কে কখনো প্রীত ছিল না বলে মনে হয় এবং তাঁকে কখনো পদোন্নতি দিয়ে বাংলা বিভাগের প্রধান করা হয়নি। তাঁর সঙ্গের হিন্দি বিভাগের এক হিন্দিভাষী মহিলা (শ্রীমতী অচলা) পর্যন্ত যোগ্যতা ও দক্ষতা দেখিয়ে বিবিসি রেডিওর হিন্দি বিভাগের প্রধান হয়ে গেছেন। কিন্তু সিরাজুর রহমান বাংলা বিভাগের প্রধান হতে পারেননি।
প্রতিবারই একজন শ্বেতাঙ্গ সাহেব বাংলা বিভাগের প্রধানের পদ থেকে অবসর নিয়েছেন আর সিরাজুর রহমানকে হয়তো আশ্বাস দেওয়া হয়েছে এবার তাঁর ভাগ্যে শিকে ছিঁড়ছে। কিন্তু সেই শিকে আর ছেঁড়েনি। তিন-তিনবার এই পদোন্নতির আশা ব্যর্থ হওয়ার পর ক্ষোভে-দুঃখে তিনি আত্মহননের হুমকি দিয়েছিলেন। তাতে তাঁর বন্ধুরা শঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু বিবিসি কর্তৃপক্ষের মন গলেনি। কমল বসু নামে পশ্চিমবঙ্গের এক হিন্দু ভদ্রলোক বিবিসির বাংলা বিভাগের প্রধান হলেন। তাঁর অধীনেই সিরাজুর রহমানের চাকরি ন্যস্ত করা হয়। সিরাজুর রহমান ভেবেছিলেন, কমল বসু চলে গেলে তিনি বাংলা বিভাগের প্রধান হবেন। কিন্তু তাঁর আশা পূর্ণ হয়নি। তাঁর মাথার ওপর জন ক্লামাস নামে এক পাদ্রিকে এনে বাংলা বিভাগের প্রধান হিসেবে বসিয়ে দেওয়া হয়। এর পর থেকে বাংলা বিভাগের কোনো শ্বেতাঙ্গ প্রধান অবসর নিলে পরবর্তী নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত সিরাজুর রহমান দুই-চার দিনের জন্য বিভাগের অস্থায়ী বা ভারপ্রাপ্ত প্রধান হতেন। তাও হতেন তাঁর যোগ্যতার জন্য নয়, হতেন বিভাগে তাঁর সিনিয়রিটির জন্য। আর সেই আহ্লাদেই তিনি কিছুদিন ডগমগ করতেন।
কিন্তু এই 'সাময়িক ডগমগ' তাঁর মনকে শান্তি দেয়নি। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, দীর্ঘকাল ব্রিটিশ সাহেবদের নিরলস পদসেবা করে তিনি তাদের মন গলাতে পারেননি। কমল বসু যখন বিবিসির বাংলা বিভাগ থেকে অবসর নেন, তখন বিবিসি রেডিওর বাংলা বিভাগ নর্থ লন্ডনের গোল্ডার্স গ্রিনে এক অভিজাত হলে তাঁকে বিরাট বিদায় সংবর্ধনা দেয়। আর সিরাজুর রহমান ৩০ বছরের দীর্ঘ চাকরি শেষে বিবিসি থেকে বিদায় নিয়েছিলেন সম্পূর্ণ আনসিরিমনিয়াসলি। বিদায় গ্রহণকালে একটি ফুলের তোড়াও কেউ তাঁর হাতে গুঁজে দেয়নি। আমাকে এই ঘটনাটি খুবই বিস্মিত করেছিল। কিছুদিন পর এর কারণটাও জানতে পেরেছিলাম। সে প্রসঙ্গ এখানে আর টানতে চাই না।
যা হোক, বিবিসি কর্তৃপক্ষের হাবভাব দেখে সিরাজুর রহমান হয়তো অনেক আগেই বুঝতে পেরেছিলেন এই প্রতিষ্ঠানে যোগ্যতার অভাব অথবা স্বভাব দোষ_যে কারণেই হোক তাঁর কোনো ভবিষ্যৎ নেই। সুতরাং বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ায় তিনি নতুনভাবে উৎসাহিত হয়েছিলেন এবং আশা করছিলেন বিবিসির চাকরির সুবাদে বঙ্গবন্ধু, বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী (স্বাধীনতা-উত্তর রাষ্ট্রপতি) প্রমুখের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা পাতিয়ে একটি উচ্চপদ বাগিয়ে নেবেন। এ জন্য বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি বঙ্গবন্ধু ও বিচারপতি চৌধুরীর কাছে ধরনা দেওয়া শুরু করেন। এই ধরনা দেওয়ার কাহিনী তাঁর আত্মকথা 'প্রীতি নিন সকলে' বইটিতেও আছে। তবে একটু রাখঢাক করে লিখেছেন।
মোদ্দা কথা, তিনি চেয়েছিলেন বিদেশে বাংলাদেশকে, বিশেষ করে বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে পরিচিত করার জন্য একটি ইউরোপভিত্তিক উচ্চপদ সৃষ্টি করে তাঁকে সেই পদে বসানো হোক। প্রথমে তিনি রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে প্রস্তাবটি জানান। রাষ্ট্রপতি তাঁকে বলেন, এই নতুন পদ সৃষ্টি এবং পদটির ক্ষমতা ও দায়িত্ব সম্পর্কে তিনি যেন লিখিতভাবে একটি প্রস্তাব রাষ্ট্রপতিকে দেন। তাহলে তিনি সেটি বিবেচনার জন্য বঙ্গবন্ধুকে দেবেন। চাকরি পাওয়ার জন্য সিরাজুর রহমানের এই ধরনা দেওয়ার বিবরণ তাঁর বই 'প্রীতি নিন সকলে'র ১২৭ পৃষ্ঠায় আছে। সিরাজুর রহমান ১২ পৃষ্ঠার একটি লিখিত প্রস্তাব রাষ্ট্রপতিকে দিয়েছিলেন।
১৯৭২ সালের জুলাই মাসে চিকিৎসার জন্য বঙ্গবন্ধু লন্ডনে এলে সিরাজুর রহমান এই চাকরির জন্য হাসপাতালে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে আবার ধরনা দেন। বঙ্গবন্ধু তাঁকে তাঁর ১২ পৃষ্ঠার প্রস্তাব পেয়েছেন বলে জানান। তিনি তাঁকে চাকরি দেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেন। আসলে সিরাজুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু পছন্দ করতেন এবং স্নেহও করতেন। তাঁর ইচ্ছে ছিল সিরাজুর রহমানকে চাকরিটি দেওয়ার। সে জন্য তাঁর প্রস্তাবটির আরো একটু বিশদ ব্যাখ্যা ঢাকায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠিয়ে দেওয়ার অনুরোধ জানান। এই বিশদ ব্যাখ্যা সিরাজ সাহেব সঙ্গে সঙ্গেই ঢাকায় পাঠিয়েছিলেন।
এরপর প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে তিনি আর কোনো সাড়াশব্দ পাননি বলে লিখেছেন। 'প্রীতি নিন সকলে' বইটিতে তিনি স্বীকার করেছেন, "ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মচারী এক বন্ধু আমাকে চিঠি লিখে জানিয়েছেন, বিবিসির চাকরি নিয়েই আমার সন্তুষ্ট থাকা উচিত। কেননা আমার অনুপস্থিতিতে আমার 'বন্ধুরা' দিবারাত্র প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার চরিত্রহনন করছেন। আমার পক্ষে এর পর একমাত্র সম্মানজনক পথ ছিল সবিনয়ে প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়ে দেওয়া যে আপাতত বিবিসির চাকরি ছাড়া আমার জন্য সম্ভব হচ্ছে না।"
একই বইয়ের ৭২ পৃষ্ঠায় সিরাজুর রহমান দাবি করেছেন, 'সাবেক বন্ধুদের প্রকাশ্য বৈরিতা এড়ানোর উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের একটি চাকরি দানের প্রস্তাব সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করতে বাধ্য হয়েছিলাম।' এখানেই সিরাজুর রহমান বড় একটি মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু তাঁকে কোনো চাকরি অফার করেননি, তিনিও সেই অফার প্রত্যাখ্যান করেননি। অফার না পেলে প্রত্যাখ্যান করার সুযোগ থাকে কোথায়?
সিরাজুর রহমান তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, তাঁর 'বন্ধুরাই' বঙ্গবন্ধুর কাছে তাঁর সম্পর্কে দুর্নাম করেছে এবং তাদের বৈরিতার ভয়েই তিনি চাকরির প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করতে বাধ্য হয়েছিলেন। ডাহা মিথ্যা। তাঁর কোনো বন্ধু তাঁর সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর কান ভারী করছেন, তা তাঁর জানা থাকলে তিনি এত বানানো কথা লিখতে পারলেন, আর 'বন্ধুদের' নাম প্রকাশ করলেন না কেন? 'ভাসুরের নাম নিতে ভাদ্রবৌয়ের এত লজ্জা কিসের? আমার জানামতে, তাঁর নাম না-জানা বন্ধুরা নন, গোটা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ই তাঁর এই নিয়োগের বিরোধিতা করেছিল। সিরাজুর রহমানের প্রস্তাবের বিশদ ব্যাখ্যা পাওয়ার পর বঙ্গবন্ধু পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন অন্যতম কর্মকর্তা মারুফ আহমদ চৌধুরীকে পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে এই পদ সৃষ্টির ও সিরাজুর রহমানকে ওই পদে নিয়োগের প্রোপোজাল তাঁর কাছে সাবমিট করার নির্দেশ দেন। মারুফ চৌধুরী বঙ্গবন্ধুকে বলেন, 'সিরাজুর রহমানের তো প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই। তিনি তো বিএ পাসও করেননি।' পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে এই প্রস্তাবের ফাইল আর প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে সাবমিট করা হয়নি (বিস্তারিত জানার জন্য পড়ুন লন্ডনে বসবাসকারী প্রবীণ সাংবাদিক ও সাহিত্যিক আবদুল মতিনের 'বিজয় দিবসের পর' গ্রন্থটির 'একটি চাকুরির জন্য' শীর্ষক দশম অধ্যায়টি, পৃষ্ঠা ৯৯)।
কিস্সা এখানেই শেষ নয়। বঙ্গবন্ধু জেনেভা থেকে দেশে ফেরার বেশ কিছুদিন পর আমি একদিন গণভবনে তাঁর কাছে গেছি। সেখানে বসা ছিলেন সদ্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী পদ ছেড়ে আসা মন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ। সিরাজুর রহমান এত ধরনা দেওয়ার পরও কেন চাকরি পেলেন না তা জানার ইচ্ছা আমার ছিল। আমি বঙ্গবন্ধুর কাছে প্রসঙ্গটি তুলতেই তিনি আবদুস সামাদ আজাদের দিকে তাকালেন। সামাদ ভাই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, 'তুমি সিরাজুর রহমানকে কতটা চেন, তা আমি জানি না। কিন্তু তাঁকে আমি ভালো করে চিনি। তা ছাড়া তাঁর সম্পর্কে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নোটও সন্তোষজনক নয়।'
সামাদ আজাদ বললেন, 'সিরাজুর রহমান ঢাকায় থাকার সময়ও দেশের কাগজে কাজ করেছেন খুব কম সময়ই। বেশির ভাগ সময় চাকরি করেছেন বিদেশি প্রচার দপ্তরে। বাংলাদেশে বিপিসি মুভমেন্ট থেকে ল্যাঙ্গুয়েজ মুভমেন্ট, ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষার এত সংগ্রাম, তার কোনোটার সঙ্গেই সাংবাদিক ও সাহিত্যিক হিসেবে তাঁর কোনো ধরনের সম্পৃক্ততা ছিল না। তাঁর সম্পর্কে রিপোর্ট ভালো নয়। ১৯৫৬ সালে যখন প্রথম সুয়েজ যুদ্ধ হয় এবং ব্রিটেন, ফ্রান্স ও ইসরায়েল মিলে প্রেসিডেন্ট নাসের ও মিসরের ওপর হামলা চালিয়েছিল, তখন পূর্ব পাকিস্তানেও বিরাট গণবিক্ষোভ দেখা দিয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা হরতাল ডাকে এবং বিদেশিদের অফিসে কর্মরত বাঙালিদেরও এক দিনের জন্য কর্মবিরতি পালনের আবেদন জানায়। এই সময় সিরাজুর রহমান ঢাকায় ব্রিটিশ ইনফরমেশন সার্ভিসে চাকরি করতেন। তাঁর আরেক বাঙালি সহকর্মী (প্রয়াত সাহিত্যিক এবং ইত্তেফাকের একসময়ের সাহিত্য সাময়িকীর সম্পাদক) শামসুল হক ওই দিনের ধর্মঘটের ডাকে সাড়া দিয়ে অফিসে যাননি। কিন্তু সাহেবদের খুশি করার জন্য সিরাজুর রহমান গিয়েছিলেন।'
আবদুস সামাদ আজাদ বললেন, 'মিসর আক্রমণ করায় দেশ-বিদেশের মানুষের ব্রিটেনের ওপর ক্ষোভটাই ছিল বেশি। ঢাকার বিক্ষোভকারীরাও পল্টনে অবস্থিত ব্রিটিশ তথ্যকেন্দ্রে আগুন ধরিয়ে দেয়। সেটি ছিল কাঠের তৈরি একটি বাংলো প্যাটার্নের বাড়ি। সিরাজুর রহমান সেদিন শুধু কপালের জোরে আগুনে পুড়ে মারা যাননি। তাঁর যেমন কলেজি শিক্ষা নেই, তেমনি ভাষা-সাহিত্যেও কোনো দখল বা অবদান আছে, তার কোনো প্রমাণ নেই। এমন এক ব্যক্তির জন্য সর্ব-ইউরোপীয় কালচারাল অ্যাম্বাসেডরের উচ্চপদ সৃষ্টি কি সম্ভব?' সামাদ ভাইয়ের বক্তব্য শুনে বঙ্গবন্ধু নিশ্চুপ ছিলেন।
এর পরও সিরাজুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু চাকরিটি দিতে আগ্রহী ছিলেন। বলেছিলেন, 'সিরাজের কলেজি শিক্ষাদীক্ষা নেই, তাতে কী? তাঁর বিদ্যাবুদ্ধি ভালো।' হয়তো তিনি এই ব্যাপারে সবার মত অগ্রাহ্য করে তাঁকে চাকরিটি দিতেনই। কিন্তু ওই সময়ে তাঁর কানে সম্ভবত ভারতের প্রভাবশালী কূটনীতিক এবং বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের (লন্ডন-দিলি্ল-ঢাকা) সঙ্গী শশাঙ্ক শেখর ব্যানার্জির একটি অভিমত (সিরাজুর রহমান সম্পর্কে) পেঁৗছে যায়। বঙ্গবন্ধু যখন পাকিস্তানের কারাগারে বিচারাধীন, তখন সিরাজুর রহমান একটি মিথ্যা খবর নিয়ে হাজির হয়েছিলেন লন্ডনে ভারতীয় দূতাবাসে এবং খবরটি শশাঙ্ক শেখর ব্যানার্জিকে জানিয়েছিলেন। এই খবরটি মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ায় শশাঙ্ক ব্যানার্জি সন্দেহ করেন, এর পেছনে বাংলাদেশবিরোধী গভীর কুমতলব ছিল।
তিনি যখন পরবর্তীকালে 'Indians security dilemmas : Pakistan and Bangladesh' শীর্ষক বইটি লেখেন, তখন সিরাজুর রহমানের এই 'উদ্দেশ্যমূলক মিথ্যাচারের' বিবরণটিও তাঁর বইয়ে লিপিবদ্ধ করেন। তার আগেই এই বিবরণ বঙ্গবন্ধুর কানে পেঁৗছে গিয়েছিল। সুতরাং তাঁর জন্য একটি উচ্চপদ সৃষ্টি করে সেই পদে তাঁকে বসানো বঙ্গবন্ধুর একান্ত ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সম্ভব হয়নি।
তখন থেকেই বঙ্গবন্ধু, তাঁর পরিবার ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে সিরাজুর রহমানের রাগ একেবারে প্রতিহিংসায় পরিণত হয়েছে। শশাঙ্ক শেখর ব্যানার্জির বই থেকে এই ঘটনাটির উল্লেখ করলেই আমার পাঠকদের পক্ষেও আসল সিরাজ চরিত্র অনুধাবন করা সহজ হবে।
(শেষাংশ আগামী মঙ্গলবার)
লন্ডন, ২৫ জুলাই, সোমবার, ২০১১
সিরাজুর রহমান যদি তাঁর লেখাটি আমার প্রতি ব্যক্তিগত ও অসত্য মন্তব্য করার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতেন, যা তিনি অতীতেও করেছেন, তাহলে আমি এবারেও তাঁর বিরুদ্ধে কলম ধরতাম না। কিন্তু তিনি আমার বিরুদ্ধে মিথ্যাচারেই তাঁর লেখাটি সীমাবদ্ধ রাখেননি, তিনি জাতির জনক ও স্বাধীনতার স্থপতির ভাবমূর্তি এবং মুক্তিযুদ্ধের সময়ের অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার ওপর জঘন্য মিথ্যাচারের কালিমা লেপন করেছেন এবং একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থক কাগজে প্রকাশ করেছেন এবং স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত এবং তাদের দোসর বিএনপির অপপ্রচারগুলোকে স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস বলে চালানোর চেষ্টা করেছেন। এ কাজে বিবিসি রেডিওর বাংলা বিভাগের সাবেক অস্থায়ী বা ভারপ্রাপ্ত প্রধান হিসেবে নিজের পরিচয়কে বারবার ব্যবহার করে বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মকে বিভ্রান্ত ও প্রভাবিত করার চেষ্টা করছেন।
সম্প্রতি তিনি লন্ডনের 'গার্ডিয়ান' পত্রিকায় চিঠিপত্র কলামে পাকিস্তানের জেল থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পথে লন্ডনে অবস্থানের সময়ে কোনো কোনো ঘটনাকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ডাহা মিথ্যার রঙে রঞ্জিত করে প্রকাশ করেছেন (অবশ্য 'গার্ডিয়ানে' সঙ্গে সঙ্গে তার প্রতিবাদও ছাপা হয়েছে)। তাতেও বিবিসি রেডিওর বাংলা বিভাগের সাবেক ভারপ্রাপ্ত প্রধানের পরিচয়টি তিনি ব্যবহার করেছেন। যিনি নিজেকে বাংলাদেশের একজন গুরুত্বপূর্ণ সাংবাদিক বলে দাবি করেন এবং 'গায়ে মানে না আপনি মোড়ল' সেজে বসে আছেন, তিনি সেই সাংবাদিকতার পরিচয়ে তাঁর চিঠিটা 'গার্ডিয়ানে' না পাঠিয়ে বিবিসির চাকরি ছাড়ার পরও সেই পরিচয় ব্যবহার করে চিঠি পাঠাতে গেলেন কেন? তাঁর চালাকিটা স্পষ্ট। বিবিসির পরিচয় ছাড়া তাঁর চিঠিটা গার্ডিয়ানে ছাপা হতো না। তাঁর কোনো সাংবাদিক খ্যাতি লন্ডনে যেমন নেই, তেমনি তাঁর নিজের দেশেও নেই। জামায়াতি পত্রিকা ছাড়া কোনো জাতীয় দৈনিকে তাঁর লেখা ছাপা হয় না।
তবু তাঁর মিথ্যা কথনগুলোর প্রতিবাদ হওয়া প্রয়োজন। জাতীয় ইতিহাসের এই বিকৃতি এবং জাতীয় নেতাদের চরিত্রহননের এই ক্রমাগত অপচেষ্টা রোধ করা না গেলে আমাদের নতুন ও তরুণ প্রজন্ম বিভ্রান্ত হবে এবং সে জন্য আমরা দায়ী হব। আমার ব্যক্তিগত চরিত্রহননে দেশ ও জাতির কোনো ক্ষতি হবে না, কিন্তু জাতির ইতিহাস ও জাতীয় ব্যক্তিত্বদের নিয়ে দেশদ্রোহমূলক মিথ্যা প্রচার দেশ ও জাতির অপূরণীয় ক্ষতি করবে। তার ওপর এই মিথ্যা প্রচার চলছে বিবিসির সাইনবোর্ডের ঢালের আড়ালে। সুতরাং ইতিহাসভিত্তিক সত্যোদ্ঘাটনে আমার লেখাটি একটু বড় হচ্ছে। এ জন্য পাঠকদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
১৯৭৪ সালে অসুস্থ স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য লন্ডনে আসার সময় আমি একেবারে পথের ফকির ছিলাম এবং তাঁর কাছে বিবিসির একটি চাকরির আশায় ধরনা দিয়েছিলাম এবং আমার ইংরেজি, বাংলা ভালো নয়; উচ্চারণ শুদ্ধ নয়, এ জন্য চাকরি দিতে না পেরে খুচরো কাজের খুদকুড়ো দিয়ে কিছু আর্থিক সংস্থানের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন, জন্ম-মিথ্যাবাদী (নড়ৎহ-ষধরৎ) না হলে এসব কথা কারো পক্ষে লেখা বা বলা সম্ভব নয়। আমার সম্পর্কে এই মিথ্যা এবং আরো কয়েকটি মিথ্যা সম্পর্কে আমি পরে সংক্ষেপে জবাব দেব। প্রথমে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে এবং পরবর্তীকালে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ সম্পর্কে তাঁর প্রচণ্ড বিদ্বেষ পোষণ এবং অনবরত কুৎসা রটনার আসল কারণটি উল্লেখ করব। ইচ্ছা ছিল না এত দীর্ঘকাল পর এসব নোংরা মিথ্যার জঞ্জাল ঘাঁটি। কিন্তু সিরাজুর রহমানই আমাকে বাধ্য করলেন।
আগেই বলেছি, সিরাজুর রহমান দীর্ঘকাল বিবিসি রেডিওর বাংলা বিভাগে চাকরি করেছেন বটে, কিন্তু যোগ্যতার বিচারে বিবিসিতে তাঁর চাকরি হয়নি এবং দীর্ঘকাল তাঁকে চাকরিতে রাখতে বাধ্য হলেও বিবিসি কর্তৃপক্ষ তাঁর যোগ্যতা ও দক্ষতা সম্পর্কে কখনো প্রীত ছিল না বলে মনে হয় এবং তাঁকে কখনো পদোন্নতি দিয়ে বাংলা বিভাগের প্রধান করা হয়নি। তাঁর সঙ্গের হিন্দি বিভাগের এক হিন্দিভাষী মহিলা (শ্রীমতী অচলা) পর্যন্ত যোগ্যতা ও দক্ষতা দেখিয়ে বিবিসি রেডিওর হিন্দি বিভাগের প্রধান হয়ে গেছেন। কিন্তু সিরাজুর রহমান বাংলা বিভাগের প্রধান হতে পারেননি।
প্রতিবারই একজন শ্বেতাঙ্গ সাহেব বাংলা বিভাগের প্রধানের পদ থেকে অবসর নিয়েছেন আর সিরাজুর রহমানকে হয়তো আশ্বাস দেওয়া হয়েছে এবার তাঁর ভাগ্যে শিকে ছিঁড়ছে। কিন্তু সেই শিকে আর ছেঁড়েনি। তিন-তিনবার এই পদোন্নতির আশা ব্যর্থ হওয়ার পর ক্ষোভে-দুঃখে তিনি আত্মহননের হুমকি দিয়েছিলেন। তাতে তাঁর বন্ধুরা শঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু বিবিসি কর্তৃপক্ষের মন গলেনি। কমল বসু নামে পশ্চিমবঙ্গের এক হিন্দু ভদ্রলোক বিবিসির বাংলা বিভাগের প্রধান হলেন। তাঁর অধীনেই সিরাজুর রহমানের চাকরি ন্যস্ত করা হয়। সিরাজুর রহমান ভেবেছিলেন, কমল বসু চলে গেলে তিনি বাংলা বিভাগের প্রধান হবেন। কিন্তু তাঁর আশা পূর্ণ হয়নি। তাঁর মাথার ওপর জন ক্লামাস নামে এক পাদ্রিকে এনে বাংলা বিভাগের প্রধান হিসেবে বসিয়ে দেওয়া হয়। এর পর থেকে বাংলা বিভাগের কোনো শ্বেতাঙ্গ প্রধান অবসর নিলে পরবর্তী নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত সিরাজুর রহমান দুই-চার দিনের জন্য বিভাগের অস্থায়ী বা ভারপ্রাপ্ত প্রধান হতেন। তাও হতেন তাঁর যোগ্যতার জন্য নয়, হতেন বিভাগে তাঁর সিনিয়রিটির জন্য। আর সেই আহ্লাদেই তিনি কিছুদিন ডগমগ করতেন।
কিন্তু এই 'সাময়িক ডগমগ' তাঁর মনকে শান্তি দেয়নি। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, দীর্ঘকাল ব্রিটিশ সাহেবদের নিরলস পদসেবা করে তিনি তাদের মন গলাতে পারেননি। কমল বসু যখন বিবিসির বাংলা বিভাগ থেকে অবসর নেন, তখন বিবিসি রেডিওর বাংলা বিভাগ নর্থ লন্ডনের গোল্ডার্স গ্রিনে এক অভিজাত হলে তাঁকে বিরাট বিদায় সংবর্ধনা দেয়। আর সিরাজুর রহমান ৩০ বছরের দীর্ঘ চাকরি শেষে বিবিসি থেকে বিদায় নিয়েছিলেন সম্পূর্ণ আনসিরিমনিয়াসলি। বিদায় গ্রহণকালে একটি ফুলের তোড়াও কেউ তাঁর হাতে গুঁজে দেয়নি। আমাকে এই ঘটনাটি খুবই বিস্মিত করেছিল। কিছুদিন পর এর কারণটাও জানতে পেরেছিলাম। সে প্রসঙ্গ এখানে আর টানতে চাই না।
যা হোক, বিবিসি কর্তৃপক্ষের হাবভাব দেখে সিরাজুর রহমান হয়তো অনেক আগেই বুঝতে পেরেছিলেন এই প্রতিষ্ঠানে যোগ্যতার অভাব অথবা স্বভাব দোষ_যে কারণেই হোক তাঁর কোনো ভবিষ্যৎ নেই। সুতরাং বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ায় তিনি নতুনভাবে উৎসাহিত হয়েছিলেন এবং আশা করছিলেন বিবিসির চাকরির সুবাদে বঙ্গবন্ধু, বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী (স্বাধীনতা-উত্তর রাষ্ট্রপতি) প্রমুখের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা পাতিয়ে একটি উচ্চপদ বাগিয়ে নেবেন। এ জন্য বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি বঙ্গবন্ধু ও বিচারপতি চৌধুরীর কাছে ধরনা দেওয়া শুরু করেন। এই ধরনা দেওয়ার কাহিনী তাঁর আত্মকথা 'প্রীতি নিন সকলে' বইটিতেও আছে। তবে একটু রাখঢাক করে লিখেছেন।
মোদ্দা কথা, তিনি চেয়েছিলেন বিদেশে বাংলাদেশকে, বিশেষ করে বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে পরিচিত করার জন্য একটি ইউরোপভিত্তিক উচ্চপদ সৃষ্টি করে তাঁকে সেই পদে বসানো হোক। প্রথমে তিনি রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে প্রস্তাবটি জানান। রাষ্ট্রপতি তাঁকে বলেন, এই নতুন পদ সৃষ্টি এবং পদটির ক্ষমতা ও দায়িত্ব সম্পর্কে তিনি যেন লিখিতভাবে একটি প্রস্তাব রাষ্ট্রপতিকে দেন। তাহলে তিনি সেটি বিবেচনার জন্য বঙ্গবন্ধুকে দেবেন। চাকরি পাওয়ার জন্য সিরাজুর রহমানের এই ধরনা দেওয়ার বিবরণ তাঁর বই 'প্রীতি নিন সকলে'র ১২৭ পৃষ্ঠায় আছে। সিরাজুর রহমান ১২ পৃষ্ঠার একটি লিখিত প্রস্তাব রাষ্ট্রপতিকে দিয়েছিলেন।
১৯৭২ সালের জুলাই মাসে চিকিৎসার জন্য বঙ্গবন্ধু লন্ডনে এলে সিরাজুর রহমান এই চাকরির জন্য হাসপাতালে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে আবার ধরনা দেন। বঙ্গবন্ধু তাঁকে তাঁর ১২ পৃষ্ঠার প্রস্তাব পেয়েছেন বলে জানান। তিনি তাঁকে চাকরি দেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেন। আসলে সিরাজুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু পছন্দ করতেন এবং স্নেহও করতেন। তাঁর ইচ্ছে ছিল সিরাজুর রহমানকে চাকরিটি দেওয়ার। সে জন্য তাঁর প্রস্তাবটির আরো একটু বিশদ ব্যাখ্যা ঢাকায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠিয়ে দেওয়ার অনুরোধ জানান। এই বিশদ ব্যাখ্যা সিরাজ সাহেব সঙ্গে সঙ্গেই ঢাকায় পাঠিয়েছিলেন।
এরপর প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে তিনি আর কোনো সাড়াশব্দ পাননি বলে লিখেছেন। 'প্রীতি নিন সকলে' বইটিতে তিনি স্বীকার করেছেন, "ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মচারী এক বন্ধু আমাকে চিঠি লিখে জানিয়েছেন, বিবিসির চাকরি নিয়েই আমার সন্তুষ্ট থাকা উচিত। কেননা আমার অনুপস্থিতিতে আমার 'বন্ধুরা' দিবারাত্র প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার চরিত্রহনন করছেন। আমার পক্ষে এর পর একমাত্র সম্মানজনক পথ ছিল সবিনয়ে প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়ে দেওয়া যে আপাতত বিবিসির চাকরি ছাড়া আমার জন্য সম্ভব হচ্ছে না।"
একই বইয়ের ৭২ পৃষ্ঠায় সিরাজুর রহমান দাবি করেছেন, 'সাবেক বন্ধুদের প্রকাশ্য বৈরিতা এড়ানোর উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের একটি চাকরি দানের প্রস্তাব সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করতে বাধ্য হয়েছিলাম।' এখানেই সিরাজুর রহমান বড় একটি মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু তাঁকে কোনো চাকরি অফার করেননি, তিনিও সেই অফার প্রত্যাখ্যান করেননি। অফার না পেলে প্রত্যাখ্যান করার সুযোগ থাকে কোথায়?
সিরাজুর রহমান তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, তাঁর 'বন্ধুরাই' বঙ্গবন্ধুর কাছে তাঁর সম্পর্কে দুর্নাম করেছে এবং তাদের বৈরিতার ভয়েই তিনি চাকরির প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করতে বাধ্য হয়েছিলেন। ডাহা মিথ্যা। তাঁর কোনো বন্ধু তাঁর সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর কান ভারী করছেন, তা তাঁর জানা থাকলে তিনি এত বানানো কথা লিখতে পারলেন, আর 'বন্ধুদের' নাম প্রকাশ করলেন না কেন? 'ভাসুরের নাম নিতে ভাদ্রবৌয়ের এত লজ্জা কিসের? আমার জানামতে, তাঁর নাম না-জানা বন্ধুরা নন, গোটা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ই তাঁর এই নিয়োগের বিরোধিতা করেছিল। সিরাজুর রহমানের প্রস্তাবের বিশদ ব্যাখ্যা পাওয়ার পর বঙ্গবন্ধু পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন অন্যতম কর্মকর্তা মারুফ আহমদ চৌধুরীকে পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে এই পদ সৃষ্টির ও সিরাজুর রহমানকে ওই পদে নিয়োগের প্রোপোজাল তাঁর কাছে সাবমিট করার নির্দেশ দেন। মারুফ চৌধুরী বঙ্গবন্ধুকে বলেন, 'সিরাজুর রহমানের তো প্রয়োজনীয় শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই। তিনি তো বিএ পাসও করেননি।' পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে এই প্রস্তাবের ফাইল আর প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে সাবমিট করা হয়নি (বিস্তারিত জানার জন্য পড়ুন লন্ডনে বসবাসকারী প্রবীণ সাংবাদিক ও সাহিত্যিক আবদুল মতিনের 'বিজয় দিবসের পর' গ্রন্থটির 'একটি চাকুরির জন্য' শীর্ষক দশম অধ্যায়টি, পৃষ্ঠা ৯৯)।
কিস্সা এখানেই শেষ নয়। বঙ্গবন্ধু জেনেভা থেকে দেশে ফেরার বেশ কিছুদিন পর আমি একদিন গণভবনে তাঁর কাছে গেছি। সেখানে বসা ছিলেন সদ্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী পদ ছেড়ে আসা মন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ। সিরাজুর রহমান এত ধরনা দেওয়ার পরও কেন চাকরি পেলেন না তা জানার ইচ্ছা আমার ছিল। আমি বঙ্গবন্ধুর কাছে প্রসঙ্গটি তুলতেই তিনি আবদুস সামাদ আজাদের দিকে তাকালেন। সামাদ ভাই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, 'তুমি সিরাজুর রহমানকে কতটা চেন, তা আমি জানি না। কিন্তু তাঁকে আমি ভালো করে চিনি। তা ছাড়া তাঁর সম্পর্কে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নোটও সন্তোষজনক নয়।'
সামাদ আজাদ বললেন, 'সিরাজুর রহমান ঢাকায় থাকার সময়ও দেশের কাগজে কাজ করেছেন খুব কম সময়ই। বেশির ভাগ সময় চাকরি করেছেন বিদেশি প্রচার দপ্তরে। বাংলাদেশে বিপিসি মুভমেন্ট থেকে ল্যাঙ্গুয়েজ মুভমেন্ট, ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষার এত সংগ্রাম, তার কোনোটার সঙ্গেই সাংবাদিক ও সাহিত্যিক হিসেবে তাঁর কোনো ধরনের সম্পৃক্ততা ছিল না। তাঁর সম্পর্কে রিপোর্ট ভালো নয়। ১৯৫৬ সালে যখন প্রথম সুয়েজ যুদ্ধ হয় এবং ব্রিটেন, ফ্রান্স ও ইসরায়েল মিলে প্রেসিডেন্ট নাসের ও মিসরের ওপর হামলা চালিয়েছিল, তখন পূর্ব পাকিস্তানেও বিরাট গণবিক্ষোভ দেখা দিয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা হরতাল ডাকে এবং বিদেশিদের অফিসে কর্মরত বাঙালিদেরও এক দিনের জন্য কর্মবিরতি পালনের আবেদন জানায়। এই সময় সিরাজুর রহমান ঢাকায় ব্রিটিশ ইনফরমেশন সার্ভিসে চাকরি করতেন। তাঁর আরেক বাঙালি সহকর্মী (প্রয়াত সাহিত্যিক এবং ইত্তেফাকের একসময়ের সাহিত্য সাময়িকীর সম্পাদক) শামসুল হক ওই দিনের ধর্মঘটের ডাকে সাড়া দিয়ে অফিসে যাননি। কিন্তু সাহেবদের খুশি করার জন্য সিরাজুর রহমান গিয়েছিলেন।'
আবদুস সামাদ আজাদ বললেন, 'মিসর আক্রমণ করায় দেশ-বিদেশের মানুষের ব্রিটেনের ওপর ক্ষোভটাই ছিল বেশি। ঢাকার বিক্ষোভকারীরাও পল্টনে অবস্থিত ব্রিটিশ তথ্যকেন্দ্রে আগুন ধরিয়ে দেয়। সেটি ছিল কাঠের তৈরি একটি বাংলো প্যাটার্নের বাড়ি। সিরাজুর রহমান সেদিন শুধু কপালের জোরে আগুনে পুড়ে মারা যাননি। তাঁর যেমন কলেজি শিক্ষা নেই, তেমনি ভাষা-সাহিত্যেও কোনো দখল বা অবদান আছে, তার কোনো প্রমাণ নেই। এমন এক ব্যক্তির জন্য সর্ব-ইউরোপীয় কালচারাল অ্যাম্বাসেডরের উচ্চপদ সৃষ্টি কি সম্ভব?' সামাদ ভাইয়ের বক্তব্য শুনে বঙ্গবন্ধু নিশ্চুপ ছিলেন।
এর পরও সিরাজুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু চাকরিটি দিতে আগ্রহী ছিলেন। বলেছিলেন, 'সিরাজের কলেজি শিক্ষাদীক্ষা নেই, তাতে কী? তাঁর বিদ্যাবুদ্ধি ভালো।' হয়তো তিনি এই ব্যাপারে সবার মত অগ্রাহ্য করে তাঁকে চাকরিটি দিতেনই। কিন্তু ওই সময়ে তাঁর কানে সম্ভবত ভারতের প্রভাবশালী কূটনীতিক এবং বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের (লন্ডন-দিলি্ল-ঢাকা) সঙ্গী শশাঙ্ক শেখর ব্যানার্জির একটি অভিমত (সিরাজুর রহমান সম্পর্কে) পেঁৗছে যায়। বঙ্গবন্ধু যখন পাকিস্তানের কারাগারে বিচারাধীন, তখন সিরাজুর রহমান একটি মিথ্যা খবর নিয়ে হাজির হয়েছিলেন লন্ডনে ভারতীয় দূতাবাসে এবং খবরটি শশাঙ্ক শেখর ব্যানার্জিকে জানিয়েছিলেন। এই খবরটি মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ায় শশাঙ্ক ব্যানার্জি সন্দেহ করেন, এর পেছনে বাংলাদেশবিরোধী গভীর কুমতলব ছিল।
তিনি যখন পরবর্তীকালে 'Indians security dilemmas : Pakistan and Bangladesh' শীর্ষক বইটি লেখেন, তখন সিরাজুর রহমানের এই 'উদ্দেশ্যমূলক মিথ্যাচারের' বিবরণটিও তাঁর বইয়ে লিপিবদ্ধ করেন। তার আগেই এই বিবরণ বঙ্গবন্ধুর কানে পেঁৗছে গিয়েছিল। সুতরাং তাঁর জন্য একটি উচ্চপদ সৃষ্টি করে সেই পদে তাঁকে বসানো বঙ্গবন্ধুর একান্ত ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সম্ভব হয়নি।
তখন থেকেই বঙ্গবন্ধু, তাঁর পরিবার ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে সিরাজুর রহমানের রাগ একেবারে প্রতিহিংসায় পরিণত হয়েছে। শশাঙ্ক শেখর ব্যানার্জির বই থেকে এই ঘটনাটির উল্লেখ করলেই আমার পাঠকদের পক্ষেও আসল সিরাজ চরিত্র অনুধাবন করা সহজ হবে।
(শেষাংশ আগামী মঙ্গলবার)
লন্ডন, ২৫ জুলাই, সোমবার, ২০১১
No comments