সবার জন্য শিক্ষা এবং বাস্তবতা by আবুল কাসেম হায়দার
বাংলাদেশের পরিসংখ্যান ব্যুরোর মতে বর্তমানে দেশে দরিদ্রের হার ৩১.৫ শতাংশ। ১৯৭০ সালে এই সংখ্যা ছিল ৮০ শতাংশের বেশি। দারিদ্র্য নিরসনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বেশ অগ্রসরমান একটি দেশ। বিভিন্ন মত এবং সূত্র অনুযায়ী এ তথ্য সঠিক নয় বলে অনেকের দাবি। সূত্র মতে, দারিদ্র্যের সংখ্যা এখনো বাংলাদেশে ৪১ শতাংশের মতো হবে। এর পরও বলা যায়, বাংলাদেশের দারিদ্র্যের হার ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে।
সরকার ২০১৫ সালের মধ্যে সবার জন্য শিক্ষা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। দেশের নতুন প্রজন্মেও সব জনশক্তিকে শিক্ষিত করে গড়ে তোলার বিশাল পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সরকার। ২০১৫ সালের মধ্যে সবাইকে শিক্ষার আওতায় আনা কি সম্ভব হবে?
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চিত্র : বাংলাদেশে ৮৬ হাজার গ্রাম রয়েছে। এই ৮৬ হাজার গ্রামের মধ্যে ১৬ হাজার ১৪২টি গ্রামে এখন পর্যন্ত কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই। শিক্ষার আলো এই ১৬ হাজার ১৪২টি গ্রামে প্রবেশ করতে পারছে না। এসব গ্রামে বেসরকারি উদ্যোগেও কোনো প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা নেই। তাহলে আমরা বুঝতে পারছি, কী অন্ধকার জগতে আমাদের বিশাল জনগোষ্ঠী রয়েছে।
সরকারের নতুন উদ্যোগ : প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নীতিমালা অনুযায়ী সরকার সারা দেশে মাত্র এক হাজার ৫০০টি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। সরকার কর্তৃক নির্বাচিত দেড় হাজার গ্রামে দুই কিলোমিটার দূরত্বে এই এক হাজার ৫০০ প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হবে। বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে মোট ১০ ধরনের প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে, যার সংখ্যা ৮১ হাজার ৪৩৪টি। এর মধ্যে মোট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৩৭ হাজার ৬৭২টি, নিবন্ধিত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ২০ হাজার ১০৭টি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা তিন হাজার ১৮৬টি। সরকারি রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা বর্তমানে প্রায় এক কোটি ৮০ লাখ। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল ২৮ হাজার ১০৬টি। বর্তমানে এই সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৩৭ হাজার ৬৭২টি।
প্রাথমিক বিদ্যালয়_কতিপয় সমস্যা : বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষার বহু সমস্যা রয়েছে। কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সমস্যা সম্পর্কে আমরা এ প্রবন্ধে কিছুটা আলোচনা করব_
১. স্কুলে শিশুবান্ধব পরিবেশের অভাব : প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে পড়াশোনার জন্য শিশুবান্ধব পরিবেশ নেই। ছাত্রছাত্রীদের বসার স্থান, বিশুদ্ধ পানি, টয়লেট প্রভৃতি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে নেই বললেই চলে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ১৩ শতাংশ স্কুলে বিশুদ্ধ পানির জন্য টিউবওয়েল নেই। টয়লেট নেই প্রায় ৫০ শতাংশ প্রাথমিক স্কুলে। ছাত্রছাত্রীদের জন্য শিক্ষার পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে চেয়ার, টেবিল, ব্ল্যাকবোর্ড ও বেঞ্চের পাশাপাশি শিশুদের জন্য বিনোদন এবং মানসিক বিকাশের জন্য খেলার মাঠ ও ফুলের বাগান থাকা দরকার। কিন্তু গ্রামের ২২ শতাংশ বিদ্যালয়ে খেলার মাঠ নেই। আবার কোথাও মাঠ থাকলেও খেলার উপযোগী মাঠ নেই।
২. শিক্ষকদের দায়িত্ব পালন : নতুন শিক্ষানীতি-২০১০ অনুযায়ী, একজন শিক্ষকের সাপ্তাহিক কর্মঘণ্টা হচ্ছে ৩৬ ঘণ্টা। পাঠদান ১৮ ঘণ্টা, শিক্ষার্থী পরিচালনা ও সংশোধন ৬ ঘণ্টা, অনুশীলনী তৈরি ৮ ঘণ্টা এবং অন্যান্য কাজ ৪ ঘণ্টা। অনেক শিক্ষক এই সময়সূচি পালন করেন না, যদিও তাঁদের দেখাশোনার জন্য প্রতিটি উপজেলায় একজন করে শিক্ষা কর্মকর্তা রয়েছেন। আবার, তিনিও ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করেন না। দায়িত্ব পালন না করার জন্য কোনো জবাবদিহিতার ব্যবস্থা থাকলেও কার্যকর নয়। তাই প্রাথমিক শিক্ষার মান নেই বললেই চলে। আবার এসব শিক্ষককে দিয়ে বাড়তি বেশ কিছু কাজ বিভিন্ন সময় সরকারসহ অন্যান্য সংস্থা করিয়ে থাকে। যেমন, জাতীয় এবং স্থানীয় নির্বাচন, টিকা খাওয়ানো, উপবৃত্তি, আদমশুমারি প্রভৃতি। তাই দেখা যায়, সব শিক্ষক নিয়মিত পাঠদান করতে পারেন না বা করেন না।
৩. প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের খাবার ও স্বাস্থ্যের মান : গ্রামাঞ্চলে সরকারি-বেসরকারি সব স্কুলেই শিক্ষার্থী আসে দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে। তাদের মধ্যে ৫৫ শতাংশ শিশুই অপুষ্টির শিকার। ৫৬ শতাংশ শিশু রয়েছে, যাদের ওজন প্রয়োজনের তুলনায় কম। দেখা যায়, অধিকাংশ শিশুর ভিটামিন 'এ'-র অভাব রয়েছে। লৌহ এবং আয়োডিনের অভাব অনেক বেশি। ক্ষুধা এবং অপুষ্টির কারণে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ হওয়ার আগেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৩৩ শতাংশ এবং ইবতেদায়ি মাদ্রাসার ৪৩ শতাংশ সুবিধাবঞ্চিত দরিদ্র পরিবারের সন্তান ঝরে পড়ে। প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ বিশ্বের অনেক দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এক বেলা খাবারের ব্যবস্থা রয়েছে। এ ব্যবস্থা চালু করা খুবই প্রয়োজন। অপুষ্টি এবং ঝরে পড়া বন্ধ করতে হলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দুপুরে টিফিন বা খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
দুর্নীতির কবলে প্রাথমিক শিক্ষা : সব সরকারেরই বিভিন্ন উদ্যোগকে ধ্বংস করে দিচ্ছে দুর্নীতি। নানা রকম অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা কার্যক্রম শ্লথ গতিতে রূপ নিয়েছে। শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও কর্মশালার নামে কোটি কোটি টাকা বিভিন্নভাবে আত্মসাৎ করছেন কর্মচারীরা। কমিশনের নামে কর্মকর্তারা বিদেশ ভ্রমণে ব্যস্ত রয়েছেন। এতে দেশের কোটি কোটি টাকা অপচয় হচ্ছে। কিন্তু এই বিদেশ ভ্রমণ দেশের শিক্ষার মানোন্নয়নে কোনো ভূমিকা রাখেনি। এমন কর্মকর্তাও রয়েছেন, যাঁরা ইতিমধ্যে সাত-আট বার প্রশিক্ষণের নামে বিভিন্ন দেশ ঘুরে এসেছেন। সরকারকে শক্ত হাতে দুর্নীতি দমন করার জন্য এগিয়ে আসতে হবে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। দেশের বিশাল এক জনগোষ্ঠী শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। জাতিকে শিক্ষিত করতে না পারলে কোনোক্রমেই দারিদ্র্য দূর করা যাবে না। কয়েকটি বিষয়ে এ প্রবন্ধে পরামর্শ রাখার চেষ্টা করব_
১. সরকারের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা : সরকার পরিকল্পনা করে ভালো, কিন্তু বাস্তবায়ন খুবই দুর্বল। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। যে ১৬ হাজার ১৪২টি গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই, সেখানে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কার্যকর পরিকল্পনা এবং বাজেট বরাদ্দ করতে হবে। সরকার প্রাথমিক শিক্ষার সার্বিক উন্নয়নের জন্য মাত্র সাড়ে ৫৮ হাজার কোটি টাকার এক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। ২০১৬ সালের জুলাই মাসের মধ্যে এই কর্মসূচি সমাপ্ত হবে। কিন্তু সব গ্রামে শিক্ষার আলো পেঁৗছানোর কর্মসূচি এতে নেই। এই কর্মসূচিকে বর্ধিত করে সবার জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।
২. ধনীদের এগিয়ে আসা : দেশের অশিক্ষা-দারিদ্র্য দূর করার জন্য সরকারের পাশাপাশি ধনী ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসতে হবে। সরকার এ ব্যাপারে বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারে। ধনী ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানকে একটি সুযোগ দেওয়া যেতে পারে এই মর্মে_যে পরিমাণ অর্থ প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা এবং পরিচালনার জন্য খরচ হবে, তা সম্পূর্ণ আয়কর মুক্ত করা হবে। তাহলে অনেক ধনী ব্যক্তি এ খাতে দান করতে এগিয়ে আসবেন। দেশে বর্তমানে ১৬ হাজার ১৪২টি গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সরকারকে অত্যন্ত জরুরি একটি জাতীয় প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। এই প্রকল্পে ৮ হাজার ৭১টি গ্রামকে নিতে হবে। সারাদেশ থেকে ৮ হাজার ৭১ জন ধনী ব্যক্তিকে খুঁজে বের করতে হবে, যাঁরা প্রত্যেকে একেকটি গ্রামে একটি করে প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এবং পরিচালনা করার জন্য এগিয়ে আসবেন। এসব ব্যক্তিকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দিতে হবে।
৩. এনজিওগুলোকে আরো কাজ করতে হবে : দেশের মাত্র কয়েকটি এনজিও শিক্ষা কার্যক্রম চালাচ্ছে। সরকার পরিকল্পিতভাবে আরো এনজিওকে প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালানোর জন্য উৎসাহিত করতে পারে। অবশিষ্ট ৮ হাজার ৭১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার লক্ষ্যে এনজিওগুলোকে এক বা একাধিক প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনে রাজি করানোর জন্য বিশেষ কর্মসূচি নিতে হবে। এনজিও ব্যুরোর মাধ্যমে এ কাজটি শুরু করলে চলতি বছরের মধ্যে ৮ হাজার ৭১টি গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন এবং পরিচালনার ব্যবস্থা করা যাবে। এ জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে।
৪. দুর্নীতিমুক্ত প্রাথমিক শিক্ষা : আমরা সমাজ থেকে দুর্নীতি নির্মূল করতে চাই। তাই সমাজের শিক্ষার প্রাথমিক স্তর হচ্ছে প্রাইমারি শিক্ষা বিভাগ। শিক্ষার এই স্তর থেকে প্রথমে দুর্নীতি দূর করতে হবে। কিভাবে এটা দূর করা যাবে? উপায় হচ্ছে, মন্ত্রী মহোদয় থেকে সর্বনিম্নে শ্রমিককে প্রথমে প্রতিজ্ঞা করতে হবে_'আমরা অন্যায় করব না, দুর্নীতি করব না, রাষ্ট্রের সম্পদ দখলের চেষ্টা করব না, অন্যের হক নষ্ট বা দখলের চেষ্টা করব না'। তবেই দুর্নীতি কিছুটা হলেও কমবে। এভাবে সবার পক্ষ থেকে চেষ্টা শুরু হলে দুর্নীতি অবশ্যই হ্রাস পাবে। আসুন, আমরা সবাই প্রতিজ্ঞা করি, 'আমি দুর্নীতি করব না, আমি অন্যায় করব না, আমি ঘুষ গ্রহণ করব না'। তবেই আমাদের দায়িত্ব পালন করা হবে। দুর্নীতির খবর পেলে সরকারকে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। আইনের দরবারে সবাইকে অর্পণ করতে হবে। আইনের ফাঁক দিয়ে যাতে কোনো দুর্নীতিবাজ বাঁচতে না পারে, সেদিকে সব সময় নজর রাখতে হবে।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা, চেয়ারম্যান, ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি ও সাবেক সহ-সভাপতি, এফবিসিসিআই
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চিত্র : বাংলাদেশে ৮৬ হাজার গ্রাম রয়েছে। এই ৮৬ হাজার গ্রামের মধ্যে ১৬ হাজার ১৪২টি গ্রামে এখন পর্যন্ত কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই। শিক্ষার আলো এই ১৬ হাজার ১৪২টি গ্রামে প্রবেশ করতে পারছে না। এসব গ্রামে বেসরকারি উদ্যোগেও কোনো প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা নেই। তাহলে আমরা বুঝতে পারছি, কী অন্ধকার জগতে আমাদের বিশাল জনগোষ্ঠী রয়েছে।
সরকারের নতুন উদ্যোগ : প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নীতিমালা অনুযায়ী সরকার সারা দেশে মাত্র এক হাজার ৫০০টি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। সরকার কর্তৃক নির্বাচিত দেড় হাজার গ্রামে দুই কিলোমিটার দূরত্বে এই এক হাজার ৫০০ প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হবে। বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে মোট ১০ ধরনের প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে, যার সংখ্যা ৮১ হাজার ৪৩৪টি। এর মধ্যে মোট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৩৭ হাজার ৬৭২টি, নিবন্ধিত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ২০ হাজার ১০৭টি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা তিন হাজার ১৮৬টি। সরকারি রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা বর্তমানে প্রায় এক কোটি ৮০ লাখ। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল ২৮ হাজার ১০৬টি। বর্তমানে এই সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৩৭ হাজার ৬৭২টি।
প্রাথমিক বিদ্যালয়_কতিপয় সমস্যা : বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষার বহু সমস্যা রয়েছে। কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সমস্যা সম্পর্কে আমরা এ প্রবন্ধে কিছুটা আলোচনা করব_
১. স্কুলে শিশুবান্ধব পরিবেশের অভাব : প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে পড়াশোনার জন্য শিশুবান্ধব পরিবেশ নেই। ছাত্রছাত্রীদের বসার স্থান, বিশুদ্ধ পানি, টয়লেট প্রভৃতি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে নেই বললেই চলে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ১৩ শতাংশ স্কুলে বিশুদ্ধ পানির জন্য টিউবওয়েল নেই। টয়লেট নেই প্রায় ৫০ শতাংশ প্রাথমিক স্কুলে। ছাত্রছাত্রীদের জন্য শিক্ষার পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে চেয়ার, টেবিল, ব্ল্যাকবোর্ড ও বেঞ্চের পাশাপাশি শিশুদের জন্য বিনোদন এবং মানসিক বিকাশের জন্য খেলার মাঠ ও ফুলের বাগান থাকা দরকার। কিন্তু গ্রামের ২২ শতাংশ বিদ্যালয়ে খেলার মাঠ নেই। আবার কোথাও মাঠ থাকলেও খেলার উপযোগী মাঠ নেই।
২. শিক্ষকদের দায়িত্ব পালন : নতুন শিক্ষানীতি-২০১০ অনুযায়ী, একজন শিক্ষকের সাপ্তাহিক কর্মঘণ্টা হচ্ছে ৩৬ ঘণ্টা। পাঠদান ১৮ ঘণ্টা, শিক্ষার্থী পরিচালনা ও সংশোধন ৬ ঘণ্টা, অনুশীলনী তৈরি ৮ ঘণ্টা এবং অন্যান্য কাজ ৪ ঘণ্টা। অনেক শিক্ষক এই সময়সূচি পালন করেন না, যদিও তাঁদের দেখাশোনার জন্য প্রতিটি উপজেলায় একজন করে শিক্ষা কর্মকর্তা রয়েছেন। আবার, তিনিও ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করেন না। দায়িত্ব পালন না করার জন্য কোনো জবাবদিহিতার ব্যবস্থা থাকলেও কার্যকর নয়। তাই প্রাথমিক শিক্ষার মান নেই বললেই চলে। আবার এসব শিক্ষককে দিয়ে বাড়তি বেশ কিছু কাজ বিভিন্ন সময় সরকারসহ অন্যান্য সংস্থা করিয়ে থাকে। যেমন, জাতীয় এবং স্থানীয় নির্বাচন, টিকা খাওয়ানো, উপবৃত্তি, আদমশুমারি প্রভৃতি। তাই দেখা যায়, সব শিক্ষক নিয়মিত পাঠদান করতে পারেন না বা করেন না।
৩. প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের খাবার ও স্বাস্থ্যের মান : গ্রামাঞ্চলে সরকারি-বেসরকারি সব স্কুলেই শিক্ষার্থী আসে দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে। তাদের মধ্যে ৫৫ শতাংশ শিশুই অপুষ্টির শিকার। ৫৬ শতাংশ শিশু রয়েছে, যাদের ওজন প্রয়োজনের তুলনায় কম। দেখা যায়, অধিকাংশ শিশুর ভিটামিন 'এ'-র অভাব রয়েছে। লৌহ এবং আয়োডিনের অভাব অনেক বেশি। ক্ষুধা এবং অপুষ্টির কারণে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ হওয়ার আগেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৩৩ শতাংশ এবং ইবতেদায়ি মাদ্রাসার ৪৩ শতাংশ সুবিধাবঞ্চিত দরিদ্র পরিবারের সন্তান ঝরে পড়ে। প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ বিশ্বের অনেক দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এক বেলা খাবারের ব্যবস্থা রয়েছে। এ ব্যবস্থা চালু করা খুবই প্রয়োজন। অপুষ্টি এবং ঝরে পড়া বন্ধ করতে হলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দুপুরে টিফিন বা খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
দুর্নীতির কবলে প্রাথমিক শিক্ষা : সব সরকারেরই বিভিন্ন উদ্যোগকে ধ্বংস করে দিচ্ছে দুর্নীতি। নানা রকম অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা কার্যক্রম শ্লথ গতিতে রূপ নিয়েছে। শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও কর্মশালার নামে কোটি কোটি টাকা বিভিন্নভাবে আত্মসাৎ করছেন কর্মচারীরা। কমিশনের নামে কর্মকর্তারা বিদেশ ভ্রমণে ব্যস্ত রয়েছেন। এতে দেশের কোটি কোটি টাকা অপচয় হচ্ছে। কিন্তু এই বিদেশ ভ্রমণ দেশের শিক্ষার মানোন্নয়নে কোনো ভূমিকা রাখেনি। এমন কর্মকর্তাও রয়েছেন, যাঁরা ইতিমধ্যে সাত-আট বার প্রশিক্ষণের নামে বিভিন্ন দেশ ঘুরে এসেছেন। সরকারকে শক্ত হাতে দুর্নীতি দমন করার জন্য এগিয়ে আসতে হবে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। দেশের বিশাল এক জনগোষ্ঠী শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। জাতিকে শিক্ষিত করতে না পারলে কোনোক্রমেই দারিদ্র্য দূর করা যাবে না। কয়েকটি বিষয়ে এ প্রবন্ধে পরামর্শ রাখার চেষ্টা করব_
১. সরকারের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা : সরকার পরিকল্পনা করে ভালো, কিন্তু বাস্তবায়ন খুবই দুর্বল। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। যে ১৬ হাজার ১৪২টি গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই, সেখানে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কার্যকর পরিকল্পনা এবং বাজেট বরাদ্দ করতে হবে। সরকার প্রাথমিক শিক্ষার সার্বিক উন্নয়নের জন্য মাত্র সাড়ে ৫৮ হাজার কোটি টাকার এক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। ২০১৬ সালের জুলাই মাসের মধ্যে এই কর্মসূচি সমাপ্ত হবে। কিন্তু সব গ্রামে শিক্ষার আলো পেঁৗছানোর কর্মসূচি এতে নেই। এই কর্মসূচিকে বর্ধিত করে সবার জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।
২. ধনীদের এগিয়ে আসা : দেশের অশিক্ষা-দারিদ্র্য দূর করার জন্য সরকারের পাশাপাশি ধনী ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসতে হবে। সরকার এ ব্যাপারে বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারে। ধনী ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানকে একটি সুযোগ দেওয়া যেতে পারে এই মর্মে_যে পরিমাণ অর্থ প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা এবং পরিচালনার জন্য খরচ হবে, তা সম্পূর্ণ আয়কর মুক্ত করা হবে। তাহলে অনেক ধনী ব্যক্তি এ খাতে দান করতে এগিয়ে আসবেন। দেশে বর্তমানে ১৬ হাজার ১৪২টি গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সরকারকে অত্যন্ত জরুরি একটি জাতীয় প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। এই প্রকল্পে ৮ হাজার ৭১টি গ্রামকে নিতে হবে। সারাদেশ থেকে ৮ হাজার ৭১ জন ধনী ব্যক্তিকে খুঁজে বের করতে হবে, যাঁরা প্রত্যেকে একেকটি গ্রামে একটি করে প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এবং পরিচালনা করার জন্য এগিয়ে আসবেন। এসব ব্যক্তিকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দিতে হবে।
৩. এনজিওগুলোকে আরো কাজ করতে হবে : দেশের মাত্র কয়েকটি এনজিও শিক্ষা কার্যক্রম চালাচ্ছে। সরকার পরিকল্পিতভাবে আরো এনজিওকে প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালানোর জন্য উৎসাহিত করতে পারে। অবশিষ্ট ৮ হাজার ৭১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার লক্ষ্যে এনজিওগুলোকে এক বা একাধিক প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনে রাজি করানোর জন্য বিশেষ কর্মসূচি নিতে হবে। এনজিও ব্যুরোর মাধ্যমে এ কাজটি শুরু করলে চলতি বছরের মধ্যে ৮ হাজার ৭১টি গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন এবং পরিচালনার ব্যবস্থা করা যাবে। এ জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে।
৪. দুর্নীতিমুক্ত প্রাথমিক শিক্ষা : আমরা সমাজ থেকে দুর্নীতি নির্মূল করতে চাই। তাই সমাজের শিক্ষার প্রাথমিক স্তর হচ্ছে প্রাইমারি শিক্ষা বিভাগ। শিক্ষার এই স্তর থেকে প্রথমে দুর্নীতি দূর করতে হবে। কিভাবে এটা দূর করা যাবে? উপায় হচ্ছে, মন্ত্রী মহোদয় থেকে সর্বনিম্নে শ্রমিককে প্রথমে প্রতিজ্ঞা করতে হবে_'আমরা অন্যায় করব না, দুর্নীতি করব না, রাষ্ট্রের সম্পদ দখলের চেষ্টা করব না, অন্যের হক নষ্ট বা দখলের চেষ্টা করব না'। তবেই দুর্নীতি কিছুটা হলেও কমবে। এভাবে সবার পক্ষ থেকে চেষ্টা শুরু হলে দুর্নীতি অবশ্যই হ্রাস পাবে। আসুন, আমরা সবাই প্রতিজ্ঞা করি, 'আমি দুর্নীতি করব না, আমি অন্যায় করব না, আমি ঘুষ গ্রহণ করব না'। তবেই আমাদের দায়িত্ব পালন করা হবে। দুর্নীতির খবর পেলে সরকারকে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। আইনের দরবারে সবাইকে অর্পণ করতে হবে। আইনের ফাঁক দিয়ে যাতে কোনো দুর্নীতিবাজ বাঁচতে না পারে, সেদিকে সব সময় নজর রাখতে হবে।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা, চেয়ারম্যান, ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি ও সাবেক সহ-সভাপতি, এফবিসিসিআই
No comments