স্বাগত সোনিয়া গান্ধী-দুই প্রতিবেশীর সুসম্পর্কই আমাদের কাম্য

ভারতের ক্ষমতাসীন ইউনাইটেড প্রোগ্রেসিভ অ্যালায়েন্স (ইউপিএ) এবং কংগ্রেস দলের প্রধান সোনিয়া গান্ধী গতকাল দুই দিনের এক সফরে বাংলাদেশে এসেছেন। তিনি এখানে অটিজম সম্মেলনে যোগদানের পাশাপাশি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অনন্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে যে 'স্বাধীনতা সম্মাননা' প্রদান করা হচ্ছে, তা গ্রহণ করবেন। তিনি প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর পুত্রবধূ। আমরা তাঁর এ সফরকে স্বাগত জানাই।


ভারত ও বাংলাদেশ একই ঐতিহ্যের অধিকারী দুটি প্রতিবেশী দেশ। সৎ প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক বিদ্যমান থাকা এই উভয় দেশের জন্যই জরুরি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর থেকে কয়েক দশক ধরে সেই সম্পর্ক খুবই শীতল ছিল। ফলে দুটি দেশের মধ্যে অনেক সমস্যাই অমীমাংসিত রয়ে গেছে। আশা করা যায়, সোনিয়া গান্ধীর বর্তমান সফর দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্কের এই শীতলতা কাটিয়ে ওঠার পথ দেখাবে এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের আসন্ন বাংলাদেশ সফরের মধ্য দিয়ে তা পূর্ণতা পাবে। কারণ সোনিয়া গান্ধী সরাসরি ভারতের ক্ষমতায় না থাকলেও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা তাঁকেই দেশটির ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু মনে করেন। কাজেই তাঁর এ সফরকে শুধু দুই দেশের বিশ্লেষকরাই নন, আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সফর হিসেবেই দেখছেন।
অনেক বিলম্বে হলেও ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সম্মাননা প্রদানের মাধ্যমে এ সত্যই প্রকাশিত হয়েছে, আমরা অকৃতজ্ঞ নই। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী এবং তার দোসরদের অত্যাচার-নিপীড়ন সইতে না পেরে প্রায় এক কোটি মানুষ ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। ভারতের অর্থনৈতিক অবস্থাও তখন আজকের মতো এতটা ভালো ছিল না। এর পরও দীর্ঘ ৯ মাস ধরে এক কোটি শরণার্থীকে ভরণ-পোষণের অত্যন্ত কঠিন দায়িত্বটি পালন করেছে ভারতের সরকার ও জনগণ। পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সরবরাহ করা, বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারকে সব ধরনের সহায়তা করা, জাতিসংঘ ও কূটনৈতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের যৌক্তিকতা তুলে ধরাসহ অনেক কাজই করতে হয়েছে ভারত সরকারকে। শেষ দিকে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীও যৌথ কমান্ডের অংশ হিসেবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে, জীবন দিয়ে যুদ্ধ করেছে। আর এ সবই সম্ভব হয়েছে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর অসীম মানবিক মূল্যবোধ, কূটনৈতিক দক্ষতা ও তৎপরতা এবং বাংলাদেশের প্রতি ভালোবাসার কারণে। তিনি ছিলেন তাঁর পিতা ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহর লাল নেহরুর মতোই উদারমনা ও বিচক্ষণ এক রাজনৈতিক নেতা। বাংলাদেশের দুর্গত মানুষকে স্বচক্ষে দেখার জন্য তিনি একের পর এক শরণার্থী শিবির ঘুরে বেড়িয়েছেন, তাদের মধ্যে খাবার বিতরণ করেছেন এবং খোঁজখবর নিয়েছেন। শুধু তা-ই নয়, স্বাধীন বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে পরিচিত করানো এবং দেশটির পক্ষে স্বীকৃতি আদায়ের জন্য তিনি দুনিয়া চষে বেড়িয়েছেন। কাজেই তৎকালীন ভারত সরকার, ভারতীয় জনগণ এবং ব্যক্তি ইন্দিরা গান্ধীর কাছে আমরা অনেকভাবেই ঋণী। তাঁর জীবদ্দশায় আমরা যদি তাঁকে এ সম্মাননা জানাতে পারতাম, তাহলেই সবচেয়ে ভালো হতো। এর পরও এ সম্মাননা প্রদানের মাধ্যমে জাতি আজ এক গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য পালন করল।
বাংলাদেশের তিন দিকেই ভারত। ফলে দুটি দেশের মধ্যে রয়েছে বিশাল সীমান্ত এলাকা, রয়েছে কিছু অমীমাংসিত সমস্যা। তার ওপর দুটি দেশই উন্নয়নকামী। কাজেই দেশ দুটি যদি পরস্পরের হাত ধরাধরি করে এগিয়ে যেতে পারে, তাহলেই উন্নয়ন সর্বাধিক গতি পাবে। আর সে জন্য চাই বন্ধুত্বপূর্ণ ও সৎ প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও ইতিবাচক মনোভাব এবং আলোচনার মাধ্যমে সব সমস্যা সমাধানে আগ্রহ। মুজিব-ইন্দিরা চুক্তিতে অনেক সমস্যারই সমাধান ছিল। কিন্তু বিভিন্ন সময় দুই দেশের সম্পর্কের অবনতির কারণে সেগুলোর বাস্তবায়ন থেমে গিয়েছিল। আমরা চাই, মুজিব-ইন্দিরা চুক্তিকে ভিত্তি ধরে দেশ দুটি পর্যায়ক্রমে বিদ্যমান সব সমস্যারই সমাধান করবে। প্রয়োজনে নতুন নতুন চুক্তিতে উপনীত হবে এবং কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বিশ্বায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করবে।

No comments

Powered by Blogger.