ভারত-রুশদি-তসলিমা ফের রাজনীতির ইস্যু by পার্থ চট্টোপাধ্যায়
মৌলবাদীরা রাজনীতিতে তাদের চাপ ক্রমশ শক্ত করে তুলতে বদ্ধপরিকর। তারা বেছে নিয়েছে সালমান রুশদি ও শেষে তসলিমাকে। কারণ এই মুহূর্তে ভারতে সাম্প্রদায়িক জিগির তোলার মতো আর কোনো ইস্যু নেই। গত জানুয়ারির শেষে জয়পুর সাহিত্য সম্মেলনে সালমান রুশদিকে ঢুকতে দেয়নি এই শক্তি।
এখন এদের আক্রমণের লক্ষ্য তসলিমা। ভারত সরকার কি এবারও তসলিমাকে বিদায় দেবে? তসলিমা নাসরিন আবার ফিরে এলেন। না, সাময়িক নির্বাসন থেকে ভারতে তিনি ফিরে এসেছেন বেশ কিছুদিন হলো। কিন্তু চুপচাপ বাস করছিলেন দিলি্লতে। ছয় মাসের ভারতীয় ভিসা পেয়েছিলেন তিনি। শর্ত ছিল, কোনো বিতর্কের মধ্যে না জড়িয়ে চুপচাপ লক্ষ্মীটি হয়ে থাকলে ভারত সরকার তার ভিসার মেয়াদ ছয় মাস ছয় মাস করে বাড়াতে পারে।
তসলিমার খুব ইচ্ছা ছিল কলকাতা বইমেলা পরিদর্শনের। এর আগে তিনি আগের মতো আবার কলকাতায় পাকাপাকিভাবে থাকার আবেদন জানিয়েছিলেন। ২০০৭ সালে কলকাতা থেকে রাতারাতি উৎখাত হতে হয় তাকে। তার এবার আশা ছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি নিজেকে 'মুক্তচিন্তার' মানুষ বলে দাবি করেন আর ২০১১ সালে ভোটের সময় তসলিমা আগ বাড়িয়ে মমতার সমর্থনে আনন্দবাজার পত্রিকার প্রথম পাতায় একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন, সেই মমতা ক্ষমতায় এসে তাকে ফুলের মালা দিয়ে কলকাতায় অভ্যর্থনা জানাবেন। এমন একটি আশা নিয়ে দু'বছর নির্বাসনে থাকার পর আবার ভারতে এসেছিলেন তসলিমা। তসলিমা তার ইউরোপে নির্বাসনের জীবন নিয়ে লিখেছিলেন সদ্য প্রকাশিত বই 'নির্বাসন'। কোনো বড় প্রকাশক এমনকি তার এককালের পৃষ্ঠপোষক আনন্দবাজার গোষ্ঠীও তার বই ছাপতে সাহস করেনি। 'নির্বাসন' তাই ছেপেছে এক অনামি প্রকাশক 'পিপলস বুক সোসাইটি'। সেই বইয়ের উদ্বোধন হওয়ার কথা ছিল গত ১ ফেব্রুয়ারি কলকাতা পুস্তক মেলায়। উদ্বোধন করার কথা ছিল অভিনেতা ও নাট্যব্যক্তিত্ব রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তের। কিন্তু রুদ্রপ্রসাদ মেলায় এসে পেঁৗছার আগেই মেলার উদ্যোক্তা পাবলিশার্স অ্যান্ড বুক সেলার্স গিল্ড যে অডিটোরিয়ামে বইটির উদ্বোধন হওয়ার কথা সেটি বন্ধ করে দেয়। কেন? কলকাতা পুলিশ তাদের জানিয়েছে, তসলিমা নাসরিনের বইটি সম্পর্কে কলকাতার কিছু সংখ্যালঘু সংগঠন আপত্তি জানিয়েছে। তারা পুলিশের কর্তাদের সঙ্গে দেখা করে জানিয়েছে, এ বইটি প্রকাশিত হলে কলকাতায় দাঙ্গা বেধে যেতে পারে। সুতরাং পুলিশ কোনো ঝুঁকি নিতে চায় না। উদ্বোধন অনুষ্ঠান এমতাবস্থায় করতে দেওয়া যায় না।
বইটি কিন্তু নিষিদ্ধ হয়নি। কিন্তু এবারের বইমেলা সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট। এটাই বইমেলার নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। যখন যে সরকার ক্ষমতায় তারাই অদৃশ্যে থেকে বইমেলা নিয়ন্ত্রণ করে। আগে যেমন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য নিয়ন্ত্রণ করতেন, এখন মমতা ও তার সরকারের প্রভাব বইমেলার সর্বত্র। এই বিতর্ককে কেন্দ্র করে তসলিমা আবার ২০০৭-এর পর পশ্চিমবঙ্গের খবরের কাগজে প্রধান খবর হয়ে উঠলেন। নির্বাসনের প্রকাশক পিপলস বুক সোসাইটির সামনে পুলিশ পোস্টিং বসে গেল। কিন্তু তা সত্ত্বেও মহাশ্বেতা দেবীর ছেলে সাহিত্যিক নবারুণ ভট্টাচার্য ওই স্টলের সামনে বইটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করলেন।
বাংলাদেশ থেকে নির্বাসিত হওয়ার পর তসলিমা একটি বাংলা প্রকাশনা সংস্থার পৃষ্ঠপোষকতায় ২০০৪ সালে কলকাতায় এসে রাউডন স্ট্রিটে একটি ফ্ল্যাটে পাকাপাকিভাবে বাস করতে থাকেন। তসলিমার ইসলামবিরোধী মন্তব্য ও তার লেখায় খোলাখুলি যৌনতার বর্ণনা অনেক মধ্যবিত্ত পাঠকের বিরক্তির কারণ হলেও শিক্ষিত অনেক মধ্যবিত্ত হিন্দু কলকাতাবাসীর কাছে তসলিমার লেখাগুলো জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তসলিমার 'লজ্জা' ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত হয়। এই বইটিকে নিয়েই তসলিমা বাংলাদেশে সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠেন। কিন্তু এপার বাংলায় বইটি খুবই জনপ্রিয় হয়। যদিও অনেক সমালোচক বইটিকে সাহিত্য হিসেবে খুব দুর্বল বলে মন্তব্য করেন। ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত হয় 'আমার মেয়েবেলা'। ২০০২ সালে 'উতল হাওয়া'। ২০০৩ সালে 'দ্বিখণ্ডিত'। ২০০৪ সালে 'ক' ও 'সেই সব অন্ধকার'। এসব বই-ই প্রথম প্রকাশিত হয় ঢাকায়। পরে সেগুলোর ভারতীয় সংস্করণ একে একে প্রকাশিত হতে থাকে। পশ্চিমবঙ্গে 'দ্বিখণ্ডিত' প্রথম প্রকাশিত হয় ২০০৩ সালে। এ বইটিতে ইসলামবিরোধী মন্তব্য আছে, এ অভিযোগে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কিছু লোক বইটিকে নিষিদ্ধ করার জন্য কলকাতা হাইকোর্টে আবেদন করে। হাইকোর্ট বইটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। এর পাল্টা মামলা দায়ের হলে ২০০৫ সালে বইটির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়।
দশ বছর ধরে ইউরোপের বিভিন্ন শহরে বসবাস করার পর ২০০৪ সাল থেকে তসলিমা কলকাতায় থিতু হয়ে বাস করছিলেন। তিনি বহুবার সবাইকে জানিয়েছেন, কলকাতাকেই তিনি তার স্থায়ী আবাস বলে গ্রহণ করতে চান। যদিও কলকাতায়ও তসলিমা খুব স্বস্তিতে ছিলেন না। তার একসময়ের কবি-সাহিত্যিক বন্ধুরা যারা তাকে নিয়ে প্রথম দিকটায় খুব হইচই করেছিলেন এবং কলকাতার যেসব জনপ্রিয় লেখক তার ফ্ল্যাটে নিয়মিত যাতায়াত করতেন, তাদের বেশিরভাগই বাংলাদেশে 'জনপ্রিয়তা' হারানোর ভয়ে তার সঙ্গ ত্যাগ করেন।
ভারতেও কোনো সভা-সমিতিতে যোগ দিতে হলে তাকে কলকাতা স্পেশাল ব্রাঞ্চের অনুমতি নিতে হয়। মৌলবাদীরা এখানেও তার বিরুদ্ধে লেগেছিল এবং তাকে সর্বদা সিকিউরিটি নিয়ে চলতে হতো।
'দ্বিখণ্ডিত' একটি বিতর্কিত বেস্ট সেলার হিসেবে ভারতের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হতে থাকে। অসমিয়া ভাষায়ও তসলিমার বইয়ের অনুবাদ হয়। কিন্তু সারা ভারতের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া একমাত্র অন্ধ্রপ্রদেশ থেকেই তসলিমার বিরুদ্ধে মৌলবাদীরা সক্রিয় হয়। সেটি ২০০৭ সালের ৯ আগস্ট। তসলিমা গেছেন হায়দ্রাবাদ প্রেস ক্লাবে তেলেগু ভাষায় অনূদিত 'শোধ' বইটির উদ্বোধন করতে। হঠাৎ মজলিশ-ই-ইত্তেহাদুল-মুসলিমিন নামের একটি রাজনৈতিক দলের বিধায়কের নেতৃত্বে ত্রুক্রদ্ধ জনতা এসে চড়াও হয়ে সংবাদ সম্মেলনটি পণ্ড করে দেয়। নিরাপত্তাকর্মীরা তখন তসলিমাকে পেছনের দরজা দিয়ে বাইরে নিয়ে সোজা কলকাতার বিমানে উঠিয়ে দেন।
ঠিক এই কাণ্ডটাই ঘটে কলকাতায়। কলকাতার ১৭ জন মুসলমান নেতা একটি ফতোয়া জারি করে তসলিমাকে কলকাতা ছাড়তে বলেন। তাদের একজন আবার ঘোষণা করেন, তসলিমাকে যে হত্যা করবে তাকে তিনি বহু টাকা পুরস্কার দেবেন। ওই সময় বামফ্রন্ট শাসনের অন্তিমকাল। সিঙ্গুরে মমতার নেতৃত্বে তৃণমূল আন্দোলন দানা বেঁধে উঠছে। রাজ্যে আইন-শৃঙ্খলা আলগা হয়ে এসেছে (আজও তেমনই আছে)। সে সময় একদল সংখ্যালঘু কলকাতার মুসলমান অধ্যুষিত এলাকা পার্ক সার্কাস অঞ্চলে তসলিমাকে কলকাতা থেকে বহিষ্কারের দাবিতে হাঙ্গামা শুরু করে দেয়। তারা গাড়িতে আগুন লাগায়। প্রবল বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করে। মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য পার্টির সঙ্গে পরামর্শ করে কলকাতার এক রাজস্থানী ব্যবসায়ীর সাহায্যে তসলিমাকে রাতারাতি বিমানে উঠিয়ে রাজস্থানে এক অজ্ঞাত জায়গায় পাঠিয়ে দেন। সেটি ২০০৭-এর ২২ আগস্ট। রাজস্থান থেকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রণব মুখার্জির সঙ্গে কথাবার্তা বলে তসলিমাকে দিলি্ল নিয়ে এসে পুলিশ পরিবৃত্ত অবস্থায় একরকম অন্তরীণ করে দিলি্লতে রাখা হয়। তসলিমা চেয়েছিলেন অন্তত কলকাতার ফ্ল্যাট থেকে তিনি তার ব্যক্তিগত জিনিসপত্র যাতে নিয়ে আসতে পারেন সে জন্য একবার যেন তাকে কলকাতায় যেতে দেওয়া হয়। কিন্তু তাকে যেতে দেওয়া হয়নি। তার ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে সেটি সেবার রিনিউ করা হয়নি। তসলিমা আবার ভারত ছাড়েন।
এরপর আবার ভারতে আসার ভিসা পান তসলিমা। এবার তার আশা ছিল, মমতা তাকে সাহায্য করবেন।
কিন্তু ভারতই এখন টালমাটাল। উত্তর প্রদেশের ভোটে সংখ্যালঘুদের সমর্থন পাওয়ার জন্য সব রাজনৈতিক দলই মরিয়া। বিশেষ করে কংগ্রেস যে কোনোভাবে উত্তর প্রদেশের জমি ফিরে পেতে চাইছে। দলিত আর মুসলমানরাই সেখানে নির্বাচনী বৈতরণী পার করার বড় কাণ্ডারি। কংগ্রেস ও মুলায়ম সিং যাদবের এসপি দলের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে কে কত বেশি সংরক্ষণের কোটা বাড়াতে পারে। কংগ্রেসের হয়ে রাহুল ও তার বোন প্রিয়াঙ্কা এখন চরকির মতো ঘুরছেন ইউপিতে। মুলায়ম সিং যাদবের ছেলে অখিলেশ যাদব, যাকে তার সমর্থকরা 'নেতাজি' বলে ডাকে, তিনিও রাহুলের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছেন। মায়াবতীও তার ক্ষমতা ধরে রাখতে মরিয়া। এই ফাঁকে ভারতের মৌলবাদী মুসলমানরা রাজনীতিতে তাদের চাপ ক্রমশ শক্ত করে তুলতে বদ্ধপরিকর। তারা বেছে নিয়েছে সালমান রুশদি ও শেষে তসলিমাকে। কারণ এই মুহূর্তে ভারতে সাম্প্রদায়িক জিগির তোলার মতো আর কোনো ইস্যু নেই।
গত জানুয়ারির শেষে জয়পুর সাহিত্য সম্মেলনে সালমান রুশদিকে ঢুকতে দেয়নি এই শক্তি। এখন এদের আক্রমণের লক্ষ্য তসলিমা। ভারত সরকার কি এবারও তসলিমাকে বিদায় দেবে?
ড. পার্থ চট্টোপাধ্যায় : ভারতীয় সাংবাদিক
তসলিমার খুব ইচ্ছা ছিল কলকাতা বইমেলা পরিদর্শনের। এর আগে তিনি আগের মতো আবার কলকাতায় পাকাপাকিভাবে থাকার আবেদন জানিয়েছিলেন। ২০০৭ সালে কলকাতা থেকে রাতারাতি উৎখাত হতে হয় তাকে। তার এবার আশা ছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি নিজেকে 'মুক্তচিন্তার' মানুষ বলে দাবি করেন আর ২০১১ সালে ভোটের সময় তসলিমা আগ বাড়িয়ে মমতার সমর্থনে আনন্দবাজার পত্রিকার প্রথম পাতায় একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন, সেই মমতা ক্ষমতায় এসে তাকে ফুলের মালা দিয়ে কলকাতায় অভ্যর্থনা জানাবেন। এমন একটি আশা নিয়ে দু'বছর নির্বাসনে থাকার পর আবার ভারতে এসেছিলেন তসলিমা। তসলিমা তার ইউরোপে নির্বাসনের জীবন নিয়ে লিখেছিলেন সদ্য প্রকাশিত বই 'নির্বাসন'। কোনো বড় প্রকাশক এমনকি তার এককালের পৃষ্ঠপোষক আনন্দবাজার গোষ্ঠীও তার বই ছাপতে সাহস করেনি। 'নির্বাসন' তাই ছেপেছে এক অনামি প্রকাশক 'পিপলস বুক সোসাইটি'। সেই বইয়ের উদ্বোধন হওয়ার কথা ছিল গত ১ ফেব্রুয়ারি কলকাতা পুস্তক মেলায়। উদ্বোধন করার কথা ছিল অভিনেতা ও নাট্যব্যক্তিত্ব রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তের। কিন্তু রুদ্রপ্রসাদ মেলায় এসে পেঁৗছার আগেই মেলার উদ্যোক্তা পাবলিশার্স অ্যান্ড বুক সেলার্স গিল্ড যে অডিটোরিয়ামে বইটির উদ্বোধন হওয়ার কথা সেটি বন্ধ করে দেয়। কেন? কলকাতা পুলিশ তাদের জানিয়েছে, তসলিমা নাসরিনের বইটি সম্পর্কে কলকাতার কিছু সংখ্যালঘু সংগঠন আপত্তি জানিয়েছে। তারা পুলিশের কর্তাদের সঙ্গে দেখা করে জানিয়েছে, এ বইটি প্রকাশিত হলে কলকাতায় দাঙ্গা বেধে যেতে পারে। সুতরাং পুলিশ কোনো ঝুঁকি নিতে চায় না। উদ্বোধন অনুষ্ঠান এমতাবস্থায় করতে দেওয়া যায় না।
বইটি কিন্তু নিষিদ্ধ হয়নি। কিন্তু এবারের বইমেলা সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট। এটাই বইমেলার নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। যখন যে সরকার ক্ষমতায় তারাই অদৃশ্যে থেকে বইমেলা নিয়ন্ত্রণ করে। আগে যেমন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য নিয়ন্ত্রণ করতেন, এখন মমতা ও তার সরকারের প্রভাব বইমেলার সর্বত্র। এই বিতর্ককে কেন্দ্র করে তসলিমা আবার ২০০৭-এর পর পশ্চিমবঙ্গের খবরের কাগজে প্রধান খবর হয়ে উঠলেন। নির্বাসনের প্রকাশক পিপলস বুক সোসাইটির সামনে পুলিশ পোস্টিং বসে গেল। কিন্তু তা সত্ত্বেও মহাশ্বেতা দেবীর ছেলে সাহিত্যিক নবারুণ ভট্টাচার্য ওই স্টলের সামনে বইটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করলেন।
বাংলাদেশ থেকে নির্বাসিত হওয়ার পর তসলিমা একটি বাংলা প্রকাশনা সংস্থার পৃষ্ঠপোষকতায় ২০০৪ সালে কলকাতায় এসে রাউডন স্ট্রিটে একটি ফ্ল্যাটে পাকাপাকিভাবে বাস করতে থাকেন। তসলিমার ইসলামবিরোধী মন্তব্য ও তার লেখায় খোলাখুলি যৌনতার বর্ণনা অনেক মধ্যবিত্ত পাঠকের বিরক্তির কারণ হলেও শিক্ষিত অনেক মধ্যবিত্ত হিন্দু কলকাতাবাসীর কাছে তসলিমার লেখাগুলো জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তসলিমার 'লজ্জা' ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত হয়। এই বইটিকে নিয়েই তসলিমা বাংলাদেশে সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠেন। কিন্তু এপার বাংলায় বইটি খুবই জনপ্রিয় হয়। যদিও অনেক সমালোচক বইটিকে সাহিত্য হিসেবে খুব দুর্বল বলে মন্তব্য করেন। ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত হয় 'আমার মেয়েবেলা'। ২০০২ সালে 'উতল হাওয়া'। ২০০৩ সালে 'দ্বিখণ্ডিত'। ২০০৪ সালে 'ক' ও 'সেই সব অন্ধকার'। এসব বই-ই প্রথম প্রকাশিত হয় ঢাকায়। পরে সেগুলোর ভারতীয় সংস্করণ একে একে প্রকাশিত হতে থাকে। পশ্চিমবঙ্গে 'দ্বিখণ্ডিত' প্রথম প্রকাশিত হয় ২০০৩ সালে। এ বইটিতে ইসলামবিরোধী মন্তব্য আছে, এ অভিযোগে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কিছু লোক বইটিকে নিষিদ্ধ করার জন্য কলকাতা হাইকোর্টে আবেদন করে। হাইকোর্ট বইটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। এর পাল্টা মামলা দায়ের হলে ২০০৫ সালে বইটির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়।
দশ বছর ধরে ইউরোপের বিভিন্ন শহরে বসবাস করার পর ২০০৪ সাল থেকে তসলিমা কলকাতায় থিতু হয়ে বাস করছিলেন। তিনি বহুবার সবাইকে জানিয়েছেন, কলকাতাকেই তিনি তার স্থায়ী আবাস বলে গ্রহণ করতে চান। যদিও কলকাতায়ও তসলিমা খুব স্বস্তিতে ছিলেন না। তার একসময়ের কবি-সাহিত্যিক বন্ধুরা যারা তাকে নিয়ে প্রথম দিকটায় খুব হইচই করেছিলেন এবং কলকাতার যেসব জনপ্রিয় লেখক তার ফ্ল্যাটে নিয়মিত যাতায়াত করতেন, তাদের বেশিরভাগই বাংলাদেশে 'জনপ্রিয়তা' হারানোর ভয়ে তার সঙ্গ ত্যাগ করেন।
ভারতেও কোনো সভা-সমিতিতে যোগ দিতে হলে তাকে কলকাতা স্পেশাল ব্রাঞ্চের অনুমতি নিতে হয়। মৌলবাদীরা এখানেও তার বিরুদ্ধে লেগেছিল এবং তাকে সর্বদা সিকিউরিটি নিয়ে চলতে হতো।
'দ্বিখণ্ডিত' একটি বিতর্কিত বেস্ট সেলার হিসেবে ভারতের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হতে থাকে। অসমিয়া ভাষায়ও তসলিমার বইয়ের অনুবাদ হয়। কিন্তু সারা ভারতের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া একমাত্র অন্ধ্রপ্রদেশ থেকেই তসলিমার বিরুদ্ধে মৌলবাদীরা সক্রিয় হয়। সেটি ২০০৭ সালের ৯ আগস্ট। তসলিমা গেছেন হায়দ্রাবাদ প্রেস ক্লাবে তেলেগু ভাষায় অনূদিত 'শোধ' বইটির উদ্বোধন করতে। হঠাৎ মজলিশ-ই-ইত্তেহাদুল-মুসলিমিন নামের একটি রাজনৈতিক দলের বিধায়কের নেতৃত্বে ত্রুক্রদ্ধ জনতা এসে চড়াও হয়ে সংবাদ সম্মেলনটি পণ্ড করে দেয়। নিরাপত্তাকর্মীরা তখন তসলিমাকে পেছনের দরজা দিয়ে বাইরে নিয়ে সোজা কলকাতার বিমানে উঠিয়ে দেন।
ঠিক এই কাণ্ডটাই ঘটে কলকাতায়। কলকাতার ১৭ জন মুসলমান নেতা একটি ফতোয়া জারি করে তসলিমাকে কলকাতা ছাড়তে বলেন। তাদের একজন আবার ঘোষণা করেন, তসলিমাকে যে হত্যা করবে তাকে তিনি বহু টাকা পুরস্কার দেবেন। ওই সময় বামফ্রন্ট শাসনের অন্তিমকাল। সিঙ্গুরে মমতার নেতৃত্বে তৃণমূল আন্দোলন দানা বেঁধে উঠছে। রাজ্যে আইন-শৃঙ্খলা আলগা হয়ে এসেছে (আজও তেমনই আছে)। সে সময় একদল সংখ্যালঘু কলকাতার মুসলমান অধ্যুষিত এলাকা পার্ক সার্কাস অঞ্চলে তসলিমাকে কলকাতা থেকে বহিষ্কারের দাবিতে হাঙ্গামা শুরু করে দেয়। তারা গাড়িতে আগুন লাগায়। প্রবল বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করে। মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য পার্টির সঙ্গে পরামর্শ করে কলকাতার এক রাজস্থানী ব্যবসায়ীর সাহায্যে তসলিমাকে রাতারাতি বিমানে উঠিয়ে রাজস্থানে এক অজ্ঞাত জায়গায় পাঠিয়ে দেন। সেটি ২০০৭-এর ২২ আগস্ট। রাজস্থান থেকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রণব মুখার্জির সঙ্গে কথাবার্তা বলে তসলিমাকে দিলি্ল নিয়ে এসে পুলিশ পরিবৃত্ত অবস্থায় একরকম অন্তরীণ করে দিলি্লতে রাখা হয়। তসলিমা চেয়েছিলেন অন্তত কলকাতার ফ্ল্যাট থেকে তিনি তার ব্যক্তিগত জিনিসপত্র যাতে নিয়ে আসতে পারেন সে জন্য একবার যেন তাকে কলকাতায় যেতে দেওয়া হয়। কিন্তু তাকে যেতে দেওয়া হয়নি। তার ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে সেটি সেবার রিনিউ করা হয়নি। তসলিমা আবার ভারত ছাড়েন।
এরপর আবার ভারতে আসার ভিসা পান তসলিমা। এবার তার আশা ছিল, মমতা তাকে সাহায্য করবেন।
কিন্তু ভারতই এখন টালমাটাল। উত্তর প্রদেশের ভোটে সংখ্যালঘুদের সমর্থন পাওয়ার জন্য সব রাজনৈতিক দলই মরিয়া। বিশেষ করে কংগ্রেস যে কোনোভাবে উত্তর প্রদেশের জমি ফিরে পেতে চাইছে। দলিত আর মুসলমানরাই সেখানে নির্বাচনী বৈতরণী পার করার বড় কাণ্ডারি। কংগ্রেস ও মুলায়ম সিং যাদবের এসপি দলের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে কে কত বেশি সংরক্ষণের কোটা বাড়াতে পারে। কংগ্রেসের হয়ে রাহুল ও তার বোন প্রিয়াঙ্কা এখন চরকির মতো ঘুরছেন ইউপিতে। মুলায়ম সিং যাদবের ছেলে অখিলেশ যাদব, যাকে তার সমর্থকরা 'নেতাজি' বলে ডাকে, তিনিও রাহুলের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছেন। মায়াবতীও তার ক্ষমতা ধরে রাখতে মরিয়া। এই ফাঁকে ভারতের মৌলবাদী মুসলমানরা রাজনীতিতে তাদের চাপ ক্রমশ শক্ত করে তুলতে বদ্ধপরিকর। তারা বেছে নিয়েছে সালমান রুশদি ও শেষে তসলিমাকে। কারণ এই মুহূর্তে ভারতে সাম্প্রদায়িক জিগির তোলার মতো আর কোনো ইস্যু নেই।
গত জানুয়ারির শেষে জয়পুর সাহিত্য সম্মেলনে সালমান রুশদিকে ঢুকতে দেয়নি এই শক্তি। এখন এদের আক্রমণের লক্ষ্য তসলিমা। ভারত সরকার কি এবারও তসলিমাকে বিদায় দেবে?
ড. পার্থ চট্টোপাধ্যায় : ভারতীয় সাংবাদিক
No comments