ঘুষ দুর্নীতি উন্নয়ন অগ্রগতির প্রধান অন্তরায় by ইফতেখার আহমেদ টিপু
দুর্নীতিতে সর্বোচ্চ স্থানটি ছিল বাংলাদেশের। এখন আর বাংলাদেশ সেই অবস্থানে নেই। অনেকটাই উত্তরণ ঘটেছে। এর পরও যা আছে, তাকেও সহনীয় পর্যায় বলার সুযোগ নেই। এখনো ঘুষ দুর্নীতির দুর্বিপাকে আবদ্ধ রয়েছে ১৬ কোটি মানুষের নিয়তি। সরকারের এমন কোনো দপ্তর নেই, যেখানে ঘুষ-উপরির দৌরাত্ম্য নেই।
ঘুষ-দুর্নীতির ভূত তাড়াতে জনগণের ট্যাঙ্রে টাকা খরচ করে যাদের পোষা হয়, তাদের ঘাড়েও ভর করেছে আরো বড় ভূত। ফলে ঘুষ দুর্নীতির প্রতিভূদের ঠেকানোর যেন কেউ নেই। হাসপাতালে শিশু জন্মের সময় প্রসূতির ভর্তি ও যত্ন-আত্তি থেকে শুরু করে মৃত ব্যক্তির কবরের জায়গা কিনতেও ঘুষের প্রয়োজন হয়। লাশ কাটাতেও ঘুষ দিতে হয় ডোমদের। শিক্ষাঙ্গনে ভর্তি, হাসপাতালে চিকিৎসা, পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স, চাকরি লাভ, এমনকি মসজিদ-মন্দিরের জন্য সরকারি অর্থের বরাদ্দ নিতে গেলেও ঘুষ দিতে বাধ্য হয় মানুষ। ঘুষ ছাড়া সরকারি দফতরের সেবা মেলে না, এটি যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন কি বেসরকারি ব্যাংক-বীমার চাকরি ও সেবার জন্যও অপরিহার্য হয়ে উঠেছে ঘুষের লেনদেন। বেসরকারি দাতা সংস্থার সহায়তা নিতেও দিতে হয় উপরি। সময়ের সঙ্গে ঘুষ-উৎকোচের লেনদেন সর্বগ্রাসী আকার ধারণ করছে। দ্রব্যমূল্য বাড়ার অজুহাতে বাড়ছে ঘুষ-উৎকোচের পরিমাণ।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য দুর্নীতি দমন কমিশন গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু নানা বিধিনিষেধের বেড়াজালে প্রায় ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে পড়েছে। দুর্নীতি-সংক্রান্ত চার শতাধিক রিট ও ফৌজদারি মামলা সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন। এগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির সম্ভাবনাও কম। সব মিলিয়ে সর্বশেষ দুর্নীতি পরিস্থিতি বিবেচনা করলে দেশে দুর্নীতি কমেছে বলা কঠিন। দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের মানুষকে সবচেয়ে বেশি ঘুষ দিতে হয় বলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) জরিপ প্রকাশ করেছে, জরিপের বিষয় ছিল 'ডেইলি লাইফস অ্যান্ড করাপশন : পাবলিক ওপিনিয়ন ইন সাউথ এশিয়া'। জরিপে অংশগ্রহণকারী বাংলাদেশিদের ৬৬ শতাংশ বলেছেন, সরকারি সেবা পেতে তাঁদের ঘুষ দিতে হয়। ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ও শ্রীলঙ্কায় এই হার যথাক্রমে ৫৪, ৫০, ৩২ ও ২৩ শতাংশ। বাংলাদেশের সেবাপ্রার্থীদের মধ্যে ৭৫ শতাংশ বলেছেন, পুলিশকে তাঁদের ঘুষ দিতে হয়। এরপর দ্বিতীয় অবস্থানে আছে বিচার বিভাগ। ঘুষ প্রদানকারীদের মধ্যে ৬৬ শতাংশ নিয়েই শীর্ষে আছে বাংলাদেশ। এরপর আছে ভারত (৫৪ শতাংশ) ও পাকিস্তান (৫০ শতাংশ)। জরিপকারীদের মধ্যে ৬২ শতাংশ মনে করেন দুর্নীতি বেড়েছে। ঘুষ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে ভারতসহ বিভিন্ন দেশে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হলেও বাংলাদেশে তেমন তৎপরতা দেখা যায় না। সরকার এ ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে ঘুষ-দুর্নীতি বন্ধ হবে কী করে? দিন দিন সরকারের সব বিভাগেই ঘুষ-দুর্নীতি বাড়ছে। ঘুষ-দুর্নীতি হচ্ছে জাতীয় সমস্যা। এটাকে দলীয় দৃষ্টিতে না দেখে দলমত-নির্বিশেষে সবার উচিত এর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তোলা। এর বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপের পাশাপাশি সামাজিক আন্দোলনও গড়ে তুলতে হবে। ঘুষ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে নাগরিক সচেতনতাও বাড়ানো প্রয়োজন।
ঘুষ-দুর্নীতি জাতিগতভাবে আমাদের উন্নয়ন-অগ্রগতির প্রধান অন্তরায়। বিশ্বের যেসব দেশ অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভরতা অর্জন করেছে, তাদের মধ্যে দুর্নীতির প্রবণতা কম। আমাদের দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলমান। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন, ঘুষ হলো কবিরা গুনাহ। যে গুনাহ আল্লাহর দরবারে মাফ হবে না। এটা জেনেও কিভাবে ঘুষ প্রবণতা চলে? আসলে এ দেশে নৈতিক অবক্ষয়ের মাত্রা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে দিন দিন। এর অন্যতম কারণ শিক্ষাজীবনের শুরু থেকেই নৈতিক শিক্ষা প্রদানের ঘাটতি। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় নৈতিক শিক্ষার অনুপস্থিতি খুব বেশি মাত্রায় পরিলক্ষিত হচ্ছে।
সরকারি অফিসে প্রতিবছর শত শত কোটি টাকার দুর্নীতি ও অনিয়ম ধরা পড়লেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে এর দায়-দায়িত্ব নিরূপণ এবং দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। দুর্নীতির হোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকায় বারবার তাদের অপকর্মের পুনরাবৃত্তি ঘটে। বাংলাদেশের দুর্নীতি ও অনিয়মের যে মহোৎসব বছরের পর বছর ধরে চলছে তার পেছনে এ কারণটিই প্রধানত দায়ী বলে মনে করা হয়। দুর্নীতির কুশীলবরা এতই শক্তিশালী যে, অনিয়ম নিষ্পত্তির আগেই তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যায়। অন্য অফিসে গিয়েও পুরনো সহযোগীদের সহায়তায় অনিয়মের তথ্য-উপাত্ত নষ্ট করে ফেলতে সক্ষম হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আর্থিক অনিয়মের হোতাদের শাস্তির আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের অঙ্গীকার সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জোরদার হলেও সরকারি অফিসগুলোতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত না হওয়ায় তা কোনো কাজে আসছে না। দুর্নীতিবাজদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়ছে সমগ্র জাতি। দেশের সুনাম এবং জাতীয় অগ্রগতির জন্য তারা বিড়ম্বনা ডেকে আনছে। বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে সরকারি অফিসের কার্যক্রম নিরীক্ষার ব্যবস্থা আরো জোরদার এবং জবাবদিহিতার মধ্যে আনার ব্যবস্থা নিতে হবে।
ঘুষ-উৎকোচ-উপরি যে নামেই অভিহিত করা হোক না কেন এটি এখন বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান সমস্যা। সততার সংকট যেভাবে জাতিকে গ্রাস করে চলেছে তাতে উদ্বিগ্ন না হয়ে পারা যায় না। এ ধারা চলতে থাকলে জাতির নৈতিক মূল্যবোধ বিপর্যস্ত অবস্থার মুখে পড়বে। তার আগেই ঘুষ-উৎকোচ-উপরির বিরুদ্ধে দেশবাসীকে সচেতন হতে হবে। শুধু প্রতিবাদ নয়, প্রতিরোধের মানসিকতা নিয়ে জেগে উঠতে হবে। এটি এখন সময়েরই দাবি।
লেখক : সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক নবরাজ, চেয়ারম্যান, ইফাদ গ্রুপ
chairman@ifadgroup.com
দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য দুর্নীতি দমন কমিশন গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু নানা বিধিনিষেধের বেড়াজালে প্রায় ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে পড়েছে। দুর্নীতি-সংক্রান্ত চার শতাধিক রিট ও ফৌজদারি মামলা সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন। এগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির সম্ভাবনাও কম। সব মিলিয়ে সর্বশেষ দুর্নীতি পরিস্থিতি বিবেচনা করলে দেশে দুর্নীতি কমেছে বলা কঠিন। দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের মানুষকে সবচেয়ে বেশি ঘুষ দিতে হয় বলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) জরিপ প্রকাশ করেছে, জরিপের বিষয় ছিল 'ডেইলি লাইফস অ্যান্ড করাপশন : পাবলিক ওপিনিয়ন ইন সাউথ এশিয়া'। জরিপে অংশগ্রহণকারী বাংলাদেশিদের ৬৬ শতাংশ বলেছেন, সরকারি সেবা পেতে তাঁদের ঘুষ দিতে হয়। ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ও শ্রীলঙ্কায় এই হার যথাক্রমে ৫৪, ৫০, ৩২ ও ২৩ শতাংশ। বাংলাদেশের সেবাপ্রার্থীদের মধ্যে ৭৫ শতাংশ বলেছেন, পুলিশকে তাঁদের ঘুষ দিতে হয়। এরপর দ্বিতীয় অবস্থানে আছে বিচার বিভাগ। ঘুষ প্রদানকারীদের মধ্যে ৬৬ শতাংশ নিয়েই শীর্ষে আছে বাংলাদেশ। এরপর আছে ভারত (৫৪ শতাংশ) ও পাকিস্তান (৫০ শতাংশ)। জরিপকারীদের মধ্যে ৬২ শতাংশ মনে করেন দুর্নীতি বেড়েছে। ঘুষ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে ভারতসহ বিভিন্ন দেশে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হলেও বাংলাদেশে তেমন তৎপরতা দেখা যায় না। সরকার এ ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে ঘুষ-দুর্নীতি বন্ধ হবে কী করে? দিন দিন সরকারের সব বিভাগেই ঘুষ-দুর্নীতি বাড়ছে। ঘুষ-দুর্নীতি হচ্ছে জাতীয় সমস্যা। এটাকে দলীয় দৃষ্টিতে না দেখে দলমত-নির্বিশেষে সবার উচিত এর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তোলা। এর বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপের পাশাপাশি সামাজিক আন্দোলনও গড়ে তুলতে হবে। ঘুষ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে নাগরিক সচেতনতাও বাড়ানো প্রয়োজন।
ঘুষ-দুর্নীতি জাতিগতভাবে আমাদের উন্নয়ন-অগ্রগতির প্রধান অন্তরায়। বিশ্বের যেসব দেশ অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভরতা অর্জন করেছে, তাদের মধ্যে দুর্নীতির প্রবণতা কম। আমাদের দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলমান। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন, ঘুষ হলো কবিরা গুনাহ। যে গুনাহ আল্লাহর দরবারে মাফ হবে না। এটা জেনেও কিভাবে ঘুষ প্রবণতা চলে? আসলে এ দেশে নৈতিক অবক্ষয়ের মাত্রা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে দিন দিন। এর অন্যতম কারণ শিক্ষাজীবনের শুরু থেকেই নৈতিক শিক্ষা প্রদানের ঘাটতি। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় নৈতিক শিক্ষার অনুপস্থিতি খুব বেশি মাত্রায় পরিলক্ষিত হচ্ছে।
সরকারি অফিসে প্রতিবছর শত শত কোটি টাকার দুর্নীতি ও অনিয়ম ধরা পড়লেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে এর দায়-দায়িত্ব নিরূপণ এবং দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। দুর্নীতির হোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকায় বারবার তাদের অপকর্মের পুনরাবৃত্তি ঘটে। বাংলাদেশের দুর্নীতি ও অনিয়মের যে মহোৎসব বছরের পর বছর ধরে চলছে তার পেছনে এ কারণটিই প্রধানত দায়ী বলে মনে করা হয়। দুর্নীতির কুশীলবরা এতই শক্তিশালী যে, অনিয়ম নিষ্পত্তির আগেই তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যায়। অন্য অফিসে গিয়েও পুরনো সহযোগীদের সহায়তায় অনিয়মের তথ্য-উপাত্ত নষ্ট করে ফেলতে সক্ষম হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আর্থিক অনিয়মের হোতাদের শাস্তির আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের অঙ্গীকার সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জোরদার হলেও সরকারি অফিসগুলোতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত না হওয়ায় তা কোনো কাজে আসছে না। দুর্নীতিবাজদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়ছে সমগ্র জাতি। দেশের সুনাম এবং জাতীয় অগ্রগতির জন্য তারা বিড়ম্বনা ডেকে আনছে। বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে সরকারি অফিসের কার্যক্রম নিরীক্ষার ব্যবস্থা আরো জোরদার এবং জবাবদিহিতার মধ্যে আনার ব্যবস্থা নিতে হবে।
ঘুষ-উৎকোচ-উপরি যে নামেই অভিহিত করা হোক না কেন এটি এখন বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান সমস্যা। সততার সংকট যেভাবে জাতিকে গ্রাস করে চলেছে তাতে উদ্বিগ্ন না হয়ে পারা যায় না। এ ধারা চলতে থাকলে জাতির নৈতিক মূল্যবোধ বিপর্যস্ত অবস্থার মুখে পড়বে। তার আগেই ঘুষ-উৎকোচ-উপরির বিরুদ্ধে দেশবাসীকে সচেতন হতে হবে। শুধু প্রতিবাদ নয়, প্রতিরোধের মানসিকতা নিয়ে জেগে উঠতে হবে। এটি এখন সময়েরই দাবি।
লেখক : সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক নবরাজ, চেয়ারম্যান, ইফাদ গ্রুপ
chairman@ifadgroup.com
No comments