ঢাকা সিটি করপোরেশন-এবার চাই দুজন প্রধানমন্ত্রী! by মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর
ঢাকার পর্বতপ্রমাণ সমস্যার কীভাবে সমাধান করতে হবে, বর্তমান সরকার তার একটা লাগসই পথ বের করেছে। সেটি হলো, ঢাকা সিটি করপোরেশনকে দুই ভাগ করে ‘ঢাকা উত্তর’ ও ‘ঢাকা দক্ষিণ’ নামে দুজন মেয়রের অধীনে ঢাকা সিটি করপোরেশনের পুনর্বিন্যাস। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এতে বিপুল জনসংখ্যা-অধ্যুষিত রাজধানী ঢাকার সমস্যা মোকাবিলা করা সহজ হবে।
সত্যিই, লাগসই সমাধান!! ঢাকা সিটি করপোরেশন তথা ঢাকাবাসীর সব সেবামূলক চাহিদা দুজন মেয়র মেটাতে পারলে বর্তমান সরকার বিরাট কৃতিত্বের দাবি করতে পারবে। এই সাফল্যের (যদি হয়) সূত্র ধরে সরকার বাংলাদেশের পর্বতপ্রমাণ সমস্যার সমাধানের জন্য ‘দুজন প্রধানমন্ত্রী’র প্রস্তাবও করতে পারে। বিপুল জনসংখ্যা-অধ্যুষিত বাংলাদেশের সমস্যার সমাধান যেহেতু একজন প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না, কাজেই দুজন প্রধানমন্ত্রী হওয়াই ভালো হবে। বলা বাহুল্য, সংসদীয় নির্বাচনের মাধ্যমেই দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হবেন। সরকার ‘উপপ্রধানমন্ত্রী’ পদ সৃষ্টি করতে চাইলে আমি একমত হব না। কারণ, তাহলে তো সরকার ‘ডেপুটি মেয়র’ পদ সৃষ্টি করতে পারত। যেসব যুক্তিতে সরকার দুটি মেয়র পদ সৃষ্টি করছে, একই যুক্তিতে দুটি প্রধানমন্ত্রী পদও হতে পারে। হওয়া উচিত। বিপুল জনসংখ্যা ও সমস্যার সমাধান দুই ক্ষেত্রেই একই যুক্তি প্রযোজ্য।
আর ‘দুই প্রধানমন্ত্রী’ পদ সৃষ্টি করে দেশ শাসন করে যদি দেশের অবস্থার পরিবর্তন করা যায়, বহুমুখী সমস্যার সমাধান করা যায়, তাহলে বর্তমান সরকার, আওয়ামী লীগ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সারা বিশ্বে প্রশংসিত হবেন। সুশাসনের এ রকম মৌলিক মডেল আর কোনো দেশ দিতে পারেনি। এবার যুবলীগ শেখ হাসিনার ‘শান্তির মডেল’-এর সঙ্গে ‘প্রশাসনিক মডেল’-এর বার্তা নিয়েও পৃথিবীর নানা দেশে সফর করতে পারবে।
রাজধানী ঢাকার প্রশাসনব্যবস্থার দুর্বলতা, সিটি করপোরেশনের ক্ষমতা ও অর্থের সীমাবদ্ধতা নিয়ে গত দুই দশকে অসংখ্য সেমিনার হয়েছে। বহু লেখালেখি ও টিভি টক শোতে এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বহু বিশেষজ্ঞ, রাজনীতিবিদ, গবেষক, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি এতে অংশ নিয়েছেন। স্থানীয় সরকার বিষয়ে আমার বিশেষ আগ্রহ আছে বলে এই বিষয়ের আলোচনায় আমি শ্রোতা হিসেবে অংশ নিই। মনে পড়ে না, কোন সভায় ঢাকার জন্য দুজন মেয়রের প্রস্তাব করা হয়েছে। কেউ করলেও তা সভায় গুরুত্ব লাভ করেনি। তবে দুজন ডেপুটি মেয়রের প্রস্তাব অনেকে করেছেন।
বর্তমান সরকারের মন্ত্রিসভা এ রকম একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত কীভাবে নিল, তা আমি জানি না। কোনো গবেষণা, প্রকাশ্য জনমত জরিপ, ব্যাপক মতবিনিময়, সংসদে বিতর্ক, প্রধান বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনা—কিছুই চোখে পড়েনি। এটা তো আওয়ামী লীগের কোনো দলীয় সিদ্ধান্ত নয়। এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত। শুধু মন্ত্রিসভার সদস্যদের খেয়ালখুশিতে বা প্রধানমন্ত্রীর একক আগ্রহে (অন্যরা সুর মিলিয়েছে) এত বড় সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হয়নি। এটা গণতান্ত্রিক মনোভাব ও সুশাসনের অঙ্গীকারের প্রতিফলন নয়।
অনেকে বলতে পারেন, ‘দুই মেয়র কাজ করার আগেই তুমি এর সমালোচনা করছো কেন?’ খুব সংগত প্রশ্ন। আমি সমালোচনা করছি প্রধানত আমার বিবেচনা বোধ থেকে। দ্বিতীয়ত, আমি সমালোচনা করছি সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াটি পার্টিসিপেটরি হয়নি বলে। কোনো বিশেষজ্ঞ এর পক্ষে কিছু বলেননি। বরং অন্য কথা বলেছেন, অন্য দেশে এমন ব্যবস্থা নেই। তা ছাড়া, ডিসিসির মূল সমস্যা মেয়র পদের সংখ্যায় নয়। মূল সমস্যা অন্যত্র এবং তা বহু। দুজন মেয়র নির্বাচিত হলেই মূল সমস্যাগুলো আপনাআপনি সমাধান হয়ে যাবে না। এ জন্যই আমি সমালোচনা করছি।
প্রথমে মন্ত্রিসভা বা একটি দায়িত্বপ্রাপ্ত কমিটিকে চিহ্নিত করতে হবে, ডিসিসির মূল সমস্যাগুলো কী কী? ডিসিসির কাছে জনগণের প্রত্যাশা কী কী? তারপর দেখতে হবে, এর সমাধান কী? সমাধানের ‘প্রস্তাব’ নিয়ে বিশেষজ্ঞসহ বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে মতবিনিময় করতে হবে। বেশির ভাগ স্টেকহোল্ডার যেসব বিষয়ে সম্মতি দেবেন, (শতভাগ একমত হওয়া সম্ভব নয়) সেগুলোই মন্ত্রিসভা বাস্তবায়ন করলে সঠিক কাজ হতো। বেশির ভাগ মহল দুই মেয়র পদ সমর্থন করবে, এটা আমার মনে হয় না। তবে করতেও তো পারে। সে ক্ষেত্রে দুই মেয়র পদ মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই।
আমাদের একক নেতানির্ভর ও দূষিত রাজনীতির একটা বড় সমস্যা হলো, তারা বিশেষজ্ঞ মতামত বা স্টেকহোল্ডারদের মতামত তোয়াক্কা করে না। তাদের বিশেষজ্ঞ হচ্ছে ‘দলীয় সেবাদাস বিশেষজ্ঞ’, যারা নেত্রীর সুরে কথা বলবে (দুই বড় দলের ক্ষেত্রেই এ কথা প্রযোজ্য)। স্বাধীন বিশেষজ্ঞ মতামত দুই দলই তেমন পছন্দ করে না। বড় দুটি দল কোনো বিষয়ে স্বাধীন মতামত জানতেও খুব আগ্রহী নয়।
সরকার যখন সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছে, তখন এর বাস্তবায়ন করা কঠিন হবে না। কারণ, এর বিরুদ্ধে কোনো আন্দোলন হবে না। এসব বিষয় নিয়ে খুব কম লোকই মাথা ঘামায়। এটা তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-বেতন বাড়ার মতো বিষয় নয়। ক্যাম্পাস উত্তপ্ত হতে পারে, এমন কোনো সঠিক সিদ্ধান্তও মন্ত্রিসভা সাধারণত নেয় না। কারণ, তাঁরা জানেন, এর পরিণাম কী! ডিসিসির জন্য দুজন কেন, পাঁচজন মেয়রের পদ সৃষ্টি হলেই বা সংগ্রামী ছাত্রদের কী-ই বা এসে যায়। কাজেই প্রায় কোনো সোচ্চার প্রতিবাদ ছাড়াই (হরতাল, মিছিল, অগ্নিসংযোগ) এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হবে।
বিষয়টা এখন সর্বত্র আলোচিত হচ্ছে, তাই আলোচনার সুবিধার্থে আমি ডিসিসির সমস্যা ও সমাধান সম্পর্কে কয়েকটি কথা বলতে চাই। এটা একটি বড় গবেষণার বিষয়। তবু কয়েক লাইনে বিষয়টা লিখছি শুধু পাঠককে সমস্যাটি সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা দেওয়ার জন্য। সমস্যাটি কত বড়, তা অনুধাবন করার জন্য।
ঢাকা সিটি করপোরেশন একটি ঢাল-তলোয়ারবিহীন নিধিরাম সর্দার। কিছু উন্নয়নমূলক কাজ ও নগরের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ছাড়া বড় মাপের কোনো কাজ করার ক্ষমতা ও বাজেট ডিসিসির নেই। ঢাকা শহরের মানুষকে নানামুখী সেবা দেওয়ার জন্য ৫৬টি প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। এই ৫৬টি প্রতিষ্ঠান ১০টি মন্ত্রণালয়ের অধীন। এর কোনোটির ওপর ডিসিসির কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। বিভিন্ন সংস্থা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়কে জবাবদিহি করে। কারও ওপর মেয়র খবরদারি করতে পারেন না। কাজেই ঢাকার মানুষকে সেবা দেওয়ার কোনো একক ‘কর্তৃপক্ষ’ গড়ে ওঠেনি। মেয়রের ওপর রয়েছে মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রী। মন্ত্রীও নির্বাচিত, মেয়রও নির্বাচিত। মন্ত্রী ওই মন্ত্রিত্বের জন্য নির্বাচিত নন। মেয়র মেয়র পদের জন্য নির্বাচিত। অথচ এই ‘নির্বাচিত’ মেয়র মন্ত্রীর অধীন। অদ্ভুত ব্যবস্থা!
রাজউক, ওয়াসা, ডেসা, পুলিশ, সড়ক বিভাগ নগরের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ। অথচ এর একটির ওপরও মেয়রের কর্তৃত্ব নেই। মেয়রের কথা শুনতে তারা বাধ্য নয়। তারা জবাবদিহি করে ভিন্ন ভিন্ন মন্ত্রণালয়ে।
ডিসিসির বাজেট আর লোকবলও সীমিত। এক কোটি ২০ লাখ মানুষকে সেবা দিতে হলে যে বাজেট, লোকবল, শাখা অফিস, ডেপুটি মেয়র (অন্তত দুজন) ও প্রযুক্তিগত সুবিধা দরকার, তার ২৫ শতাংশও ডিসিসির নেই। এক কোটিরও কম লোকসংখ্যা নিয়ে পৃথিবীতে বহু দেশ আছে। তাদের প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রীও আছে। বিরাট বাজেট আছে। তার তুলনায় ঢাকার অবস্থা কী? লোকসংখ্যা কিন্তু অনেক দেশের মতোই। আমরা কি রাজধানী ঢাকাকে একটি ‘দেশের’ মতো করে ভাবতে পেরেছি? আমাদের ভাবনারও এত দৈন্য যে আমরা রাজধানী ঢাকাকে তার প্রত্যাশিত অবয়বে ভাবতে পারি না। এই ভাবনার অভাব ও অতিমাত্রায় কেন্দ্রশাসিত প্রশাসনব্যবস্থায় অভ্যস্ত বলে আমরা ঢাকার জন্য আলাদা প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার কথা চিন্তা করি না বা করতে পারি না। এটা একটা বড় মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা।
রাজধানী ঢাকাকে যদি একটি গতিশীল শহরে রূপান্তর করতে হয়, যদি আগামী ৫০ বছরের লক্ষ্য নিয়ে এর পরিকল্পনা, ডিজাইন, অবকাঠামো নির্মাণ করতে হয়, এক কোটি ৫০ লাখ লোককে (ভবিষ্যতে) সুষ্ঠুভাবে সেবা দেওয়ার জন্য সব সেবামূলক প্রতিষ্ঠানকে ঢেলে সাজাতে হয়, তাহলে ঢাকার প্রশাসনিক কাঠামো নিয়ে গবেষণা, মতামত বিনিময়, বিশেষজ্ঞ পরামর্শ ও বিদেশের কয়েকটি বড় শহরের প্রশাসনিক ব্যবস্থা স্টাডি করা দরকার। আমাদের কাছাকাছি দিল্লি (দিল্লির একজন মুখ্যমন্ত্রী রয়েছেন), মেট্রো ম্যানিলা ও টোকিও শহর আমরা পর্যবেক্ষণ করতে পারি। এই তিনটি শহর পর্যবেক্ষণ করলেই আমরা ঢাকার জন্য অনেক ধারণা পাব। নতুন করে গবেষণাও করতে হবে না।
এই ইস্যুতে মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন হলো: ঢাকার প্রশাসনিক প্রধান কে হবেন—এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে বিভিন্ন মত রয়েছে। মতগুলো হলো: (১) রাজধানী ঢাকা পরিচালিত হবে ‘সিটি গভর্নমেন্ট’ দ্বারা। প্রতিটি সেবা সংস্থা এই সরকারের অধীনে থাকবে। (২) ঢাকার জন্য একজন মেয়র, দুজন ডেপুটি মেয়র থাকবেন। (৩) ঢাকার প্রশাসনিক প্রধান হবেন রাজধানীবিষয়ক একটি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী (মনে রাখা দরকার, দিল্লির একজন মুখ্যমন্ত্রী আছেন। মন্ত্রী আরও ছোট পদ)। (৪) মেয়রকে মন্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে সব সেবামূলক প্রতিষ্ঠান ডিসিসির অধীনে রাখতে হবে।
আলাপ-আলোচনা ও অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতার আলোকে এই সমস্যার সমাধান বের করতে হবে। তবে দুজন কেন, ১০ জন ক্ষমতাহীন মেয়র দিয়েও ঢাকার বহুমুখী সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়।
ডিসিসির বর্তমান মেয়র সাদেক হোসেন খোকা ডিসিসি সংস্কারের ব্যাপারে গত আড়াই বছরে এ ব্যাপারে নানা কাজ করতে পারতেন। গবেষণা, মতামত বিনিময় ও স্টাডি ট্যুরের কাজটা এত দিনে সম্পন্ন করতে পারতেন। তিনি বর্তমান সরকার, বিরোধী দল, জাতীয় সংসদ ও জনগণের সামনে একটি কার্যকর সিটি গভর্নমেন্টের রূপরেখা দিয়ে যেতে পারতেন। সেই কাজটি তিনি করলেন না। সরকার তাঁর (অনেকের মতামতসমৃদ্ধ) রূপরেখা গ্রহণ হয়তো করত না। কিন্তু তাঁর রিপোর্টে যদি যুক্তি থাকত এবং বাস্তবসম্মত সুপারিশ হতো, তাহলে জনগণ তা গ্রহণ করত। এটা কম সাফল্য হতো না। কিন্তু তিনি সে পথে যাননি।
এখন প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভা ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কোর্টে বল। তাঁরা কীভাবে খেলবেন, জনগণ তা দেখার প্রতীক্ষায়।
তাই বলে নাগরিক সমাজের চুপ করে থাকা উচিত হবে না। ওসমানী উদ্যানের কয়েকটি গাছ রক্ষার জন্য যদি নাগরিক সমাজ আন্দোলন করতে পারে, তাহলে সেই তুলনায় ঢাকা সিটি করপোরেশন তথা ঢাকার প্রশাসনিক ব্যবস্থা অনেক বড় ইস্যু নয় কি? আসুন, এ নিয়ে জনমত তৈরি করি।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: উন্নয়নকর্মী ও কলাম লেখক।
সত্যিই, লাগসই সমাধান!! ঢাকা সিটি করপোরেশন তথা ঢাকাবাসীর সব সেবামূলক চাহিদা দুজন মেয়র মেটাতে পারলে বর্তমান সরকার বিরাট কৃতিত্বের দাবি করতে পারবে। এই সাফল্যের (যদি হয়) সূত্র ধরে সরকার বাংলাদেশের পর্বতপ্রমাণ সমস্যার সমাধানের জন্য ‘দুজন প্রধানমন্ত্রী’র প্রস্তাবও করতে পারে। বিপুল জনসংখ্যা-অধ্যুষিত বাংলাদেশের সমস্যার সমাধান যেহেতু একজন প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না, কাজেই দুজন প্রধানমন্ত্রী হওয়াই ভালো হবে। বলা বাহুল্য, সংসদীয় নির্বাচনের মাধ্যমেই দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হবেন। সরকার ‘উপপ্রধানমন্ত্রী’ পদ সৃষ্টি করতে চাইলে আমি একমত হব না। কারণ, তাহলে তো সরকার ‘ডেপুটি মেয়র’ পদ সৃষ্টি করতে পারত। যেসব যুক্তিতে সরকার দুটি মেয়র পদ সৃষ্টি করছে, একই যুক্তিতে দুটি প্রধানমন্ত্রী পদও হতে পারে। হওয়া উচিত। বিপুল জনসংখ্যা ও সমস্যার সমাধান দুই ক্ষেত্রেই একই যুক্তি প্রযোজ্য।
আর ‘দুই প্রধানমন্ত্রী’ পদ সৃষ্টি করে দেশ শাসন করে যদি দেশের অবস্থার পরিবর্তন করা যায়, বহুমুখী সমস্যার সমাধান করা যায়, তাহলে বর্তমান সরকার, আওয়ামী লীগ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সারা বিশ্বে প্রশংসিত হবেন। সুশাসনের এ রকম মৌলিক মডেল আর কোনো দেশ দিতে পারেনি। এবার যুবলীগ শেখ হাসিনার ‘শান্তির মডেল’-এর সঙ্গে ‘প্রশাসনিক মডেল’-এর বার্তা নিয়েও পৃথিবীর নানা দেশে সফর করতে পারবে।
রাজধানী ঢাকার প্রশাসনব্যবস্থার দুর্বলতা, সিটি করপোরেশনের ক্ষমতা ও অর্থের সীমাবদ্ধতা নিয়ে গত দুই দশকে অসংখ্য সেমিনার হয়েছে। বহু লেখালেখি ও টিভি টক শোতে এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বহু বিশেষজ্ঞ, রাজনীতিবিদ, গবেষক, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি এতে অংশ নিয়েছেন। স্থানীয় সরকার বিষয়ে আমার বিশেষ আগ্রহ আছে বলে এই বিষয়ের আলোচনায় আমি শ্রোতা হিসেবে অংশ নিই। মনে পড়ে না, কোন সভায় ঢাকার জন্য দুজন মেয়রের প্রস্তাব করা হয়েছে। কেউ করলেও তা সভায় গুরুত্ব লাভ করেনি। তবে দুজন ডেপুটি মেয়রের প্রস্তাব অনেকে করেছেন।
বর্তমান সরকারের মন্ত্রিসভা এ রকম একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত কীভাবে নিল, তা আমি জানি না। কোনো গবেষণা, প্রকাশ্য জনমত জরিপ, ব্যাপক মতবিনিময়, সংসদে বিতর্ক, প্রধান বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনা—কিছুই চোখে পড়েনি। এটা তো আওয়ামী লীগের কোনো দলীয় সিদ্ধান্ত নয়। এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত। শুধু মন্ত্রিসভার সদস্যদের খেয়ালখুশিতে বা প্রধানমন্ত্রীর একক আগ্রহে (অন্যরা সুর মিলিয়েছে) এত বড় সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হয়নি। এটা গণতান্ত্রিক মনোভাব ও সুশাসনের অঙ্গীকারের প্রতিফলন নয়।
অনেকে বলতে পারেন, ‘দুই মেয়র কাজ করার আগেই তুমি এর সমালোচনা করছো কেন?’ খুব সংগত প্রশ্ন। আমি সমালোচনা করছি প্রধানত আমার বিবেচনা বোধ থেকে। দ্বিতীয়ত, আমি সমালোচনা করছি সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াটি পার্টিসিপেটরি হয়নি বলে। কোনো বিশেষজ্ঞ এর পক্ষে কিছু বলেননি। বরং অন্য কথা বলেছেন, অন্য দেশে এমন ব্যবস্থা নেই। তা ছাড়া, ডিসিসির মূল সমস্যা মেয়র পদের সংখ্যায় নয়। মূল সমস্যা অন্যত্র এবং তা বহু। দুজন মেয়র নির্বাচিত হলেই মূল সমস্যাগুলো আপনাআপনি সমাধান হয়ে যাবে না। এ জন্যই আমি সমালোচনা করছি।
প্রথমে মন্ত্রিসভা বা একটি দায়িত্বপ্রাপ্ত কমিটিকে চিহ্নিত করতে হবে, ডিসিসির মূল সমস্যাগুলো কী কী? ডিসিসির কাছে জনগণের প্রত্যাশা কী কী? তারপর দেখতে হবে, এর সমাধান কী? সমাধানের ‘প্রস্তাব’ নিয়ে বিশেষজ্ঞসহ বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে মতবিনিময় করতে হবে। বেশির ভাগ স্টেকহোল্ডার যেসব বিষয়ে সম্মতি দেবেন, (শতভাগ একমত হওয়া সম্ভব নয়) সেগুলোই মন্ত্রিসভা বাস্তবায়ন করলে সঠিক কাজ হতো। বেশির ভাগ মহল দুই মেয়র পদ সমর্থন করবে, এটা আমার মনে হয় না। তবে করতেও তো পারে। সে ক্ষেত্রে দুই মেয়র পদ মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই।
আমাদের একক নেতানির্ভর ও দূষিত রাজনীতির একটা বড় সমস্যা হলো, তারা বিশেষজ্ঞ মতামত বা স্টেকহোল্ডারদের মতামত তোয়াক্কা করে না। তাদের বিশেষজ্ঞ হচ্ছে ‘দলীয় সেবাদাস বিশেষজ্ঞ’, যারা নেত্রীর সুরে কথা বলবে (দুই বড় দলের ক্ষেত্রেই এ কথা প্রযোজ্য)। স্বাধীন বিশেষজ্ঞ মতামত দুই দলই তেমন পছন্দ করে না। বড় দুটি দল কোনো বিষয়ে স্বাধীন মতামত জানতেও খুব আগ্রহী নয়।
সরকার যখন সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছে, তখন এর বাস্তবায়ন করা কঠিন হবে না। কারণ, এর বিরুদ্ধে কোনো আন্দোলন হবে না। এসব বিষয় নিয়ে খুব কম লোকই মাথা ঘামায়। এটা তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-বেতন বাড়ার মতো বিষয় নয়। ক্যাম্পাস উত্তপ্ত হতে পারে, এমন কোনো সঠিক সিদ্ধান্তও মন্ত্রিসভা সাধারণত নেয় না। কারণ, তাঁরা জানেন, এর পরিণাম কী! ডিসিসির জন্য দুজন কেন, পাঁচজন মেয়রের পদ সৃষ্টি হলেই বা সংগ্রামী ছাত্রদের কী-ই বা এসে যায়। কাজেই প্রায় কোনো সোচ্চার প্রতিবাদ ছাড়াই (হরতাল, মিছিল, অগ্নিসংযোগ) এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হবে।
বিষয়টা এখন সর্বত্র আলোচিত হচ্ছে, তাই আলোচনার সুবিধার্থে আমি ডিসিসির সমস্যা ও সমাধান সম্পর্কে কয়েকটি কথা বলতে চাই। এটা একটি বড় গবেষণার বিষয়। তবু কয়েক লাইনে বিষয়টা লিখছি শুধু পাঠককে সমস্যাটি সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা দেওয়ার জন্য। সমস্যাটি কত বড়, তা অনুধাবন করার জন্য।
ঢাকা সিটি করপোরেশন একটি ঢাল-তলোয়ারবিহীন নিধিরাম সর্দার। কিছু উন্নয়নমূলক কাজ ও নগরের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ছাড়া বড় মাপের কোনো কাজ করার ক্ষমতা ও বাজেট ডিসিসির নেই। ঢাকা শহরের মানুষকে নানামুখী সেবা দেওয়ার জন্য ৫৬টি প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। এই ৫৬টি প্রতিষ্ঠান ১০টি মন্ত্রণালয়ের অধীন। এর কোনোটির ওপর ডিসিসির কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। বিভিন্ন সংস্থা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়কে জবাবদিহি করে। কারও ওপর মেয়র খবরদারি করতে পারেন না। কাজেই ঢাকার মানুষকে সেবা দেওয়ার কোনো একক ‘কর্তৃপক্ষ’ গড়ে ওঠেনি। মেয়রের ওপর রয়েছে মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রী। মন্ত্রীও নির্বাচিত, মেয়রও নির্বাচিত। মন্ত্রী ওই মন্ত্রিত্বের জন্য নির্বাচিত নন। মেয়র মেয়র পদের জন্য নির্বাচিত। অথচ এই ‘নির্বাচিত’ মেয়র মন্ত্রীর অধীন। অদ্ভুত ব্যবস্থা!
রাজউক, ওয়াসা, ডেসা, পুলিশ, সড়ক বিভাগ নগরের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ। অথচ এর একটির ওপরও মেয়রের কর্তৃত্ব নেই। মেয়রের কথা শুনতে তারা বাধ্য নয়। তারা জবাবদিহি করে ভিন্ন ভিন্ন মন্ত্রণালয়ে।
ডিসিসির বাজেট আর লোকবলও সীমিত। এক কোটি ২০ লাখ মানুষকে সেবা দিতে হলে যে বাজেট, লোকবল, শাখা অফিস, ডেপুটি মেয়র (অন্তত দুজন) ও প্রযুক্তিগত সুবিধা দরকার, তার ২৫ শতাংশও ডিসিসির নেই। এক কোটিরও কম লোকসংখ্যা নিয়ে পৃথিবীতে বহু দেশ আছে। তাদের প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রীও আছে। বিরাট বাজেট আছে। তার তুলনায় ঢাকার অবস্থা কী? লোকসংখ্যা কিন্তু অনেক দেশের মতোই। আমরা কি রাজধানী ঢাকাকে একটি ‘দেশের’ মতো করে ভাবতে পেরেছি? আমাদের ভাবনারও এত দৈন্য যে আমরা রাজধানী ঢাকাকে তার প্রত্যাশিত অবয়বে ভাবতে পারি না। এই ভাবনার অভাব ও অতিমাত্রায় কেন্দ্রশাসিত প্রশাসনব্যবস্থায় অভ্যস্ত বলে আমরা ঢাকার জন্য আলাদা প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার কথা চিন্তা করি না বা করতে পারি না। এটা একটা বড় মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা।
রাজধানী ঢাকাকে যদি একটি গতিশীল শহরে রূপান্তর করতে হয়, যদি আগামী ৫০ বছরের লক্ষ্য নিয়ে এর পরিকল্পনা, ডিজাইন, অবকাঠামো নির্মাণ করতে হয়, এক কোটি ৫০ লাখ লোককে (ভবিষ্যতে) সুষ্ঠুভাবে সেবা দেওয়ার জন্য সব সেবামূলক প্রতিষ্ঠানকে ঢেলে সাজাতে হয়, তাহলে ঢাকার প্রশাসনিক কাঠামো নিয়ে গবেষণা, মতামত বিনিময়, বিশেষজ্ঞ পরামর্শ ও বিদেশের কয়েকটি বড় শহরের প্রশাসনিক ব্যবস্থা স্টাডি করা দরকার। আমাদের কাছাকাছি দিল্লি (দিল্লির একজন মুখ্যমন্ত্রী রয়েছেন), মেট্রো ম্যানিলা ও টোকিও শহর আমরা পর্যবেক্ষণ করতে পারি। এই তিনটি শহর পর্যবেক্ষণ করলেই আমরা ঢাকার জন্য অনেক ধারণা পাব। নতুন করে গবেষণাও করতে হবে না।
এই ইস্যুতে মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন হলো: ঢাকার প্রশাসনিক প্রধান কে হবেন—এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে বিভিন্ন মত রয়েছে। মতগুলো হলো: (১) রাজধানী ঢাকা পরিচালিত হবে ‘সিটি গভর্নমেন্ট’ দ্বারা। প্রতিটি সেবা সংস্থা এই সরকারের অধীনে থাকবে। (২) ঢাকার জন্য একজন মেয়র, দুজন ডেপুটি মেয়র থাকবেন। (৩) ঢাকার প্রশাসনিক প্রধান হবেন রাজধানীবিষয়ক একটি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী (মনে রাখা দরকার, দিল্লির একজন মুখ্যমন্ত্রী আছেন। মন্ত্রী আরও ছোট পদ)। (৪) মেয়রকে মন্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে সব সেবামূলক প্রতিষ্ঠান ডিসিসির অধীনে রাখতে হবে।
আলাপ-আলোচনা ও অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতার আলোকে এই সমস্যার সমাধান বের করতে হবে। তবে দুজন কেন, ১০ জন ক্ষমতাহীন মেয়র দিয়েও ঢাকার বহুমুখী সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়।
ডিসিসির বর্তমান মেয়র সাদেক হোসেন খোকা ডিসিসি সংস্কারের ব্যাপারে গত আড়াই বছরে এ ব্যাপারে নানা কাজ করতে পারতেন। গবেষণা, মতামত বিনিময় ও স্টাডি ট্যুরের কাজটা এত দিনে সম্পন্ন করতে পারতেন। তিনি বর্তমান সরকার, বিরোধী দল, জাতীয় সংসদ ও জনগণের সামনে একটি কার্যকর সিটি গভর্নমেন্টের রূপরেখা দিয়ে যেতে পারতেন। সেই কাজটি তিনি করলেন না। সরকার তাঁর (অনেকের মতামতসমৃদ্ধ) রূপরেখা গ্রহণ হয়তো করত না। কিন্তু তাঁর রিপোর্টে যদি যুক্তি থাকত এবং বাস্তবসম্মত সুপারিশ হতো, তাহলে জনগণ তা গ্রহণ করত। এটা কম সাফল্য হতো না। কিন্তু তিনি সে পথে যাননি।
এখন প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভা ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কোর্টে বল। তাঁরা কীভাবে খেলবেন, জনগণ তা দেখার প্রতীক্ষায়।
তাই বলে নাগরিক সমাজের চুপ করে থাকা উচিত হবে না। ওসমানী উদ্যানের কয়েকটি গাছ রক্ষার জন্য যদি নাগরিক সমাজ আন্দোলন করতে পারে, তাহলে সেই তুলনায় ঢাকা সিটি করপোরেশন তথা ঢাকার প্রশাসনিক ব্যবস্থা অনেক বড় ইস্যু নয় কি? আসুন, এ নিয়ে জনমত তৈরি করি।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: উন্নয়নকর্মী ও কলাম লেখক।
No comments