কালের যাত্রা by পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়
মা বলতেন, দেখিস একদিন মানুষ মানুষের মাংস খাবে। শৈশবে শোনা মায়ের সেই কথার অর্থ বুঝিনি। এখন দেখি মায়ের কথাটাই সত্য হচ্ছে। খবরের কাগজ এবং টেলিভিশনে বর্বর মানুষের নৃশংসতায় মানুষকেই নিহত হতে দেখে ভয়ে আঁতকে উঠি। গত ১৭ জুলাই পবিত্র শবেবরাতের রাতে আমিনবাজারে যেভাবে অসহায় নিরস্ত্র ছয় ছাত্রকে গণপিটুনিতে হত্যা করা হলো, তা ভয়াবহ এবং চরম আতঙ্কের। এ নিয়ে পত্রিকায়ই প্রতিদিন কত বাঁকাত্যাড়া খবর পড়ি।
সাংবাদিকতার ছাত্র হিসেবে ইন বিটুইন লাইনসও বোঝার চেষ্টা করি। ব্যক্তিগতভাবে চেনাজানা সূত্র থেকে খোঁজখবর নেওয়ার চেষ্টা করে বিভ্রান্ত হয়েছি। কিন্তু সব কিছুর শেষে এটা সত্য যে মিরপুর দারুস সালামের ছয় নবীন কিশোর আমিনবাজারের বড়দেশী গ্রামের অতিউৎসাহী মানুষদের নিষ্ঠুর গণপিটুনিতে গভীর রাতে পৃথিবী থেকে চিরতরে চলে গেছে। শূন্য হয়েছে মায়ের কোল, খালি পড়ে আছে তাদের পড়ার টেবিল। সহপাঠী আর পাড়া-প্রতিবেশীরা আকস্মিক আঘাত সামলে উঠে স্বাভাবিক হতে পারছে না। দুর্ঘটনা নিয়ে একেক দিন একেক কথা শুনি। প্রথম দিন থেকে পুলিশ বলছে নানা কথা, অন্যরা তো রীতিমতো ফিকশন বানানোর চেষ্টা করছেন। গ্রামবাসীর সম্মিলিত নৃশংসতায় ছয় কিশোরের জীবন রক্ষায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীর ব্যর্থতা কেন সংবিধান পরিপন্থী ও বেআইনি ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট। পুলিশ এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আইনানুগ পদক্ষেপও নেবে দেশের আরো ১০টি ঘটনার ফর্মুলায়। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া একমাত্র কিশোর আল আমিন একেকজনের প্রভাবে একেক রকম কথা বলবে। নেগোসিয়েশন হবে। আন্ডারস্ট্যান্ডিং হবে। একদিন সব আলোচনা, হৈচৈ থিতু হয়ে আসবে। তারপর! থাকে শুধু অন্ধকার! এসব জানি আমার হতাশার কথা। হতাশ না হয়ে করবটা কী! এ রকমই হচ্ছে। এ রকমই তো হয়। গণপিটুনিতে ডাকাতদলের একাধিক সদস্য নিহত হয়। ডাকাতের চোখ উপড়ে নেওয়া হয়, লঞ্চডুবিতে শত শত মানুষ হত্যা করা হয়, বাস-ট্রাকের সংঘর্ষে মানুষ মারা যায়, ইমারত ভাঙার নিরীহ শ্রমিকদের লাশ উদ্ধারের অপেক্ষায় পচে যায়, বহুতল ভবনধসে চাপা পড়ে গরিব মানুষ, মনুষ্য নির্মিত দেয়াল ভেঙে পাহাড়ের মাটিতে জীবন্ত লাশ হয় সাধারণ মানুষ। প্রিয় দেশটাতে যেন মৃত্যুরই কারবার। প্রতিদিন কত বীভৎসতার খবর পড়ে শোকাহত হই। তারপর সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো খবরের পর খবর এসে তা বালুচরের চিহ্নের মতো মিলিয়ে যায়। মাত্র কদিন আগেই মিরসরাইয়ের ভয়াবহ ৪৪ ছাপিয়ে চলে আসে আমিনবাজারের ছয়। গণমাধ্যমই বা কত ফলোআপ খবর প্রকাশ করবে! এত সময়ই বা কোথায়, এত শ্রমই দেবেন কেন সংবাদকর্মী! কর্তৃপক্ষইবা কতবার ছাপবে একই খবর! এটা সত্য। এটাই বাস্তবতা। তবু ক্ষতের দাগ থেকে যায় আমাদের মতো সাধারণ মানুষের মনে। আমিনবাজারেই তো সেতু ভেঙে বাস পড়ল গভীর পানিতে। বেশিদিন তো হয়নি। কত লাশ উদ্ধার হলো। তারপর অসমাপ্ত রেখে ঘোষিত হলো উদ্ধার কাজের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি। বেশিদিন আগের কথা নয়।
বর্ষীয়ান সাংবাদিক এবিএম মূসা আমিনবাজারে ছয় কিশোর নিহত হওয়ার ঘটনাকে 'গণহত্যা' বলেছেন। কথাটির সঙ্গে আমি জানি, অনেকেই একমত হবেন। যে এলাকায় গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে সেই এলাকাটি পুষ্পাচ্ছাদিত মনোরম উদ্যান নয়। এলাকাটি কণ্টকাস্তীর্ণ অনৈতিক অনেক ঘটনার সাক্ষ্য বহনকারী অপরাধপ্রবণ এলাকা। খুনখারাবি, ডাকাতি, মাদক ব্যবসা ইত্যাদি ওই এলাকার স্বাভাবিক ব্যাপার বলে স্বীকার করেছে প্রায় সব মহলই। অতীতে র্যাব এবং পুলিশের সদস্যও ওই এলাকায় জীবন্ত প্রবেশ করে লাশ হয়ে ফিরেছেন। অথচ শুনেছি, এ রকম এক অপরাধপ্রবণ এলাকায় পুলিশ পাহারা থাকে না। কমিউনিটি পুলিশের ব্যবস্থাও নেই। গণমাধ্যমের মাধ্যমে জেনেছি, নিহত ছয় কিশোরকে হত্যা করার জন্য মসজিদের মাইক থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়। মসজিদের ওই মাইকের ঘোষণায় বেরিয়ে আসে শত শত গ্রামবাসী। শত-সহস্রও হতে পারে। তারা লাঠিসোঁটা-অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঘিরে ফেলে ছয় নিরস্ত্র অসহায় পরদেশি কিশোরকে। তারপর সাপ বা শিয়াল পিটিয়ে মারার মতো নরহত্যা। এত মানুষ মাত্র ছয়জনকে মেরে ফেলার আগে জিজ্ঞাসাবাদ পর্যন্ত করল না। ছয় কিশোর তো শত-সহস্রকে মেরে-কেটে ফেলতে পারত না। পারত কি? এই রকম ভাবনা থেকে অন্য রকম গন্ধও পাওয়া যায় যেন। শবেবরাতের পবিত্র রাতে মসজিদের মাইক থেকে ঘোষণা দিয়ে 'গণহত্যা' চালানোর পেছনে অন্য কোনো স্বার্থ নেই তো? তদন্ত হচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি সংস্থার মানুষ প্রতিদিনই আমিনবাজারের বড়দেশী গ্রামে যাচ্ছেন। তদন্তে হয়তো বেরিয়ে আসবে ছোট-বড় নানা জাতের সাপ। কিন্তু এই হত্যাকাণ্ডের বিচার ঠিকঠাক মতো হবে তো? দেশের অনেক অঞ্চলেই গ্রামে গ্রামে 'কাইজ্যা' হয়। ঢাল-সড়কি, তীর-ধনুক নিয়ে মুখোমুখি 'কাইজ্যা' করেন গ্রামবাসী। যেখানে প্রচুর হতাহতও হয়। দা-সড়কি, তীর-বর্শার আঘাতে কে মারা যায়, তা কি আদতেই জানা যায়? আমিনবাজারের ঘটনায় পুলিশ যতই বলুক প্রকৃত দোষীদের শনাক্ত করা গেছে, আসলে তারা ধরাছোঁয়ার বাইরেই হয়তো থেকে যাবে। রাজনীতির খেলাও তো রয়েছে। পূর্বশত্রুতার জের ধরে এই সুযোগে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টাও যে চলবে না, তা-ই বা বলি কী করে! মাদক ব্যবসার আধিপত্য, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা এবং অন্যান্য ধান্ধায় দিনে দিনে ঘটনার আসল চেহারা পাল্টে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। তবে অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পারি, সবচেয়ে বিতিকিচ্ছিরি অবস্থায় পড়বে আল আমিন নামের একমাত্র বেঁচে যাওয়া কিশোরটি, নানা মহলের খেলার ক্রীড়নক হবে সে। ছয়-ছয়টি বন্ধু হারানোর শোক সে ভালো করে অনুভবও করতে পারবে না। এবিএম মূসার ভাষায় 'ভিক্ষা চাই না কুত্তা সামলান' অবস্থা তার ইতিমধ্যেই হয়েছে কি না কে জানে?
বড়দেশী গ্রামের সব মানুষ নৃশংস-বর্বর নিশ্চয়ই নয়। তাদের ভেতরে অনুশোচনা এবং অনুতাপ নিশ্চয়ই প্রবলভাবে কাজ করছে। ওই এলাকায়ও রয়েছেন অনেক মা। রয়েছে নিহত ছয় নবীন কিশোরের মতো সন্তানসন্ততি। তাদের ভাগ্যেও তো এমনটি উল্টো ঘটতে পারত। এই উপলব্ধিটুকু পাকাপোক্ত হোক সারা দেশের মানুষের অন্তরে। পশুত্ব বর্জন করে দেশের মানুষ হয়ে উঠুক মানবিক। যৌক্তিক বিচারে সমাজে সর্বগ্রাহ্য সমাধানে শান্তি আসুক। এর বেশি কী-ই বা আর প্রত্যাশা করতে পারি।
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
বর্ষীয়ান সাংবাদিক এবিএম মূসা আমিনবাজারে ছয় কিশোর নিহত হওয়ার ঘটনাকে 'গণহত্যা' বলেছেন। কথাটির সঙ্গে আমি জানি, অনেকেই একমত হবেন। যে এলাকায় গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে সেই এলাকাটি পুষ্পাচ্ছাদিত মনোরম উদ্যান নয়। এলাকাটি কণ্টকাস্তীর্ণ অনৈতিক অনেক ঘটনার সাক্ষ্য বহনকারী অপরাধপ্রবণ এলাকা। খুনখারাবি, ডাকাতি, মাদক ব্যবসা ইত্যাদি ওই এলাকার স্বাভাবিক ব্যাপার বলে স্বীকার করেছে প্রায় সব মহলই। অতীতে র্যাব এবং পুলিশের সদস্যও ওই এলাকায় জীবন্ত প্রবেশ করে লাশ হয়ে ফিরেছেন। অথচ শুনেছি, এ রকম এক অপরাধপ্রবণ এলাকায় পুলিশ পাহারা থাকে না। কমিউনিটি পুলিশের ব্যবস্থাও নেই। গণমাধ্যমের মাধ্যমে জেনেছি, নিহত ছয় কিশোরকে হত্যা করার জন্য মসজিদের মাইক থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়। মসজিদের ওই মাইকের ঘোষণায় বেরিয়ে আসে শত শত গ্রামবাসী। শত-সহস্রও হতে পারে। তারা লাঠিসোঁটা-অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঘিরে ফেলে ছয় নিরস্ত্র অসহায় পরদেশি কিশোরকে। তারপর সাপ বা শিয়াল পিটিয়ে মারার মতো নরহত্যা। এত মানুষ মাত্র ছয়জনকে মেরে ফেলার আগে জিজ্ঞাসাবাদ পর্যন্ত করল না। ছয় কিশোর তো শত-সহস্রকে মেরে-কেটে ফেলতে পারত না। পারত কি? এই রকম ভাবনা থেকে অন্য রকম গন্ধও পাওয়া যায় যেন। শবেবরাতের পবিত্র রাতে মসজিদের মাইক থেকে ঘোষণা দিয়ে 'গণহত্যা' চালানোর পেছনে অন্য কোনো স্বার্থ নেই তো? তদন্ত হচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি সংস্থার মানুষ প্রতিদিনই আমিনবাজারের বড়দেশী গ্রামে যাচ্ছেন। তদন্তে হয়তো বেরিয়ে আসবে ছোট-বড় নানা জাতের সাপ। কিন্তু এই হত্যাকাণ্ডের বিচার ঠিকঠাক মতো হবে তো? দেশের অনেক অঞ্চলেই গ্রামে গ্রামে 'কাইজ্যা' হয়। ঢাল-সড়কি, তীর-ধনুক নিয়ে মুখোমুখি 'কাইজ্যা' করেন গ্রামবাসী। যেখানে প্রচুর হতাহতও হয়। দা-সড়কি, তীর-বর্শার আঘাতে কে মারা যায়, তা কি আদতেই জানা যায়? আমিনবাজারের ঘটনায় পুলিশ যতই বলুক প্রকৃত দোষীদের শনাক্ত করা গেছে, আসলে তারা ধরাছোঁয়ার বাইরেই হয়তো থেকে যাবে। রাজনীতির খেলাও তো রয়েছে। পূর্বশত্রুতার জের ধরে এই সুযোগে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টাও যে চলবে না, তা-ই বা বলি কী করে! মাদক ব্যবসার আধিপত্য, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা এবং অন্যান্য ধান্ধায় দিনে দিনে ঘটনার আসল চেহারা পাল্টে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। তবে অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পারি, সবচেয়ে বিতিকিচ্ছিরি অবস্থায় পড়বে আল আমিন নামের একমাত্র বেঁচে যাওয়া কিশোরটি, নানা মহলের খেলার ক্রীড়নক হবে সে। ছয়-ছয়টি বন্ধু হারানোর শোক সে ভালো করে অনুভবও করতে পারবে না। এবিএম মূসার ভাষায় 'ভিক্ষা চাই না কুত্তা সামলান' অবস্থা তার ইতিমধ্যেই হয়েছে কি না কে জানে?
বড়দেশী গ্রামের সব মানুষ নৃশংস-বর্বর নিশ্চয়ই নয়। তাদের ভেতরে অনুশোচনা এবং অনুতাপ নিশ্চয়ই প্রবলভাবে কাজ করছে। ওই এলাকায়ও রয়েছেন অনেক মা। রয়েছে নিহত ছয় নবীন কিশোরের মতো সন্তানসন্ততি। তাদের ভাগ্যেও তো এমনটি উল্টো ঘটতে পারত। এই উপলব্ধিটুকু পাকাপোক্ত হোক সারা দেশের মানুষের অন্তরে। পশুত্ব বর্জন করে দেশের মানুষ হয়ে উঠুক মানবিক। যৌক্তিক বিচারে সমাজে সর্বগ্রাহ্য সমাধানে শান্তি আসুক। এর বেশি কী-ই বা আর প্রত্যাশা করতে পারি।
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments