ই-ভোটিং এবং শুদ্ধ নির্বাচনের স্বপ্ন by শাহনেওয়াজ বিপ্লব
বাংলাদেশের মানুষের একটি স্বপ্ন আছে, সেটি শুদ্ধ নির্বাচনের স্বপ্ন। বহুদিন ধরে বাংলাদেশের মানুষ স্বপ্ন দেখেছে একটি বিশুদ্ধ নির্বাচনের। যে নির্বাচনে একটি শুদ্ধ ভোটার তালিকা থাকবে। যে তালিকায় জীবিতকে মৃত বা মৃতকে জীবিত_ঘোষণা করা হবে না। কুমারীর নামের পাশে স্বামী হিসেবে লেখা হবে না বাবার নাম।
তারা স্বপ্ন দেখেছে ভোটাররা যাচ্ছে ভোটকেন্দ্রে, ভোট দিচ্ছে তাদের প্রিয় প্রার্থীকে, তারপর নিরপেক্ষভাবে গণনা হচ্ছে প্রতিটি ভোট এবং ভোটকেন্দ্রেই কেন্দ্রের কর্তা ঘোষণা করছেন নিরপেক্ষ ফলাফল। বাংলাদেশের মানুষের এ স্বপ্ন বাস্তবে কখনো রূপায়িত হয়নি। বাংলাদেশে নির্বাচন মানে এক করুণ প্রহসন। কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে অভিনীত হয়ে থাকে এ রাষ্ট্রীয় নাটক। নির্বাচনে খুনোখুনি, কেন্দ্র দখল, জাল ভোট_এসবের ভেতর বাংলাদেশে শুদ্ধ নির্বাচনের স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেছে। কথা হচ্ছে, বাংলাদেশের মানুষের শুদ্ধ নির্বাচনের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করবে কারা? ক্ষমতায় আছে এখন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। তারা বলছে, তারাই বাস্তবায়ন করতে চায় এ শুদ্ধ নির্বাচনের স্বপ্ন। সে জন্য তারা চালু করতে চায় ই-ভোটিং বা ইলেকট্রনিক ভোটিং। অন্যদিকে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো বলছে, আগামী নির্বাচনে ক্ষমতায় যাওয়া নিশ্চিত করতে ডিজিটাল কারচুপির অংশ হিসেবে আওয়ামী লীগ ইলেকট্রনিক ভোটিং চালু করতে চাইছে। ই-ভোটিং নিয়ে বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর এই পারস্পরিক বিরোধিতা ঠিক কতটা যৌক্তিক, সে বিষয়টাই আলোচনা করতে চাই।
দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ ও পাকিস্তান ছাড়া অন্য সব দেশেই ই-ভোটিং চালু হয়েছে। বাংলাদেশেও আগামী সংসদ নির্বাচনে ই-ভোটিং চালু হবে বলছে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন। তবে এরই মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ই-ভোটিং নিয়ে ব্যাপক মতানৈক্য দেখা দিয়েছে। ই-ভোটিংয়ের পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলো বলছে এই ব্যবস্থায় দ্রুততম সময়ে নির্বাচন সম্পন্ন এবং ফল প্রকাশ করা যায়, আর বিপক্ষের দলগুলো বলছে ই-ভোটিংয়ের মাধ্যমে রেকর্ড পাল্টে দিয়ে ভোট জালিয়াতি চলতে পারে। তাই বিষয়টি সম্পর্কে ধারণা পেতে আমাদের বুঝতে হবে ই-ভোটিং কী? বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন যে ই-ভোটিং মেশিনের প্রস্তাব করেছে, সেই প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ব্যালট পেপারে সিল মেরে ভোট দেওয়ার বদলে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে পছন্দের প্রতীকের পাশে সুইচ টিপে ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা। নির্বাচন কমিশনের মতে, এর ফলে ব্যালট পেপার ছাপানোর ও পরিবহনের খরচ কমবে, ভোটের ফল নির্ভুল হবে, ফল ঘোষণা দ্রুত হবে ইত্যাদি। বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন ই-ভোটিংয়ের পক্ষে অনেক যুক্তি দেখিয়েছে তাদের প্রস্তাবে, কিন্তু তার পরও বলা যায়, ই-ভোটিংয়ের সঙ্গে পেপার ভোটিংয়ের দীর্ঘ বিরোধ ও বিতর্ক রয়েছে। এ রকম বিতর্কের কারণে ইতিমধ্যে জার্মানি, নেদারল্যান্ডস ও আয়ারল্যান্ড ই-ভোটিং পরিহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
জার্মান বিশ্লেষকরা মনে করেন, ব্যালট পেপার নির্বাচন যেভাবে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব, ইলেকট্রনিক ভোটিংয়ে সেভাবে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। কারণ ব্যালট পেপার দৃশ্যমান ও স্পর্শ করা যায়। ব্যালট পেপারের কিছু অংশ চুরি বা ছিনতাই হয়ে যেতে পারে কিন্তু সামগ্রিকভাবে ভোটের ফলাফল এতে পাল্টে ফেলা সম্ভব নয়। অপরদিকে ইলেকট্রনিক ভোটে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয় কারণ একটি ইলেকট্রনিক মেশিনের ভেতর যে পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়, তা সব সাধারণ মানুষের পক্ষে জানা সম্ভব নয়। আর নির্বাচনে ভোটের গোপনীয়তার কারণে এ পদ্ধতি সবাইকে জানানো সম্ভবও হয় না। তা ছাড়া ইলেকট্রনিক ভোটিংয়ে যাচাই-বাছাইয়েরও কোনো সুযোগ থাকে না। এ ক্ষেত্রে যে সমস্যাটি সবচেয়ে বড়; সেটি হচ্ছে, নির্বাচনের ফল নিয়ে প্রশ্ন উঠলে সরকারের পক্ষে প্রমাণ করা সম্ভব নয় যে ই-ভোটিংয়ে পাওয়া ফল সঠিক, অন্যদিকে বিরোধীদের হাতেও কোনো প্রমাণ থাকে না ভোট জালিয়াতি বা অনিয়মের। ব্যালট ভোটিংয়ে হাজার হাজার মানুষের সামনে ভোট গণনার কাজটি চলে, অন্যদিকে ই-ভোটিংয়ে কম্পিউটারে একটি মাত্র সুইচ টিপে ফল সংগ্রহ করা হয়। যে জন্য ই-ভোটিংয়ের সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয় না। সে জন্য শুধু আমাদের দেশেই নয়, বিশ্বের আরো অনেক দেশেও ই-ভোটিং নিয়ে বিতর্ক চলছে। যুক্তরাষ্ট্রে ২০০৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ফ্লোরিডার ই-ভোটিং ভোট জালিয়াতির উদাহরণ দেন অনেকেই। এই নির্বাচনে ফ্লোরিডায় ইলেকট্রনিক প্রতারণার মাধ্যমে দুই লাখ ৬০ হাজার ভোট জর্জ বুশের পক্ষে টানা হয়েছিল। এই জালিয়াতি না হলে জর্জ বুশ শেষ মেয়াদে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হতে পারতেন না। অন্যদিকে ২০০৪ সালে ভারতেও ইলেকট্রনিক ভোটার মেশিন ব্যবহার শুরু হয় কিন্তু ব্যাপক নির্বাচনী অনিয়মের কারণে সে দেশেও ইভিএম ব্যবহার সমালোচনার মুখে পড়েছে। অনেক ভোটার অভিযোগ করেছেন, তাঁরা বাটন লাইট ফ্ল্যাশ করেছেন ভুল প্রার্থীর পাশে। তা ছাড়া ফলাফল পাল্টানোর নানা অভিযোগ তো ছিলই।
ই-ভোটিংয়ের এসব দুর্বলতার জন্য পাশ্চাত্যের বেশির ভাগ দেশই এখনো ই-ভোটিং চালু করতে পারেনি। এমনকি এ দুর্বলতার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের মাত্র এক-তৃতীয়াংশ স্টেটে চালু হয়েছে ই-ভোটিং। তাই বাংলাদেশের মতো ই- লিটারেসির দেশে ই-ভোটিং নিয়ে যে বিতর্ক চলছে, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন আরো সময় নিয়ে, দেশের সেরা প্রযুক্তিবিদদের নিয়ে ইভিএমের ব্যবহার গ্রহণযোগ্য করতে হবে এবং নির্বাচনের মতো একটি স্পর্শকাতর বিষয়ে ই-ভোটিং নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য বাড়াতে হবে, আর এই মতৈক্যই পারে ইভিএম ব্যবহার করে একটি শুদ্ধ, সুন্দর নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে।
লেখক : গবেষক, তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগ
ভিয়েনা আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়, অস্ট্রিয়া
দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ ও পাকিস্তান ছাড়া অন্য সব দেশেই ই-ভোটিং চালু হয়েছে। বাংলাদেশেও আগামী সংসদ নির্বাচনে ই-ভোটিং চালু হবে বলছে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন। তবে এরই মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ই-ভোটিং নিয়ে ব্যাপক মতানৈক্য দেখা দিয়েছে। ই-ভোটিংয়ের পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলো বলছে এই ব্যবস্থায় দ্রুততম সময়ে নির্বাচন সম্পন্ন এবং ফল প্রকাশ করা যায়, আর বিপক্ষের দলগুলো বলছে ই-ভোটিংয়ের মাধ্যমে রেকর্ড পাল্টে দিয়ে ভোট জালিয়াতি চলতে পারে। তাই বিষয়টি সম্পর্কে ধারণা পেতে আমাদের বুঝতে হবে ই-ভোটিং কী? বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন যে ই-ভোটিং মেশিনের প্রস্তাব করেছে, সেই প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ব্যালট পেপারে সিল মেরে ভোট দেওয়ার বদলে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে পছন্দের প্রতীকের পাশে সুইচ টিপে ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা। নির্বাচন কমিশনের মতে, এর ফলে ব্যালট পেপার ছাপানোর ও পরিবহনের খরচ কমবে, ভোটের ফল নির্ভুল হবে, ফল ঘোষণা দ্রুত হবে ইত্যাদি। বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন ই-ভোটিংয়ের পক্ষে অনেক যুক্তি দেখিয়েছে তাদের প্রস্তাবে, কিন্তু তার পরও বলা যায়, ই-ভোটিংয়ের সঙ্গে পেপার ভোটিংয়ের দীর্ঘ বিরোধ ও বিতর্ক রয়েছে। এ রকম বিতর্কের কারণে ইতিমধ্যে জার্মানি, নেদারল্যান্ডস ও আয়ারল্যান্ড ই-ভোটিং পরিহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
জার্মান বিশ্লেষকরা মনে করেন, ব্যালট পেপার নির্বাচন যেভাবে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব, ইলেকট্রনিক ভোটিংয়ে সেভাবে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। কারণ ব্যালট পেপার দৃশ্যমান ও স্পর্শ করা যায়। ব্যালট পেপারের কিছু অংশ চুরি বা ছিনতাই হয়ে যেতে পারে কিন্তু সামগ্রিকভাবে ভোটের ফলাফল এতে পাল্টে ফেলা সম্ভব নয়। অপরদিকে ইলেকট্রনিক ভোটে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয় কারণ একটি ইলেকট্রনিক মেশিনের ভেতর যে পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়, তা সব সাধারণ মানুষের পক্ষে জানা সম্ভব নয়। আর নির্বাচনে ভোটের গোপনীয়তার কারণে এ পদ্ধতি সবাইকে জানানো সম্ভবও হয় না। তা ছাড়া ইলেকট্রনিক ভোটিংয়ে যাচাই-বাছাইয়েরও কোনো সুযোগ থাকে না। এ ক্ষেত্রে যে সমস্যাটি সবচেয়ে বড়; সেটি হচ্ছে, নির্বাচনের ফল নিয়ে প্রশ্ন উঠলে সরকারের পক্ষে প্রমাণ করা সম্ভব নয় যে ই-ভোটিংয়ে পাওয়া ফল সঠিক, অন্যদিকে বিরোধীদের হাতেও কোনো প্রমাণ থাকে না ভোট জালিয়াতি বা অনিয়মের। ব্যালট ভোটিংয়ে হাজার হাজার মানুষের সামনে ভোট গণনার কাজটি চলে, অন্যদিকে ই-ভোটিংয়ে কম্পিউটারে একটি মাত্র সুইচ টিপে ফল সংগ্রহ করা হয়। যে জন্য ই-ভোটিংয়ের সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয় না। সে জন্য শুধু আমাদের দেশেই নয়, বিশ্বের আরো অনেক দেশেও ই-ভোটিং নিয়ে বিতর্ক চলছে। যুক্তরাষ্ট্রে ২০০৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ফ্লোরিডার ই-ভোটিং ভোট জালিয়াতির উদাহরণ দেন অনেকেই। এই নির্বাচনে ফ্লোরিডায় ইলেকট্রনিক প্রতারণার মাধ্যমে দুই লাখ ৬০ হাজার ভোট জর্জ বুশের পক্ষে টানা হয়েছিল। এই জালিয়াতি না হলে জর্জ বুশ শেষ মেয়াদে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হতে পারতেন না। অন্যদিকে ২০০৪ সালে ভারতেও ইলেকট্রনিক ভোটার মেশিন ব্যবহার শুরু হয় কিন্তু ব্যাপক নির্বাচনী অনিয়মের কারণে সে দেশেও ইভিএম ব্যবহার সমালোচনার মুখে পড়েছে। অনেক ভোটার অভিযোগ করেছেন, তাঁরা বাটন লাইট ফ্ল্যাশ করেছেন ভুল প্রার্থীর পাশে। তা ছাড়া ফলাফল পাল্টানোর নানা অভিযোগ তো ছিলই।
ই-ভোটিংয়ের এসব দুর্বলতার জন্য পাশ্চাত্যের বেশির ভাগ দেশই এখনো ই-ভোটিং চালু করতে পারেনি। এমনকি এ দুর্বলতার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের মাত্র এক-তৃতীয়াংশ স্টেটে চালু হয়েছে ই-ভোটিং। তাই বাংলাদেশের মতো ই- লিটারেসির দেশে ই-ভোটিং নিয়ে যে বিতর্ক চলছে, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন আরো সময় নিয়ে, দেশের সেরা প্রযুক্তিবিদদের নিয়ে ইভিএমের ব্যবহার গ্রহণযোগ্য করতে হবে এবং নির্বাচনের মতো একটি স্পর্শকাতর বিষয়ে ই-ভোটিং নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য বাড়াতে হবে, আর এই মতৈক্যই পারে ইভিএম ব্যবহার করে একটি শুদ্ধ, সুন্দর নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে।
লেখক : গবেষক, তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগ
ভিয়েনা আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়, অস্ট্রিয়া
No comments