একুশের চাওয়া একুশের পাওয়া-‘বাংলাপিডিয়া’ by দ্বিজেন শর্মা
বাঙালির জ্ঞানকোষ প্রণীত হবে এবং আমি তাতে কাজ করব—এমনটি কোনো দিন কল্পনাও করিনি। ২০০০ সালের গ্রীষ্মে এশিয়াটিক সোসাইটির বাংলাপিডিয়া প্রকল্পে আমার সম্ভাব্য নিয়োগের খবর মস্কো পৌঁছলে তড়িঘড়ি দেশে ফিরি এবং নিমতলীতে সোসাইটির কার্যালয়ে প্রধান সম্পাদক অধ্যাপক সিরাজুল ইসলামের সঙ্গে দেখা করতে যাই।
তিনি অত্যন্ত আন্তরিকভাবে আমাকে স্বাগত জানান এবং আমার জ্ঞানগম্যির কোনো খোঁজ না নিয়ে আজই কাজে যোগ দিতে বলেন।
একসময় ডুবে গেলাম রোজকার কাজকর্মে। বলতে দ্বিধা নেই, শিক্ষকতা ছাড়ার পর এমন নিরুদ্বেগ আনন্দঘন পরিবেশে আর কাজ করিনি। মস্কোয় সবই ভালো ছিল, কিন্তু অনুবাদ করতে হতো এমন সব বইপত্র, প্রধানত রাজনীতি-অর্থনীতি, যা আমার ভালো লাগার কথা নয়। জনপ্রিয় বিজ্ঞান ও কল্পবিজ্ঞানের বই অনুবাদের সুযোগ ঘটত দৈবাৎ, তাই বড় একটা অতৃপ্তি ছিল। বাংলাপিডিয়ায় কাজ করেছি আমার নিজের বিষয় জীববিদ্যায়, তাতে অঢেল স্বাচ্ছন্দ্য ও স্ফূর্তি। প্রয়োজনীয় আকরগ্রন্থ কিনতে পারতাম এবং ভুক্তিগুলো যদৃচ্ছা সংশোধন, পরিবর্ধন, সংক্ষেপণ—এমনকি পুনর্লিখনের জন্য ফেরত পাঠানোও যেত।
ছাত্রজীবন ও কর্মজীবনে নানা ধরনের বিশ্বকোষ ঘাঁটতে হয়েছে। কিন্তু বাংলাপিডিয়াকে সেগুলোর সঙ্গে মেলাতে পারতাম না, যেন এটা কেবল তথ্যপঞ্জি নয়। এতে আছে অন্যকিছু, অন্যতর কোনো সত্তা। অদ্ভুত এক অনুভব আমাকে আচ্ছন্ন করত, মনে হতো বেপথু দাঁড়িয়ে আছি বাঙালির হাজার বছরের সাধনার অতিকায় প্রতিমার সামনে। এভাবেই ক্রমাগত পাল্টাতে থাকে বইটি সম্পর্কে আমার বোধ এবং এটি হয়ে ওঠে নৈর্ব্যক্তিক বৃত্তান্তের পরিবর্তে একটি পবিত্র গ্রন্থ।
এশিয়াটিক সোসাইটি, বলা বাহুল্য, একটি অসাধ্যসাধন সম্পন্ন করেছে। শ্রীরামপুরের কেরি সাহেব থেকে ঢাকার ফ্রাঙ্কলিন পাবলিকেশন পর্যন্ত শতাধিক বর্ষ ধরে যুক্ত ও বিভক্ত বঙ্গে অনেকবারই বিশ্বকোষ প্রণয়নের চেষ্টা হয়েছে, কিন্তু কোনোটিই আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছতে পারেনি, কোনোটি এক সংস্করণেই শেষ কিংবা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়েছে। তাই বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির এ সাফল্য ঐতিহাসিক। পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে সময় লেগেছে ছয় বছর (১৯৯৭-২০০৩), কাজ করেছেন দেশ-বিদেশের ১২ শতাধিক লেখক, ভুক্তিসংখ্যা দাঁড়িয়েছিল প্রায় ছয় হাজার, সেগুলোর ভাষান্তর ও সম্পাদনে নিয়োজিত ছিলেন শতাধিক অনুবাদক ও অনুবাদ-সম্পাদক এবং টেকনিক্যাল কাজের অজস্র কর্মী।
প্রধান সম্পাদক অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম বাংলাপিডিয়ার ভূমিকায় লিখেছেন: ‘পরম নিষ্ঠা ও অসীম শ্রম দিয়ে সম্পাদনা পরিষদ সুদূর অতীত থেকে অদ্যাবধি দীর্ঘ সময়কালের বাংলাদেশ অঞ্চলের যাবতীয় ঘটনা ও বিষয় থেকে বাংলাপিডিয়ার জন্য ভুক্তি বাছাই করে। এই কাজের জন্য সম্পাদনা পরিষদের কাছে অনুকরণীয় বা প্রয়োগযোগ্য কোনো ছক ছিল না। জ্ঞানের সকল শাখা, সময়ের বিস্তৃতি, ঘটনা ও বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্য সব একত্র করে সেগুলো থেকে ভুক্তি বাছাই ও লেখা তৈরির কাজটি বলতে গেলে অবিরাম পরীক্ষা-নিরীক্ষার পথ ধরেই গঠন-পুনর্গঠন-পরিমার্জনের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয়েছে।’ সম্পাদক সৌজন্যবশত কিছু অপ্রিয় প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেছেন, যাতে ছিল বুদ্ধিজীবীদের একাংশের অপ্রত্যাশিত ঔদাসিন্য এবং কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের উটকো উৎপাত।
বাংলাপিডিয়া ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তা লাভ করে। ১০ খণ্ডের ১০ হাজার সেট বিক্রি হয়েছে তিন মাসে, অর্ধেকটাই আবার অগ্রিম। কিন্তু সংবাদপত্র ও সাময়িকীতে কি যথাযোগ্য আলোচনা হয়েছে? উল্লেখ্য কিছু অন্তত আমার চোখে পড়েনি। তবে সাধুবাদের বদলে ভুলত্রুটির অনেক সমালোচনা শুনেছি সর্বত্র। এমন বিপুল পরিসর ও প্রায়-দৃষ্টান্তহীন একটি কর্মকাণ্ড আমাদের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে যে একেবারে সম্পূর্ণ নিখুঁত হওয়ার নয়, সহজবোধ্য হওয়া সত্ত্বেও বাঙালির কাছে তার ক্ষমা নেই। যাহোক, কোনো উদ্যোগে সজীব অন্তর্বস্তু থাকলে তা আপনা থেকেই বিকশিত ও বিস্তৃত হতে থাকে। এ ক্ষেত্রেও তা ঘটেছে। ১০ খণ্ডের বাংলাপিডিয়ার পরবর্তী ফলশ্রুতি ১১ খণ্ডের বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সমীক্ষামালা ও ২৮ খণ্ডের উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ। এ তিনটি গ্রন্থমালার সমসংখ্যক ইংরেজি সংস্করণও আছে।
উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ-এর কর্মপরিষদের অন্যতম সদস্য হিসেবে সে-সম্পর্কেও কিছু বলা প্রয়োজন মনে করি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগে ছাত্র থাকাকালে (১৯৫৬-৫৮) ডেভিড প্রেইনের লেখা দুই খণ্ডের বেঙ্গল প্লান্টস (১৯০৩) ছাড়া তখন বাংলার গাছপালাবিষয়ক আর কোনো পাঠ্যবই ছিল না এবং তা-ও অতিজীর্ণ, কেবল শিক্ষকদের ব্যবহার্য। এই চলেছিল আরও দশককাল। পরে ভারত থেকে বিভিন্ন রাজ্যের ফ্লোরা প্রকাশিত হলেও বাংলার উদ্ভিদজগৎ সম্পর্কে দ্বিতীয় কোনো আকরগ্রন্থ বের হয়নি। উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ দীর্ঘদিন পর এই অভাব পূরণ করল। এটিও একটি অসাধ্যসাধন এবং আমরা এ জন্য প্রকল্প-পরিচালক অধ্যাপক জিয়া উদ্দিন আহমেদ ও তাঁর কর্মীদলের কাছে কৃতজ্ঞ। দেশে জীববিদ্যার ছাত্রছাত্রী সংখ্যা আমাদের কালের তুলনায় বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং পরিবেশ সংকটের কারণে জীবজগৎ সম্পর্কে সর্বসাধারণের আগ্রহও এখন অত্যধিক, তাঁরা সবাই এ থেকে উপকৃত হবেন।
একটি চমকপ্রদ ঘটনা দিয়েই লেখাটা শেষ করব। ২০০৩ সালে বাংলাপিডিয়ার কাজ শেষ করে লন্ডনে যাওয়ার ভিসার জন্য ব্রিটিশ দূতাবাসে গেছি। কাউন্টারে দুজন মহিলা—একজন যথারীতি সিলেটি, অন্যজন ইংরেজ। প্রথমার কাজ জিজ্ঞাসাবাদ, দ্বিতীয়ার নতমুখ নীরব লিখন। প্রথমা অনেক প্রশ্ন করলেন, দ্বিতীয়া মাথা গুঁজে লিখেই গেলেন। অবশেষে শেষ প্রশ্ন—আপনার সর্বশেষ কাজটি কী ছিল? বললাম, আমাদের ন্যাশনাল এনসাইক্লোপিডিয়া সম্পাদনা। প্রথমা সেটার অনুবাদ দ্বিতীয়াকে শোনালেন এবং এই প্রথম তিনি মুখ তুললেন এবং কয়েক সেকেন্ড আমার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকলেন।
No comments