বিশ্বব্যাংকের ঋণের মেয়াদ ৬ মাস বৃদ্ধি গ্রহণযোগ্য নয়: অর্থমন্ত্রী-চীনের দিকে এখন ঝুঁকছে বাংলাদেশ

পদ্মা সেতু নির্মাণে মালয়েশিয়া না চীন, সেই উৎস আগে নির্দিষ্ট করতে চায় সরকার। এরপর বিশ্বব্যাংকসহ অন্য দাতাদের সঙ্গে চলমান অচলাবস্থার অবসান ঘটানোর উদ্যোগ নেওয়া হবে। তবে এখন সরকারের ঝোঁক চীনের প্রতি বেশি।এদিকে, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত গতকাল মঙ্গলবার সাংবাদিকদের বলেছেন, পদ্মা সেতুতে নতুন অর্থায়ন নিয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর আগে বিশ্বব্যাংকসহ অন্য সংস্থাগুলোর সঙ্গে আবারও আলোচনা করা হবে।


দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর অর্থায়ন স্থগিত রেখেছে। এ নিয়ে তদন্ত করছে কানাডার পুলিশ। বিশ্বব্যাংক বলেছে, কানাডা থেকে তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পরই তারা পদ্মা সেতু নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। তবে ‘প্রমাণ করতে না পারলে বিদেশিদের অর্থ নেওয়া হবে না’—সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যের পর দাতাদের সঙ্গে এ নিয়ে নতুন করে টানাপোড়েন শুরু হয়। এর মধ্যে অবশ্য ঋণের কার্যকারিতার মেয়াদ শেষ হলে বিশ্বব্যাংক এই মেয়াদ ছয় মাস বাড়িয়ে দেয়। তবে বাংলাদেশ চেয়েছিল তিন মাস মেয়াদ বৃদ্ধি।
এ নিয়েও কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আমাদের দিক থেকে কোনো অনুরোধ না করা সত্ত্বেও ঋণের কার্যকারিতার মেয়াদ তারা ছয় মাস বাড়িয়েছে। আমাদের কাছে এটা গ্রহণযোগ্য নয়।’ তবে সূত্র জানায়, সরকারের উচ্চপর্যায় থেকেই মেয়াদ তিন মাসের পরিবর্তে ছয় মাস করার জন্য বিশ্বব্যাংককে বলা হয়েছিল। এরই ভিত্তিতে বিশ্বব্যাংক মেয়াদ বাড়িয়ে দিলেও অর্থমন্ত্রী এখন গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুললেন। অর্থমন্ত্রী এ নিয়ে আরও বলেন, ‘বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে পদ্মা সেতু নিয়ে এখনো সরকারের কথাবার্তা চলছে। তাদের সঙ্গে সম্পর্ক শেষ হয়ে যায়নি। তবে সময় বাড়ানোর কারণে আরও দেরি হচ্ছে। অথচ আমরা চাইছি আগামী মৌসুমেই কাজ শুরু করতে।’
চীন না মালয়েশিয়া: সরকারের উচ্চপর্যায়ের সূত্র জানায়, সরকার এই মুহূর্তে কাউকে সরাসরি ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ বলে প্রস্তাবগুলো আগে যাচাই-বাছাই করছে। সময়, খরচ, টোলের হারসহ আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো স্পষ্ট হওয়ার পর চূড়ান্ত ঘোষণা আসতে মার্চ লেগে যাবে, এমন আভাস পাওয়া গেছে। তবে বিশ্বব্যাংকসহ চার দাতার বাইরে পদ্মা সেতু নির্মাণকাজ শুরু করার বিষয়টি সরকার চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে।
দাতাদের সরাসরি ‘না’ বলা হলেও গতকাল পর্যন্ত নীতিনির্ধারকদের বক্তব্যে সরকারের অবস্থান পরিষ্কার হয়ে গেছে। যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘বিশ্বব্যাংকসহ দাতারা সময়মতো কাজ শুরু করতে না পারায় বিকল্প পথ খুঁজতে আমরা বাধ্য হয়েছি। জনগণের স্বার্থে বিশ্বব্যাংক এ বিষয়টি মেনে নেবে এবং এটা মেনে নেওয়া উচিত।’
অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব শেখ মো. ওয়াহিদ-উজ-জামান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্বব্যাংকসহ দাতাদের দিক চেয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য সরকার বসে থাকতে পারে না। তাই বিকল্প উৎস খুঁজতে সরকার বাধ্য হয়েছে। বিশ্বব্যাংক ছাড়া পদ্মা সেতু হবে না, এই ধারণা ভুল প্রমাণিত হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
সূত্র জানায়, পদ্মা সেতু নির্মাণে মালয়েশিয়া না চীন—সেই সিদ্ধান্ত এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত হয়নি। গত কয়েক দিনে মালয়েশিয়ার চেয়ে সরকারের ঝোঁক চীনের দিকে বেড়েছে। এর কারণ হিসেবে সরকারের নীতিনির্ধারক মহলের যুক্তি হচ্ছে, চীনের সহায়তা নিয়ে মালয়েশিয়া এই সেতু নির্মাণ করবে। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারির (পিপিপি) ভিত্তিতে সেতু নির্মাণ করতে চাইলে মালয়েশিয়া বিভিন্ন দেশ থেকে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা নেবে। এতে বেশি সময় লাগার আশঙ্কা রয়েছে। তাছাড়া পিপিপির আওতায় সেতু হলে নির্মাণে খরচ ও টোলের হারও তুলনামূলক বেশি হবে।
এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী গতকাল বলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণে মালয়েশিয়ার বিনিয়োগ প্রস্তাবটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। তিনি বলেন, ‘এটা পিপিপির প্রস্তাব, তবে তা ব্যয়বহুল। আমি এর পুরোপুরি জানি না।’ যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ‘জানে ওরা।’
সূত্র জানায়, এই মুহূর্তে সরকারের মনোভাব হচ্ছে, চীন ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে চুক্তি হলে সময় কম লাগতে পারে। চীনের এ ধরনের সেতু নির্মাণের অভিজ্ঞতা রয়েছে, আর্থিক ও কারিগরি দিক থেকেও চীন মালয়েশিয়ার চেয়ে তুলনামূলক স্বয়ংসম্পূর্ণ।
মালয়েশিয়া ২১ ফেব্রুয়ারি পদ্মা সেতু নির্মাণে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই করতে আনুষ্ঠানিক চিঠি দিলেও তা ওই দিন হওয়ার সম্ভাবনা কমে এসেছে। যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ইতিমধ্যে মালয়েশিয়ার পক্ষ থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি সম্ভব না হলে ২৫ ফেব্রুয়ারি সমঝোতা স্মারক সইয়ের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, মালয়েশিয়ার প্রস্তাব বিবেচনা করে দেখা হচ্ছে। চীনের প্রস্তাবও বিবেচনায় আছে। কেউ না এলে দেশের মার্কেটে বন্ড ছেড়ে পদ্মা সেতু করা হবে বলেও তিনি জানান।
আরেক প্রশ্নের জবাবে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আমাদের বিরোধ বা বৈরিতা নেই। এক পদ্মা সেতুর কারণে দীর্ঘদিনের সম্পর্কে টানাপোড়েন হওয়ার কারণ নেই। এ দেশে আরও ৩৪টি প্রকল্প রয়েছে বিশ্বব্যাংকের।’
চুক্তি বাতিল নিয়ে অর্থমন্ত্রী: সচিবালয়ে গতকাল সাবিনকোর চেয়ারম্যান আবদুল আজিজ এম আল-তুর্কির সঙ্গে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বিশ্বব্যাংকসহ অন্য উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলোর প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে বলেন, ‘যদি পিপিপিতে যাব বলেই মনে করি, তার আগে যাদের সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছে, সেগুলো হয় প্রত্যাহার করতে হবে অথবা বাতিল করতে হবে।’
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘পদ্মা সেতুর জন্য এখন আমাদের কতগুলো কাজ করতে হবে। নতুন উপায়ে সেতু নির্মাণের অর্থায়ন করা হলে বিশ্বব্যাংকসহ চার সংস্থার কাছে জানতে চাওয়া হবে যে তারা কীভাবে কী করতে পারে।’ সেতু নির্মাণে অর্থায়নের দুটি উপায় আছে উল্লেখ করে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘একটা হতে পারে সরাসরি ঋণ, অন্যটি পিপিপি। তবে পিপিপি খুব ব্যয়বহুল। বড় প্রকল্প হিসেবে আমরা চাই, এতে আরও বিনিয়োগকারীকে নিয়ে কিছু করা যায় কি না।’
পদ্মা সেতুতে নতুন অর্থায়ন নিয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর আগে বিশ্বব্যাংকসহ অন্য সংস্থাগুলোর সঙ্গে আবারও আলোচনা করা হবে বলেও জানান অর্থমন্ত্রী।

No comments

Powered by Blogger.