যুক্তি তর্ক গল্প-ক্ষমতার বৃত্তে বাঁধা পড়ছে আওয়ামী লীগ by আবুল মোমেন

দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। জোরেশোরেই শোনা যাচ্ছে। আমাদের নব্বই-পরবর্তী গণতান্ত্রিক আমলে প্রধান বড় দুই দলের মধ্যেই ক্ষমতার অদল-বদল ঘটেছে। নিয়ম করে প্রতি নির্বাচনেই এই পরিবর্তন ঘটেছে। উভয় দলই বিরোধী দলে অবস্থানের সময় মোটামুটি একই রকম ভূমিকা পালন করে চলেছে, যা পরবর্তী নির্বাচনে ক্ষমতায় যাওয়া নিশ্চিত করার জন্য মরিয়া তৎপরতার বহিঃপ্রকাশ।


এতে গণতন্ত্রের বিকাশ রুদ্ধ থাকছে, দেশের অর্থনৈতিক বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে এবং সামগ্রিকভাবে মানুষের দুর্ভোগ বেড়ে চলেছে।
বিরোধী দলে থাকলে দুই বড় দলের আচরণ প্রায় একই রকম হলেও সরকার গঠন করার পর তাতে কিছু পার্থক্য থাকছে। বিএনপি গতবার সরকারে এসেছিল জামায়াতকে সহযোগী করে। তার পাশাপাশি তারা বাংলা ভাই, জেএমবি ও হুজির মতো জঙ্গি সংগঠনকে মদদ দিয়েছিল। সে সময় দেশে একুশে আগস্টের মতো মারাত্মক গ্রেনেড হামলা ছাড়াও যশোরে উদীচীর সম্মেলনে, ঢাকায় ছায়ানটের নববর্ষের অনুষ্ঠানে, নেত্রকোনায় সিনেমা হলে এবং সারা দেশে একযোগে বোমাবাজির ঘটনাসহ ব্যাপক জঙ্গি তৎপরতা চলেছে। বাংলাদেশ হয়ে পড়েছিল জঙ্গিদের অভয়াশ্রম এবং পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দাদের ঘাঁটি। এ ছাড়া হাওয়া ভবনের কীর্তি এবং তারেক জিয়া ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের বিকল্প সরকার চালানোর ঘটনা মানুষ এখনো ভোলেনি।
আওয়ামী লীগের সরকার জঙ্গিবিরোধী স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছে, বঙ্গবন্ধুর খুনি ও জঙ্গিদের বিচার এবং অনেকের শাস্তি কার্যকর করেছে। এ ছাড়া পাকিস্তানি সামরিক গোয়েন্দাদের তৎপরতা বন্ধ করেছে। প্যারালাল সরকার চালানোও বন্ধ হয়েছে। গত তিন বছরে দেশে জঙ্গিদের তৎপরতা বন্ধ রয়েছে। গ্রেনেড-বোমা হামলার ঘটনাও ঘটেনি।
মুশকিল হচ্ছে, এটুকুতে বাংলাদেশের চলছে না, মানুষেরও চলছে না। আওয়ামী লীগের কাছে মানুষের প্রত্যাশা এমনিতেই বেশি। এবার আরও একটু বেশি। কারণ, বিএনপির গত আমলে জঙ্গিবাদী তৎপরতা, দুর্নীতি ও দুঃশাসন মিলে মানুষ এত অতিষ্ঠ ছিল যে কেবল এর থেকে মুক্তি চায়নি, স্থায়ীভাবে ব্যর্থতার বৃত্ত থেকে বাংলাদেশের মানুষ বেরিয়ে আসতে চেয়েছে। সে কারণেই তারা নির্বাচনে বিএনপির দিক থেকে প্রায় সম্পূর্ণই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। ফলে বিপুলভাবে বিজয়ী সরকারের ব্যর্থতা মানুষের কাছে কাম্য নয়।
কেবল কাম্য নয় বললেও ভুল হবে। মানুষ ঠিক ভাবতে পারছে না আওয়ামী লীগ ব্যর্থ হলে, ক্ষমতায় পুনরায় বিএনপি-জামায়াত জোট এলে তাদের ভূমিকা কী হবে, দেশের ভবিষ্যৎই বা কোন দিকে যাবে?
এযাবৎ আওয়ামী লীগ তার জঙ্গিবিরোধী ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশের এজেন্ডা পূরণের সাফল্যের কথা বলতে পারবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হওয়ায় এ বিষয়ে মানুষ আশ্বস্ত বোধ করছে।
কিন্তু জনগণের আদালতে যেকোনো সরকারের বিচারে সম্ভবত শেষ পর্যন্ত দ্রব্যমূল্য, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও নাগরিক জীবনে স্বস্তি-শান্তিই প্রাধান্য পেয়ে থাকে। জিনিসের দাম বাড়তে থাকল, ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান বাড়ছেই, গ্যাস-বিদ্যুৎ পরিস্থিতির আশানুরূপ উন্নতি নেই, দুর্নীতি আগের মতোই চলছে। বিরোধী দলকে সংসদ বা অন্যান্য কাজে অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে সরকারের অনীহা সুস্পষ্ট, একদলীয় ও এক ব্যক্তির শাসনই প্রকট রূপ ধারণ করছে। এর ফলে রাজনীতি সংঘাতের দিকে যাচ্ছে। বিএনপি-জামায়াত নির্বাচনের পরের হারানো অবস্থান যেন ফিরে পেতে শুরু করেছে। এসব আলামতে মানুষ উদ্বিগ্ন হচ্ছে ও বিরক্ত বোধ করছে।
পদ্মা সেতু কেলেঙ্কারি, স্টক মার্কেট ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থতা, বিশ্বব্যাংক ও উন্নয়ন-সহযোগীদের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন এবং নাগরিক সমাজের মতামতের প্রতি উপেক্ষা সরকারের জন্য সংকট গভীরতর করছে। সরকার অতি আত্মবিশ্বাসী হয়ে তাদের পক্ষের মানুষের মতামতের তোয়াক্কাই করছে না। এটি সরকারের জনবিচ্ছিন্নতা তৈরি করে, যার প্রতিক্রিয়া নির্বাচনে দেখা যাবে বলে আশঙ্কা হয়। ক্ষমতায় বসে সব সময় জনপ্রতিক্রিয়ার ধরনগুলো বোঝা যায় না।
বাজার ও বাস্তবতা মিলে মানুষের মনে সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। বিএনপির মধ্য ও নিম্ন পর্যায়ের নেতাদের বক্তব্যে প্রতিহিংসার ভাব স্পষ্ট। তাঁরা খালেদা জিয়ার কাছে তালিকা দিয়েছেন ক্ষমতায় এসে কাকে কাকে ডান্ডাবেড়ি পরাতে হবে। তার মধ্যে সাজেদা চৌধুরী, মতিয়া চৌধুরীর মতো নারী ও প্রকৃত রাজনৈতিক নেতারাও রয়েছেন। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ জামায়াতের দ্বিতীয় সারির নেতাকে ডান্ডাবেড়ি পরালে তার প্রতিশোধ নেওয়া হবে আওয়ামী লীগের প্রথম সারির নেতাদের ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে। প্রতিশোধের আগুন সব সময়ই মারাত্মক। আর দলীয় নেত্রী যখন এই প্রতিহিংসার মনোভাবে সায় দেন, প্রশ্রয় দিয়ে কথা বলেন, তখন দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়তেই হয়।
প্রতিহিংসার রাজনীতির দায় বিএনপির ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া যায়, কিন্তু তাতে তো দেশের মুক্তি নেই, মানুষের কল্যাণ নিশ্চিত হবে না। মানুষ আওয়ামী লীগের কাছ থেকে আরও পরিণত ও প্রজ্ঞাপূর্ণ রাজনীতি আশা করছে, যা ব্যাপক মানুষের ঐক্য প্রতিষ্ঠা করে প্রতিহিংসাপরায়ণ জঙ্গিবাদী, দেশদ্রোহী রাজনীতিকে দুর্বল করে ফেলবে। আইনি ও পুলিশি ব্যবস্থার মাধ্যমে অপরাধে লিপ্ত জঙ্গি, ধর্মান্ধ ও দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিকে হয়তো শায়েস্তা করা যায়। কিন্তু পাশাপাশি যদি দেশে সুস্থধারার গণতান্ত্রিক রাজনীতির বাতাবরণ তৈরি করা না যায়, তাহলে এই বৃত্ত থেকে দেশ বের হতে পারবে না। বরং সমগ্র রাজনীতিতেই এই দূষণ ছড়াতে থাকবে, যার বাইরে আওয়ামী লীগও থাকতে পারছে না। রাজনৈতিক অগ্রগতি তখনই হবে যখন সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও জঙ্গিবাদী রাজনীতির সম্পর্কে মোহ, বিভ্রান্তি ও বিশ্বাস কেটে যাবে। সেটা কেবল আইনি ও পুলিশি ব্যবস্থায় ঘটবে না, সুস্থ রাজনীতির মাধ্যমেই হবে। কিন্তু ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ অভ্যন্তরীণভাবে কেবল সভানেত্রী-কেন্দ্রিক হুকুম তামিলের দলে পরিণত হয়েছে। আর প্রধান বিরোধী দলের সঙ্গে চলছে শুধুই বিরোধিতার কথাবার্তা, বিষোদগার, লাগামহীন সমালোচনা। আর সারা দেশে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে চলছে ক্ষমতার দাপটের প্রকাশ। এভাবে চলতে চলতে আওয়ামী লীগের নিজস্ব রাজনীতি স্তিমিত হয়ে পড়েছে। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, নেতা-কর্মীদের কোনো রাজনৈতিক এজেন্ডা নেই। যে রাজনীতি আওয়ামী লীগের, তা মাঠপর্যায়ে জাগিয়ে রাখছে, চালিয়ে যাচ্ছে কিছু সামাজিক সংগঠন, যেমন—ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি বা সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম, কিছু সাংস্কৃতিক সংগঠন, যেমন—বিভিন্ন সাংস্কৃতিক জোট, এমনকি কিছু বামপন্থী দল।
আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বড় অংশ ক্ষমতার লাভে ভাগ বসানোর কাজে ব্যস্ত। বিভিন্ন জায়গায় দখল, অবৈধ ব্যবসা, দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ছে, কোথাও কোন্দলে জড়াচ্ছে, যা মারামারি-খুনোখুনি পর্যন্ত গড়াচ্ছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে পুলিশসহ প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে। দুর্নীতি, অপরাধ ও কোন্দল রাজনীতিহীন দলীয় পরিবেশকে আরও দূষিত করছে। যেন নিজের অজান্তে প্রতিপক্ষের ব্যক্তিকেন্দ্রিক ক্ষমতাভিত্তিক রাজনীতিহীনতার ছকে পা দিয়েছে আওয়ামী লীগ।
বাংলাদেশে অতিরাজনীতির অভিযোগ শোনা যায়। অর্থাৎ সব ক্ষেত্রেই রাজনৈতিকীকরণ হচ্ছে। আদতে হচ্ছে দলীয়করণ, বাধাগ্রস্ত হচ্ছে প্রকৃত সুস্থ রাজনীতি। আওয়ামী লীগের মতো জনসম্পৃক্ত দল এখন কেন্দ্রীভূত নেতৃত্বের এক স্থবির দল, যার কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি নেই।
এ অবস্থায় দুর্নীতি, দ্রব্যমূল্য, বিদ্যুৎ, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ব্যাহত হচ্ছে। বরং ক্ষমতাসীনদের ছত্রচ্ছায়ায় দখল, অবাঞ্ছিত কর্তৃত্বের যেসব ঘটনা ঘটে চলেছে, তা জনমনে তীব্র বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে। মানুষের মনে হতাশা জমছে, ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কা বাড়ছে। অথচ দলীয় নেতা, মন্ত্রী, সাংসদ—সবাই কেবল গা-জোয়ারি কথা বলছেন, তাতে সংঘাতের হাওয়া তপ্ত হচ্ছে দেশে। বিরোধী দল মাঠ গরম করার ও মাঠ অধিকার করার সুযোগ পাচ্ছে।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব রাজনীতির লাগাম টেনে ধরেছেন ঠিকই, কিন্তু দলীয় নেতা-কর্মীদের ক্ষমতার অপব্যবহার বা দুর্নীতির রাশ টানতে পারছেন না। মানুষ বিএনপির দুর্নীতির কথা জানে, কিন্তু দেখা গেছে, বর্তমান বাস্তবতা অসহনীয় মনে হলে তারা অন্য যে বিকল্প পায়, তাকেই ক্ষমতায় পাঠায়। ১৯৯১ থেকে এ পর্যন্ত এটাই ঘটেছে। বাংলাদেশের মানুষের এই মনস্তত্ত্বটা বোঝা দরকার। আর দেশের ভবিষ্যৎ, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভবিষ্যৎ চিন্তা করে সরকারেরও নিজের দায়িত্ব ঠিক করা উচিত। সেই সঙ্গে দলকে ক্ষমতার বৃত্তে আবদ্ধ না করে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে জনতার সঙ্গে রাখতে হবে।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.