মহাস্থানগড়ের ঐতিহ্য-দখলদারদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিন
হাজার বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অধিকারী বগুড়ার মহাস্থানগড় আজ প্রায় ধ্বংসের পথে। লোভী ও প্রভাবশালী কিছু মানুষ সংরক্ষিত এলাকা দখল করে বাড়িঘর নির্মাণ করছে। সংরক্ষিত এলাকায় সব ধরনের নির্মাণকাজ বন্ধ রাখার ব্যাপারে আদালতের দেওয়া নির্দেশও মানছে না তারা।
গতকাল মঙ্গলবারের কালের কণ্ঠে এ ব্যাপারে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, দখলদারদের পেছন থেকে মদদ দিয়ে যাচ্ছে স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি, এমনকি পুলিশও এবং বিশেষ কারণে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের লোকজনও এসব দেখেও না দেখার ভান করে আছে। এর ফলে কেবল গত তিন মাসেই সেখানে ১০টি নতুন বাড়ি তৈরি হয়েছে। আরো বাড়িঘর তৈরির পাঁয়তারা চলছে। স্থানীয়রা ছাড়াও বাইরের লোকজন গিয়ে সেখানে কম দামে জমি কিনে বাড়িঘর তৈরির আয়োজন করছে।
বাংলাদেশে ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্তি্বক গুরুত্বসম্পন্ন যে কয়টি স্থান আছে, তার মধ্যে বগুড়ার মহাস্থানগড় অন্যতম। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে এখানে গড়ে উঠেছিল পুণ্ড্র নগরী। পরবর্তী সময়ে অনেক সামন্ত রাজা এটিকে তাঁদের রাজধানী হিসেবে ব্যবহার করেছেন। আজ থেকে ৫০০ বছর আগেও এই নগরীর অস্তিত্বের বিবরণ পাওয়া যায়। কালক্রমে এর অধিকাংশ নিদর্শনই মাটির নিচে চাপা পড়ে যায়। যথাযথ খননের মাধ্যমে পুণ্ড্র নগরীর অনেক নিদর্শনই উদ্ধার করা সম্ভব। আর তাই দেশের সর্বোচ্চ আদালত প্রত্নতাত্তি্বক কার্যক্রম ছাড়া সেখানে সব ধরনের খননকাজ নিষিদ্ধ করেছেন। কিন্তু একটি মহল রাতের আঁধারে খননকাজ চালিয়ে সেখানকার মূল্যবান নিদর্শন ধ্বংস ও পাচারের কাজে নিয়োজিত বলে পত্রপত্রিকার খবরে জানা যায়। আর এখন ঘরবাড়ি তুলে 'অতি স্পর্শকাতর' হিসেবে চিহ্নিত সংরক্ষিত এলাকাও গ্রাস করার জঘন্য চেষ্টা চলছে। জাতি হিসেবে এটি আমাদের জন্য অত্যন্ত লজ্জাকর ও দুঃখজনক।
কবি জীবনানন্দ দাশ, সুকান্ত ভট্টাচার্য, বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, জ্যোতিঃপদার্থবিদ মেঘনাদ সাহা, বিপ্লবী সূর্যসেন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, কালজয়ী সংগীতজ্ঞ ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, সচীন দেব বর্মণসহ আরো অনেক সূর্যসন্তানের জন্ম দিয়েছে বাংলাদেশের মাটি। তাঁদের নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি। আমাদের পরিচয় ও ঐতিহ্যকে শাণিত করতে পারি। তাঁদের স্মৃতিগুলো সংরক্ষণের মাধ্যমে আমরা বিদেশিদের দেখাতে পারি যে আমরা ঐতিহ্যহীন নই। কিন্তু আমাদের সীমাহীন দুর্ভাগ্য যে ইতিমধ্যে আমরা তাদের ভিটেমাটি, স্মৃতিচিহ্ন সব প্রায় মুছে ফেলেছি। আর এখন ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোও ধ্বংস করে দিচ্ছি।
নাম বা বংশপরিচয়হীন মানুষ যেমন সমাজে কিছুটা অপাঙ্ক্তেয় থেকে যায়, তেমনি ঐতিহ্যহীন দেশ বা জাতিগোষ্ঠীও পৃথিবীতে কদরহীন। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশই তাদের ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালায়। বিশ্ববাসীর সামনে তারা গর্বের সঙ্গে সেসব ঐতিহ্য তুলে ধরে। তারা যে একটি প্রাচীন সভ্য জাতিসত্তার উত্তরাধিকারী, সেটা তারা অহংকারের সঙ্গে প্রচার করে এবং পর্যটকদের আকৃষ্ট করে। কিন্তু আমরা কেমন জাতি? একের পর এক আমরা আমাদের ঐতিহাসিক নিদর্শন ও পুরাকীর্তিগুলোকে ধ্বংস করে চলেছি! আমরা আশা করি, বর্তমান সরকার অচিরেই দখলকারদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবে।
No comments