ভিন্নমত-এক কোটি টাকার গাড়িতে চড়েন, কিন্তু ট্যাক্স দেওয়ার ক্ষেত্রে কৃপণ by আবু আহমেদ
খলিল সাহেব অতি ধনী লোক। ধনী হয়েছেন গত ২০ বছরে ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে। গার্মেন্ট এবং আমদানি-রপ্তানির ব্যবসা আছে। গত দুই বছর শেয়ারবাজারেও ব্যবসা শুরু করেছেন। তাঁর আফসোস হলো, তিনি কোনো ব্যাংকের ডাইরেক্টর হতে পারলেন না। তাঁর নজরে ব্যাংকের উদ্যোক্তা ডাইরেক্টররা কোনো কিছু না করে শুধু বোনাস শেয়ার বেচেই
শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। আমি ট্যাক্সের কথা ওঠাতেই তিনি বললেন, ব্যাংকের ডাইরেক্টররা শেয়ার বেচে যে ক্যাপিটাল গেইন করেছে তার ওপর কি ট্যাক্স দিচ্ছে? তাঁর কথামতো একই অবস্থা বীমা কম্পানির ডাইরেক্টরদের ক্ষেত্রেও। তাই তো দেশের অর্থনীতিতে নতুন ব্যাংক ও বীমা কম্পানির দরকার না হলেও অনেকেই এসব ব্যবসা করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ও বীমা নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ বরাবর দরখাস্ত দিয়ে বসে আছেন, তাঁদের ব্যাংক ও বীমা কম্পানি চাই। তাঁর কথামতো ব্যাংক ও বীমা ব্যবসা হলো অতিসহজ ব্যবসা। আপনি মূলধন জোগান দিন, অনুমতি নিন, ভালো এমডি বা সিইও নিয়োগ দিন_ব্যস, আপনার কাজ হয়ে যাবে।
বছর তিনেক পর পাবলিক ইস্যুতে যান বা শেয়ারবাজারে শেয়ার বিক্রি করুন, এরপর বছর বছর বোনাস শেয়ার দিন, দেখবেন আপনার ধনী হওয়ার দরজা খুলে গেছে। খলিল সাহেবের এসব কথার সঙ্গে আমিও একমত। তাই তো দেশের অর্থনীতিতে আরো ব্যাংকের দরকার না হলেও সরকার বলছে, তারা কিছু ব্যাংকের অনুমতি দেবে। এখানেও নিরপেক্ষতার বালাই নেই। এত দরখাস্তের মধ্যে নিজেদের লোকদের দরখাস্ত খুঁজতে গিয়ে নিশ্চয়ই নিজেদেরও কিছু লোক বাদ যাবে। দেশের সব উপজেলা এবং বড় হাট-বাজারগুলোতেও এখন ব্যাংক ও বীমা কম্পানির শাখা চলে গেছে। কেউ এসএমই নামে, কেউ রুরাল ব্যাংকিংয়ের নামে অনুমতি নিয়ে সর্বত্রই এ ব্যবসার দোকান খুলে বসেছে। ব্যাংকের ব্যবসাটা না হয় বুঝলাম, কিন্তু বীমা কম্পানিগুলো কী ব্যবসা করছে তার মাথা-মুণ্ডু কিছু বুঝে আসে না। তবে সবারই লক্ষ্য বেশি বেশি লাভ করা। ব্যাংকিং কম্পানিগুলোর একেক সিইও বেতন পাচ্ছেন মাসে ১০-১২ লাখ টাকা বা তারও বেশি। এত প্রতিযোগিতা, তার পরও ব্যাংকগুলো শুধু বেশি লাভ করেই চলেছে। গত সাত-আট বছর একটানা বোনাস শেয়ার ইস্যু করার কারণে ক্ষুদ্র শেয়ার বিনিয়োগকারীরা এখন আশা করছেন অনন্তকাল ব্যাংকগুলো বোনাস শেয়ার দিয়ে যাবে। তবে শেয়ারবাজার অতি চাঙা থাকায় বাংলাদেশ ব্যাংক একটা ব্যাপারে সন্তুষ্ট হয়েছে। সেটা হলো, বোনাস ও রাইট শেয়ার ইস্যু করে ব্যাংকগুলো অতি দ্রুত বাসেল-২ এর বড় মূলধনের শর্ত পূরণ করতে সক্ষম হয়েছে।
এখন ব্যাংকগুলোর মূলধন অনেক বড়, ৪০০ থেকে ৬০০ কোটি টাকা। তবে বীমা কম্পানির মূলধন এখনো অনেক ছোট। অনেকে বলেন, উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের তদারকি না থাকায় বীমা কম্পানিগুলো ফাঁকিজুঁকির ব্যবসা করছে। বীমা কম্পানিগুলোর আয়-ব্যয় ও স্থিতিপত্রও সহজে কেউ বোঝে না। ওইসব নিয়ে হৈচৈও নেই। যাক, খলিল সাহেবের ট্যাক্স দেওয়ার ধরন ও ট্যাক্সের ক্ষেত্রে তাঁর মনোভাবের দিকে আসি। খলিল সাহেব বলেন, সমাজে অন্য ট্যাক্সদাতারা বেশি নিগৃহীত হন। ট্যাক্সম্যানরা তাঁদের পেছনে ছোটে বেশি। তাঁর অন্য কথা হলো, অন্য ১০ জন যেখানে ট্যাক্সই দেন না সেখানে তো তিনি অন্তত কিছু ট্যাক্স দেন। খলিল সাহেবকে জিজ্ঞেস করলাম, ট্যাক্স ফাঁকি কী করে দেন? উত্তরে বললেন, অনেক কথা আছে। ব্যবসায় কম মুনাফা দেখালেই হলো। আর শেয়ারবাজারে তো মূলধন আয় ট্যাক্স-ফ্রি। আরো পথ আছে, যেগুলো ইনকাম ট্যাক্স উকিল বাতলে দেবে। আর যে সরকার অতীতে ৭-১০ শতাংশ ট্যাক্স দিয়ে অপ্রদর্শিত আয়কে সাদা করার সুযোগ দিয়েছে, সেই সুযোগে তিনিও কয়েক কোটি টাকা সাদা করে নিয়েছেন। আপনি অনেক কম ট্যাক্স দিচ্ছেন, এ কথা শুনে অনেকটা রাগতস্বরে বললেন, আপনার ট্যাক্সম্যানরা এই দেশে স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা কী পরিমাণ ট্যাক্স দিচ্ছে সেটা কি দেখছে? এমনকি স্বর্ণ কেনার বদলে যে ক্রয়পত্রটি ওরা দেয়, তাতে ভ্যাট নামের যে টাকাটা উল্লেখ থাকে সে ভ্যাট সরকারি তহবিলে জমা হচ্ছে কি না তার কী প্রমাণ আছে।
অধিকাংশ স্বর্ণ দোকানে লেনদেন হয় নগদে। কেউ চেক দিয়ে মূল্য পরিশোধ করতে চাইলে বিক্রেতা গড়িমসি করে। নগদ অর্থে লেনদেন হলে সেই লেনদেনকে ট্যাক্সের আওতার বাইরে রাখতে সুবিধা। আর ভ্যাটই বা কিভাবে আদায় করা হচ্ছে। এই দেশে কেউ কি জানে, কত অংশ স্বর্ণ তারা কাগজপত্রের মাধ্যমে আমদানি করছে আর কত অংশ স্বর্ণ পুরনো ক্রেতাদের থেকে আবার ক্রয় করছে? আপনারা বলছেন, অর্থনীতিতে হাজার হাজার কোটি টাকার কালো টাকা জমা হয়েছে। স্বর্ণবাজার তো কালো টাকা উৎপাদনের ভালো উৎস। আপনার রাজস্ব বোর্ড এসব উৎস বন্ধ করতে কী করছে? আপনি বলছেন, আমি ৫০ লাখ টাকার প্রাডো-পাজেরোতে চড়ি। কিন্তু যেসব লোকের ছেলেমেয়েরা পুরো খরচায় বিদেশে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে, তারা কী পরিমাণ ট্যাক্স দিচ্ছে? রাজস্ব বোর্ড কি ওইসব খোঁজখবর রাখে? গুলশানে এখন ১০ ডিসিমেল জমির মূল্য কত? তিনি সে জমি বেচে ওই টাকাকে আবার ডলারে বিদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে সে খবর কি কেউ রাখে? ঢাকা শহরে জমির যে আকাশচুম্বী মূল্য হলো, ওগুলোর ওপর কোন বেটা কত ক্যাপিটাল গেইনস ট্যাক্স দিচ্ছে? আপনার সরকার তো কিছু লোককে কিছু না করে অবিশ্বাস্যরূপে ধনী হতে সহযোগিতা করছে। আর ঘুষ-দুর্নীতি কোথায় হচ্ছে না? ঘুষের টাকা তো ট্যাক্স নেটের আওতায় আনা যাবে না। তাহলে সেগুলো যাচ্ছে কোথায়? হয় ভোগে না হলে বিদেশে।
আপনার সরকারের কি ক্ষমতা আছে বিদেশি ব্যাংকে বাংলাদেশি ধনীদের কত টাকা আছে তা জানার? গুলশানের মূল্যবান রেস্টুরেন্টগুলোতে গাড়ি হাঁকিয়ে এসে যারা দিন-রাত খাচ্ছে আর খাওয়াচ্ছে, তারা কত টাকা ট্যাক্স দিচ্ছে? আমাদের বাংলাদেশের নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা ছাত্রকে পড়াতে চার বছরে কত টাকা লাগে? ওসব ছাত্রের বাবার সবার ঞওঘ আছে কি? সুতরাং আপনি আমার প্রাইভেট পাজেরো দেখে আমাকে জিজ্ঞেস করছেন, আমি কত টাকা ট্যাক্স দিই? আসলে এ ক্ষেত্রে আমি অনেকটা সৎ। এই যে দেশে একটা স্কুল, একটা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করলে ওই খরচ তো আমার রাজস্ব বোর্ড ট্যাক্স হিসাব করার সময় বাদ দেবে না। কয়েকটা গরিব ছাত্রকে আমি বিনা খরচে পড়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছি। এসব ব্যয় যদি ট্যাক্স রিবেট বা মওকুফের মধ্যে ধরেন, তাহলে আমি আমার আয় অনুযায়ী ঠিকই ট্যাক্স দিই। সমাজে যেখানে দুর্নীতি সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে, সেখানে শুধু আমাদের মতো কিছু লোক থেকে পূর্ণাঙ্গ সততা আশা করতে পারেন না। আর আপনার মতো অধ্যাপকই কোথায় যেন লিখেছিলেন, এই দেশ থেকে বহুজাতিক চোরাচালান চক্রগুলো বেচাকেনার মাধ্যমে বছরে শত শত মিলিয়নস অব ডলার বিদেশে পাচার করছে। সেখানে রাজস্ব বোর্ড কি কিছু দেখে না? আর সরকারকে অত ট্যাক্স দিয়েই বা লাভ কী? সরকার যে অর্থ ব্যয় করছে তার কত অংশ প্রকৃত জনকল্যাণে ব্যয় হচ্ছে, আর কত অংশ লোপাট হচ্ছে? খলিল সাহেবের এসব কথা আমি অবশ্যই মনোযোগ দিয়ে শুনেছি। শুধু ভাবলাম, তাঁর অনেক কথার মধ্যে সত্যতা আছে। তবুও আমার মতো লোক চাইবে, সক্ষম সব লোক ট্যাক্সনেটের মধ্যে আসুক এবং কালো টাকার উৎপাদনের উৎসগুলো বন্ধ হোক।
লেখক : অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments