চরাচর-বিধবাপল্লী by হাকিম বাবুল

একটি পাড়ার সব পুরুষ মানুষ মেরে ফেলা হয় বলে ওই এলাকার নাম এখন 'বিধবাপল্লী'। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এই বিধবাপল্লী এক আলাদা স্থান দখল করে আছে। শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার কাকরকান্দি ইউনিয়নের একটি গ্রাম সোহাগপুর। ভারতের মেঘালয় রাজ্যসংলগ্ন সবুজ-শ্যামলিমা, পাখির কলকাকলি ভরা এই গ্রামের উত্তর-পূর্ব প্রান্ত দিয়ে বয়ে চলেছে বয়সের ভারে নুইয়ে পড়া একটি নদী বুড়ি ভোগাই।


দক্ষিণে গ্রামটিকে লতার মতো জড়িয়ে আছে আরেকটি নদী সুতিয়া। পশ্চিমে অতন্দ্রপ্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে আছে দুটি গ্রাম_বেনুপাড়া ও রসাইতলা। ১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই সোহাগপুর গ্রামটিতেই ঘটে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। পাকিস্তানি হানাদারদের সেদিনের পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডে প্রাণ হারিয়েছেন ১৮৭ নিরীহ মানুষ।
সেদিন সকাল ৭টা। গ্রামের মানুষ কেউবা লাঙল-জোয়াল নিয়ে রোপা আমন ধান লাগানোর জন্য জমিতে ব্যস্ত, কেউবা বাড়িতেই অলস বসে আছেন। এমন সময় রক্তভুক বাঘের মতো জীবন হননের জন্য পশুবৃত্তি জেগে ওঠা হানাদার বাহিনীর প্রায় ১৫০ জনের একটি দল সোহাগপুর গ্রামে হামলে পড়ে। কাদের ডাক্তার নামে পাশের গ্রামের এক রাজাকারের দেওয়া তথ্যে হানাদার বাহিনী এ গ্রামে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালায়। হানাদাররা ওই গ্রামের প্রফুল্লের দিঘি থেকে সাধুর আশ্রম পর্যন্ত এলাকা ঘিরে ফেলে। হামলার প্রথম শিকার হন রমেন রিসিল, চট পাথাং, মিরিশ গ্রাব্রিল নামে তিন উপজাতি। রমেন রিসিল দুই শিশুকন্যা সন্ধ্যা দিও ও কুমুদিনি দিওকে নিয়ে ঘরেই ছিলেন। এমন সময় স্থানীয় রাজাকার নসিমুদ্দিন লসা ঘর থেকে ডেকে আনে রমেন রিসিলকে। তারপর তিনজনকে একত্রে গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনারা। ১১ বছরের সিরাজ আলী চাচা হাসেন আলীর সঙ্গে মাঠে গিয়েছিল। হাসেন আলী এবং কামলা আবদুল লতিফ, সফর উদ্দিন, জহুরুল হক, শহর আলী, আনসার আলী মাঠে কাজ করছিলেন। সিরাজ আলী নির্বিঘ্নে বসেছিল ক্ষেতের আইলে। হঠাৎ গুলির শব্দে চমকে ওঠে। তাকিয়ে দেখে বিলের ভেতর সারিবদ্ধভাবে পলো দিয়ে জেলেরা যেভাবে মাছ ধরে, ঠিক তেমনিভাবে ঘাতকরূপী হানাদার বাহিনীও তাদের সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে এগিয়ে আসছে। মুহূর্তেই হানাদার বাহিনী সবাইকে গুলি করে লুটিয়ে দেয় মাটিতে। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যায় কিশোর সিরাজ আলী।
মধ্যযুগীয় বর্বরতা আর আকাশ ফাটানো গর্জনে যখন গ্রামবাসীর আর্তচিৎকার মুহূর্তে নিস্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে, তখন আলেক নেছার ঘরে আশ্রয় নেন তাঁর ভাই কিতাব আলী, শহরউদ্দিন, ইব্রাহিম, পালক ছেলে মমিন, সতিনের ছেলে মোহাম্মদ, নিজের ছেলে মন্নাছ, ভগি্নপতি ঈমান আলী মুন্সী। একসঙ্গে উঠানে দাঁড় করিয়ে আলেক নেছার সামনে গুলি করে হত্যা করা হয় ১১ জনকে। ছয় ঘণ্টাব্যাপী এই নির্মম হত্যাযজ্ঞ চলার পর এক রাজাকারের চালানো গুলি দুই গ্রামবাসীর শরীর ভেদ করে এক পাকিস্তানি সেনার শরীরে বিদ্ধ হলে অন্য হানাদাররা সঙ্গে সঙ্গে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে ওই রাজাকারকে হত্যা করে। এর পরই থেমে যায় হত্যাকাণ্ড। হানাদাররা চলে যায় অন্যত্র। দিনের বেলায়ই সারা গ্রামে নেমে আসে রাতের নিস্তব্ধতা।
স্বাধীনতা অর্জনের পর, ২০০৮ সালে ৩৭ বছর পর শেরপুর জেলা প্রশাসন ও অনির্বাণ-৩০-এর সেনাবাহিনীর সদস্যরা এই গ্রামের বীর শহীদদের স্মৃতি সংরক্ষণে স্মৃতিফলক নির্মাণ এবং গণকবর চিহ্নিত করে। শহীদ পরিবারের বিধবাদের পুনর্বাসনের জন্য আয়বর্ধনমূলক প্রকল্প গ্রহণ করলেও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সেগুলো এখন আর চালানো সম্ভব হচ্ছে না। সরকারিভাবে বর্তমানে শহীদ পরিবারের বেঁচে থাকা ৩৪ জন বিধবাকে বয়স্ক ভাতা ও বিধবা ভাতা ছাড়াও কৃষিমন্ত্রী ও বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নরের সহায়তায় ট্রাস্ট ব্যাংক মাসিক ভাতার ব্যবস্থা করায় তাঁরা এখন কোনোমতে খেয়েপরে বাঁচতে পারছেন। কিন্তু এসব শহীদ পরিবারের বিধবাদের জন্য আজও রাষ্ট্রীয়ভাবে মুক্তিযোদ্ধা ভাতার মতো শহীদ পরিবার ভাতা দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই এসব শহীদ পরিবারের বিধবাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মানিত করার দাবি জানিয়েছেন।
হাকিম বাবুল

No comments

Powered by Blogger.