চারদিক-একজন সুবিদ আলীর কাহিনি

কাহিনি এক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। একাত্তরের মার্চ মাসের মাঝামাঝি জেনেভা গেলেন একটি আন্তর্জাতিক শিক্ষা সম্মেলনে বক্তব্য দিতে। ১৭ মার্চ ফেরার পথে লন্ডন এসে শুনলেন পঁচিশে মার্চের কালরাত্রির নির্মম ঘটনার বিবরণ। রোমহর্ষক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে। অসংখ্য সন্তানকে হারিয়েছেন।


ইতিমধ্যে যুক্তরাজ্যে অবস্থানকারী বাঙালিরা বিক্ষোভ করেছে হাইড পার্কে। বিচারপতি চৌধুরী প্রবাসী স্বল্প আয়ের বাঙালিদের আন্দোলনে যোগ দিলেন। বিক্ষিপ্ত ও অসংগঠিত বিলেতবাসীকে সংগঠিত করার পর বিচারপতি চৌধুরী একটি কেন্দ্রীয় দপ্তরের প্রয়োজন অনুভব করলেন। প্রবাসীদের দু-এক পাউন্ড করে দেওয়া চাঁদায় আন্দোলনের জন্য যে তহবিল গড়ে উঠছে, তা একটি বাড়ি ভাড়া করার জন্য যথেষ্ট না। ইতিমধ্যে লন্ডনের সব বাঙালি কূটনীতিক ডিফেক্ট করে পাকিস্তানের চাকরি ছেড়ে মুজিবনগর সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছেন। তাঁদের আয় নেই। পরিবার-পরিজন নিয়ে অনিশ্চিত জীবন যাপন করছিলেন। এমন সময় একদিন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী মহীউদ্দিন আহমেদকে ডেকে পাঠালেন। হাতে তুলে দিলেন পাঁচ হাজার পাউন্ড। তখনকার দিনে পাঁচ হাজার পাউন্ড বিশাল অর্থ।
লন্ডন হাইকমিশন থেকে প্রথম ডিফেক্টকারীদের পথপ্রদর্শক মহীউদ্দিন আহমেদ, পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। বর্তমানে লেখক ও কলামিস্ট। সর্বক্ষণ বিচারপতি চৌধুরীর সহকর্মী ও আন্দোলনের সমন্বয়কারী। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘স্যার, টাকাটা কার নামে লিখে রাখব?’ বিচারপতি চৌধুরী বললেন, ‘নাম জানতে হবে না। লিখে রাখো সুবিদ আলী।’ কে এই সুবিদ আলী—নেপথ্যে অর্থ জোগান দিচ্ছেন প্রবাসী বাঙালির স্বাধীনতার আন্দোলনে? রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হয়ে দেশে ফেরার দিন মহীউদ্দিন আহমেদকে ডেকে হেসে বললেন, ‘সুবিদ আলী হচ্ছেন শিল্পপতি জহুরুল ইসলাম।’ কাহিনিটি জহুরুল ইসলামের ইন্তেকালের পর মহীউদ্দিন তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে সবিস্তারে কোনো একটি পত্রিকায় লিখেছিলেন। আজ সুবিদ আলীর ১৬তম মৃত্যুদিনে তাঁকে স্মরণ করে তাঁর লেখা কাহিনির সারাংশ পুনরুল্লেখ করলাম।
কাহিনি দুই: জহুরুল ইসলাম ছিলেন প্রথম বাঙালি, যিনি মধ্যপ্রাচ্যে ব্যবসা গড়ে তোলেন। কয়েক শ বাঙালি চাকরি করতেন তাঁর বেঙ্গল ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন নামের গৃহায়ণ প্রতিষ্ঠানে। লন্ডনে তাঁর ব্যবসার একটি শাখা ছিল। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুর মর্মান্তিক মৃত্যুর পর আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, সাহিত্যিক দেশ থেকে পালিয়ে এলেন লন্ডনে। কোথায় থাকবেন এসব উদ্বাস্তু, কে জোগাবে খাওয়া-পরা? কেন, সুবিদ আলী আছেন না? বন্ড স্ট্রিট অক্সফোর্ড স্ট্রিটের সংযোগস্থলে বেঙ্গল ডেভেলপমেন্টে যাওয়া-আসা করেন এসব শরণার্থী। সেই দপ্তরে পঁচাত্তরের আগস্টের শেষে লন্ডনে এসে আমিও নিয়মিত যেতাম। প্রখ্যাত সানডে টাইমস-এর সম্পাদক হ্যারি ইভান্সের কল্যাণে পত্রিকাটিতে খণ্ডকালীন সাংবাদিক হিসেবে নিয়োগ পেলাম। নিয়মিত যাতায়াত করতাম সুবিদ আলীর দপ্তরে। সেখানে দেখা হলো সিলেটের বনেদি পরিবারের সন্তান বন্ধু জাকারিয়া খানের সঙ্গে। মাঝেমধ্যে আসতেন লন্ডনপ্রবাসী কলামিস্ট বন্ধু আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। আমাদের শুধুই আড্ডা হতো। মাসের শেষে শুধু আড্ডা দেওয়ার পর ফেরার সময় কারও কারও হাতে অন্যের মাধ্যমে একটি খাম গোপনে ধরিয়ে দিতেন সুবিদ আলী ওরফে জহুরুল ইসলাম।
কাহিনি তিন: পঁচাত্তরের শেষে অথবা ছিয়াত্তরের প্রথম দিকে দেশত্যাগী অনেকে প্রাণের ঝুঁকি নিয়েও দেশে ফিরতে লাগলেন। আমিও দেশে ফেরার সিদ্ধান্তটি সুবিদ আলীকে জানালাম। তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘দেশে কী করবেন? কামালের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবেন।’ কামাল মানে তাঁর ছোট ভাই, বর্তমানে নাভানার পরিচালক শফিউল ইসলাম।
কাহিনি চার: বাহাত্তরে দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু ৩২ নম্বরে পাকিস্তানি বুলেটে ক্ষতবিক্ষত বসবাসের অনুপযোগী বাড়িতে ওঠেননি। সেটি বাসযোগ্য করে দিল জহুরুল ইসলামের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান।
দেশে এলাম, একদিন ইস্টার্ন টাওয়ারে দেখা করতে গেলাম কামালের সঙ্গে। অনেক গল্প হলো। আসার সময় ধরিয়ে দিলেন একটি খাম। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী আছে এতে?’ কামালের উত্তর, ‘লন্ডন থেকে বড় ভাই বলে দিয়েছেন, আপনি যখন আসবেন, এ রকম একটি খাম হাতে তুলে দিতে।’ সংসার প্রতিপালনে উপার্জনহীন আমি তখন দিশেহারা। নিজ পেশায়ও কোনো চাকরি জোগাড় করতে পারছিলাম না। দুর্দিনে সেই খাম আমার জন্য ছিল আশাতীত প্রাপ্তি। বাসায় এসে সুবিদ আলীর খাম খুলে তখনকার দিনে পাঁচ হাজার টাকা পেয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে গেলাম। পরে শুনেছি, সে সময় দিশেহারা অসহায় বঙ্গবন্ধু অনুসারী সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই দুর্দিনে সুবিদ আলীর খাম পেতেন।
আমাদের সুবিদ আলী প্রথম জীবনে ছিলেন সিঅ্যান্ডবির (বর্তমানে গৃহায়ণ পরিদপ্তর) করণিক। এর ঠিকাদারি কাজ করত পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নিয়ন্ত্রিত কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। সুবিদ আলী তথা জহুরুল ইসলাম ভাবলেন, আমাদের কাজ ওরা করবে কেন? প্রতিষ্ঠানটির প্রধান প্রকৌশলী বাঙালি দেশপ্রেমিক মাইনুল ইসলামের সমর্থন এবং উৎসাহে জহুরুল ইসলাম সামান্য করণিকের কাজ ছেড়ে দিলেন। প্রথমে ছোটখাটো নির্মাণকাজ, পরে বেঙ্গল করপোরেশনের পরিচয়ে বড় কাজ হাতে নিলেন। ক্রমে ক্রমে দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ল তাঁর সুনাম। দুবাই, ইরান ও সৌদি আরবে অনেক রাস্তাঘাট এবং বসতি স্থাপনে প্রতিষ্ঠানটি সুনাম অর্জন করল। বাঙালি শিল্পপতিদের অগ্রপথিক পাটকলসহ বেশ কয়েকটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান করে হাজার হাজার বাঙালির কর্মসংস্থান করলেন জহুরুল ইসলাম। সুবিদ আলীর কী হলো? নিজ জন্মভূমি কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরে প্রতিষ্ঠা করলেন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রথম চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়। গড়লেন আধুনিক হাসপাতাল, যেখানে গরিব-দুঃখী এবং নিম্নবিত্ত গ্রামবাসী পায় বিনামূল্যে অথবা স্বল্প খরচে চিকিৎসাসেবা। আপন মর্যাদা রক্ষায় মুখ ফুটে বলতে পারেন না এমন মধ্যবিত্ত ও স্বল্পবিত্তের অভাবী কবি, শিল্পী, সাংবাদিকের কাছে বড় ভাইয়ের ঐতিহ্য অনুসরণে কামাল এখনো সুবিদ আলীর খাম পৌঁছে দিচ্ছেন। এই হলো সুবিদ আলীর সংক্ষিপ্ত কাহিনি। ডান হাতে দান করতেন, বাঁ হাত টের পেত না।
এবিএম মূসা

No comments

Powered by Blogger.