সময়ের প্রতিধ্বনি-দ্রব্যমূল্য : দেখার যেন কেউ নেই by মোস্তফা কামাল

দ্রব্যমূল্য নিয়ে একটি জাতীয় দৈনিকের প্রতিবেদনের কয়েকটি লাইন আমার বেশ মনঃপূত হয়েছে। আমার মনে হয়, সাধারণ মানুষের মনের কথা ওই লাইনগুলোতে ফুটে উঠেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'বাজার থেকে চিনি উধাও করার চার দিন পর ব্যবসায়ীরা জানালেন, এখন থেকে চিনি পাওয়া যাবে। এমনকি প্রায় সব ধরনের খাদ্যপণ্যের দাম আকাশ ছোঁয়ানোর পর ব্যবসায়ীরা আশ্বাস দিলেন, রমজান মাসে বাজারদর স্থিতিশীল থাকবে।'


এর চেয়ে হাস্যকর উক্তি আর কী হতে পারে! এ ধরনের উক্তি করার অর্থ হচ্ছে সাধারণ মানুষের সঙ্গে মশকরা করা। এভাবেই অতি মুনাফাখোর ব্যবসায়ীরা দিনের পর দিন মানুষের সঙ্গে মশকরা করে চলেছেন। তাঁরা সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকা নিয়ে তামাশা করছেন। তাঁরা প্রতারণার ফাঁদ পেতে দূরে বসে থাকেন। সেই ফাঁদে মানুষ পা দিলেই তাঁরা খুশিতে গদগদ হয়ে ওঠেন। তাঁরা আমাদের দেশের ব্যবসায়ী। অবশ্য ব্যবসায়ী বলা কতটা যৌক্তিক হবে সেটা ভেবে দেখা দরকার। সাধারণ মানুষ তাঁদের ব্যবসায়ী বলতে রাজি নন। তাঁরা মুনাফাখোর বলতেই বেশি পছন্দ করেন। কেবল মুনাফাখোররাই পারেন বাজার থেকে চিনি উধাও করে দিয়ে দাম বাড়িয়ে দিতে। আমরা বরাবরই দেখে আসছি, বাজারে খাদ্যপণ্যের ঘাটতি ফেলে দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা করেন তাঁরা। এটা প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই নয়।
আমাদের কিছু ব্যবসায়ী আছেন, যাঁরা সয়াবিন তেল আমদানি করেন। তাঁরা সিন্ডিকেট করে পুরো বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করছেন। তাঁরা যখন খুশি দাম বাড়িয়ে দেন। এসব দেখার যেন কেউ নেই। সরকারের আছে; কিন্তু সরকারের কথা ব্যবসায়ীরা শোনেন না। জনগণের কী হলো তা নিয়েও তাঁদের মাথাব্যথা নেই। তাঁরা নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত। কত দ্রুত বিত্তবৈভবের মালিক হওয়া যায় সে চিন্তায় তাঁরা বিভোর থাকেন। তাঁরা এখন আর ঢাকার অভিজাত এলাকায় বাড়ি কিংবা দামি গাড়ি কেনার কথা ভাবেন না। তাঁরা ভাবেন কত দ্রুত বিদেশে বাড়ি কেনা যাবে। বিদেশের ব্যাংকে কত টাকা জমা করতে পারবেন এসব নিয়ে। আগে ব্যবসায়ীদের একটা মনোভাব ছিল, দ্রুত একটা দামি গাড়ি কিনবেন। গুলশান, বারিধারা, বনানী, উত্তরা কিংবা ধানমণ্ডি এলাকায় একটা বাড়ি করবেন। এখন আর দেশে থাকার কথাই কেউ ভাবেন না। তাঁরা এই দেশে ব্যবসা করবেন। আর খরচ করবেন বিদেশে। ছেলেমেয়েরা বিদেশে পড়াশোনা করবে। বিদেশে তাঁদের জন্য নিশ্চিত ভবিষ্যৎ গড়তে এ দেশে তাঁরা শুধু ব্যবসা করেন। অতি মুনাফার অর্থ জমা করেন বিদেশি ব্যাংকে।
মাননীয় হাইকোর্ট দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে বারবার নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু এসব আমলে নেওয়ার প্রয়োজন মনে করছেন না ব্যবসায়ীরা। আইনকানুন নিয়মনীতি মানলে তো তাঁরা কোর্টের নির্দেশনা আমলে নেবেন!
আমাদের দুর্ভাগ্য, আমাদের কারো কোনো দেশপ্রেম নেই। দেশের প্রতি ভালোবাসা নেই। দেশের মানুষ কষ্টে থাকুক এটাই অনেকে কামনা করেন। তাঁরা নিজেরা ভালো থাকবেন কিন্তু দেশের মানুষকে কষ্টে রাখবেন। এটা তাঁদের নীতি।
আমি জানি, আমার এই লেখায় ব্যবসায়ীদের কিছু আসে-যায় না। তাঁরা না সরকার, না আইন-আদালত কাউকেই তো তোয়াক্কা করেন না। পত্রপত্রিকায় তাঁদের নিয়ে যে লেখালেখি হয় তাতেও তাঁদের কিছু হয় না। কারণ, তাঁরা এসব পড়েও দেখেন না। সে সময় কোথায়!
আরেকটা ব্যাপার লক্ষ করেছি, ব্যবসায়ীদের সবকিছুই যেন গা-সহা হয়ে গেছে। যতই বলা হোক, তাঁদের কোনো বিকার নেই। সরকার এত করে বলছে, হাইকোর্ট একের পর এক নির্দেশনা দিচ্ছে, পত্রিকায় এত লেখা হচ্ছে, টিভি মাধ্যমে রিপোর্টের পর রিপোর্ট প্রকাশ হচ্ছে অথচ কোনো ব্যবসায়ীকেই এসব স্পর্শ করে না। তাঁদের এমন মনোভাব কেন, তা আমাদের কাছে বোধগম্য নয়।
আমরা জানি, রমজানের মর্মার্থ হচ্ছে, সিয়াম সাধনা। এর মানে শুধু এই নয় যে, কম আহার করা। সবকিছুতেই সিয়াম সাধনার দরকার। ব্যবসা করলে অবশ্যই মুনাফা করতে হবে। মুনাফা ছাড়া ব্যবসা টিকবে না। কিন্তু সেই মুনাফা নিশ্চয়ই মাত্রাতিরিক্ত হবে না। ব্যবসা তো আমাদের মহানবী (সা.)ও করেছিলেন। সেই অর্থে ব্যবসাকে আমরা মহৎ কাজ হিসেবে বিবেচনা করতে পারি। কিন্তু ব্যবসার মানে তো এই নয় যে, সরকারি প্রকল্পের অর্থের মতো লুটেপুটে খাওয়া। মানুষকে ঠকানো, মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করা। গোডাউনে খাদ্যপণ্য আটকে রেখে বাজারে ঘাটতি সৃষ্টি করাকে ব্যবসা বলা যায় না। চিনির ক্ষেত্রে আমরা সেটাই দেখেছি। চিনির দাম বাড়ানোর অপকৌশল হিসেবে বাজার থেকে চিনি উধাও করে দেওয়া হয়েছে।
আগে আমদানিকারকদের একটা সিন্ডিকেটের কথা আমরা জানতাম। এখন দেখা যাচ্ছে, মিল মালিকরাও সেই কাজটিই করছেন। অথবা যাঁরা পণ্যসামগ্রী কিনে মজুদ করে রাখেন, তাঁরাও সিন্ডিকেট সৃষ্টি করেছেন। তাঁরা দাম বাড়ানোর জন্য নানা অপকৌশলের আশ্রয় নেন। এই প্রবণতাকে প্রতারণা ছাড়া আর কী বলা যায়!
আগে রমজান মাসে দাম বাড়ানো হতো। এখন রমজান আসার আগেই দাম বাড়ানো হয়। ব্যবসায়ীরা জানেন, রমজানে চিনি এবং তেলের মতো অতি প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম যতই হোক মানুষকে কিনতেই হবে। আর হুজুগে বাঙালি চিনি আর তেল কেনার জন্য একেবারে হুমড়ি খেয়ে পড়ল! অবস্থাটা এমন যেন এক দিনেই সব শেষ হয়ে যাবে। তাই বেশি বেশি কিনে রাখতে হবে। একটু ধৈর্য ধরার মানসিকতাও কারো নেই। সেই সুযোগটিই নিচ্ছেন অতিমুনাফাখোর ব্যবসায়ীরা। এর মধ্যেই হয়তো কোটি কোটি টাকা বাজার থেকে তুলে নিয়েছেন। বলা প্রয়োজন, আন্তর্জাতিক বাজারে চিনি এবং সয়াবিন তেলের দাম এখন পড়তির দিকে। এর পরও কোন অজুহাতে দাম বাড়ানো হলো?
খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ানোর এই প্রতিযোগিতা উপমহাদেশ ছাড়া বিশ্বের আর কোথাও আছে কি না সন্দেহ। কোনো সভ্য দেশে এই প্রবণতা চলতে পারে না। কোনো খাদ্যপণ্যের দাম পাঁচ পয়সা বাড়ানো হলেও তার জন্য সরকার এবং সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে ব্যাখ্যা দেওয়া উচিত। বিশ্বের উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ব্যাখ্যা দেওয়ার রীতি চালু আছে। কথায় কথায় দাম বাড়ানোর এখতিয়ার কারো থাকা উচিত নয়। এটা কেবল অসভ্য দেশেই চলতে পারে। যেখানে কেউ কাউকে মানে না। সভ্য দেশের আইন যেখানে অচল। আমাদের অবস্থা কি অসভ্য দেশের মতো!
আমি একটি কথা প্রায়ই বলে থাকি। আমাদের দেশে কিছু ব্যবসায়ী আছেন যাঁরা এই দেশের আলো বাতাসে বড় হয়েছেন, এই দেশে ব্যবসা করেন, এই দেশ থেকে সব সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করেন কিন্তু তাঁরা এই দেশকে ভালোবাসেন না। আমার মনে হয়, এসব মানুষের এই দেশে থাকা উচিত নয়। এই দেশে থাকার অধিকার তাঁদের নেই। প্রতিটি মানুষকে 'এটা আমার প্রাণের দেশ' বলে মনে করতে হবে। হৃদয় দিয়ে দেশকে ভালো না বাসলে দেশের জন্য কিছু করার মানসিকতা জন্ম নেবে না। আর সেটা না হলে প্রজন্মের পর প্রজন্ম এ দেশে মুনাফাখোর জন্ম নেবে। তারা দেশের চেয়ে নিজেদেরই বেশি ভালোবাসবে। আর দেশ বিপদে পড়লে তারা কেটে পড়বে।
অথচ এই দেশের কত সমৃদ্ধ ইতিহাস। এই দেশের মানুষ ভাষার জন্য লড়াই করেছেন। বুকের তাজা রক্ত দিয়ে মায়ের ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন। শুধু তা-ই নয়, স্বাধীন ভূখণ্ডের জন্য মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর জন্য দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন। লাখো বাঙালি প্রাণ দিয়েছেন। সেই দেশ আজ কেন এত পশ্চাৎপদ থাকবে? সেই দেশের মানুষ কেন না খেয়ে থাকবে? সেই বীরের জাতির মাথা কেন আজ অবনত থাকবে?
কিছু ব্যবসায়ীর কর্মকাণ্ডে যেন পুরো ব্যবসায়ী সমাজের মুখ লজ্জায় ঢেকে না যায়; সে জন্য তাঁরা নিশ্চয়ই নিজেদের শোধরাবেন। তাঁরা যে এই দেশকে ভালোবাসেন তার প্রমাণ রাখবেন। আমরা আশা করি ব্যবসায়ীদের শুভবুদ্ধির উদয় হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যক্তিগতভাবে সাধারণ মানুষের দুঃখকষ্ট লাঘবে কিছু চেষ্টা-তদবির করলেও তাঁর সরকারের কর্মকাণ্ডে সন্তুষ্ট হতে পারছি না। প্রধানমন্ত্রী ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করেছেন। অস্থিতিশীল বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে ব্যবসায়ীদের প্রতি সহায়তার অনুরোধ করছেন। এরপর কি সরকারের আর কিছুই করণীয় নেই?
সরকার টিসিবি নামক প্রতিষ্ঠানটিকে যদি সক্রিয় করতে পারে তাহলে হয়তো কিছু কাজে আসবে। ব্যবসায়ীদের একচেটিয়া ব্যবসা করার ক্ষেত্রে টিসিবি কিছুটা রাশ টানতে পারে। অথচ টিসিবিকে কার স্বার্থে ঠুঁটো জগন্নাথ করে রাখা হয়েছে তা বুঝতে পারছি না। একটা সময় অতি মুনাফাখোরদের শত্রু ছিল টিসিবি। সেই টিসিবির অস্তিত্ব মৃতপ্রায়। আমরা চাই, সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বস্তি ফিরে আসুক। সেই দায়িত্ব সরকারকেই পালন করতে হবে। ব্যবসায়ীদের আস্থায় নিয়ে হোক আর চাপে ফেলে হোক কাজটি সরকারকেই করতে হবে।


লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
mkamalbd@hotmail.com

No comments

Powered by Blogger.