মানবাধিকার-র্যাবের দেশে বসবাস by শাহ্দীন মালিক
১২ ফেব্রুয়ারি প্রথম পৃষ্ঠার একটা খবরের শিরোনাম ছিল ‘তাজউদ্দীনের নাতিকে পেটাল পুলিশ’। ধরে নিচ্ছি প্রথম আলোর পাঠকেরা খবরটি পড়েছেন। চোখ এড়ানোর কথা নয়। তাই পুনরাবৃত্তি নিষ্প্রয়োজন। অবশ্য ১২ ফেব্রুয়ারির প্রধান শিরোনাম ছিল সাংবাদিক দম্পতি খুন। মেহেরুন রুনি ও সাগর সরওয়ারের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের খবর।
আমরা সবাই চলে যাব—এভাবে চলে যাওয়া দুঃখ দেয়, উৎকণ্ঠা বাড়ায় আর রাষ্ট্র নামক বিকট দানবের ওপর রাগ, ক্ষোভ থেকে দেশটাকে তিতে তিতে লাগে। দেশের প্রতি দরদ না থাকলে নিবেদিতপ্রাণ সাংবাদিক হওয়া যায় না। ওদের দরদ দেশ আর পাবে না। দেশটাকে এ মুহূর্তে তিতে তিতে, বেসুরা, বেখাপ্পা, বেমানান লাগছে।
ভালো হোক মন্দ হোক—এ দেশটাকে নিয়ে সংসার করতে হবে। আশা থাকবে, পুলিশ খুনিদের খুঁজে বের করবে। বের করতে সম্ভবত বাধ্য হবে। কারণ, ‘মিডিয়ার চাপ’ থাকবে কিন্তু পুলিশ যে ক্রমান্বয়ে র্যাব হয়ে যাচ্ছে। মাঝেমধ্যে মনে হয় অযথা মামলা-মোকদ্দমা করি, মামলা-মোকদ্দমা আইনের কথা মনে করি, বলি। ব্লাস্ট বনাম বাংলাদেশ মামলায় ২০০৩ সালে পুলিশ কীভাবে আসামি বা অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করবে, জিজ্ঞাসাবাদের সময় কী ধরনের আচরণ করবে, গ্রেপ্তারের পর তাকে কতক্ষণের মধ্যে খবর দেবে ইত্যাদি সংক্রান্ত সভ্য দেশের মতো অনেকগুলো নির্দেশনা ছিল।
একদিনে তো আর হয় না। তবে বোকার মতো ভেবেছিলাম, যাত্রা তো এবার শুরু হলো, মোকামে পৌঁছাতে বেশি সময় লাগবে না। তখন কে জানত যে এই রায়ের কয়েক মাসের মধ্যে ‘ক্রসফায়ার’ শুরু হবে। কোথায় উঠে গেল গ্রেপ্তার আর জিজ্ঞাসাবাদের সময় অভিযুক্ত বা আসামির সঙ্গে ভালো ব্যবহার করার বাধ্যবাধকতা।
২০০৪ থেকে এখন পর্যন্ত কেটে গেল ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার, আত্মরক্ষা ইত্যাদি নিয়ে। তারপর গুম আর গুপ্তহত্যা। আগেও বলেছি, আবারও বলছি—দেশে যখন ঠান্ডা মাথায় খুন করার লাইসেন্সপ্রাপ্ত বাহিনী থাকে, তখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছ থেকে আইনানুগ আচরণের প্রত্যাশা শুধু স্বপ্ন, আকাশকুসুম চিন্তা।
প্রথম আলোর খবরের প্রথম বাক্যই ছিল ‘তুই সোহেল তাজের ভাগনে, এমন শিক্ষা দিব যে জীবনেও ভুলবি না।’ এই ফ্রাংকেনস্টাইন রাজনীতিবিদেরা বানাচ্ছেন। সোহেল তাজ অত্যন্ত সজ্জন। সে জন্যই বোধ হয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নোংরামি তাঁর সহ্য হয়নি। এখানে ‘ওমুকের ভাগনে’ ব্যাপারটা মুখ্য নয়। অসিলা মাত্র। যারই ভাগনে হোক না কেন, ঠিকই পেটাত।
পেটানো ছাড়া পুলিশকে আর কী-ই বা শেখানো হয়। তদুপরি কয়েক বছর ধরে ক্রমাগত বলা হচ্ছে—মেরে শেষ করে দাও, দেশ থেকে অপরাধ উবে যাবে।
যখন ঠান্ডা মাথায় মানুষ মারলে কিছু হয় না—গত সাত বছরে কারও কিছু হয়েছে অর্থাৎ দু-একজন ছাড়া র্যাবের কেউ শাস্তি পেয়েছে বলে শুনিনি—তখন সামান্য পেটানোতে কী আসে যাবে? র্যাবের দেশে এভাবেই থাকতে হবে। মাঝেমধ্যে ভাব দেখাব—না, আইনকানুন আছে, জজকোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট সবই আছে। আমরা বিজ্ঞ আইনজীবীরা আছি, প্রধান বিচারপতি থেকে শুরু করে সদ্য নিয়োগ পাওয়া সহকারী বিচারক—সবাই এবং সবই আছে।
২.
অনেক দিন ধরেই খেয়াল করছি আন্তর্জাতিক অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল যখন ‘রিমান্ড’ অর্ডার দিচ্ছে, অর্থাৎ সাঈদী ও অন্য অভিযুক্তদের জিজ্ঞাসাবাদের আদেশ দিচ্ছে, তখন আদেশে বলে দেওয়া হচ্ছে যে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের তাদের আইনজীবী, আত্মীয়-বন্ধুদের উপস্থিতিতে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। হচ্ছেও তাই। অর্থাৎ যুদ্ধাপরাধী-মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের বেলায় আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সেই ব্লাস্ট বনাম বাংলাদেশ মামলার নির্দেশনা অক্ষরে অক্ষরে পালন করছে এবং ট্রাইব্যুনালের বিচারকেরাও এই ট্রাইব্যুনালের আওতাধীন। সবার জন্য সভ্য দেশের আচার-আচরণ ও আইন প্রয়োগ নিশ্চিত করছে।
এ দেশে ১৯ বছরের একটা তরুণকে পুলিশ লাঠিপেটা করে, কারণ সে প্রকারান্তরে বলেছিল যে সে তাজউদ্দীন আহমদের নাতি। এখন যাঁরা ক্ষমতায় আছেন, তাঁদের করজোড়ে নিবেদন করছি—আপনারা, প্লিজ, ২০১৩-র শেষ বা ২০১৪-এর শুরুর স্বপ্নিল দিনগুলোর কথা চিন্তা করেন। নিকট-ভবিষ্যৎ নিয়ে আরও মধুর স্বপ্ন দেখেন। পুলিশও এখন র্যাব হয়ে যাচ্ছে।
ড. শাহ্দীন মালিক: অ্যাডভোকেট সুপ্রিম কোর্ট, পরিচালক, স্কুল অব ল, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments