এক সাধারণ অসাধারণ মা by বুলবন ওসমান
মা মানেই তো এক সাধারণ মানুষ। মায়েরা আবার কবেই-বা অসাধারণ হয়? অসাধারণ মা বলে কি পৃথিবীতে কেউ আছেন? অসাধারণ হতে গেলে কী লাগে? দর্শন, বিত্তবান, শিল্প বা রাষ্ট্র পরিচালনায় দক্ষতা বা যুগান্তকারী কোনো আবিষ্কার বা উদ্ভাবন। এসব কেন্দ্র করে একজন অসাধারণত্ব অর্জন করেন।
তেমন মহিলা এবং তিনি যদি মা হন তবেই তো অসাধারণ হবেন। এবার আসি আমার মার কথায়। গত বছর ১৩ ফেব্রুয়ারি আমার মা সালেহা ওসমান শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মায়ের মৃত্যুশয্যার পাশে ছিলাম আমি, ভাদ্রবধূ বুলা (মেজ ভাই ইয়াফেস ওসমানের স্ত্রী), খালাতো ভাই আল্লারাখা, আর মার পরিচারিকা মর্জিরন ও পারভিনের মা। বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর। আমার বাবা সাহিত্যিক শওকত ওসমান নিয়ম-কানুন মেনে চলতেন। একটি ঐতিহাসিক ট্র্র্যাজেডি তার জীবনকেও দারুণভাবে প্রভাবিত করে, যার ফলে তিনি মারা যান ৮২ বছর বয়সে ১৯৯৮ সালের ১৪ মে। ট্র্যাজিক ঘটনাটি হলো ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সপরিবারে নিহত হওয়া। বাবা এ ঘটনায় এতটাই মর্মাহত হন যে, দেশ ছেড়ে প্রায় ছ'বছর কলকাতায় নির্বাসনে কাটালেন। আর ফিরলেন যক্ষ্মা ও পেপটিক আলসার নিয়ে। শরীরটা আগের কাঠামোয় আর ফিরে যেতে পারেনি। মা-বাবা শতায়ু হবেন_ আমার এই প্রত্যাশা পূর্ণ হয়নি।
আমরা যে বাড়িতে ভূমিষ্ঠ হয়েছি নানার সে বাড়িটি পাকা এবং তিনতলা। মায়ের জন্মের বছরখানেক পর এ বাড়িটি তৈরি। গ্রামের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত বন্যা নিরোধক উঁচু বাঁধ থেকে এ বাড়িটি দেখা যায়। তিনতলা বাড়ির পাশে বড় পুকুর। তার পাড়ে বাঁশঝাড়। ১৯৩৮ সালে মার বিয়ে হয়। কলকাতায় সাখাওয়াত মেমোরিয়ালের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রী। বয়স তেরো।
মার চরিত্রের যে বড় দুটি দিক আমাকে আকৃষ্ট করে তার প্রথমটি হলো সংসারকে সুচারুরূপে চালানো_ যাকে আজকের ভাষায় বলে ম্যানেজমেন্ট। দ্বিতীয়টি হলো সুদৃঢ় ব্যক্তিত্ব_ সংসারে সবাইকে ঠিক পথে পরিচালনা করা। আর একটা জিনিস এখনও মনে পড়ে, সবসময় বাবাকে সাহিত্যচর্চা করার সুযোগ করে দিতেন মা। বাবা লিখতে বসলে সেদিকে কারও যাওয়া চলবে না। মাকে নিয়ে উপন্যাস লেখা যায়। সেটা গোর্কির মা হবে না বা পথের পাঁচালীর সর্বজয়াও হবে না, কিন্তু ছেলেবেলায় পথের পাঁচালী পড়ার পর মাকে আমার সর্বজয়া মনে হতো। শওকত ওসমানের 'জননী' অবশ্য অনেক সংগ্রামী মায়ের জীবন। মা খুব ভালো রাঁধতে পারতেন। হয়তো সব সন্তানই মাকে এই প্রমাণপত্র দেবে। তবু বলছি তিনি ভালো রাঁধুনি ছিলেন। মুরগির কোর্মা ছিল এর মধ্যে সবার ওপরে।
আত্মীয়-স্বজনের আসা পছন্দ করতেন। নিজেরও ঘুরে বেড়ানোর অভ্যাস ছিল। সে জন্য আমি অবসর নেওয়ার পর অবসরের টাকা দিয়ে গাড়ি কিনতে অনেকটা বাধ্য করেন। কিন্তু হায়, গাড়ি চড়ার সুযোগ পেলেন মাত্র দু'বছর। তারপর গাড়ি চড়ে শেষ নিবাসে পেঁৗছে গেলেন মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে।
রোগশয্যায় মা একদিন আমাকে ডাকলেন। সামনে দাঁড়িয়েছি, বললেন_ আমাকে পাঁচশ'টা টাকা দেবে বাবা!
মার কথাটা এত মমতা মাখা_ এমন স্বর আমি কোনোদিন শুনিনি। মার কিছু টাকা ছিল, যা তিনি নিজের জন্য খরচ করতেন। অসুস্থ হওয়ার পর তা আমার কাছে থাকত। নিজের টাকা এভাবে করুণভাবে চাইবেন কেন?
বলি, কী করবেন?
পাশে থাকা এক পরিচারিকাকে দেখিয়ে বললেন, ওকে দেব।
আমার মনে হলো দুর্দান্ত প্রভাবশালী মানুষ পরাজিত হয়ে গেলে যে স্বরে কথা বলে মার কণ্ঠস্বর যেন তেমনি। প্রখর ব্যক্তিত্বের অধিকারী মাকে আমি কখনও এভাবে কথা বলতে দেখিনি। আজও আমাকে সেই কণ্ঠস্বর তাড়া করে ফেরে। আর যখনই মনে পড়ে মনটা খারাপ হয়ে যায়।
আমরা যে বাড়িতে ভূমিষ্ঠ হয়েছি নানার সে বাড়িটি পাকা এবং তিনতলা। মায়ের জন্মের বছরখানেক পর এ বাড়িটি তৈরি। গ্রামের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত বন্যা নিরোধক উঁচু বাঁধ থেকে এ বাড়িটি দেখা যায়। তিনতলা বাড়ির পাশে বড় পুকুর। তার পাড়ে বাঁশঝাড়। ১৯৩৮ সালে মার বিয়ে হয়। কলকাতায় সাখাওয়াত মেমোরিয়ালের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রী। বয়স তেরো।
মার চরিত্রের যে বড় দুটি দিক আমাকে আকৃষ্ট করে তার প্রথমটি হলো সংসারকে সুচারুরূপে চালানো_ যাকে আজকের ভাষায় বলে ম্যানেজমেন্ট। দ্বিতীয়টি হলো সুদৃঢ় ব্যক্তিত্ব_ সংসারে সবাইকে ঠিক পথে পরিচালনা করা। আর একটা জিনিস এখনও মনে পড়ে, সবসময় বাবাকে সাহিত্যচর্চা করার সুযোগ করে দিতেন মা। বাবা লিখতে বসলে সেদিকে কারও যাওয়া চলবে না। মাকে নিয়ে উপন্যাস লেখা যায়। সেটা গোর্কির মা হবে না বা পথের পাঁচালীর সর্বজয়াও হবে না, কিন্তু ছেলেবেলায় পথের পাঁচালী পড়ার পর মাকে আমার সর্বজয়া মনে হতো। শওকত ওসমানের 'জননী' অবশ্য অনেক সংগ্রামী মায়ের জীবন। মা খুব ভালো রাঁধতে পারতেন। হয়তো সব সন্তানই মাকে এই প্রমাণপত্র দেবে। তবু বলছি তিনি ভালো রাঁধুনি ছিলেন। মুরগির কোর্মা ছিল এর মধ্যে সবার ওপরে।
আত্মীয়-স্বজনের আসা পছন্দ করতেন। নিজেরও ঘুরে বেড়ানোর অভ্যাস ছিল। সে জন্য আমি অবসর নেওয়ার পর অবসরের টাকা দিয়ে গাড়ি কিনতে অনেকটা বাধ্য করেন। কিন্তু হায়, গাড়ি চড়ার সুযোগ পেলেন মাত্র দু'বছর। তারপর গাড়ি চড়ে শেষ নিবাসে পেঁৗছে গেলেন মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে।
রোগশয্যায় মা একদিন আমাকে ডাকলেন। সামনে দাঁড়িয়েছি, বললেন_ আমাকে পাঁচশ'টা টাকা দেবে বাবা!
মার কথাটা এত মমতা মাখা_ এমন স্বর আমি কোনোদিন শুনিনি। মার কিছু টাকা ছিল, যা তিনি নিজের জন্য খরচ করতেন। অসুস্থ হওয়ার পর তা আমার কাছে থাকত। নিজের টাকা এভাবে করুণভাবে চাইবেন কেন?
বলি, কী করবেন?
পাশে থাকা এক পরিচারিকাকে দেখিয়ে বললেন, ওকে দেব।
আমার মনে হলো দুর্দান্ত প্রভাবশালী মানুষ পরাজিত হয়ে গেলে যে স্বরে কথা বলে মার কণ্ঠস্বর যেন তেমনি। প্রখর ব্যক্তিত্বের অধিকারী মাকে আমি কখনও এভাবে কথা বলতে দেখিনি। আজও আমাকে সেই কণ্ঠস্বর তাড়া করে ফেরে। আর যখনই মনে পড়ে মনটা খারাপ হয়ে যায়।
No comments