মালদ্বীপ কোন পথে?-আরেক আলোকে by ইনাম আহমদ চৌধুরী

গণবিক্ষোভের মুখে নাশিদ পদত্যাগ করেছেন। নিঃসন্দেহে এটা দুঃখজনক। তবে তার পরিবর্তে এখন সংবিধান অনুযায়ী ভাইস প্রেসিডেন্ট দায়িত্ব নিয়েছেন এবং নির্ঘণ্ট অনুযায়ী সাধারণ নির্বাচনের অঙ্গীকার করেছেন। নাশিদের এমডিপি এবং অন্য রাজনৈতিক দলগুলো শান্তিপূর্ণ উপায়ে তাদের প্রাক্-নির্বাচনী প্রস্তুতিমূলক কর্মকাণ্ড শুরু করুক, যাতে বাইরের শক্তির


কোনো হস্তক্ষেপের অজুহাত বা মওকা না হয় ইস্তফা দিয়েই মালদ্বীপের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট নাশিদ অবিলম্বে নতুন নির্বাচনের দাবি জানিয়েছেন। বিক্ষোভ-সমাবেশ করেছেন। আর প্রাক্তন ভাইস প্রেসিডেন্ট হাসান ওয়াহিদ, যিনি এখন নতুন প্রেসিডেন্ট এক বাক্যেই সে দাবি নাকচ করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, সাধারণ নির্বাচন নির্ঘণ্ট মোতাবেক আগামী বছর হওয়ার কথা। তখনই হবে।
এদিকে এই সংকট উত্তরণের পথ বাতলে দিতে রাজধানী মালেতে চলে এসেছেন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবার্ট ব্লেক। জাতিসংঘের মহাসচিবের প্রতিনিধি একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি জেনারেল। এসেছেন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নিযুক্ত সচিব গণপতি। বিভিন্ন দিক থেকে আসছে শলাপরামর্শ। প্রশ্ন এখন, মালদ্বীপ যাবে কোন পথে?
২০০৮ সালে যখন মালদ্বীপের প্রথম গণতান্ত্রিক বহুদলীয় নির্বাচন হলো, আশা ছিল গণতন্ত্রের রাজপথ থেকে দেশটার স্খলন হবে না। সেই আশা ও বিশ্বাসে এখন ফাটল ধরার মুখোমুখি। আশঙ্কা হচ্ছে অনভিপ্রেত বিদেশি হস্তক্ষেপেরও। বারো শতাধিক দ্বীপ নিয়ে ভারত মহাসাগরে প্রশান্ত নৈসর্গিক সৌন্দর্যের বিভূষিত মালদ্বীপের অবস্থান। সাম্প্রতিককালে অবসর ও আমোদপিপাসু পরিব্রাজকদের একটি অতি প্রিয় গন্তব্যস্থল। 'এপার সাগর ওপার সাগর মধ্যিখানে দ্বীপ, দ্বীপ নয়তো সদ্য ফোটা নীপ। নীপ নয়তো হাজার ফুলের মেলা, বিশ্ববাসী যেথায় এসে করছে লীলাখেলা।' বীচি বিক্ষুব্ধ মহাসাগর পরিবৃত মালদ্বীপের নিস্তরঙ্গ জীবনে হঠাৎ নেমে এসেছে অশান্তি ও অনিশ্চয়তার ঘূর্ণি।
মোহাম্মদ নাশিদ দিনবদলের স্লোগান নিয়ে এলেন বটে, নির্বাচনে ভূতপূর্ব প্রেসিডেন্ট গাইউমের সঙ্গে তার দলের এবং সহযোগীদের ভোটপ্রাপ্তির ব্যবধান ছিল সংকীর্ণ। নাশিদ সরকার গঠন করে কিছু কিছু সংস্কারধর্মী পদক্ষেপ নিলেন বটে, কিন্তু তিনি তার সহযোগীদের সঙ্গে একটা ব্যবধানের সৃষ্টি করলেন। তারা ভাবলেন, রাষ্ট্র পরিচালনা মূলস্রোত থেকে তারা বঞ্চিত। হাসান সাইদ, নাফিস ইব্রাহিম প্রমুখ গুরুত্বপূর্ণ কোয়ালিশন সহযোগীদের সঙ্গে নাশিদের সৃষ্টি হলো ক্রমবর্ধমান মতপার্থক্য। নাশিদবিরোধী বিক্ষোভ শুরু হলে তারা চলে গেলেন নাশিদের বিরুদ্ধে। গত মাসে নাশিদ ক্রিমিনাল কোর্টের বিচারপতি আবদুল্লাহ মোহাম্মদকে গাইউমপন্থি বিপক্ষ দলের সঙ্গে সমঝোতা এবং অসদাচরণের অভিযোগে গ্রেফতারের আদেশ দেন। তা হয়ে দাঁড়াল এক বিস্ফোরক। গাইউমের আমলে ২০০ জন বিচারক নিযুক্ত হয়েছিলেন সারা জীবনের জন্য। তারা ভূতপূর্ব প্রেসিডেন্ট গাইউমের সহযোগী এবং আত্মীয়দের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ বিচারের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিলেন।
নাশিদ চেষ্টা করছিলেন এ ধরনের পক্ষপাতিত্বমূলক বিচারিক আধিপত্য খর্ব করে সংবিধান পরিবর্তন করা। ইতিহাসের পরিহাস যে, গণতান্ত্রিক পদ্ধতি চালু করতে গিয়ে নাশিদ নিজেই শুরু করলেন অগণতান্ত্রিক এবং অসহিষ্ণু আচরণ। তিনি বিচক্ষণতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে পারলেন না।
ভূতপূর্ব অ্যাটর্নি জেনারেল হাসান সাইদের দ্বিভেদী কওমি পার্টি (ডিকিউপি) তো প্রচারপত্র বের করে নাশিদকে ইসলামবিরোধী এবং ইসরায়েলের প্রতি অতিরিক্ত সৌহার্দ্যমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য অভিযুক্ত করল। তিন সপ্তাহাধিক গণবিক্ষোভে যখন পুলিশ যোগদান করল, নাশিদ তখন সেনাবাহিনীর পরামর্শে পদত্যাগ করলেন। তিনি বললেন, সংঘর্ষ এড়ানোর জন্য মালদ্বীপে স্থিতিশীলতার খাতিরেই তিনি এই পদক্ষেপ নিলেন।
সংবিধান অনুযায়ীই ভাইস প্রেসিডেন্ট হাসান ওয়াহিদ রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিলেন। সুতরাং এই পরিবর্তনকে সম্ভবতর এখনও অসাংবিধানিক কিংবা একটি মিলিটারি ক্যু বলা সঙ্গত হবে না। সেনাবাহিনীর মুখপাত্র কর্নেল আবদুল লতিফ তো বলেই দিলেন, কোনো সেনা অভ্যুত্থান ঘটেনি। হাসান ওয়াহিদও সংবিধান সংরক্ষণ করে বহুদলীয় ঐক্যবদ্ধ সরকার গঠনের অঙ্গীকার করে বলে দিলেন, সূচি অনুযায়ী আগামী বছর হবে সাধারণ নির্বাচন। যুক্তরাষ্ট্র নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে হাসান ওয়াহিদকে স্বীকৃত জানাল এবং আমার মনে হয় এটি হয়েছে একটি সঙ্গত ও সময়োচিত পদক্ষেপ। নাশিদ এবং তার মালদ্বীপ ডেমোক্রেটিক পার্টির সদস্যরা যদিও একটি আশু নির্বাচনের দাবি তুলছেন এবং বিক্ষোভ করছেন, মনে হয় না তাতে তারা সাফল্য অর্জন করবেন। বরং বিক্ষোভ চালিয়ে গেলে তা সাংঘর্ষিক রূপ নিতে পারে এবং তখনই হবে বিদেশি হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা। মালদ্বীপবাসীর উচিত হবে সে ধরনের পরিস্থিতির যাতে উদ্ভব না হয়, সে বিষয়ে সচেতন থাকা।
ইতিমধ্যে এক পশ্চিমা রাষ্ট্রদূত কলম্বোতে মন্তব্য করেছেন, মালদ্বীপ হবে এক ট্রপিক্যাল আফগানিস্তান। তিনি তালেবান সৃষ্টির সব উপাদান মালদ্বীপে প্রত্যক্ষ করলেন। অথচ আসল কথাটাই উল্লেখ করলেন না। আফগানিস্তানে তো তালেবান সৃষ্টি হয়েছিল বিদেশি হস্তক্ষেপের জন্য_ সিআইএর প্রত্যক্ষ কার্যক্রমে।
বিচক্ষণ পর্যবেক্ষকরা যা এখন ভয় করতে শুরু করেছেন তা হচ্ছে, মালদ্বীপের নিস্তরঙ্গ জীবনে ইসরায়েলি মোসাদ, ভারতীয় 'র' এবং আমেরিকান সিআইএর মুখ্য ভূমিকা। মোসাদ এবং ভারতীয় 'র'র সঙ্গে দীর্ঘকালীন সহযোগিতামূলক সম্পর্ক রয়েছে। ভারতীয় পররাষ্ট্র দফতরের এক মুখপাত্র ইতিমধ্যেই মন্তব্য করেছেন যে, 'মালদ্বীপের প্রতি আমাদের কমিটমেন্ট রয়েছে।' নাশিদ ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের সঙ্গে একটি প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তি করেন। সেটা মালদ্বীপের কাল হতে পারে। ওই চুক্তি অনুসারে ভারত এই দ্বীপে প্রশিক্ষণের জন্য একটি বিমান বাহিনী স্কোয়াড্রন রক্ষণ, ২৬টি কোস্টাল রাডার স্থাপন ও মালদ্বীপের আকাশসীমায় সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। যদি ভারত দেখে যে, নতুন প্রেসিডেন্ট হাসান ওয়াহিদ দ্বীপের সম্পূর্ণ সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও দেশীয় স্বার্থ সংরক্ষণ বিধায় ভারতের আধিপত্য খর্ব করার কোনো চেষ্টা করছেন, তখন তারা কী ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন, তা নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণ রয়েছে। ১৯৮৮ সালে ভারতীয় বিমান বাহিনীর দুটি আই-এল-৭৬ আগ্রা থেকে এক হাজার ৬০০ ছত্রীসেনা নিয়ে দ্বীপে অবতীর্ণ হয় তথাকথিত ৮০০ তামিল ইলম সমর্থকের একটি কাল্পনিক দ্বীপজয়ের চেষ্টা বানচাল করে। পরে দেখা গেল সম্পূর্ণটাই ছিল তামিল 'মার্সেনারি' সহযোগে পরিচালিত একটি ভয়-দেখানো পাতানো খেলা। তা ছাড়া ২০০৯ সাল থেকে অধিক সংখ্যায় ভারতীয়রা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজে দ্বীপে নিয়োজিত থাকছেন। এসব দ্বীপবাসীকে যথেষ্ট শঙ্কিত করে তুলেছে। একজন ভারতীয় রাজনৈতিক নেতা তো 'ভারতের নিরাপত্তা'র জন্য সিকিমের মতো মালদ্বীপের ভারত অন্তর্ভুক্তিরও কথা তুলেছেন। লক্ষণীয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন পূর্ণ সচিব পর্যায়ের প্রতিনিধি মালদ্বীপ এসেছেন
যা হোক, এখন করণীয় হচ্ছে মালদ্বীপের সংবিধান অক্ষুণ্ন রেখে এই সংকটাপূর্ণ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য নবনিযুক্ত প্রেসিডেন্ট হাসান ওয়াহিদকে হটানোর চেষ্টা না করা। তা নিঃসন্দেহে রক্তক্ষয়ী এবং অস্থিতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে। ২০১৩ সালে নির্বাচন হওয়ার কথা। হাসানও তা অনুষ্ঠানের অঙ্গীকার করেছেন। মালদ্বীপের সব দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত হবে, সেই নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া। খুব যে বেশি সময় আছে তা নয়। মালদ্বীপের জন্য বাইরের হস্তক্ষেপ এখন বিষবৎ বর্জনীয়। গণতন্ত্রকামী মালদ্বীপবাসীর উচিত হবে, নিজেদের সমস্যার সমাধানকল্পে নিজেদেরই উদ্যোগ গ্রহণ এবং বর্তমান অবস্থায় তাতো সুকঠিন নয়।
গণবিক্ষোভের মুখে নাশিদ পদত্যাগ করেছেন। নিঃসন্দেহে এটা দুঃখজনক। তবে তার পরিবর্তে এখন সংবিধান অনুযায়ী ভাইস প্রেসিডেন্ট দায়িত্ব নিয়েছেন এবং নির্ঘণ্ট অনুযায়ী সাধারণ নির্বাচনের অঙ্গীকার করেছেন। নাশিদের এমডিপি এবং অন্য রাজনৈতিক দলগুলো শান্তিপূর্ণ উপায়ে তাদের প্রাক্-নির্বাচনী প্রস্তুতিমূলক কর্মকাণ্ড শুরু করুক, যাতে বাইরের শক্তির কোনো হস্তক্ষেপের অজুহাত বা মওকা না হয়। সংবিধানে কোনো পরিবর্তন আনতে হলে তা নতুন নির্বাচিত পার্লামেন্টই বিবেচনা করতে পারে। সার্কভুক্ত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ নিঃসন্দেহে মালদ্বীপের বর্তমান সমস্যার আশু সমাধান প্রত্যাশী। অনেক বাংলাদেশি বর্তমানে কর্মরত রয়েছেন। আমরা আশা করি, মালদ্বীপে সাংবিধানিক প্রক্রিয়া অক্ষুণ্ন থাকবে। শান্তির দ্বীপ হিসেবেই অক্ষুণ্ন থাকবে তার পরিচিতি, সুনাম ও আকর্ষণ।

ইনাম আহমদ চৌধুরী : সাবেক সচিব ও কলাম লেখক

No comments

Powered by Blogger.